বেজে ওঠে আলোর ঝংকার
কোন্ তীর্থে যাব আজ? কোথাও যাবার পথ নেই।
এই দম-আটকানো অন্ধকারে। হাত্ড়ে
হাত্ড়ে পথ চলি সারাক্ষণ, এগিয়েছি
ভেবে দেখি পিছিয়ে গিয়েছি বহুদূর,
যাত্রাই করিনি যেন, এরকম স্থানু
এখানে আমরা সব পচাগলা শবের মতোই।
এই মাত্র এ কাকে করেছি আলিঙ্গন
ভরাট ব্যাকুলতায়? মানুষের মতো, তবু কেন
মানব হয় না মনে অনুভবে? সর্বাঙ্গে কর্কশ
লোম তার, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে তীব্র গন্ধকের ঘ্রাণ।
বন্ বন্ লাঠি ঘোরে চতুর্দিকে, অস্ত্র শানানোর
শব্দে ঘুম নেই চোখে বস্তুত ব্যাপক
কারাগারে; মোহান্ত ও শাস্ত্রীদের মুখে
সর্বদা ধর্মের বুলি, অথচ শহজে মাতে ওরা নরবলি
এবং বীভৎস কোলাহলে। সুন্দরের
দিকে দাঁত খিঁচিয়ে সদলে তেড়ে আসে বার বার।
পূর্ণিমা, প্রেমের গান আর নৃত্যকলা
আর মুক্তপক্ষ মননকে ওরা বেআইনী
করেছে সদর্পে, কবিদের মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে
ঝরিয়েছে লানতের বৃষ্টি অবিরাম।
অকস্মাৎ কার কণ্ঠে বেজে ওঠে আলোর ঝংকার
‘তীর্থের কী প্রয়োজন এবার গা ঝাড়া দাও একত্রে সবাই,
হাতকড়া খসে যাবে চোখের পলকে,
খুলে যাবে সকলের পায়ের শেকল অচিরেই,
সূর্যোদয় বিছাবে গালিচা তোমাদের খোলা পথে।
২২/৮/৯৫
ভ্রমণ
চড়ায় ঠেকেছে নাও আগে দাঁড়, বৈঠা কোথায় উধাও।
মাছ খেলা করে চার পাশে,
দমকা হাওয়ায় নড়ে ছেঁড়া পাল। ‘জড়ো করো
দড়িদড়া ভাঙা কাঠ। আবার বানাও নাঙা গায়
নতুন আঙ্গিকে নাও’ ব’লে দীর্ঘদেহী
পল এলুয়ার
এলেন নৌকোয় উঠে, ধরলেন হাল; মাঝিবেশে
তাঁকে দেখে একস্মাৎ মৃতকল্প সর্পিনীর মতো শুক্নো খাল
ফুঁসে ওঠে, নদী হয়, জল চিরে নৌকো
চলে প্রায় অক্ষরবৃত্তের টানে অজানার পানে।
আরো কিছু কথা এলুয়ার
জলের মতন স্বরে বলেন, সেসব কথার
মানে বোধাতীতে থেকে যায় একঝাঁক
পাখির ডানার অন্তরালে। দেখি নিই তিনি এই
গলুইয়ে, স্তম্ভিত আমি। নৌকো পাক খায় সীমাহীন
নদীর আবর্তে, ভেসে চলি বড় একা
অসহায় কুহকের মতো কুয়াশায়।
যখন কবিতা পড়ি
যখন কবিতা পড়ি প্রাতঃস্মরণীয় কবিদের
একটি কি দুটি চিত্রকল্প কিংবা দুর্লভ উপমা
দেখি, পাই অমোঘ পঙ্ক্তির দেখা, তখন নিজেকে
বড় বেশি ব্যর্থ মনে হয়। কবি ব’লে খ্যাতি রটে,
অথচ নিজেই জানি এই অভিধার যোগ্য নই
আমি, শামুকের মতো নিজের ভেতর সর্বক্ষণ
সংকুচিত থাকি, অন্তর্গত বিষণ্ণতা ব’য়ে নিয়ে
মানুষের হাটে ঘুরি, নানা ছলে ব্যর্থতাকে ঢাকি।
তবু কেন শব্দের ভ্রমর গুন্গুনিয়ে যায় এই
অবেলায়? কেন নক্ষত্রেরা কবিতার পঙ্ক্তি হ’য়ে
লুকোচুরি খেলে? কেন ঘাসের উপর শিশিরের
বিন্দুগুলি আমাকেই লক্ষ্য ক’রে হয় জ্বলজ্বলে?
আমার পথের ধারে কে এক রহস্যময়ী হাতে
পুষ্পময় ডালা নিয়ে আশ্চর্য মুদ্রায় উপস্থিত?
৭/৭/৯৩
যখন তুমি শোকের বাড়ি থেকে ফিরে এলে
তখন তুমি বিষাদে আছো, তখন তোমাকে
লেহন করছে শোকের বাড়ির ভারী ছায়া, তখন তোমার
সত্তায় লোবানের ঘ্রাণ, সদ্য কেনা মার্কিন
কাপড়ের কেমন গন্ধ, কোরানের
আয়াতের সুর, অনেকের বিলাপধ্বনি; তখন সেই
দুপুরে জলধারা,
কোনো মৃত মুখ দেখতে তোমার ভালো লাগে না।
শোকের বাড়ি থেকে ফিরে এসে তুমি
আমার সঙ্গে কথা বললে টেলিফোনে। তোমার
কণ্ঠস্বরে আমি বিষাদের মুখ দেখলাম,
শুনতে পেলাম চাপা হাহাকার। সেই মুহূর্তে তুমি
মৃত্যুর ছায়ার দাঁত-নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত।
আমি তোমাকে ক্যামেলিয়া আর
থালাভর্তি স্বর্ণচাঁপা আর সযত্নে গাঁথা
বেলফুলের মালার কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম।
তোমার চেতনার প্রান্তরে ছুটিয়ে দিলাম এক পাল
হরিণ, তোমাকে স্নাত করলাম
ঝর্ণাতলার গানে, আমি তোমার মতো ক’রে
তোমাকে ভালোবাসার কথা শোনালাম।
মৃত্যুর থাবার নিচে ছিল যে-বাড়ি, যে বাড়ি আমি
কখনো দেখব না, যে বাড়ির প্রতিটি ঘরে
কলরব করছিল শোকের কালো অক্ষরসমুদয়,
সে বাড়ির ছায়া তোমার মন থেকে
সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে আমি তোমার কানে
অর্পণ করলাম জীবনের স্তব। আখেরে
সব কিছুই মৃত্যু আর অবলুপ্তির অধীন ভেবে
তুমি বিষাদকেই প্রাধান্য দিলে সেই প্রাণবন্ত দুপুরে।
২১/৫/৯৫
শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া
যখন পাখিরা সব ম্লান গোধূলিতে আসমানে
রহস্য ছড়িয়ে ফিরছিলো নীড়ে আর
জনসভা থেকে লোকজন
যে যার আপন ঘরে ফেরার তাগিদে মশগুল,
তখন পথের ধারে একজন লোক
পড়ে ছিল একাকী নিঃসাড়। তাকে ঘিরে
একটি জটলা গড়ে ওঠে
নিমেষেই, কেউ কেউ খুব ঝুঁকে দেখে নেয় তাকে
জরিপ করার ভঙ্গিমায়। লোকটার
চোখের পাতায় মৃত্যু তার শেষ চিহ্ন রেখে গেছে।
কেমন গুঞ্জন ওঠে চতুর্দিকে-একজন বলে,
“লোকটা কি কট্রর জামাতপন্থী ছিল
“আরে তোবা তোবা কোনকালে ঘাতকের
সংশ্রবে সে আসেনি ভুলেও”, অন্যজন
সোজাসাপটা জানায়। তাহ’লে
“সে কি জাতীয়তাবাদী, জাতীয়তাবাদী ব’লে শধু
ফাটিয়েছে গলা নিত্যদিন?”
“না, তেমন কিছু নয়” একজন সুস্পষ্ট মন্তব্য
ছুঁড়ে দিয়ে সাত তাড়াতাড়ি
দূরে সরে যায়।
“তবে কি লোকটা
আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী কোনো” ব’লে কেউ
এক উপভাষার আবীর মুঠোমুঠো ছড়ায় প্রস্থানকালে।
“এ লোক আওয়ামী লীগের কেউ নয় সুনিশ্চিত।
“তা’হলে যে পড়ে আছে রাস্তার ধুলায় বড় একা
সে কি কম্যুনিস্ট একজন?” ভিড় থেকে
একজন গুঞ্জনের নিরাসক্ত ক্যানভাসে কিছু
আঁকা জোঁকা করে জানালেন
উদাসীন, “মার্ক্সবাদে দীক্ষা তার হয়নি কখনো।
“ওসব কিছুই নয়, বস্তুত সে কবি, প্রকৃত মানুষ একজন।
১৭/২/৯৫