রেস্তোরাঁয় এক সন্ধ্যেবেলা
রেস্তোরাঁয় অনেকদিন পরে
ছিলাম বসে দুজনে মুখোমুখি।
ভেবেছিলাম ভ্রমণ সেরে এসে
তোমাকে মেয়ে দেখাবে খুব সুখী।
কিন্তু একি তোমার মুখ জুড়ে
অসম্ভব কালো মেঘের সাজ।
চশমা খুলে বললে ধু-ধু স্বরে-
‘আমার মন খারাপ খুব আজ।
যখন তুমি টানা দু’চোখ মেলে
আমার দিকে তাকাও অনুরাগে,
হৃদয় হয় বিলাসখানি টেড়ি,
চতুর্দিকে পদ্মকলি জাগে।
টেবিল ক্লথে আঁচড় কাটো নখে,
চুমুক দাও কফির পেয়ালায়।
একটি ঝড়ে সত্তা আলুথালু,
ঝোড়ো হাওয়ায় প্রদীপ কে জ্বালায়?
রেস্তোরায় নিঝুম কোণে বসে
নিজের চোখে নাচাও খঞ্জনা।
আমার প্রেম তোমাকে পারে নাকি
ভুলিয়ে দিতে আগের বঞ্চনা?
তোমার মন কেন যে ভালো নেই,
বুঝি না, হায়, মধুরতমা নারী।
বুলাও ঠোঁটে হাল্কা কিছু ফাগ,
পাল্টে নাও গোধূলিরঙ শাড়ি।
লুকিয়ে থাকে কাছেই আততায়ী,
হাসির ফাঁকে ঝল্সে ওঠে ছোরা।
মিত্র কে যে, জানতে পেলাম না;
লাফায় শুধু আগুন বুকজোড়া।
তোমাকে নিয়ে কখনো যদি শুই,
অবিবাহের চাদর যাবে পুড়ে?
কোরো না আর লজ্জা মিছেমিছি,
কামজ কীট খাচ্ছে কুরে কুরে।
ভালোবাসার সানাই বেজে যায়,
সে-সুরে মজে একাকী পথ চলি।
তোমার কাছে নিত্য নিয়ে যাই
অসংকোচে আমার পদাবলী।
তোমাকে করি কী করে বিশ্বাস?
আমার প্রেম সত্যি যদি চাও,
এভাবে আর ছুটো না ডানে-বামে;
ত্যাগের দৃঢ় দীক্ষা তুমি নাও।
প্রবোধ দিই মনকে নিশিদিন-
হে মেয়ে তুমি নও তো স্বৈরিণী;
সেজন্যেই তোমার ছোঁওয়া পেলে,
রক্তে বাজে সেতার রিনিঝিনি!
রয়েছো লিপ্ত কী নিয়ে
উদাসীন এই শহরে এখন
ভেবে মরি তুমি রয়েছো লিপ্ত কী নিয়ে?
ক্ষুব্ধ ঈগল চঞ্চুর ঘায়ে
নিমেষে আমার শান্তি নিয়েছে ছিনিয়ে।
জোনাকির ভিড়ে খাপছাড়াভাবে
কতকাল আর বাইরে থাকবো দাঁড়িয়ে?
ভয়ের পাথর বুক জুড়ে থাকে,
ফেলবো কি হায় তোমাকে কখনো হারিয়ে?
রূপালি হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে
ভেসে ওঠে বুঝি তোমার বুকের আদল।
পরমুহূর্তে শূন্যতা হাসে,
দ্রুত তালে বাজে পরিহাসপ্রিয় মাদল।
প্রণয় তোমার রহস্যমোড়া,
যেন সে হরিণ লতাগুল্মের আড়ালে।
তোমার দু’চোখ কাছে ডেকে নেয়,
দূরে সরে যায় হাতখানি বুকে বাড়ালে।
তোমাকে বুঝতে পারিনি এখনো,
মনে হয় শুধু ঘুরছি গোলকধাঁধায়।
কখনো তোমার কোন আচরণ
হাসায় আমাকে, কখনো কেবলি কাঁদায়।
চোখে জ্বালা ধরে, বুকে বৃশ্চিক;
দহনের কথা কাউকে ভুলেও বলি না।
বিচ্ছেদ-নদী মাঝে-সাঝে বয়,
তার মারে তুমি হও কি কখনো মলিনা?
যন্ত্রশাসিত যুগে তুমি-আমি
গাণিতিক প্রেম করবো হিসেব মিলিয়ে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে না রোবট,
কস্মিনকালে দেয় না নিজেকে বিলিয়ে।
যখন আমার ঠোঁটে রাখো ঠোঁট,
গোধুলি বেলায় হঠাৎ জানাও বিদায়,
তোমার মনের অবচেতনের
হদিস না পেয়ে থাকি অবিরাম দ্বিধায়।
যদি মরে যাই, বলবে না কেউ
তোমাকে বিধবা; রক্ত জবার বালিশে
মাথা পেতে তুমি থাকবে ঘুমিয়ে,
জ্বলবে শরীর স্বপ্নের কড়া পালিশে।
এই ঘর এই সিঁড়ি, ভাঙ্গা পথ
প্রজাপতিসহ থাকবে মনের ভেতর।
নোংরা হাতের নিষ্ঠুর টানে
আল্গা হবে কি হৃদয়ে-প্রোথিত শেকর।
শপথ ভঙ্গ
হয়েছে সাক্ষাৎ বহুবার, ঘনিষ্টতা
হরিণের মতো
করেছে নিভৃতে জল পান ঝিলে মুখ রেখে ছোট
ছোট ঢেউ তুলে; অকস্মাৎ শ্বাপদের শব্দ শুনে
দ্রুত ছুটে গিয়ে আত্মগোপন করেছে
বাঁচিয়ে শিং-এর ভাস্কর্যটি ঝোপেঝাড়ে।
খোলা পথে যেতে মনে মনে করেছি শপথ, তার কথা
কাউকে কখনো বলবো না।
কখন যে চন্দনা হঠাৎ পরিহাসে
বলে ওঠে প্রকৃতির গালে চুমো খেয়ে-
কেউ কিছু বলার আগেই দলত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীর
মতো লিখে নিজেই নিজের কথা ফাঁস করে দিয়েছো বেবাক।
শাদা-লাঠি
একটি বছর ধরে শাদা লাঠি হাতে নিয়ে সর্বক্ষণ আমি
শহরে ভ্রমণকারী, দেখেও অনেক কিছু না দেখার ভান
করি; ম্লান গোধূলিতে তুমি
সে কোন্ হ্রদের তীরে যাও চলে নিতম্ব দুলিয়ে
আমার সম্মুখ দিয়ে, স্মিত মুখে কী সহজে, হায়,
ফোটাও বিচিত্র ফুল বেগানা বাগানে।
নিমিষে আমাকে ছুঁড়ে দাও বিস্মৃতির-ধুধু চরে।
ভাবো, আমি কিছুই দেখিনা। যাও তুমি
ঈর্ষার রঙের মতো মোটর হাঁকিয়ে
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, এলোমেলো অস্তিত্বের আমার
ধুলো লাগে, অসহায় চেয়ে থাকি দুটি চোখ মেলে,
যদিও আমার হাতে কম্পমান কংকালের মতো শাদা লাঠি।
খুব রাত করে
যখন ঘুমোতে যাও বিছানায় কতিপয় বেয়াড়া বেড়াল।
চেটে পুটে খায়
আমার অস্থির মজ্জা, ফোঁস করে ওঠে
নানান বর্ণের সাপ। ঈগল-সাপের
কী হিংস্র লড়াই বাধে হৃদয়ে আমার। শাদা লাঠি
কেড়ে নিয়ে লোহিত পুরুষ
বলে আর্ত স্বরে-
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও তাকে, বুকে যার
ফণিমনসার বন দ্রুত বেড়ে যায়।
কী করে উপড়ে ফেলি নিজেরই হৃৎপিণ্ড অকস্মাৎ?
থাক শাদা লাঠি হাতে।