- বইয়ের নামঃ গন্তব্য নাই বা থাকুক
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপরূপ এক আস্তানার দিকে
আমাকে একরাশ কাঁটার ওপর ক’জন চটজলদি
শুইয়ে দিলো। আমার মৃত্যু হয়নি তখনো, অথচ
তড়িঘড়ি ওরা গুমোট অন্ধকারে অসহায় আমাকে
অনেকটা পথ টেনে-হিঁচড়ে
নিয়ে এলো বিয়াবান প্রান্তরে। কারা যেন
দূর থেকে হিংস্র কৌতূহলে দেখছে
দৃশ্যটি; আমি না পারছি চিৎকার করতে,
না কান্নায় ভাসতে। একটা চাপা ক্রোধে
তছনছ হয়ে যাচ্ছি। আকাশ যদি আমাকে
গিলে ফেলে এই মুহূর্তে, মেনে নেবো আপত্তিহীন।
ওরা আমাকে হেলায় একদিকে ঠেলে দিয়ে ছুটলো
ফেরার পথে কিংবা গায়েব
হয়ে গেলো অজানা কোথাও। গা ঝেড়ে
উঠে পড়ি, সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে প্রতিফলিত শূন্যতা।
হেঁটে চলেছি ক্রমাগত; বেয়াড়া ক্লান্তি দখল
করে নিচ্ছে আমাকে, ভীষণ শুকনো
হয়ে আসছে গলা, যেন কেউ আমার
মুখের ভেতর গুঁজে দিয়েছে একরাশ বালি, এখুনি
দম বন্ধ হয়ে আসবে ভেবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি
নিজের অজান্তেই ধূসর আকাশের দিকে
বিহ্বল তাকিয়ে থাকি। ঘাড় ফিরিয়ে
তাকাতেই আজগবি সব ছবি মুখ ভেঙচাতে থাকে আমাকে।
শরীরকে যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম, খানিক
পরেই চমকে, থমকে দাঁড়াই। এ কি! সামনে
পথ রুখে দাঁড়ায় তিনটি করোটি,
ওদের মুখ-গহ্বর থেকে
বেরিয়ে আসে নিষেধের ভাষা। আমার
মাথার ধূসর চুলের গুচ্ছ দাঁড়িয়ে যায় কাঁটার ধরনে।
এগুতে পারবো কি? উপরে তাকাতেই
চাঁদের বাঁকা হাসি যেন ভীষণ
হিংস্রতায় আমাকে খুবলে খেতে চায়। হঠাৎ
তিনটি করোটি নেচে চৌদিকে
ঘুরতে ঘুরতে আমার গলা জুড়ে সেঁটে থাকে! শিউরে
ওঠার মতো শক্তিটুকুও যেন সম্পূর্ণ লুট হয়ে গেছে।
ঝটকা খেতেই বামে তাকিয়ে দেখি অচেনা
কে যেন আমাকে হাত ধ’রে অপরূপ
এক আস্তানার দিকে নিয়ে চলেছেন। প্রশান্ত
কজন সাধক ‘স্বাগতম’ ব’লে আমাকে ডেকে নেন এবং
সঙ্গে সঙ্গে আমার গলায় লটকে-থাকা করোটিত্রয় উধাও,
পরিবর্তে আসমানি তারাপুঞ্জের মালা দুলছে।
১১-১০-২০০৩
অপরূপ গালিভার
ঘোর অমাবস্যাতেও মধ্যদিনের সূর্যালোক
ছড়িয়ে দেন যিনি, কে তিনি? কে তিনি?
তাঁকে দেখার
সৌভাগ্য ঝলসে উঠেছিল জীবনে একবারই
ভিনদেশে এক খরখরে দুপুরে। সত্যি কি তাঁকেই
দেখেছিলাম না কি অন্য কাউকে?
যাঁর কথা পড়েছি সোৎসাহে মেধাবী
পণ্ডিতদের রচনায় , শুনেছি বিজ্ঞজনদের ভাষণে, তাঁকেই
দেখেছি, কী করে বলি? মূক, নির্বাক, ভ্যাবাচ্যাকা
মাংসপিণ্ড কী করে হতে পারেন সেই উদ্দাম পুরুষ!
একদা যাঁর মায়াবী আঙুলের স্পর্শে এক লহমায় হারমোনিয়ামের রীডগুলো
নেচে উঠতো পরীদের মতো, যাঁর কণ্ঠস্বরের
মায়ায় খুলে যেতে চাইতো
কারার লৌহ কপাট, দুরন্ত লস্ফে যিনি
ছুঁতে পারতেন জ্যৈষ্ঠের ঝোড়ো মেঘদল,
কী করে বলি তাঁকেই দেখছি? কোথায়
সেই বাবরি, যার ঝাঁকুনিতে ঝরতো রাশি রাশি অগ্নিকণা?
একদা যাঁর অগ্নিবীণা নিদ্রা হরণ করতো জালিমদের,
যাঁর চেতনায় সামুদ্রিক মাছের মতো খেলা করতো
সত্য, সুন্দর আর সাম্যের স্বপ্ন, তিনি আমার
এই জন্মশহরে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ কয়েকটি দিন,
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! সত্যি কি সেই
অপরূপ গালিভার ছিলেন লিলিপুটদের দঙ্গলে?
২১-৫-২০০৩
অরূপ নক্ষত্রলোকে
যখণ একলা নিজ ঘরে বসে থাকি
গভীর তন্ময়তায়, নানা ভাবনার
বুদ্ধুদ মনের জলাশয়ে, কখনো বা কুয়াশায়
চকিতে মিলিয়ে যায় কোন্ অজানায়।
কখনো গভীর রাতে সত্তা থেকে নিদ্রা মুছে গেছে
চোখে পড়ে কে এক নিভৃত ছায়া যেন
বারান্দায় পায়চারি করে। ছায়াময় আগন্তুক
ঘরে এসে দাঁড়ার দু’হাত পিছনে রেখে খানিক সম্মুখে
ঝুঁকে, দেখে যেন মনে হয় চেনা। শয্যা ছেড়ে উঠে
পড়ি নিমেষেই আজ অজান্তে আমার ছুঁই তাঁর পদযুগ।
উদ্ভাসিত আলোমালা, সেই আগন্তুক
আর বাক্যহারা অবনত আমি নিঃস্পন্দ দাঁড়িয়ে
থাকি, ভাবি- তবে কি আমার এই দীন আস্তানায়
পথ ভুলে এসেছেন কোনো দেবদূত?
কোনো কথা না বলেই তিনি মৃদু হেসে
দু’হাত পিছনে রেখে, ঈষৎ সম্মুখে ঝুঁকে ধীরে
হেঁটে দূরে দীপ্ত বৃত্তে করেন প্রবেশ। ‘জয় হোক রবীন্দ্রের’
ধ্বনি গুঞ্জরিত হতে থাকে অরূপ নক্ষত্রলোকে!
৪-৫-২০০৩
অসম্পূর্ণ বাগানের কথা
না, তোমাদের কারো সঙ্গেই কোথাও
কোনোদিন দেখা হয়নি আমার। তোমাদের কথা
ভুলেও এতদিন কেউ বলেনি আমাকে। মেঘের আড়ালে
উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ঢাকা পড়েছিলে। হঠাৎ
একদিন ডানে বামে ঘুরতে ঘুরতে আমার
মতোই এক পথিকের সৌজন্যে আবছা দুটি
অসম্পূর্ণ ফুলের চারা দৃষ্টিগোচর হলো গোধূলিবেলায়।
কাছে গিয়ে দেখি সৌন্দর্য মাথা তুলে রয়েছে আকাশের দিকে।
ঔদ্ধত্য ছিলো কি ওদের সেই ভঙ্গিতে? এমনই মুগ্ধ
ছিলাম ওদের খণ্ডিত উপস্থিতিতে, তেমন ভাবার
ইচ্ছেই হয়নি। আমার খুব সাধ হলো চারা দুটির আধফোটা
ফুলগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে। একজন কবি
আমাকে তোমাদের দু’জনকে
আংশিক সৌন্দর্য দেখিয়েছিলেন তার এক বর্ণনায়।
তারপর থেকেই অচেনা তোমাদের অসম্পূর্ণ বাগান
দেখার পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ি। আজো
কখনো খাঁখাঁ দুপুরে, কখনো-বা মধ্যরাতে। এই যে
কোনো কোনো দিন হঠাৎ ক’টি আধফোটা ফুলের
সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এ রকমই কি হতে থাকবে বহুদিন?
০৪-১০-২০০৩
অসহায় পঙ্ক্তিমালা
অবসন্ন কবি কি নিঝুম বসে ছিলো নিজ ঘরে এক কোণে
বেতের চেয়ারে মধ্যরাতে। আচানক
কে কবিকে চটকানা মারলো নিশীথে? হুড়মুড়ে
শব্দ কী দাপট
দেখায় চৌদিকে! আসমান যেন অনেক নিচুতে
নেমে এসে ভেঙচি কাটে। রাতজাগা শায়ের পড়ন্ত
তারাদের লুফে নিতে হাতের তালুতে
বেজায় তৎপর হয়। অন্তরালে ক্ষুধার্ত ইঁদুর
কবির সাধের পাণ্ডুলিপি চেটেপুটে খেতে থাকে। পাণ্ডুলিপি
নিমেষে মিলায় শূন্যে, কবি করতলে নক্ষত্রের মালা নাড়ে!
উদাসীন শায়েরর দৃষ্টি শুধু ক্ষ্যাপা আসমানে
সেঁটে থাকে বহুক্ষণ, যেন মুখস্থ করছে সব
খুঁটিনাটি প্রতিক্রিয়া নক্ষত্র এবং
ভীষণ পীড়িত চন্দ্রমার। এ কেমন
গজব পড়ছে চতুর্দিকে বহুকাল ধরে, ভেবে
অতল বিষাদে ডোবে কবি হাহাকার বুকে নিয়ে!
কে যেন প্রবল ঠেলে দিতে থাকে তাকে বড় কণ্টকিত পথে
এ গহন রাতে। মেঘ চিরে ফুঁড়ে খাপছাড়া এক
মুখ করে উচ্চারণ, ‘জনহীন পথে একা হেঁটে যাওয়া ছাড়া তোর
মুক্তি নেই। অন্তরাল থেকে কেউ নাড়ছে নাছোড়
কলকাঠি-‘চল মুসাফির, এই পথে চল’ বাক্য
হতবাক শায়েরের একান্ত পরিচালক যেন।
ধীরে হেঁটে যেতে যেতে বহুদূর শায়ের নিজেকে পেয়ে যায়
বিয়াবান এক
এলাকায়; ‘এসো, এসো’ ব’লে কারা তাকে
কাছে টানে, অথচ সেখানে থমথমে
জনহীন স্তব্ধতাই উটের ধরনে
বাড়িয়ে রয়েছে গলা। স্পন্দমান প্রাণীর অস্তিত্ব নেই কোনো।
অকস্মাৎ শায়ের নিজেকে মানবরূপী অন্ধ পশুদের
দঙ্গলে ভীষণ একা দেখে নিমেষেই
বড় হিম হয়ে যায়। আসমানে ভাঙাচোরা চাঁদ
বাঁকা হাসি হেসে ভীত কবির পুরোনো এক
কবিতার কতিপয় পঙ্ক্তি ছুঁড়ে দেয় নিচে-
অসহায় পঙ্ক্তিমালা কী বিধুর ধুলোয় গড়ায়।
২৩-৫-২০০৩
আমার কলমটিকে বেশ কিছুদিন
আমার কলমটিকে বেশ কিছুদিন টেবিলের
এক কোণে অন্ধকারে ফেলে
রেখে প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম বস্তুত। ওর গায়ে
কিছু ধুলো জমেছিল স্পর্শহীনতায়।
কী ক’রে ছিলাম এতদিন ওকে একটুও না ছুঁয়ে?
কী ক’রে সম্ভব হলো আমার এ আচরণ, ভেবে
আজ এই গোধূলিতে কেমন বিপন্ন,
অসহায় মনে হয়। আমি তো নিজেরই কাছে অচেনা এখন।
এখন আমার বন্ধ্যা মনের প্রান্তরে অকস্মাৎ
কতিপয় পুষ্পময় হাওয়ার-দোলানো
ছোট গাছ যেন বা আনন্দে আত্মহারা,
গানে মশগুল, আমি অন্য কেউ হয়ে গানে মিশে যাই।
তাহ’লে কি আমার কলম অভিমান-মুক্ত হয়ে
এই ডান হাতের পাঁচটি আঙুলকে
বন্ধ্যাত্বের খরাত্বকে অপরূপ জলসেচে ফের
নতুন ফসলে ধনী করবে এমন অবেলায়?
কলম, তুমি তো ঢের পথ পেরিয়ে এসেছো
এতদিনে, কখনো সখনো
খেয়েছো হোঁচট খুব, শক্র শিবিরের বাঁকা দৃষ্টি,
মশকরা করেছে তোমাকে বিদ্ধ, তবু আজো ছাড়ি নি তোমাকে।
যে যা-ই বলুক, যত অবহেলা আমার সত্তাকে
ছিন্নভিন্ন করুক নিয়ত, তবু আমি
সন্তের মতোই এই কাগজের পাতায় পাতায়, যতদিন
বেঁচে আছি, শব্দের মিছিল ভালোবেসে সাজাবোই।
এই তো এখন এই গোধূলিতে কতিপয় শব্দ এসে
আমার নিষ্ক্রিয় কলমকে
কল্পনা এবং বাস্তবের মিলনকে অর্থময় করে
তোলার তাগিদে বড় ব্যাকুল হয়েছে বেশ কিছুকাল পর।
১৬-৭-২০০৩
আসমানে উড়বে পায়রা
পুতুলের মতো
ফুটফুটে, ছোট মেয়েটির কথা ছিল
সুন্দর খেলনা নিয়ে ঘরের ভেতর
খেলায় নিমগ্ন থাকা। অথচ সে পথে
ধুলোবালি আর পাশে মায়ের লাশের
দিকে কান্নাময় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। হন্তারক
বুলেটের সন্ত্রাসে মহিলা নিমেষেই জীবনের
শাখা থেকে পরিপক্ব ফলের মতোই খসেছেন!
কী-যে হবে মাতৃহীন শিশুটির পরিণাম, বলা
মুশকিল। ভয়াবহ যুদ্ধপীড়িত সময়ে এই
পিতৃমাতৃহীন বালিকার ভবিষ্যৎ ঠিক কোন রূপ নেবে
এ প্রশ্নের জবাব এখন পাওয়া যাবে কার কাছে?
উড়োজাহাজের
গর্ভ কিংবা ট্যাঙ্কবাহী কামানের গলা
সোৎসাহে উগরে দেয় মৃত্যুময় গোলা।
নিমেষেই মাটি গিলে খায় কত তরতাজা প্রাণ!
সেই সব অগ্নিকুণ্ড জানে না, বোঝে না প্রতিপক্ষ
খৃস্টান, মুসলমান নাকি
অন্য কোনও ধর্মীয় বিশ্বাসে নিবেদিত-
মৃত্যুর মুহূর্তে কেউ জানে না কোথায় তার লাশ পাবে ঠাঁই।
এই দুনিয়ায়
ন্যায়ের নেই কি কোনও বিজয়ের আশা?
‘আছে, আছে’ ব’লে ধূমায়িত মেঘ থেকে
কে পাখি আশার সুরে গান গেয়ে যায়।
একদিন বাগদাদ, বসরার গুলবাগ থেকে
হবে দূর অশুভের ছায়া, মানব মানবী ফের
সাজাবে সংসার ভালোবেসে প্রশান্তির ছায়াতলে;
আসমানে উড়বে পায়রা শত শত উৎসবের দীপ্ত তালে।
৬-৪-২০০৩
আসমানে শারদীয় চাঁদ
কারো সাতেপাঁচে নাক গলাবার প্রবণতা
আদপে গায়েব ছিলো। নিজের মামুলি
গণ্ডির ভেতরে বিচরণে
কাটিয়েছি দিন, মাস এবং বছর।
যদিও নিজেকে মাঝে মাঝে
ভাসিয়ে দিয়েছি মেঘে এবং উড়েছি
বিচিত্র রঙের পাখিদের পেছনে এবং হাত
বাড়িয়ে ধরার ফাঁদ গড়তে চেয়েছি।
সাফল্য জোটেনি, তবু খেলার নেশায় প্রতিবার
পরাজয় মেনে নিয়ে আনন্দের গুঁড়ো
কুড়িয়েছি এদিক সেদিক। ঝকঝকে ভবিষ্যের
আশায় অনেক হেঁটে অন্ধকারে এবড়ো-খেবড়ো
কত পথে খেয়েছি কামড় ঢের পোকা-মাকড়ের;
তবুও জীইয়ে রেখে স্বপ্ন হাত দিয়েছি বাড়িয়ে।
কারা যে আমাকে আচানক এক কবন্ধ গুহায়
ঠেলে দিলো অমাবস্যা রাতে,
ঠাওর করার কোনো সুযোগ পাইনি
কিছুতেই। আঁধার যে এরকম ভীষণ ভঙ্গিতে
কামড়ে ধরতে পারে, ধারণা ছিলো না
কোনো দিন। অন্ধকার এ প্রকার হিংস্রতা পেয়েছে কোন দেশে?
মাংস ছিঁড়ে খাবে নাকি এই বিরানায়? হায়,
আমি কি অদৃশ্য হয়ে যাবো
সাততাড়াতাড়ি আঁধারের নিপীড়নে? অকস্মাৎ
ভয়ানক হাসির আওয়াজ
গুহাকে কাঁপিয়ে তোলে। কে জানে কোত্থেকে
এক অর্ধ মানব এবং অর্ধ পশু গুহায় লাফিয়ে পড়ে।
আমার শিরায় রক্তধারা তুষারের মতো জমে
আমাকে মৃত্যুর খুব কাছে অতি দ্রুত
নিয়ে যেতে থাকে। আমি প্রায় হাল ছেয়ে
চোখ বুজে ফেলি। কী-যে হলো, আচমকা
বিকট শব্দের এক ধমকে গুহায় পুরো মাথা উড়ে গিয়ে
জেগে ওঠে গুহার জ্বলজ্বলে আসমানে শারদীয় চাঁদ
অপরূপ হাসি তার ছড়িয়ে চৌদিকে
আমাকে অভিবাদন জানিয়ে প্রফুল্ল অতিশয়।
১৪-৯-২০০৩
ঋজু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই
বলপয়েন্টের ক্যাপ বহুক্ষণ খুলে রেখেও যখন শাদা
কাগজে ফোটাতে শব্দ ব্যর্থ হই, ফের
লেখনীটি বন্ধ করি ক্যাপে। কিছুক্ষণ কেটে গেলে
বলপয়েন্টেকে বন্দিদশা থেকে রেহাইয়ের পর
আবার টেবিলে ঝুঁকে কাগজের বুকে
কিছু আঁকিবুকি কাটি, না-লেখা সম্ভাব্য পঙ্ক্তিমালা
আন্ধারে গুমরে মরে। ইচ্ছে হয়, আঙুল কামড়ে ধরি আর
উত্তপ্ত মাথার চুল ছিঁড়ি।
মাঝে মাঝে মনে হয়, খাঁখাঁ কাগজের বুকে নান্দনিক কিছু
কাব্য পঙ্ক্তি ফোটাতে না পেরে
চটজল্দি নিজেকে সুতীক্ষ্ণ হতাশার গিলোটিনে
হাঁটু গেড়ে বসানো কি এতই জরুরি?
আমরা তো মাঝে মাঝে প্রেমিকার সঙ্গে সাক্ষাতের
জন্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকি, তেমনি কি কবিতার
সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় দীর্ঘকাল
অপেক্ষা করা কি আরও বেশি কাঙ্ক্ষণীয় নয়? যতদূর জানি,
একজন প্রয়াত মহান কবি কবিতা সৃষ্টির গূঢ় রহস্যের
মহাসত্য করেছেন গাঢ় উচ্চারণে, “প্রতীক্ষা শেখাও প্রভু।“
তবে এ রকমও হয়,- দীর্ঘ প্রতীক্ষা সত্ত্বেও কোনও
কোনও কাব্য-প্রয়াসের অপমৃত্যু ঘটে! তবু কবি
সাধনায় টানেন না ছেদ, কবিতা নামের দ্রুত
পলায়নপর হরিণীর পেছনেই ছুটতে থাকেন নিত্য।
কবিতা যদিও মায়াবিনী ব’লে খ্যাত, তবু নয়
একরোখা, বহুমুখী সত্তা তার, এ-কথা সবার
জানা আছে। কখনও সে অপরূপা স্বপ্নময়ী, কখনও বাস্তবে
ঝলমলে; কখনও সওয়ার হয়ে পক্ষীরাজে সাত
আসমানে ওড়ে, কখনও বা রোদে-পোড়া,
বৃষ্টিভেজা মৃত্তিকায় হাঁটে, কখনও বিনম্র স্বরে গান
গায় আর কখনও উজ্জ্বল জনসভায় জোরালো কণ্ঠে গর্জে ওঠে-
আজও আমি তার সব রূপের বন্দনাগীতে সত্যি মজে আছি।
আমার একান্ত সাধনায় তার সন্তোষ সৃষ্টিতে
কতটা সার্থক আমি জানা নেই, তবু আজ অব্দি
রোগ শোকে দগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কিছুকেই
প্রমাদক্রমেও উঁচু স্তরে বসাইনি। জয় হোক
কবিতার, মানবের সর্বদা আবৃত্তি ক’রে হিংস্র আঁধারকে
তুচ্ছ ভেবে স্বদেশের মাটিতেই ঋজু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই।
১৩-১১-২০০৩
ঋতুবদলের সামান্য পদ্য
জীবনের অনেকটা পথ পেরুলেও মানে তার
পুরোপুরি কখনো যায় কি বোঝা? এই
আমি দুনিয়ার এক কোণে
কাটিয়ে দিয়েছি চুয়াত্তর বছরের দিনরাত,
তবু মনে হয়, বাস্তবিক
ছিলাম যেন-বা অতিশয় আবছায়া কুয়াশায়।
বস্তুত ভাবলে দেখা যাবে মেঘনা নদীর তীরে
ঝিমোনো পাড়া গাঁ পাড়াতলীতেই
আমার প্রবীণ পূর্বপুরুষেরা আর আমার জনক
হয়েছেন ভূমিষ্ঠ এবং মানুষের মঙ্গলার্থে
রেখেছেন দীর্ঘস্থায়ী কিছু নিদর্শন। সেখানেই
বাল্যকালে প্রথম দেখেছি সর্ষেক্ষেতে আনন্দিত
প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি আর কাজলা দিঘিতে
কিশোর কিশোরীদের প্রফুল্ল সাঁতার বহুদিন।
বস্তুত প্রত্যেক ঋতু কী সুন্দর নগ্নতায় ফুটে
ওঠে পাড়াগাঁয়ে, গ্রামবাসী অনেকেই
অথচ মানুষ
দারিদ্র্যের প্রহারে কাতর খুব প্রায়শই, শহরের
বস্তিও নিয়ত বড় দুমড়ে মুচড়ে যায় অভাবের কালো
দংশনে এবং কতিপয় নারী বাঁচার তাগিদে বেপরোয়া
দেহের বেশাতি করে। আস্তাবল ক্রমশ উজাড় হয় আর
গাঁয়ের গোয়ালে হন্তারক মৃত্যু ঢুকে পড়ে দ্রুত। তবু নীল
আসমানে পূর্ণিমার চাঁদ হাসে, নদীবক্ষে মাছ
প্রফুল্ল সাঁতার কাটে, কবিকুল লেখে ঋতুবদলের পদ্য।
৩০-১০-০৩
এই যে আমি
রাত্রি এসে হঠাৎ আমায়
আদ্যোপান্ত জড়ায় এবং
দেখায় কিছু
আজব ছবি। ছবিগুলো কেমন যেন
ভাঙাচোরা, ভয়-দেখানো ভঙ্গি ওদের।
কেউ আমাকে ভেংচি কাটে, কেউ বা নখের
ডগায় কিছু পাখির ছেঁড়া মাথা দোলায়
ডানে বামে। কেউ বা এসে কামড়ে ধরে।
হঠাৎ দেখি পড়ে আছি খাঁখাঁ পথের
কিনারে ঘেঁসে। উঠে বসার, নড়া-চড়ার
শক্তি উধাও; দু’ চোখে নীল পর্দা কারা
দিলো সেঁটে। একটি খুবই হিংস্র পাখি ঘন ঘন
ঠুক্রে খাচ্ছে আমার মাথা। কপাল থেকে রক্তধারা
বইছে বেজায়। এখুনি এই খাঁখাঁ পথে
হয়তো আমি থাকবো প’ড়ে
বেগানা এক লাশের মতো, পশু, পাখির খোরাক হবো।
এই যে আমি মধ্যরাতে নিজের ঘরে
আছি শুয়ে, আমার চোখে উঠছে ভেসে
ভয়-জাগানো নানা ছবি-
এগুলো কি ভবিষ্যতের
আগাম ছবি? নাকি মনের আবছা কোণে
গড়ছি শুধু নানা ঢঙের ভয়-দেখানো মূর্তিগুলো?
শান্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্ন দেখি যাচ্ছি ভেসে
অচিন দেশে-নানা ঢঙের লোক সেখানে
হেঁটে বেড়ায়। ওদের মুখে
সুখের হাসি ফুলের মতো আছে ফুটে।
তবু হঠাৎ বিকট কিছু চিত্র আমায়
দিলো ঠেলে বিপদ ঘেরা ধূসর পথে কাঁপতে থাকি
আমার চোখে প্রেতের নাচন চলতে থাকে
রাত্রি জুড়ে। নতুন ভোরের
আভাস মনে ফোটায় নতুন ফুলের আভা,
ভাসতে থাকি অচিন পাখির কিছু দূরের সুরের ঢেউয়ে।
২৬-০৯-০৩
এই যে বিশ্বের নানা এলাকায়
পশু, পাখি অনর্থক আহত করে না মানুষকে, ধবধবে
শার্ট, ট্রাউজার-পরা দুরন্ত মানুষ প্রায়শই
ঝরায় রক্তের বৃষ্টি, চিহ্ন যার
কখনো পড়ে না ধরা চর্মচক্ষু শতবার খুঁজলেও। শুধু
উদ্দিষ্ট শিকার ষোলআনা পায় টের
অদৃশ্য অস্ত্রের ধার। মর্মপীড়া বেড়ে চলে প্রহরে প্রহরে।
এই আমি শত চেষ্টা সত্ত্বেও হয়েছি ব্যর্থ ক্ষত
সৃষ্টি করে ভোগাতে শক্রকে। অকেল্যাণ
করিনি কামনা তার অমাবস্যা-রাতে। থাক, থাক,
সুখে থাক সেই অকল্যাণকামী আমার সর্বদা।
এই যে বিশ্বের নানা এলাকায়
হৈ-হাঙ্গামা চলছে হামেশা, মানুষের
তাণ্ডবে ঝরছে রক্ত মানবের যখন তখন-
বড় বেশি বিবমিষা জাগে
সে সব দৃশ্যের কথা ভেবে
নানা দেশে বিচলিত নাগরিকদের।
তুমি যে এখন নিজ বাসভূমে একলা ঘরের
এক কোণে বসে বাগদাদ, বসরার ভগ্নস্তূপ
দেখছো টিভিতে আর সংবাদপত্রের
পাতা জুড়ে পুত্র, কন্যা-হারা জননীর
ছবি, মূক হয়ে থাকা ছাড়া কী-ই বা করতে পারো?
সমবেদনার ঢলে আর্তনাদ আর্তনাদ যাবে নাতো ভেসে।
এখন তো বিচূর্ণ, ব্যথিত ইরাকের বুক জুড়ে
আহাজারি; মাঝে মাঝে প্রতিবাদী মিছিলের গর্জনে সুনীল
আসমান কেঁপে ওঠে। বসরার প্রোজ্জ্বল গোলাপ
হতে চায় ফের স্বাধীনতাকামী জনতার প্রাণের ইরাক।
৪-৫-২০০৩
একটি বাগান, তিনটি কোকিল
হঠাৎ আমাকে মধ্যরাতের সুনসান পথ গূঢ় ইশারায়
ডেকে নিয়ে যায়। কী ক’রে যে আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে
নেমে এসে এই খাঁখাঁ রাস্তায় হেঁটে যেতে শুরু করলাম ভেবে
পাইনি মোটেই। হেঁটে যেতে-যেতে দূরে দেখি একি
বড় ঝুঁকে-থাকা একটি বৃক্ষ মাথা নেড়ে কাকে
স্বাগত জানায়। আমি নই সেই শ্রদ্ধেয় জন, নিশ্চিত জানি।
তবে কাকে এই গূঢ় নিবেদন? কোন সে মানব
অথবা মানবী, বলবে কি কেউ? বাঁ দিকে তাকিয়ে
দেখি একজন বেখাপ্পা লোক রয়েছে দাঁড়িয়ে
শীর্ণ শরীরে জড়িয়ে জীর্ণ ধূসর চাদর। চোখ দুটো তার
জ্বলজ্বলে তারা, ঘাড়-বেয়ে-নানা তুমুল কেশর। কাঁধে তার এক
নীরব কোকিল যেন-বা স্থাপিত। লোকটার চোখ পুষ্প ঝরায়।
হঠাৎ রাতের নীরবতা চিরে কাঁধের কোকিল
গান গেয়ে ওঠে। বেখাপ্পা লোক দু’হাতে দূরের
তারার বাজনা বাজিয়ে নাচের ছন্দে দুলতে
দুলতে চকিতে আকাশের নীল ছড়ায় বাতাসে। স্বপ্নের ঘোর
ছেয়ে যায় কবি, ঘুমন্ত দু’টি ভিখিরির চোখ কখন যে কার
ঘরে মৃত্যুর থাবা হানা দেবে, জানা নেই কারো।
এখনো লোকটা নেচেই চলেছে, হঠাৎ কোকিল তার কাঁধ ছেড়ে
উড়ে যায় দূরে ধু-ধু অজানায়। লোকটার হাত
ছুঁড়ে দেয় তারা ডানে বামে আর আখেরে হঠাৎ
নিজেই সে ঘুরে পড়ে যায় দূরে। নিষ্প্রাণ তার
শরীর লুটোয় শুষ্ক মাটিতে, সেখানে চকিতে গড়ে ওঠে এক
ফুলের বাগান, গান গেয়ে যায় তিনটি কোকিল।
৯-১১-২০০৩
এত পথ পেরুনোর পর
এত পথ পেরুনোর পর যদি মোটরকার বিগড়ে যায়, তাহ’লে
মাথায় হাত দিয়ে ব’সে পড়া ছাড়া
উপায় কী? মাথা চাপড়ে
বিলাপ করলেই সমস্যার হিল্লে হবে, এমনও তো নয়। পেছনে
প’ড়ে থেকে যে কোনও ফায়দা নেই, এই সহজ
সত্যটি উপলব্ধি করতে খুব বেশি দেরি হয়নি আমার।
চলেছি জংলি পথে বড় একা, মাথা তুলে
আকাশের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো কুষ্ঠ রোগীর
মুখের মতো চাঁদ। তবু সান্ত্বনা খুঁজে পাই খানিক,
হাঁটি, হেঁটে চলি। মাঝে মাঝে নিজের
অজান্তেই কেঁপে উঠি জ্বরাক্রান্ত রোগীর মতো। মনে হয়,
পেছন থেকে কে যেন
অনুসরণ করছে আমাকে। বড় কষ্টে নিজেকে
বিরত রাখি ঘুরে দাঁড়ানোর স্পৃহা থেকে।
হঠাৎ তারার ফুলঝুরি আমাকে ঘিরে ধরে
চৌদিক থেকে। আশ্চর্য অনুরণন
আমার সত্তায়; নিজেকে কেন জানি পুরাকালের
কোনও গ্রীক দেবতার মতো মনে হয়, যেন এখুনি
আকাশ থেকে আমার উপর বর্ষিত হবে স্বর্গীয়
পুষ্পবৃষ্টি। অথচ আমি স্বদেশের সোঁদা মাটিতেই রয়েছি।
হাঁটছি, ক্রমাগত হেঁটে চলেছি অথচ কিছুতে
পুরোচ্ছে না পথ। যেন এই বন সুদৃঢ়
আটকে রেখেছে সবদিক থেকে পথটিকে। কিছুতে
শেষ হওয়ার নয় এর পরিধি। আমি আর ধূলিঝড়ে কত ঘুরবো?
২১-৩-২০০৩
কখন থেকে এলোমেলো
কখন থেকে এলোমেলো
ঘুরছি শুধু বড় একা,
কখনো পথ সোজা বটে,
কখনো ফের আঁকাবাঁকা।
গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো অনেক কিছু
ভেংচি কাটে।
ঘুরছি শুধু, লাটিম যেন দিগ্বিদিক।
কে যেন ঠিক ছায়ার মতো পেছনে এই
হতভাগার হেঁটে বেড়ায়,
থামে, যখন আমি থামি।
পদ্য লিখি বলেই এমন দশা আমার?
ঘুম আসে না রাত্রিবেলা,
দিনের বেলা। মনের মাঠে
যখন তখন ছুটে বেড়ায় পাগলা ঘোড়া।
কখনো ফের সন্ধেবেলা
হঠাৎ দেখি অনেক দূরে
পুকুরঘাটে রূপ-ঝরানো
কে এক নারী বসে আছে
পা ভিজিয়ে শীতল জলে। আমার দিকে
ডাগর চোখে দৃষ্টি দিতেই
কেমন আমি অতীত যুগের
মূর্তি হয়ে অনড় থাকি সারাবেলা
হঠাৎ দেখি, একি কোথায়
গায়েব হলো পুকুর ঘাটের সেই রূপসী?
পুকুর উধাও, একলা আমি
পদ্য লেখার খাতায় মাথা গুঁজে ঘুমের
আবছা ছায়ায় পড়ে আছি!
পুকুর ঘাটে
দেখা নারীর মুখে মায়া
কী করে এই একটুকুতেই ভুলতে পারি?
১৮-৬-২০০৩
কবিতার একটি পঙ্ক্তির সন্ধানে
বেশ কিছুদিন থেকে আমার কলম আলস্যে
মজে রয়েছে। আকাশ পাতাল কতবার যে এক করেছি,
মাথার চুল টেনে ধরেছি বারবার, তাকিয়ে রয়েছি
জানালার বাইরে কবিতার একটি পঙ্ক্তির সন্ধানে।
শুধু ধু-ধু বালি ওড়ে চৌদিকে; চাপা পড়ে যাই বেজায়
খরার থাবার নিচে। নিজেকে ভীষণ অনাবশ্যক মনে হয়।
লেখার টেবিল, টেবিলে গচ্ছিত কতিপয় জরুরি,
অপরিহার্য বই, লেখার সরঞ্জাম আমার দিকে করুণা
ছড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। হয়তো-বা আমার
ব্যর্থতা এতই ব্যথার্ত করে ওদের যে, তাদের চোখ ফেটে
অশ্রু ঝরার উপক্রম। আমি অসহায় একাকী
বসে থাকি নিষ্ফলা ক্ষেতের মতো, আমাকে গ্রেপ্তার করে হতাশা।
এমন তো নয় আমার কবিতা প্রত্যাখ্যাত এখন
পাঠকসমাজে। এমন তো নয় জাঁদরেল সমালোচক কেউ
আমার পদাবলী দেখে নাক সিঁটকোন, তবে কেন কবিতা
হেলায় আমাকে ত্যাগ করবে গোধূলি বেলায়?
সম্প্রতি অভীষ্ট শব্দাবলী খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খাই বড়,
হাতড়ে-পাওয়া শব্দ হারিয়ে যায় অন্ধকারে বেখবর,
পাই না সন্ধান ক’রে কিছুতেই। স্মৃতি খুব বিভ্রান্ত করে ইদানীং,
এমনকি নিজের পাড়ার নামসুদ্ধ ভুলে যাই, সেই নাম জানার
উৎকণ্ঠায় অন্যদের কাছে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা মেলে ধরি। তবে কি
উন্মাদ হয়ে চলেছি? না কি স্মৃতিহীন, কবিতাছুট হয়ে থাকবো!
১৪-৩-২০০৩
কে এক পাখি আমার খুব কাছে এসে
বুঝতে পারছি না, কোথায় এই গা-এ কাঁটা –দেয়া আন্ধারে
ওরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। না, আমি তো এখনও
নিষ্প্রাণ নই, এখনও আমার হৃৎপিণ্ড
ধুকধুক করছে। নিজের শরীরে চিমটি কাটলে
টের পাবো না, এমন তো নয়।আমাকে
ওরা কি কাঁটাময় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়ে চলেছে কোথাও?
হাত ছুঁয়ে টের পাচ্ছি, পুরো হাত, গলা, বুক, মুখও
খুব ভেজা, রক্তের গন্ধ বেজায়
উত্যক্ত করছে আমাকে। ওরা যে চাবুক কষে
মেরেছিলো সারা গায়ে, সেই উৎপীড়নেই
আমার শরীরের, বলা যেতে পারে,
অসহায় অস্তিত্বের বটে, তবে তিল তিল ক’রে ক্ষইয়ে
আমার জীবনকে ছেঁড়া, ছিনভিন্ন ন্যাকড়া বানিয়ে ছাড়বে।
ক’দিন পর প্রায় জাদুবলে যেন বন্দিদশা থেকে
মুক্তির উন্মুক্ত উপত্যকায় পৌঁছে যাই। নিমেষে
আমার শরীর থেকে রক্তধারার নাছোড় দাগ
গায়েব। কেমন ফুরফুরে আমেজ
আমার দেহমনে। অথচ প্রকৃত আশ্রয় নেয়ার মতো
গাছপালা আর জলাশয় আর ভব্য জনগণময়
জায়গা তো দৃষ্টিগোচর নয় এখনও। হাঁটছি, হাঁটছি, হাঁটছি;
তবে কি ক্লান্তির কুয়াশায় ডুবে ঘুমিয়ে পড়বো আখেরে?
কে এক পাখি আমার খুব কাছে এসে মানবিক
কণ্ঠস্বরে বলে, ‘হে পথিক, এখনই যাত্রা থামিও না।
যাও, এগিয়ে যাও। ভয়কে জয় ক’রে, সকল
বাধা, বিপদ ডিঙিয়ে , হতাশা মুছে ফেলে যাও, এগিয়ে যাও।
২১-৩-২০০৩
কে একজন ঘরের এক কোণে
কে একজন ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসে আছেন চুপচাপ,
আপাদমস্তক তার খবরের কাগজে তৈরি। আমি ওর
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কাগুজে দুটি চোখ
তাকালো আমার দিকে। বড় নিঃস্পৃহ সেই দৃষ্টি,
যেন কোনও কিছুই কে বিন্দু গুরুত্ব বহন করে না কাগুজে
সেই দৃষ্টির কাছে। কাগজ, কালি আর টেলিপ্রিন্টারের ঘ্রাণ
বাষ্পের মতো ভাসছে সারা ঘরে, মনে হলো ঘর
এবং আমি নিজেও খবরের কাগজে তৈরি।
অথচ আমি, এই আমি সংবাদপত্রে রূপান্তরিত হতে
চাই না কোনও মতে। এই আমার মানবিক সত্তাকে
বজায় রাখার জন্যেই তো আমার সাধনা। সংবাদের
গুরুত্বকে এতটুকু খাটো ক’রে দেখছি না, খবরের
সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দুনিয়াসুদ্ধ লোকেরই কাম্য। সংবাদপত্র
সভ্যতারই অব্দান। তবু আমার অবয়ব, আমার চোখমুখ
সংবাদপত্রে রূপান্তরিত হোক, এ আমার কাম্য নয়। এমন
পরিণতির আগে আমি আত্মহনের লিপ্ত হবো।
সভ্যতার কসম, আমি ফুলের সুরভি, নদীর ঢেউয়ে জ্যোৎস্নার
চাঞ্চল্য, মায়ের কোলে শিশুর হাসি, নারীর রূপ, কবিতার
হরেক রকম চিত্রকল্প, ফসলের ঢেউ ভালবাসি, প্রিয়তমার
ভালবাসার খবরও চাই, কিন্তু খবরের কাগজ হতে চাই না, চাই না!
১৫-৩-২০০৩
কোন দুঃস্বপ্ন তাকে
এইতো ক’দিন আগেও তাকে আমার দু’টি চোখ দেখেনি,
অথচ বড় বেশি গভীর দেখেছে
পোড়-খাওয়া অন্তর। আমি ভিড়ঘেরা
তার মৃত্যুশয্যা অথবা নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ কবর দেখিনি,
কোন দুঃস্বপ্ন তাকে নিয়ে গেলো বড় শীতল,
অন্তহীন অন্ধকারে? কে ওকে
দিয়েছিলো চিরপ্রস্থানের মন্ত্রণা
জীবনের বসন্তকালে? কে সেই অন্তরালের
নির্দয় বিভীষিকা? কোন সেই ছদ্মবেশী দিশারি,
যে মধুর বাক্যের আড়ালে বিধ্বংসী পথ দেখিয়ে চলে?
কবিতার প্রেম তাকে চালনা করেছে
সুন্দরের পথে, আরো ভিন্ন পথে। কখনো
কোনো পথ মোহন রূপে বড় নিকটে
নিয়ে গেছে, কখনো অমৃতের পাত্রের ছলে দু’হাতে
দিয়েছে তুলে গরলের গ্লাস। সোৎসাহে
করেছে পান বিশ্বসের কাঁধে কাঁধ রেখে!
যে কবিতার খাতা সযত্নে রাখতো সে দেরাজে,
যার পাতাগুলো এখন দিনরাত করবে
মাতম রূপময় শব্দাবলীর অভাবে, বড় মলিন
হতে থাকবে ধুলোয়। কারো চোখ কি অশ্রুসজল
হয়ে উঠবে দেখে পুরোনো
পঙ্ক্তিমালা, কবিতার খসড়া আর অনেক পাতার শূন্যতা?
উপমা, উৎপ্রেক্ষা অথবা অন্ত্যমিল, কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে
উদ্বেগ কিংবা সংসারের বিবেচনা-কিছুই
করবে না আর বিচলিত তাকে। সে কি এখন
উড়ছে মেঘে নাকি জনহীন, জ্যোৎস্নাশোভিত
অনন্য হ্রদে কাটছে সাঁতার? তার পায়ের
ছন্দে উড়ছে মুক্তপ্রতিম জলকণা-কেউ কি ভাববে?
কোন্ কালবেলায়
ইট, পাথর, লোহা, সিমেন্ট, সিমেন্ট, লোহা,
পাথার, ইট ডানে বামে
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ সব দিকে
চেপে বসেছে। গাছ-গাছালির বুকে ইট, পাথর, লোহা
জেঁকে বসেছে আর সহজে সবুজ পাতা
কিংবা ফুল চোখে পড়ছে না কারও। কোকিল
গান গাওয়ার মতো ঠাঁই পাচ্ছে না কোথাও, ঘরে ঘরে
শিশুরা বড় বেশি ধুঁকছে শ্বাসকষ্টে।
মানুষের সাধের তৈরি মেকি, ঠুনকো সভ্যতার
তর্জন গর্জনে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে
নাগরিকদের। নিজেদের কীর্তির
বড়াই তাদের পাঁড়মাতাল ক’রে তুলেছে; অনেকে
আমাকে গাড়ল ভেবে ড্রইংরুমের জম্পেশ
আড্ডায় ভাবনায় ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছেন।
এমনও হতে পারে, অনুমান করি, আমার
কথাবার্তা শুনে অনেকে মনে মনে
আমাকে পাগলা গারদে ঠেলে দেয়ার
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মানব মানবীর কথা না ব’লে
আমি কেন কোয়েল, দোয়েল, গাছগাছালি, ফুল, টিয়া,
বুলবুল, ময়ূর ময়ূরী, চড়ই- এদের দিকে
থাকি মনোযোগী। এদের প্রতি যত্নবান না হ’লে
হয়তো দরদালান থাকবে, কিন্তু মানুষ থাকবে না।
অমনোযোগের এই মহামারী কায়েম থাকলে
সর্বনাশ আমাদের করবে গ্রাস। ফুল, পাখি, উদ্ভিদ-
এদের অভিশাপে হয়তো আচানক একদিন
আমাদের উপর হিংস্র পশুর মতোই
ঝাঁপিয়ে পড়বে রুদ্রমূর্তি প্রকৃতি। চতুর্দিকে
পড়ে থাকবে বহুতল সব দালানের ধ্বংসস্তূপ। সর্বনাশ
ড্রাগনের মতো মহানন্দে কাঁটাময় লেজ নাড়বে
জনহীনতায়। কে জানে কখন কোন্ কালবেলায়?
১৬-৩-২০০৩
কোন্ দিকে আজ
(শাহমান মৈশান প্রিয়বরেষু)
কোন্দিকে আজ পা বাড়াবো?
পথ যে বড় উঁচু-নিচু, পিছল খুব।
তাছাড়া এই পথের বাঁকে
ঝোপে ঝাড়ে হিংস্র কিছু পশু থাকে;
সুযোগ বুঝে পথচারীর ঘাড়ে হঠাৎ
লাফিয়ে পড়ে। শরীরটিকে জখম ক’রে
মাংস ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে।
ঝোপে রক্ত লেগে থাকে।
আচ্ছা, যদি পথ মিশে যায় দূর আকাশে,
তখন আমি পারবো কি সেই পথটি বেয়ে
নীল আকাশে পৌঁছে যেতে?
পৌঁছে গেলে চাঁদের মুখে খাবো চুমো,
হাঁটবো সুখে ঝলমলে ঐ
তারার মেলায়, কুড়িয়ে নেবো রত্ন কিছু।
কিন্তু আমি নিজেই মাটির ঘ্রাণে মুগ্ধ হতে খুবই
ভালোবাসি। গাছের সারি, নদী এবং
নীল আকাশে পাখির মালা সকল সময় দেখতে চাই।
এই যে আমার দেয়াল-ভরা বইয়ের সারি,
লেখার ছোট্র টেবিলখানা, পুরোনো এক
চেয়ার সবই আজো আমার প্রিয় খুবই।
কোথায় যাবো সন্ধেবেলা, আঁধার ঘিরে
ধরছে আমায় এবং একটি কালো পাখি আমার দিকে
আসছে ধেয়ে লালচে চোখের ধমক নিয়ে
আসছে আমার লেখার কলম কেড়ে নিতে।
২০-১০-২০০৩
কয়েকটি শকুনের হতাশা
লোকটা তৃষ্ণার্ত খুব, এদিক সেদিক হন্যে হয়ে
ঘুরছে, তাকাচ্ছে চারদিকে, যদি কোনো
জলাশয় চোখে পড়ে যায়। ধু-ধু, শুধু
ধু-ধু সব দিক; হায়, তৃষ্ণায় বিশুষ্ক বুক ফেটে যাবে না তো!
আচানক সেই লোক পড়ে যায় একটি গাছের
নিচে এসে, মুখের বিশুষ্ক কষ বেয়ে
কিছু ফেনা খানিক স্ফুরিত হয়, লোকটার চোখ
দুটো বোজা। মৃত্যু কি ভীষণ লোভে অতিদ্রুত
চেটে নিচ্ছে তার পরমায়ু? কয়েকটি লাল
পিঁপড়ে সারি বেঁধে মৃতপ্রায় লোকটির শরীরে উঠছে।
প্রাত্যহিক রীতি অনুসারে এই ব্যক্তি ভোরবেলা ঠিক
শয্যাত্যাগ করেছিলো, দাঁত মাজা, হাত-মুখ ধোওয়া,
কবোষ্ণ চায়ের পেয়ালায় মুখ রাখা, সংবাদপত্রের পাতা
ওল্টানো, খবরে ডুবে থাকা কিছুক্ষণ-সবই তার
চলছিলো প্রথামতো। তাকালো সে নীল আসমানে,
অতঃপর আচমকা কী-যে হলো, লোকটা বেরিয়ে গেলো একা।
যাত্রা ছিলো তার কোন দিকে, নিজেই সে
জানতো না, হেঁটে গেছে, হেঁটে গেছে শুধু
হেঁটে গেছে একাকীত্বে ডুবে-থাকা, বেপরোয়া কিংবা
সব কিছুকেই তুড়ি মেরে ওড়ানোপ্রবণ একজন,
নাকি ধ্বংসলীলা চেখে দেখার মতোই
একরোখা, বেয়াড়া পুরুষ।
সূর্য মধ্যাকাশ ছেড়ে নেমে আসতেই নড়ে ওঠে
লোকটার নিস্তেজ শরীর, কয়েকটি
শকুন কাছেই ছিলো বসে আহারের প্রতীক্ষায়। তবে
নিস্তেজ মানুষটির নড়াচড়া দেখে
কিয়দ্দূরে উড়ে গিয়ে গাছের শাখায় বসে, যেন
হতাশা ওদের কিছু ম্লান করেছিলো লোকটির মৃদু জাগরণে।
০৩-১১-২০০৩
খুব বেশি দূরে নয়
কণ্টকিত দুঃস্বপ্নের ভীষণ কালিমা নিয়ে শঙ্কিত সত্তায়
সবেমাত্র উঠেছি কি জেগে? এক গা ঘেমেই
নিজেকে কেমন ক্লান্ত, অসহায় মনে হয়। বড় ক্লান্ত দুটি
চোখ যেন ফের নিভে আসবে, এমন ধারণার
আওতায় বন্দি হই; পাশে কী নিশ্চিন্ত হয়তো-বা স্বপ্নময়
নিদ্রায় আছেন মগ্ন জীবনসঙ্গিনী।
মনে হয়, আটকে পড়েছি যেন হিংস্র মাকড়সার জালে, মাথা
কবিতার পঙ্ক্তি মনে, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথী’, সেই কবে লিখে
গেছেন রবীন্দ্রনাথ, আজও তাঁর বাণী
বড় সত্য রূপে
করছে বিরাজ
বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায়। দেখছে তো
বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে ইরাকের
বুকে আজ দারুণ মার্কিনী বোমার অনাচার,
মৃত্যুগন্ধী যুদ্ধবাজ ট্যাঙ্কের ঘর্ঘরে বিচরণ।
ইরাকের তেলের দুর্দমনীয় ঘ্রাণে উন্মাতাল বুশ দিব্যি
মেতেছেন ধ্বংসযজ্ঞে-পুরুষ, রমণী, শিশু কত
ঘরহীন, ক্ষুধার্ত খুঁজছে হন্যে হয়ে দিগ্ধিদিক
আশ্রয় এবং খাদ্য। এ কেমন ভয়ঙ্কর দুর্ভোগ তাদের
জীবনে দিয়েছে হানা? ওরা তো ভাঙেনি লাঠি কোনও
মোড়লের মাথায়, দেয়নি ছাই কারও বাড়া ভাতে।
প্রাচীন শহর বাগদাদ বোমার তাণ্ডবে আজ
পুড়ছে ভীষণ, ধসে পড়ছে দালান, ভগ্নস্তূপে সভ্যতার
প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে শক্রর লালসাময় মুখে চুনকালি
মেখে দিতে ইরাকের সৈনিকেরা নিয়ত প্রস্তুত। যত বোমা
করুক আঘাত যত্রতত্র, আক্রোশে পোড়াক শত
ঘরবাড়ি, পারবে না কেউ
কখনও করতে রদ চাঁদ সুরুজের আসা-যাওয়া
ইরাকের মুক্ত আসমানে। পারবে না কোনও যুগে।
বাগদাদে ফুল গাছে ফুটবে রঙিন ফুল, বসরায় ফুটবে গোলাপ,
তরুণ তরুণী ভালবেসে সাজাবে সংসার আর প্রতিদিন
রেডিও টেলিভিশনে, নিজ বাসগৃহে শিল্পীগণ
গাইবে বিচিত্র গীত, বাদ্যে ফোটাবে মুধুর সুর। সে দেশের
জমিন সেদিন শক্রমুক্ত, লাপাত্তা বোমার গন্ধ, চতুর্দিকে
জনতার আনন্দ মিছিল, সে মুহূর্ত খুব বেশি দূরে নয়।
২৪-৩-২০০৩
গন্তব্য নাই বা থাকুক
বিকেলে চলার পথে অকস্মাৎ আকাশের দিকে
চোখ রাখতেই উদ্বেগের কালো ডানা
ঝাপটাতে থাকে মনে। ভাসমান মেঘমালা ভীষণ রক্তিম
হয়ে চোখ রাঙাচ্ছে প্রবল। পর মুহূর্তেই নামে
তপ্ত লাল জলধারা; এই জ্বালা-ধরানো বর্ষণে
পুড়ে, হায়, ভস্মমূর্তি হয়ে যাব নাকি?
জ্বলে পুড়ে যেন আমি আলাদা পথিক, কৃপাপ্রার্থী
জানি না কাদের কাছে, কার কাছে! কেমন অচেনা
মনে হয় চেনা পথ, ঘনিষ্ঠ এলাকা, গাছপালা
কোথায় আমার বাড়ি? কারা বলে দেবে
আমার ঠিকানা আজ? পথ জুড়ে বিছানো বিষাক্ত কাঁটা আর
বিপদের ফণা উত্তোলিত ঠিক ডানে বামে, সম্মুখে পেছনে।
এই পোড়া শরীরের বোঝা বয়ে হেঁটে যাব আর কত পথ
অবেলায় লাল বৃষ্টিধারা বিপন্ন সত্তায় নিয়ে? দিশাহারা
আমি শুনি চতুর্দিক থেকে আর্তনাদ ভেসে এসে
আমাকে বিপন্ন করে আরো বেশি। পোড়া গন্ধ চৌদিকে দাপট
দেখাচ্ছে মেজাজি মোড়লের মতো। পথের দু’ধারে সারি সারি
বাড়ির কঙ্কাল আর গাছের ধূসর লাশ শাসাচ্ছে আমাকে।
কোথায় আশ্রয় পাব? জন-মানবের সাড়া নেই, অকস্মাৎ
মাটি ফুঁড়ে কয়েকটি শীর্ণকায় হাত নড়ে ওঠে,
যেমন গাছের পাতাহারা বেঁটে ডাল কম্পমান
ঝোড়ো বাতাসের চড়ে। হাতগুলো ভীষণ আক্রোশে
আমার পা ধরে দ্রুত পাতালে নামাতে চায়; ভীত
সন্ত্রস্ত এবং মূক আমি মুক্তি পেতে চেয়ে বন্দি থেকে যাই!
জানি না কী ক’রে যেন হাতগুলো নুয়ে পড়ে মুক্ত আমি দ্রুত
ছুটে যাই সামনের দিকে। লাল বৃষ্টি থামেনি তখনও,
এক হাঁটু পানি ভেঙে বিরানায় পড়ি-মরি ক্রমশ এগোই-
জানি না কোথায় কোন আস্তানার দিকে। আস্তানা আছে কি কোনও?
থাক বা না থাক, এই ছদ্মবেশী তাণ্ডবের জাল
ছিঁড়ে যত দ্রুত পারা যায় যেতে হবে, গন্তব্য থাকুক আর
নাই-বা থাকুক;
কণ্টকিত পথ,
ফাঁদ পাতা পথ,
যত ক্রূর হোক…
০৮-০৮-২০০২
ঘর আমাকে কবরের ঘ্রাণে
মাঝে মাঝে আচমকা নিজেকে
নিঃস্পন্দ, নিষ্প্রাণ বেভে ঘরের
এক কোণে বসে থাকি একলা-
যেন আমি ঘরেরই
আসবাব, এ রকম নিষ্প্রাণ!
আচানক এক শব্দে নিস্তব্ধতা অধিক
স্তব্ধতর হয়, ঘর আমাকে
কবরের ঘ্রাণে আচ্ছাদিত করে বেজায়!
ভাবি, অতিদূর কোনোকালে দুনিয়া
অকস্মাৎ হবে কি মানবহীন, নিরেট
বস্তু কোনো? না থাকলে গাছপালা, গায়ক
পাখি, নদীনালা কিংবা সবুজ
প্রান্তর, হবে কি নরনারী সেই বিরান,
নিষ্প্রাণ অঞ্চলে প্রেমবাণী উচ্চারণে উৎসাহী?
কে আমাকে ডাকে সুমধুর সুরে দূরে? কোথায়
কোন্ বিরানায় তার আস্তানা?
নাকি শূন্যে ভাসমান অজানা
সে-জন? দেয় না দেখা কখনো কি কাউকে?
না কি শুধু আমার
দৃষ্টি থেকে বহু দূরে আড়ালে
থাকাই উদ্দেশ্য তার! সে কি কোনো মায়ার
ছলনায় ধ্বংস ডেকে আনবে?
১৫-৬-২০০৩
ঘুমোবার আগে
আজকাল রাতে ঘুমোবার আগে বাতি
নিভাতে গেলেই অকস্মাৎ
থমকে দাঁড়াই বলে সহজে স্যুইচ
টেপাই হয় না ঘরে বাতি জ্বলতেই থাকে আর
নিজে আমি বিছানায় শুয়ে পড়লেও চোখ, মন
থাকে নিদ্রাহারা, হিজিবিজি ছবি কিছু দেয় হানা।
দেয়ালের বুক ফুঁড়ে কঙ্কালের বীভৎস ভগ্নাংশ ক্রমাগত
ঝরে আর নেচে নেচে গায়ে কাঁটা-দেয়া
কাহিনী শোনাতে থাকে। মেঝে ফুঁড়ে ভেসে
আসে অতিদূর শতাব্দীর রমণীর
আর্ত কণ্ঠস্বর জল্লাদের ঝলসানো খড়ুগে বিদ্ধ
ছিন্ন মুণ্ডু কাঁদতে কাঁদতে আচানক হেসে ওঠে।
একজন রাতকানা গবেষক পাণ্ডিত্যের আভা
লাভের আশায় এক কোণে
প্রাচীন টেবিলে ঝুঁকে চষে চলেছেন হলুদ পুঁথির পাতা,
জীর্ণ পাতাদের ঝরে পড়বার দুর্ঘটনা রোধের চেষ্টায়
গবেষক সর্বক্ষণ হুঁশিয়ার! কণ্ঠে তার মালা
পরাবার বাসনা প্রবল হয় আমার এ নৈশ প্রহরে।
মন্ত্রমুগ্ধ আমি তার দিকে এগোতেই দৃষ্টিপট
থেকে সেই দৃশ্য লুপ্ত, চৌদিক ব্যাকুল
হাতড়াতে থাকি জন্মান্ধের মতো আর
আমাকে একটি ডাকাবুকো পাখি এসে নিরর্থক
ঠোকরাতে থাকে, রক্ত ঝরে, চিৎকার করতে চাই,
নিষ্ঠুর কে যেন কণ্ঠ শব্দহীন করেছে আমার।
কী ক’রে যে আচানক আমার ভেতর জন্ম নেয় অপরূপ
ডালপাতাময় গাছ, সবুজ পাতারা
নৃত্যপর হয়, ডালে তিনরঙা তিন পাখি গান
গেয়ে ডেকে আনে প্রজাপতিদের, বুঝি না কিছুই। ক্লান্তি চোখে,
মনে আলগোছে
বিছায় নিদ্রালু পাটি। মেঘের পেলবতায় ঢলে মিশে যাই।
২০-৫-২০০৩
চলার পথে হেঁটে হেঁটে
চলার পথে হেঁটে হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে গাছের তলায় বসে পড়ি;
ফের এগোবার ইচ্ছাটুকু
পুষে রাখতে ঝিমিয়ে-পড়া মনোভাবে।
আচ্ছা যদি এখন ঝড়ে
কেঁপে ওঠে কোমল জমি, বৃক্ষগুলো
কোন্ ভরসা জাগবে মনে?
থাকব না কি কামড়ে ধরে সোঁদা মাটি?
দিন ফুরোলে সন্ধ্যা নামে,
আঁধায় হয়ে আসে শহর আর পাড়া গাঁ।
এই তো আমার জীবন দ্রুত
যাচ্ছে ডুবে নুড়ির মতো অগাধ জলে!
হঠাৎ মনে ভয় জাগে কি?
কোন্ ক্ষণে যে বুনো পশুর মতো চিন্তা লাফায় এবং
শীতল বুকে মৃত্যু যেন
কালো হাসি ছুড়ে আমায় চেপে ধরে।
২১-১০-২০০৩
ছাড়বো নাকো মধ্যপথে
নিত্য আমি যাচ্ছি ক্ষয়ে,
চোখের আলো নিভে যাওয়ার
ভাবনা শুধু শুভ্র ভোরে, রাত-বিরেতে
প্রবলভাবে দিচ্ছে হানা, উঠছি কেঁপে।
স্বপ্ন দেখার সাধে রোজই
দু’চোখ বুজি, ভেসে বেড়াই মেঘের সঙ্গে,
আড্ডা জুড়ি তারার পাড়ায়,
তবু আমার ঘুম আসে না কোনো মতে।
মধ্যরাতে লেখার খাতা
খুলে বসি, আঁচড় কাটি ইচ্ছে মতো, কিন্তু লেখা
হয় না কিছুই। হতাশ হয়ে লেখনীকে
থামাই এবং বসে থাকি কলম রেখে।
তবে কি এই বৃদ্ধকালে
চাষের জমি বন্ধ্যা হলো? তবে কি, হায়, কাব্য আমায়
ঘেন্না ক’রে ধু-ধু মরুর বুকে হঠাৎ
ফেলে গেলো? অমাবস্যা আমায় ঘিরে ধরলো শেষে?
কিন্তু আমি নিচ্ছি শপথ,
কাব্যলোকের নিঠুর দেবী যতই তার সাধকটিকে
দিক সরিয়ে হেলা ভরে, তবু আমি
কিছুতে এই সুন্দরীকে ছাড়বো নাকো মধ্যপথে।
২৯-১০-২০০৩
ছড়ায় না ঘ্রাণ আন্দোলিত যূথি
ছিলাম আপন মনে, যেমন উড়ন্ত পাখি থাকে
আসমানে। বাতাসের ঢেউ, মনে হয়,
নিয়ে যাবে নক্ষত্রের এলাকায়। চাঁদ
করবে আদর ভেবে যাচ্ছিলাম উড়ে
মেঘের পাড়ায়, অকস্মাৎ মেঘদল
গলে গিয়ে রূপান্তরে বৃষ্টিধারা হয়।
ঝরে, বৃষ্টি ঝরে আমি
ক্রমশ ভিজতে থাকি বৃষ্টির আদরে।
দেখি এক নিঃসঙ্গ যুবক জানালার
শিক ধ’রে বাইরে তাকিয়ে আছে আর
কী গভীর মনোযোগে যেন
করছে মুখস্থ বৃষ্টি ধারা। হয়তোবা চোখে তার
কারো বেদনার্ত মুখচ্ছবি
গভীর উঠেছে ভেসে, বুক জুড়ে নাছোড় ধোঁয়াশা।
মনে পড়ে, একদা আমিও
এমন বাদল দিনে কল্পনায় কারো মুখ বুকে
নিভৃতে ধারণ ক’রে কত না প্রহর
কাটিয়েছি, গড়েছি স্বর্গীয় বাসরের প্রতিচ্ছবি।
দিন তো থাকে না কারো এক ছাঁচে গড়া;
গহন সজল দিন কখন যে রুক্ষ,
ধু-ধু হয়ে যায় আর বুকের ভেতর
হয়তো ছড়ায় না ঘ্রাণ সিক্ত, আন্দোলিত যূথি।
১৫-৬-০৩
জনহীন অনন্য আশ্রমে
শহরের হট্ররোল থেকে দূরে, বহুদূরে জ্যোৎস্নাস্নাত এক
জনহীন অনন্য আশ্রমে মাঝে মাঝে
গানের স্বর্গীয় সুর ধ্বনি প্রতিধ্বনি
হয়ে যেন অমরাবতীকে স্পর্শ করে বার বার।
যখন আবার নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়
আশ্রমের অপরূপ অপরূপ অস্তিত্বে, জ্যোৎস্নায় একজন
দীর্ঘকায় দেবতুল্য পুরুষ করেন পায়চারি ঘাসময়
উঠোনের বুকে, তার শ্বেত শ্মশ্রু আর
মাথার সফেদ চুল কী মোহন নড়ে
নিশীথের রুপালিহাওয়ায় আর মাঝে মাঝে তাকে
গাছের পাতারা নুয়ে প্রণতি জানায়। তিনি
কৃতজ্ঞতাবশত করেন উচ্চারণ সদ্যসৃষ্ট কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
বহু পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় মধ্যরাতে
পৌঁছে যাই সে আশ্রমে একান্ত একাকী। অকস্মাৎ
ডাগর জ্যোৎস্নায় দেখি, একজন ঋষি ঈষৎ সমুখে ঝুঁকে
হাঁটছেন বড় একা। মনে হলো, চিনি তাকে, তবুও কেমন
অন্য কোনো গ্রহের দেবতা বলে ভ্রম হয়। তিনি
অকস্মাৎ তাকান আমার দিকে। একি সত্য? নাকি কালো মিথ্যা!
সত্য, মিথ্যা যা-ই হোক, দৃষ্টি তার আমাকে করেছে
ধন্য, ভেবে যদি নিমেষের জন্যে আনন্দের পেয়ালায়
ক্ষণকাল চুমো খাই, তা হ’লে এ বিশ্বে ক্ষতি কার?
অন্তত আমাকে করবেন ক্ষমা জানি বিশ্বকবি।
১আগস্ট ২০০৩
জ্যোৎস্নামাখা মধ্যরাতে
জ্যোৎস্না-মাখা মধ্যরাতে নিঝুম-পথে
একলা আমি যাচ্ছি হেঁটে।
আগে পিছে দৃষ্টি রাখি, কিন্তু কোনো
আদম কোথাও দেয় না দেখা।
এই যে আমি বিজন পথে বড় একা
খুঁজছি ডেরা একটু শুধু ক্লান্তিকণা মুছে নিতে
কিংবা ঘুমের মেঘে ভেসে জড়িয়ে কোনো
সোহাগিনীর দীপ্ত শরীর উধাও হতে।
হেঁটে হেঁটে পথের ধারে একটি গাছের
কাছে গিয়ে ছায়ার আদর গায়ে মেখে
ঋষির ঢঙে বসে পড়ি। হঠাৎ দেখি, সামনে আমার
দাঁড়ানো এক বাউল হাতে একতারাটা ঝুলিয়ে নিয়ে।
দেখেই তাকে উঠে দাঁড়াই, শ্রদ্ধা জানাই নুইয়ে মাথা।
চেহারা তার চেনা খুব, সাধক তিনি লালন সাঁই-
মাথায় আমার হাত রেখে তার স্নেহ বুলিয়ে,
একটি চোখের আলোয় তিনি দেন ভাসিয়ে পথিকটিকে।
একতারাকে সুর বানিয়ে লালন এক লালনগীতি
গাইতে গাইতে গেলেন মিশে জ্যোৎস্না-ধোওয়া
চক্রবালে। আমি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে থাকি
ধূসর পথে; সাগর মেতে ওঠে মনে, পা চালিয়ে এগিয়ে যাই।
জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্তিরে
জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্তিরে মাটির নিচে নিঃসাড়, নীরব
ঘুমের কুয়াশা শুষে নিয়ে সত্তায় এমন ভাষাহীন
থাকা এত একা বছরের পর বছর সাজে কি
আপনার? কী করে নিলেন মেনে এই
পরিস্থিতি? কেন গর্জে উঠে আসমানি
বাজের মতোই প্রতিবাদে দেননি কাঁপিয়ে ত্রিভূবন?
যখন এ-পথে হেঁটে যায় জনসাধারণ, তারা
কখনো কীভাবে
এখানে এ মাটি আর রোদ-পোড়া ঘাসের তলায়
আছেন গভীর ঘুমে মগ্ন একজন
প্রায় চিহ্নহীন, দীপ্র নাম যার আজো উচ্চারিত দিগ্ধিদিক।
কেউ কেউ ভাবে হয়তো-বা, পরমুহূর্তেই খিস্তিতে বিভোর।
হয়তো-বা প্রায়শই ভুলে থাকে তাকে নানা জন; কোনো কোনো
উপলক্ষে পুস্তকের ধুলোবালি ঝেড়ে ঝুড়ে কিছু
আবৃত্তির অনুষ্ঠানে মাতে। তবে গীতিমালা তার
ফুলের মতোই পরিস্ফুট নিত্য স্মৃতির বাগানে।
ভাগ্যিস গানের ডালি তিনি সাজিয়েছিলেন মেতে
শব্দ আর সুরে নিত্য সৃজনের কুহকী আহ্বানে।
কবি, ক্ষমা করবেন এই অধমকে। যতদিন
আছি নক্ষত্রের নিচে ধুলোবালি গায়ে নিয়ে আর
কবিতার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার সাধনায় মগ্ন,
আপনাকে করবো স্মরণ শ্রদ্ধাভরে। এও জানি
এতে আপনার কণামাত্র কিছু এসে যাবে না কখনো। তবু
কবরের ঘাসগুলো অনুরাগে নড়বে হাওয়ায় পূর্ণিমায়।
২৪-৮-২০০৩
তার আগমন এবং প্রস্থান
কিছুক্ষণ ঘরে ব’সে থাকার পরেই জাঁহাবাজ অন্ধকার
আমাকে গ্রেপ্তার করে ওয়ারেন্ট ছাড়াই, বেজায়
ধমকাতে থাকে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ারের
হাতল আঁকড়ে ধরি। এ রকম বিদঘুটে আঁধার কখনো
নজরে পড়েনি বাস্তবিক। অকস্মাৎ কিয়দ্দূরে
অপরূপ আলোচক্র সৃষ্টি হয়। তিমির কাঁপতে থাকে খুব।
আলোচক্র থেকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে আসেন
নিঃশব্দে মহিমময় সুদীর্ঘ পুরুষ আর আমি
ইন্দ্রজাল-সম্মোহিত মানুষের মত
নিমেষে চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়াই। দীর্ঘদেহী
পুরুষের, লক্ষ করি, পাঞ্জবি, বুকের
এলাকা ভীষণ রক্তময়, চোখ দুটি সমুজ্জ্বল ইতিহাসে।
একটিও শব্দ তিনি করেন না উচ্চারণ, শুধু
সুদৃঢ় তর্জনী তার উত্তোলিত আসমানে, যার
বুকে ফুটে আছে সংখ্যাহীন
জ্বলজ্বলে তারার মিছিল। সত্তা তার
মহান কবির মত একান্তে করছে উচ্চারণ
অনুপম পদাবলী সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর প্রগতির।
ব্যাকুল জিজ্ঞাসু আমি কিছু জবাব পাওয়ার জন্যে
খানিক এগিয়ে যাই, কিন্তু তিনি আচানক উজ্জ্বলতা থেকে
ধোঁয়াটে কোথায় তার রক্তাক্ত চওড়া বুক আর মিনারের
মত উঁচু সাহসী শরীর নিয়ে চলে যান কোন্ অজানায়!
১৩-৮-২০০৩
তিরস্করণী হাতের শুশ্রূষায়
যখন একা বসে থাকি ঘরে, হঠাৎ
চেয়ার, টেবিলে, বুক-শেল্ফ দাঁত খিঁচিয়ে
আমার দিকে এগিয়ে
আসতে থাকে। বারান্দার রেলিং
ভীষণ ভেংচি কাটে আর চার দেয়াল
নোংরা বমি উগরে দেয় ঘন ঘন।
গা গুলিয়ে আসে আমার।
তৎক্ষণাৎ ঘর ছেড়ে চলে যাবো অন্য কোথাও,
তার জো নেই, পা দুটো যেন কেউ বেজায়
শক্ত করে আটকে দিয়েছে মেঝেতে।
নিরুপায় আমি নিজেকেই খুব ধিক্কার
দিতে থাকি। আমি কি অভিশপ্ত কেউ? নইলে এমন বেহাল
কেন আমার? কত আর নিজের চুল ছিঁড়বো এভাবে?
আচমকা দেখি, সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, উঠছি, উঠছি,
কিন্তু কোথায়? জানা নেই। এখুনি
পা ফসকে নিচে ধুলো আর বিকট কাঁটাময় বিরান অঞ্চলে
অচেতন পড়ে থাকবো কি ক্ষতবিক্ষত শরীরে?
এই তো নিজেকে দেখতে পাচ্ছি পুষ্পময় বাগানে
তিনজন রূপসীর সঙ্গে আলাপরত। আমার
দিকে ওরা ছুড়ে দিচ্ছে অজস্র রক্তগোলাপ। তৎক্ষণাৎ নিজেকে
প্রশ্ন করি- এ কি বাস্তব না কি ছলনাময় মায়াবীর চমক?
হঠাৎ এক লহমায় গলা-ডোবনো কুৎসিত কাদা আমাকে
গ্রাস করছে অট্রহাসিতে মশগুল হয়ে, আমি ডুবছি, ডুবছি, ডুবছি।
দুঃস্বপ্নের জাল থেকে ছিটকে পড়ি সুশান্ত
জমিনে। দেখি, আমার দিকে প্রসারিত দুয়ালু
এক হাত আশ্বাসে ঝলসিত। নিজের
হাত রাখি সে-হাতে। চৌদিকে সঙ্গীত ধ্বনিত
হতে থাকে। প্রসারিত তিরস্করণী হাতে শুশ্রূষায় এখন
আমি সুস্থতায় প্রফুল্ল, সমুদ্র পাড়ি দিতে প্রস্তুত।
১৯-১০-২০০৩
ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে
ভীষণ ঘুরছে মাথা, হাত-পা টলছে, যেন ঢেউয়ে
নৌকা, তবু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, উদ্যম হারালে
চলবে না। আমাদের চোখের সামনে চাঁদটিকে
গিলে খাচ্ছে দূরন্ত খবিশ, শহরের
সবগুলো বাগিচার নানাবিধ ফুল
কীটের সন্ত্রাসে নিমেষেই ঝরে পড়ছে লোলুপ মৃত্তিকায়।
যে-ভাবে কাঁপছে জমি, মনে হয়, নিমেষেই দরদালানের,
কাতার পড়বে ধ্বসে তাসের ধরনে। চেয়ে দ্যাখো,
কেমন নড়ছে সব-গাছগাছড়া এবং খসে
পড়ছে পাখির নীড়। অথচ অদূরে মেতে আছে বেপরোয়া
ক’জন জুয়াড়ি তিন তাসের খেলায়। কালবেলা
কী দ্রুত আসছে ধেয়ে বারবার, তবুও টনক নড়ছে না।
অতিদূর কোথাও কে যেন অতিশয়
নিবিড় করুণ সুর তুলছে বাঁশিতে, সেই সুরে
ভবিষ্যৎ কালের ধ্বংসের পূর্বাভাস সদ্য-বিধবার কান্না
হয়ে ঝরে যাচ্ছে অবিরত। পদতলে বারবার
মাটি কম্পমান আর কোন্ দিক থেকে যেন ঘন
ঘন ভেঙে-পড়া ফ্ল্যাটদের আর্তনাদ ভেসে আসে।
বিপদের কালো মেঘে ছেয়ে যাবে আমাদের সুনীল আকাশ-
কোনও কোনও জ্ঞানী বলেছিলেন আগেই,-
প্রাসাদ, কুটির সবই ভুগর্ভে বিলীন হবে, যদি না মানব
আগেভাগে সুন্দর, কল্যাণ-প্রদর্শিত পথে হেঁটে
মহত্ত্বের সাধনায় মনেপ্রাণে সদা
ব্রতী হয়। হিংসা, দ্বেষ ঘৃণা সৃষ্টি নয় ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে।
পাগলের প্রলাপ এসব, বলে হো-হো হেসে ওঠে
জুয়াড়ির ঝাঁক আর মদিরার স্রোতে ভেসে কোমর দুলিয়ে
রাম্ভা সাম্ভা নেচে নিজেদের সমাজ সংসার মিছে সব ভেবে,
আপদ বিপদ ভুলে বস্তুত আপনকার পকেট হাতড়ে
শূন্যতাকে পেয়ে দিব্যি ঢলে পড়ে ইয়ারের কাঁধে আর হিন্দি
ফিল্মের চটুল সুর টেনে আনে জিভের ডগায়।
ওদিকে ক্ষুধার্ত জমি খাদ্য চাই বলে ভয়ানক গর্জে ওঠে
চৌদিকে, পাখিরা নীড় ছেড়ে অতিদূর আসমানে উড়ে যায়।
১০-০৯-০২
নক্ষত্রের মানব কলোনি
পা হড়কে পড়তে পড়তে কোনওমতে নিজেকে
সামলে নিই এই গা-ছমছমে অমাবস্যা-রাতে। মনে
হলো, কে যেন পিছন থেকে
আচনকা ধাক্কা দিলো, অথচ
পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না। সারা
শরীরে ছমছমে অনুভূতি; এ কোথায় চলেছি?
ইচ্ছে হলো, গলা ছেড়ে কাউকে ডাকি, ভীতি
এবং উৎকণ্ঠা গলায় যেন
মুঠো মুঠো শুষ্ক বালি গুঁজে দিলো। এক হাত
দূর থেকে অতিশয় কর্কশ কোনও কণ্ঠস্বর আমাকে
বেয়াড়া চড় বসিয়ে দেয়, ‘কে রে তুই আমাদের এলাকায়
বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছিস? এখুনি দূর হ।
মাছি-মারা কেরানির মতো খুব ভড়কে গিয়ে
লেজ গুটিয়ে তক্ষুনি দিক পরিবর্তন করি। হাঁটতে হাঁটতে
মাথার ঘাম পায়ে লুটিয়ে পৌঁছে যাই
এক হ্রদের কিনারে। নজর কাড়ে হ্রদেরর জলে পা ডুবিয়ে
বসে-থাকা, সব ভুলিয়ে-দেয়া হৃদয় হরণকারী
এক রূপসী, যার সত্তায় অপ্রতিরোধ্য আহ্বান।
আমার বয়সের ধূসরিমা বিস্মৃত হয়ে এগিয়ে যাই
ওর দিকে সম্মোহিত পথিকের ধরনে। আচমকা
বিকট এক আওয়াজ ওকে মুছে ফেলে সেই
দৃশ্য থেকে, যেমন রাগী চিত্রকর ক্যানভাস থেকে নিশ্চিহ্ন
করে তার সৃষ্টি। আশাহত, বিব্রত আমি
হাহাকার হ’য়ে ঘুরতে থাকি সরোবরের চারদিকে। নিমেষে
এক ধরনের উন্মত্ততা আমাকে
দখল ক’রে নেয়। আমি খোরাক হবো হিংস্র বিরানার?
অকস্মাৎ মধ্যরাতে দূর থেকে ভেসে-আসা
বস্তি উজাড়ের বুক-কাঁপানো আর্তনাদ আমাকে
ছিনিয়ে আনে ছেঁড়াখোঁড়া ঘুম থেকে। কেমন
অবাস্তব মনে হয় ঘরের চেয়ার, টেবিল, বুক শেল্ফ, দেয়ালে
সাজানো রবীন্দ্রনাথের ছবি; নিজের অস্তিত্ব প্রতিভাত
পদচারী ছায়ারূপে। হ্রস্ব এক মোমবাতি টেবিলে
গলে গলে পড়ছে। নানা ধরনের ছায়ার কণ্ঠে করুণ কোরাস।
কখনও কখনও ইচ্ছে হয়, ঘরপোড়া দুঃখীদের
বসবাসের জন্যে আকাশ থেকে
ছিঁড়ে আনি অগণিত জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, একটি
বাড়ি নির্মাণ করি নক্ষত্রমালা দিয়ে, নাম রাখি ‘মানব কলোনি’।
যদি ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে আনি আকাশের পুষ্পরাজি,
আসমান করবে না প্রতিবাদ, সুনিশ্চিত জানি।
২২-০১-২০০৩
নিজেকে নিয়ে পঙ্ক্তিমালা
আমি তো অনেক আগে একটি মাটির ঘরে ভোরে
প্রথম মেলেছিলাম চোখ মিটিমিটি,
অথচ কাঁদিনি একরত্তি গুরুজনদের শত
চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে। পরবর্তীকালে দুটি
চোখ থেকে ঢের পানি ঝরবে বলেই সম্ভবত
সে আঁতুড়ঘর ছিল বড় সুনসান।
যদিও পুরোনো এক গলির ভেতরে জন্ম আমার, ক্রমশ
সময়ের দ্রুত পদধ্বনি
আমাকে এগিয়ে নিয়ে পৌঁছে
দিয়েছে সম্মুখে, বেছে নিয়েছি সঠিক ডেরা আর
গেয়েছি দরাজ কণ্ঠে গান কত না আসরে। চোখে
ছিল স্বপ্ন ভাবীকাল এবং সফল জীবনের,
যে জীবন সৌন্দর্য এবং
শান্তির আভায় সুশোভিত।
যখন জীবন ছিল যৌবনের সতেজ আলোয় ঝলসিত
প্রগতির নিশানে শোভিত আর মিছিলের দীপ্র
আহ্বানে অধীর, একদিন নাদিরার অপরূপ
ভাষণ আমাকে রাজপথে বাহুদ্বয়
উঁচিয়ে স্লোগান দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে বারবার। আজও সেই
স্মৃতিটুকু জ্বলজ্বলে দুপুরে দূরকে নিকট করে বড়।
এখনো তো বাংলার চোখ থেকে অনিবার জল
ঝরে দিনরাত, বুক তার বর্বরের
দংশনে রক্তাক্ত অতিশয়। নতুন নাদেরা কোনো
নিয়েছে পতাকা হাতে প্রবল কাঁপাচ্ছে রাজপথ,
পুলিশের লাঠির প্রহারে তপ্ত পিচঢালা পথে
পড়ছে লুটিয়ে, ফের মাথা তুলে উঠছে দাঁড়িয়ে
অপরূপ মিনারের মতো। মিছিলে শরিক হতে
প্রৌঢ়ত্বেও কুণ্ঠাহীন এই আমি দেশ ও দশের কল্যাণের প্রয়োজনে।
আমার শরীর আজ নিরন্তর কালের প্রহারে
খুব ক্ষত-বিক্ষত, অথচ মন যুবার মতোই
সতেজ, নতুন বাগানের শোভা বাড়ানোর স্পৃহা
সর্বদা জাগ্রত-সব বাধা বিপত্তি উজিয়ে
যেতে চাই দূরে, বহুদূরে প্রগতির
পতাকা-শোভিত এক শান্তিময় জগতের দিকে-বুঝি তাই
কখনো নক্ষত্র-দীপ্ত আকাশে, কখনো মাটিতেই বেশি থাকি।
২১-১০-২০০৩
নিজের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করি
এই যে নিজের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করি, বড় বদরাগী
দুপুরের সঙ্গে চোখ রাঙাই খামোকা
বারবার, তবুও দুপুর কমায় না তাপ তার। আমি শেষে
হাল ছেড়ে বিকেলের প্রতীক্ষায় থাকি। আসবে কি আর কেউ?
বিকেল কি সত্তার সুঘ্রাণে তার বাগানের রূপ পেয়ে
দুজনের মিলনের কুঞ্জ হয়ে উঠবে চকিতে? অকস্মাৎ
একটি উন্মত্ত পশু আমাকে থাবায় বিদ্ধ করে
নীরেট আঁধারে ঘষটাতে ঘষটাতে ছিঁড়ে খাবে অবশেষে।
‘আমাকে বাঁচাও’ বলে চেঁচালেও কিছুতেই
আসবে না কেউ পশুটিকে তাড়িয়ে আমাকে দ্রুত
বাঁচাতে পাশব স্বৈরাচার থেকে আর
নির্ঘাৎ পতন থেকে। কতিপয় অমানুষ নিয়ে যাবে ক্রমে
বিদ্ধ করে আমাকেই, রক্ত অবিরত ঝরে, যেন জীবনের
আলো নিভে যায় শেষে। কৌতূহলী কিছু চোখ সে-দৃশ্য দেখবে।
কে আমি, যে হাঁটে পথে একা একা আর আচমকা
চেয়ে দ্যাখে গাছপালাহারা এবড়ো-খেবড়ো এক
জমিনে দাঁড়িয়ে আছে জনহীনতায়? এক ঝাঁক জাঁহাবাজ
ক্ষ্যাপা পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ভয়ার্ত সত্তায়।
মাঝে মাঝে যখন একলা বসে থাকি নিজ ঘরে,
প্রশ্ন জাগে, এই যে এখনও বেঁচে আছি এ শহরে
এই মাটি, এই গাছ-পালা, নদী-নালা,
এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে নিত্য দ্বিপ্রহর অমাবস্যা-রাত
মনে হয় সর্বদা যেখানে, যে-দেশের জন্য আত্মদান
করেছেন শহীদেরা।
০১-০১-২০০৩
নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন
ইদানীং এদিক সেদিক দৃষ্টি মেলে মনে হয়,
জীবনের গোধূলিবেলায় দৃশ্যাবলি
কী রকম যেন
ওলটপালট, বিদঘুটে মনে হয়। আশেপাশে গাছপালা
বেশি নেই। দু’চারটি চোখে পড়ে বটে, কিন্তু ওরা,
মনে হয়, কী ভিষণ ক্ষেপে আছে, যেন বা এখুনি
দাঁত, নখ খিঁচিয়ে আসবে তেড়ে। মানুষের অবহেলা,
উৎপীড়ন, সীমাহীন অত্যাচার সহ্যাতীত ঠেকছে এখন
বৃক্ষ-সমাজের। বৃক্ষহীনতায় মনুষ্যসমাজ লুপ্ত হবে-
এই সত্য বিস্মৃতির ধোঁয়াশায় দ্রুত ঠেলে দিয়েছে মানুষ।
যদি বলি, বহুদিন থেকে হারাম রাতের ঘুম
আমার, দিনেও নিদ্রাহীন রক্তচক্ষু নিয়ে থাকি
বহুমুখী সমস্যার খোঁচা খেতে খেতে,
তা’হলে হবে না সত্যকথনের এতটুক অপলাপ। চোখ
জ্বালা করে সারাক্ষণ, কী এক বেজায় হিংস্র পাখি
ক্রমাগত ঠোকরাতে থাকে
বিভিন্ন প্রহরে; মগজের, হৃৎপিণ্ডের
রক্তক্ষরণের চাপে ম্রিয়মাণ হতে থাকি।
দর্পণে দেখি না মুখ ইদানীং, পাছে কোনওদিন
নিজেরই চেহারা দেখে ভয়ের খপ্পরে
পড়ে যাই। প্রতিদিন নিজের সঙ্গেই লুকোচুরি
খেলি বাস্তবের মুখ-ভেঙচি এড়ানোর প্রত্যাশায়
স্মৃতি আজকাল বড় বেশি প্রতারণা করে, ধু-ধু
মরুভূমি রূপে এই আজকের আমাকে নিয়ত
নিয়ে যায় শূন্যতায়। ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি শুধু
এদিক সেদিক, কোথায় যে
আছি, নিজ আস্তানায় না কি কখনও না-দেখা অন্য
কোনও স্থানে, বুঝতে পারি না। এক ঝাঁক কালো পাখি
মাথার উপরে বহুক্ষণ ঘুরপাক খেতে খেতে
অতি দ্রুত কখন যে কোথায় হঠাৎ
নিমেষে মিলিয়ে যায়, বুঝতে না পেরে
ধন্দে পড়ে যাই; হায়, কেমন অচেনা লাগে নিজেকে তখন।
মাঝে মাঝে এমন বিহ্বল হয়ে পড়ি,
বিছানায় গড়াগড়ি কিংবা টেবিলের পাশে চেয়ারের কোলে
বসে থাকা বড়ই অসহ্য বোধ হয়। আচানক
উঠে পড়ি, পায়চারি করি কিছুক্ষণ, ভাবনার
এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। শেল্ফে সাজানো
বইগুলো আমার ব্যর্থতা পাঠ করতে করতে এ রকম
মূক হয়ে থাকে, যেন শব্দের ভাণ্ডার
সব লুট হয়ে গেছে সুচতুর তস্করের গায়েবি কৌশলে।
বহুরূপী বঞ্চনার ঘূর্ণিবাতে পড়েও যে টিকে
আছি, মাঝে মাঝে অকস্মাৎ
সুরের ঝলক এসে আমাকে করায় স্নান আর কোনও
কবিতার পঙ্ক্তিমালা পৌঁছে দেয় কোনও অলৌকিক
ঠিকানায়, তখন ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা
জানাই নীরবে, চেয়ে থাকি বেধড়ক
কাটা-পড়া বৃক্ষ-সমাজের দিকে। আমার জানালা
দিয়ে ক্ষয় রোগীর মতোই চাঁদ প্রবেশের পথ
কিছুতে পায় না খুঁজে। আমি নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন রাত
কাটাই নিজের ছোট ঘরে খুব পায়চারি করে।
২৫-৩-২০০৩
পরনে সফেদ শাড়ি, মুখে চন্দ্রাভা
সাত বছর ধরে মা আমার দুনিয়াদারির
ঝুটঝামেলায় অনুপস্থিত। মাথা খুঁড়ে
মরলেও তাঁকে আর একটিবারও
দেখতে পাবো না। বড়ই অনুপস্থিত তিনি।
মাঝে মাঝে তার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
ইচ্ছে থাকলেও কখনো কখনো
বড় বেশি দেরি হয়ে যায় জিয়ারত করার
দিন। ধিক্কার দিই নিজেকে গাফেলতির দরুন।
লেখার টেবিলে কলম নিয়ে বসলেই হঠাৎ
মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। এই তো
তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার পাশে,মাথা বুলিয়ে
দিচ্ছেন, তাঁর দোয়ার ঝরনা ঝরছে সন্তানের মাথায়।
এই তো কোনার ঘরে জায়নামাজে
দাঁড়িয়ে, বসে তিনি নিজেকে সমর্পণ ক করতেন
খোদার দরবারে। আজো সেই দৃশ্য
সুস্পষ্ট ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে, বড় সাধ হয়
চুম্বন করি অপরূপ দৃশ্যটিকে। মনে হয়, অদূরে
নক্ষত্ররাজির গোলাকার অপার্থিব আলোয়
মা আমার দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চুপ,
নিবেদিতা, আলোকিত সত্তা। নুয়ে আসে আমার মাথা।
গোরস্তানে গেলেই কী এক নিস্তব্ধতা দখল
করে নেয় আমাকে। একদিন বিকেলে
মায়ের কবরের পাশে বসেছিলাম, হঠাৎ স্তব্ধতা
চিরে জেগে উঠলো কোকিলের ডাক। থেমে থেমে করুণ
সেই ডাক থেকে যেন ঝরছিলো কবোষ্ণ
রক্তের ফোঁটা। আহত কোকিলের সুন্দর
আর্তনাদ গোরস্তানকে অধিকতর নিঝুম
করে তুললো, সেই আর্তস্বরে আমি
আমার মাতৃবিচ্ছেদের বেদনা
কিছুদিন পর যেন নতুন করে অনুভব করলাম।
গোধূলি প্রগাঢ় হ’লে পর আমার পাশে কারো
উপস্থিতি অনুভব করলাম। যেন কেউ আমার
কাঁধে তার কোমল হাত স্থাপন
করলো, বড় চেনা মনে হলো সেই নির্জন
স্পর্শ; ঘুরে তাকাতেই দেখি মা আমার দাঁড়িয়ে
আছেন, পরনে তার সফেদ শাড়ি, মুখে চন্দ্রাভা। কে জানে
এই উপস্থিতি সত্যি নাকি আমার
প্রবল ইচ্ছা-প্রসূত দৃশ্যেরই অপরূপ বিভ্রম?
১-১১-২০০৩
পাথর-শাসানো পথ হেঁটে
তবে কি এখনো এত কাঁটাময়, পাথর-শাসানো
পথ হেঁটে আসার পরেও
আমাকে এমন চোখ-রাঙানি এবং রকমারি
শাস্তি ভোগ ক’রে যেতে হবে ক্রমাগত?
একদা আমার ঠোঁটে সহজে আসতো
নেমে নানা সুগন্ধি ফুলের ওষ্ঠ আর
কোকিল উঠতো ডেকে সকল ঋতুতে
আমার অনেক কাছে, এখন নীরব ওরা বহুকাল থেকে!
এখন আমার ঠোঁট বড়ই বিশুষ্ক, ফেটে গেছে
খরার তাণ্ডবে আর পা দুটো ক্ষতের দংশনে
বস্তুত অচল প্রায়। তবুও আমাকে
কাঁটাময়, পাথর-শাসানো পথ আর কত পাড়ি
দিতে হবে, জানা নেই। আমি তো ভীষণ
ক্লান্ত আজ, কত সঙ্গী ইতিমধ্যে হন্তারক ছোবলে নিশ্চিহ্ন!
আমি আর কতকাল রক্ত ঝরাতে ঝরাতে, খুব
খোঁড়াতে খোঁড়াতে এই বহুরূপী শক্রর মিছিল
দেখে যাবো? আর কতবার এই তুমুল আসরে
তুখোড় কপট সখাদের থিয়েটারি রঙবাজি দেখে যাবো?
হঠাৎ দুপুরবেলা অদূরে একটি হ্রদ চোখে
পড়ে যায়। হ্রদের কিনারে
পৌঁছে জলে নিজের মুখের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে উঠি। এ কোন্ অচেনা লোক যাকে
কখনো দেখিনি আগে? আমি কি আমার
গতায়ু সত্তাকে এই জলাশয়ে দেখছি? আমি কি মৃত তবে?
হ্রদের শীতল জলে মুখ ধুয়ে গাছের ছায়ায়
শান্তির আস্বাদ কিছু পেতে চাই। জানি
এ প্রয়াস বস্তুত ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কোনো কিছু
হতেই পারে না। সূর্য তাপ অনেকটা কমানোর
পরে ফের পথ ধরি, পঙ্গুর ধরনে হেঁটে হেঁটে
এগোই অজানা গন্তব্যের দিকে, পরিণাম যা হোক তা হোক।
৪-৮-২০০৩
বলো কোন আস্তানায় যাবো?
আমার আপনকার কণ্ঠস্বর কখনও সখনও
বড়ই অচেনা লাগে নিজেরই নিকট,
যখন দেয়ালে কিংবা আকাশের দিকে
তাকিয়ে কীসব এলেবেলে কথা বলি
বুঝিবা নিজেরই সঙ্গে। সে-সব অদ্ভুত কথা নিজেও বুঝি না
কখনও সখনও, যেন অন্য কেউ বলে যায় আমার মাধ্যমে।
এই ঢাকা, প্রিয়তম শহর আমার, একে মন
দিয়েছি বিলিয়ে অকৃপণ
দাতার ধরনে, এ শহর কত না মধুর স্মৃতি
এঁকেছে প্রাণের পটে, কেউ কি রেখেছে
হিসেব কখনও তার? কত না ঘুরেছে দিনরাত
উদ্ভ্রান্ত তরুণ কবি অলিতে গলিতে, রাজপথে! তার কাছে
বাগানের ফুল, গাছপালা, মনে হতো,
হয়েছে মাতাল যেন নিজেদেরই ঘ্রাণে।
বার্ধক্যের জীর্ণ ঘাটে পৌঁছে কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
ভাবে, প্রশ্ন করে নিজেকেই-জীবন কি মরীচিকা শেষ তক?
থাকা না-থাকার ধাঁধা কোনও? এই যে টেবিলে ঝুঁকে
এত কালো শব্দের ভরা হলো সাদা পাতা
দিবানিদ্রা ত্যাগ করে, রাত জেগে বছরের পর
বছর কাটিয়ে, বলো আখেরে কী তার পরিণতি?
অনন্যা রূপসী এক নিঠুরাই মায়াবী সঙ্কেতে প্রায়শই
ডেকে নিয়ে যায় অনুপম
হ্রদের কিনারে, প্ররোচিত করে নেমে এসে তীরে
সাঁতার কাটার জন্যে। সেই
আমন্ত্রণ পারি না উপেক্ষা
করতে বস্তুত কিছুতেই। পুলকিত নেমে পড়ি তড়িঘড়ি।
একি! তাকে স্পর্শ আর চুম্বন করার
মুহূর্তেই, হায়, ডুবে যেতে থাকি হ্রদের পাতালে,
পারি না নিশ্বাস নিতে, কখন যে কার করুণায়
নিজেকে দেখতে পাই এক বটগাছের তলায়। চোখে পড়ে,
লাল আলখাল্লা পরা সেবারত একজন সস্নেহে তাকিয়ে
আছেন আমার দিকে। কিছু না বলেই মৃদু হেসে
কে জানে কোথায় শান্ত পায়ে
মিলিয়ে গেলেন যেন অদূর দিগন্তে। সূর্য ডোবে
প্রথামতো, বলো কোন আস্তানায় যাবো?
২৮-১১-২০০৩
বৃষ্টি ধারায় দৃষ্টি মেলে
এখন আমি
কাজলা দিনে ছোটো ঘরে
ব’সে দূরে বৃষ্টি ধারায় দৃষ্টি মেলে
বসে আছি।
পাশে আমার চোখ-জুড়ানো
মন-মাতানো
এক তরুণী
হাঁটুতে মুখ রেখে ধূসর
মেঘের বুকে ডুব দিয়েছে। এখন তাকে
খুঁজলে আমি পাবো না ঠিক,
যদিও সে ঘরেই আছে।
বৃষ্টি আমায় বদলে দিয়ে
কোন্ সে সুদূর ধূসর ঘাটে
বসায় ব’লে আমার প্রাণে
লাগছে দোলা ভিন্ন তালে।
এখন আমি নইকো কোনো
পদ্য লেখক, সামান্য এক
বৃষ্টিভেজা খুব একেলা
ছন্নছাড়া জলেভেজা পথিক কোনো।
ঘুরে বেড়াই দিনদুপুরে, রাতদুপুরে
যেমন ইচ্ছে ডানে বামে।
আপন মনে যখন তখন
বুকের কাছে ঝুলাছে এই
এক তারাতে ফোটাই কিছু
অচিন পদ্ম! ফুলের ঘ্রাণে হৃদয় মাতে।
১৬-৬-২০০৩
ভাসমান মেঘে যাচ্ছি
ভাসমান মেঘে যাচ্ছি জানি না কোথায়। আচমকা
টুপ করে যদি পড়ে যাই কোনো পাহাড়ে অথবা
বিয়াবান বনে, তবে নির্ঘাৎ পশুর খাদ্য হয়ে
যাবো, জানবে না কেউ। আপাতত মেঘে চেপে দূরে,
বহুদূরে অনেক উঁচুতে যাত্রী আমি। কী সুন্দর
বসেছে তারার মেলা। এখানে তো মহানন্দে বাস করা যায়।
অথচ আমাকে কেউ ‘স্বাগতম’ বলে কাছে ডেকে
নিচ্ছে না, সবাই এক নিঃশব্দ হেলায়
দলে দলে যাচ্ছে হেঁটে অথবা বসছে অপরূপ
পুষ্পকুঞ্জে, আলাপে উঠছে মেতে। কারা ওরা? অবয়ব যেন
মানুষেরই মতো, তবু নয় তো মানব। খাপছাড়া,
অনাহূত যেন আমি। কী করি? কী করি?
বাতাসকে বলি নিচু কণ্ঠস্বরে, ‘আমাকে উড়িয়ে
নিয়ে যাও অন্য কোনোখানে। আমি আর
পারি না সইতে এই হিম নীরবতা, এ নিষ্ঠুর
অবহেলা। দয়ালু বাতাস
আমাকে নক্ষত্র-মেলা থেকে নিয়ে যায় সবুজ উপত্যকায়
এক লহমায় আর ঘাসের সুঘ্রাণে যেন দারুণ মাতাল হয়ে যাই।
নেশা কেটে গেলে জনহীন, ঘাসময় উপত্যকা
বড় একঘেয়ে, অতিশয়
বেগানা, নির্দয় মনে হয়। কিছুকাল এখানে কাটালে জানি
নির্ঘাত উন্মাদ হয়ে যাবো। যদি আনন্দের সুরে
প্রায়শ স্পন্দিত হতে চাই, চাই নিত্য মানবের কলরবে
প্রেরণার ছন্দ পেতে, তবে এখানেই ডেরা বেঁধে নিতে হবে।
২-১০-২০০৩
যখন আমি একলা থাকি
যখন আমি
একলা থাকি আমার ঘরে
কিংবা বাইরে পথে ঘাটে,
ভিড়ের মাঝে হারিয়ে কি যাই?
কে আমাকে সন্ধ্যেবেলা
অনেক দূরে নেয়ার জন্যে ফন্দি আঁটে?
হঠাৎ তাকে হারাই ভিড়ে!
পথের দিশা যায় মুছে যায়,
কে আমাকে পথ দেখাবে?
যাবো আমি অনেক দূরে, একলা যাবো।
যাবোই দূরে, অনেক দূরে;
না গেলে কি মিলবে রেহাই?
কে তুমি এই পথে আমার
বাধ সেধেছো, নিচ্ছ টেনে
ঘোর আঁধারে?
আমি কি কাল এখানে এই
বিকেল বেলা গাছতলাতে ছিলাম একা
কেমন যেন খাপছাড়া এক লোকের মতো
ছিলাম মিশে সবুজ ঘাসে?
তিনটি ফড়িং আমার মুখে বসেছিল
আয়েশ করে? কাল কি এমন হয়েছিল?
এ যে কেমন ধন্দে পড়ে
খাচ্ছি খাবি বিপথে এই খানাখন্দে।
কেউ কি আমায়
ঘরে ফেরার পথ দেখাবে?
কেউ কি হঠাৎ জ্বালবে বাতি,
যার আলোকে ফুটবে হঠাৎ
দৃষ্টিপথে পদ্ম-গাঁথা দিঘল সাঁকো-
পারবো যেতে কাঙ্ক্ষিত সেই ঠিকানাতে?
কখনো কি ইচ্ছে হলেই
মনের মতো ঠিকানা, হায়,
দেয় কি ধরা দৃষ্টিপথে?
ইচ্ছে হলেই সবার পায়ে
খায় কি চুমো স্বপ্নে-দেখা রক্ত গোলাপ?
কার হাতে কোন্ স্বর্ণ-পাখি হঠাৎ বসে?
২৩.৬.২০০৩
যাচ্ছিলাম তো ঠিকানাবিহীন
কেন এই দৃশ্য ভেবে ওঠে বারবার
সুস্পষ্ট আমার চোখে? মুছে
ফেলতে যতই চেষ্টা করি, ব্যর্থ হই তত আর
হৃৎপিণ্ড-কাঁপানো নানা দৃশ্য দাঁত-নখ
ভীষণ খিঁচিয়ে
আমাকে দখল করে। আমার চোখের
সামনেই গুঁড়িয়ে যায় সব ঘর-বাড়ি
এক লহমায় আর বেবাক বিপন্ন নর-নারী
মাতম করার ক্ষণটুকু না পেতেই ডুবে যায়
ক্ষুধিত মাটির নিচে। কারা পরিচিত
খুব, কারাই-বা
বেগানা সে-কথা ভেবে দেখিনি তখন।
বারবার হানা দিচ্ছে যে ভীষণ দৃশ্য তা-কি
সত্যি না-কি কোনো
দুঃস্বপ্ন আমাকে খুব বিপন্ন করার মতলবে নিয়মিত
ছুড়ে দিচ্ছে রক্ত-হিম-করা দৃশ্যাবলি
আমার দু’চোখে। ক্ষয়ে যেতে থাকি এই বিরানায়, কয়েকটি
কালো ঘোড়া ধেয়ে আসে হিংস্রতায় আমার গণ্ডিতে।
আসমানে দৃষ্টি পড়তেই দেখি কে যেন ভরাট
পূর্ণিমার চাঁদকে ভীষণ
দ্রুত চেটে অনেকটা খেয়ে ফেলেছে এবং রক্তের শিশির ঝরঝরে নদী হয়ে
বইছে দিগন্তে। হতবাক আমি বেশ কিছুক্ষণ
চোখ মুদে থাকি আর মুদিত চোখেও বিভীষিকা
খেলা করে অবিরাম। মাথার ভিতর
কারা যেন অগোচরে ঢুকিয়ে দিয়েছে রাশি রাশি তীক্ষ্ণ কাঁটা।
২
হঠাৎ হোঁচট খেতে খেতে
সামলে নিয়ে এগোই আস্তে খোলা পথে।
দেখার কত কিছুই আছে ডানে বামে,
এখনো তো চলার পথে দৃষ্টি মেলে দেখি বটে
নর-নারী, অবোধ শিশু, দোকানদারি, গাছ-গাছালি।
মনে অনেক ছবি জমে, যায় হারিয়ে তবু কিছু।
৩
ঘুমিয়ে ছিলাম নিজের ঘরের পুরনো খাটের
শয্যায় একা। মশারিটা আজ হয়নি খাটানো,
মশারা দিব্যি নিচ্ছিল শুষে অনেক রক্ত
আমার রুগ্ন শিরা থেকে, আমি পাইনি কো টের
মোটেও তখন। আমি কি ঘুমের সাগরের ঢেউ
উজিয়ে সাঁতার কেটে অজানার টানে বহুদূরে
অচিন দেশের উদ্দেশে ভেসে যাচ্ছিলাম তো ঠিকানাবিহীন।
জলের ঝাপটা লাগছিল চোখে, আখেরে ছুঁলাম অপরূপ তীর।
অভীষ্ট তীরে পৌঁছুনো জানি সহজ তো নয়। বড়ই অচেনা,
জমি হিংসুক, গাছপালা সব তেড়ে আসতেই ইচ্ছুক খুব
অষ্টপ্রহর। পশুগুলো সবই বিকট, হিংস্র। তাহলে কোথায়
আশ্রয় নেব এমন প্রহরে অতিশয় এই ক্লান্ত শরীরে?
হঠাৎ ভীষণ ঝোড়ো হাওয়া এসে আমাকে উড়িয়ে
নিয়ে যায় দূরে, বহু দূরে যেন পাখি হয়ে আমি উড়ছি আকাশে।
৪
বেজায় নোংরা আবর্জনার স্তূপ থেকে
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। একরাশ ধুলো,
নানা এলেবেলে জিনিসের টুকরো টাকরা শরীরে
লেগেছিল আঠার মতো। অনেক
জোরে গা ঝাড়া দিয়েও পুরোপুরি আবর্জনামুক্ত
হতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। খানিক এগুতেই হঠাৎ
অস্ত্রসজ্জিত কজন বদমেজাজি জবরদস্ত লোক
আমাকে গ্রেপ্তার করল। কী আমার অপরাধ কিছুতে
জানতেই পারলাম না। ওদের
সুরত দেখেই পিলে চমকে উঠেছিলো আমার।
সমুদ্রের কিনার ঘেঁসে ওরা আমাকে
হাত-বাঁধা হালতে নিয়ে যাচ্ছিলো। কী-ই বা আমার
কসুর জানাবার প্রয়োজনই বোধ করেনি। সমুদ্রের ধোঁয়াটে
কিনারে আমাকে দাঁড় করিয়ে
কোনো কিছু না বলেই তিনজন বিদঘুটে, নিষ্ঠুর
আজব জীব স্টেনগান আমার দিকে তাক করে বুলেট
ছুড়তে ছুড়তে নোংরা দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল। আমি নিষ্প্রাণ
লুটিয়ে পড়েছিলাম নাকি গুলিবিদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনো?
২৯-১০-২০০৩
যেন খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও
যেন খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসমানে পূর্ণিমা-চাঁদটি দেখা
দিয়েছে, বিলোচ্ছে জ্যোৎস্না আমাদের আপন শহরে, পরক্ষণে
মনে হয়, ওর মুখ জুড়ে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। বুকে তার
ছোরা বিঁধে আছে, বুলেটের সন্ত্রাসের চিহ্নগুলো
ছড়ানো ছিটোনো ইতস্তত। বেজায় ঝরছে রক্ত,
আক্রান্ত চাঁদের বোবা আর্তনাদে কম্পমান চৌদিক এখন।
চাঁদের এমন হাল দেখে আমার শহর আজ
আহ্লাদে হবে কি আটখানা? আমরা কি ধেই ধেই
করে নেচে বেড়াব সবাই ঘরে আর খোলা পথে
অগ্নিঝরা মাছ মাংস আর সব্জির বাজারে?
সম্প্রতি শংকার ছায়া ঘিরে ধরেছে আমার শহরকে
বড় গাঢ় হয়ে, বুঝি তাই বৈদ্যুতিক
বাতিও পারে না কিছুতেই ঘোচাতে শজারু-তিমিরের এই
হিংস্র দৃষ্টি একই ঘরে বাস করে পারি না দেখতে
কেউ কারও মুখ আর পরস্পর ঠোকাঠুকি হলে
ব্যর্থ হই চিনে নিতে কেউ কারও কণ্ঠস্বর, ভয়ার্ত চেহারা।
এভাবেই কি কাটবে দিনরাত নির্ঘুম আতঙ্কে? প্রায়শই
মিত্রকে শক্রর ছায়া ভেবে কেঁপে উঠি, পড়ি মরি
দূরে সরে যেতে চেয়ে চকিতে পাথুরে
পা দু’টির ভারে এক চুলও নড়তে পারি না আর
দুঃস্বপ্নের কাঁটাময় বিষাক্তি আঁধারে। কাছ থেকে, গিরগিটি,
নেউল, বৃশ্চিক তেড়ে আসে আমাকে ঠুকরে খেতে।
এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় প্রিয়জনদের
নিয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজে বেড়াবার লোভ
মাঝে মাঝে মাথা তোলে। কিন্তু এই জন্মমাটি, এই
চিরচেনা গলি, এই গাছপালা, মাঠ, নদী মানুষের মেলা
ছেড়ে কোন অজানায়, কোন সে চুলোয় যাবো? এই
দম-বন্ধ-করা, স্টেনগান উঁচানো স্থানেই শ্বাস নিতে চাই।
রেস্তোরাঁর ওরা ক’জন
একজন বুড়োসুড়ো ভদ্রলোক হরহামেশা
শহরের হৃৎপিণ্ডে-দাঁড়ানো একটি মাঝারি রেস্তোরাঁয় প্রত্যহ
সন্ধেবেলা এক কোণে ব’সে থাকেন একা। বলেন না
কোনও কথা কারও সঙ্গে, ইশারায় ডাকেন
কালেভদ্রে বেয়ারাকে, বাঁধা ফরমাশ রয়েছে রঙ চা-এর
কখনও সখনও দু’তিনটি টোস্টের।
অদূরে অন্য এক টেবিলে ক’জন যুবক যখন
হৈ-হুল্লোড় সমেত জোটে, নরক
গুলজার হয় বটে নিমেষেই। অনেকে
বিরক্তির চুলকুনিতে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকেন,
অথচ ভয়ে মুখে কুলুপ আঁটাই থাকে সবার;
হয়তো গা-সওয়া হয়ে গেছে শব্দের দাপট।
রেস্তোরাঁয় ওরা ক’জন যুবক প্রায়শ অশ্লীল আলাপে
নরক গুলজার করে, কোথায়
কোন্ পাড়ায় মাস্তানি করার
অপরাধে গুরুজনদের ঝাঁঝালো বকুনি ঢের শুনতে
হয়েছে। কারও কানপট্রি কিংবা মাথা ফাটানোর দরুন
মায়ের চোখে প্রতিবাদী পানি দেখে মন ঈষৎ খারাপ হয়েছে।
রেস্তোরাঁর এক কোণে নীরব বসে-থাকা প্রবীণ
খুঁটিয়ে দেখেন সেই তুমুল ঝোড়ো যুবাদের;
কখনও সখনও প্রবীণের ঠোঁটে হাসি খেলে যায়,
সেই হাসিতে ফোটে প্রশ্রয়ের শেফালি, যদিও অন্যদের
দেহ-মনে বিরক্তির স্ফুলিঙ্গ
জ্বলতে থাকে নিয়মিত। এমনই সেই রেস্তোরাঁর সংসার!
ফুঁসতে ফুঁসতে হঠাৎ একদিন সারা দেশ তুমুল
আগুন-ঝরানো আন্দোলনে বোমার
ধরনে ফেটে পড়ে। রেস্তোরাঁয় সেই প্রবীণ
আর অন্যেরা আসেন মাঝে মাঝে; কেবল
সেই উচ্ছল, উদ্দাম যুবারা গরহাজির
কিছুদিন থেকে। প্রবীণ ব্যক্তিটি ওদের সন্ধানে ক’দিন
ঘোরাফেরা ক’রে জানতে পারলেন-প্রতিবাদী মিছিলে
যোগ দিয়ে, জনসভায় জালিম সরকার-বিরোধী
সভায় আগুন-ঝরানো বক্তৃতা দিয়ে ওদের দু’জন
পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন, ওদের লাশ জনগণের মাথার ওপর শোভিত হয়েছে, এবং রেস্তোরাঁর
অন্য বন্ধুরা আলোর প্রহর গুনছেন কারাগারের আন্ধারে।
৩১-৩-২০০৩
শকুন, নেউল আর কঙ্কালের সহবতে
এমন আদিম নিস্তব্ধতা আমার অভিজ্ঞতার আওতার
পরপারে; এটা কি শ্মশান নাকি গোরস্তান সুনসান? এই
জ্যোৎস্নাময় মধ্যরাতে আমি কি নিঃসঙ্গ পড়ে আছি
খাপছাড়া বিষণ্ণ ভাগাড়ে? কিয়দ্দূরে
একটি কি দুটি লোভাতুর শবাচারী
শকুনের পদচারণায় ঈষৎ শিউরে উঠি, চোখ দুটি
অজান্তেই বুজে আসে। ক্ষণকাল পরে
গলায় কিসের যেন স্পর্শ অনুভূত হয়। চোখে পড়ে
আমার গলার দিকে এগুচ্ছে ক্রমশ
জীর্ণ শীর্ণ পাঁচটি আঙুল-কোনও মতে ভয়াবহ
আঙুল ক’টিকে দূরে ছুঁড়ে দিই এক ঝটকায়; উঠে
পড়ি স্যাঁৎসেঁতে সেই মাটির বিছানা থেকে। পদযুগ টলে।
শকুনেরা কী এক অদ্ভুত স্বরে হেসে স্তব্ধতাকে
ঠুকরে ঠুকরে মৃত বাছুরের শরীরে দাঁড়িয়ে
পরমুহূর্তেই ধেই ধেই নেচে ওঠে। নৃত্যপর মুখগুলো বাছুরের
নরম, করুণ মাংসে ভরে ওঠে। কোথায় পালাবো
এই, বলা যেতে পারে, ভূতুড়ে জায়গা থেকে, কিছুতে পাই না
ভেবে, শুধু বোবা হয়ে থাকবো এমন এতকাল?
কতকাল শকুন, নেউল আর কঙ্কালের সহবতে কাটাবো জীবন?
কতকাল বাগানের সুঘ্রাণ এবং সুন্দরের সান্নিধ্যের
আভা থেকে থাকবো বঞ্চিত? কতকাল কবিতার
মাধুর্য আমার বোধে সঞ্চারিত হবে না, কে ব’লে দেবে এই
পীড়িত, দলিত লোকটিকে, যাকে আমি
নিজেরই ফতুর সত্তা ব’লে জানি, যার হাহাকার, ধু-ধু দীর্ঘশ্বাস
মাথা কুটে মরছে বুভুক্ষু বিরানায়? আমার এ নিশীথের
প্রহরে নিজেকে বড় বেশি আজগবি মনে হচ্ছে প্রতিক্ষণ।
যদি ফিরে যাই এ মুহূর্তে নিজ চেনা বাসগৃহে, তা’হলে কি
আমার আপনজন এ-আমাকে করবে গ্রহণ
নিজেদের কেউ ব’লে? না কি সন্দেহের অমাবস্যা
তাদের করবে বাধ্য আমাকে নির্ঘাৎ সঁপে দিতে
উৎপীড়কের হাতে। অসহায় দিগ্ধিদিক তাকাবো নির্বোধ
দৃষ্টি মেলে, যেন আমি নির্বাক বৃক্ষের সহোদর!
১২-৩-২০০৩
সত্যি কি গিয়েছিলাম
আচানক ডাগর চাঁদ জ্বরতপ্ত রোগীর মতো
কাঁপতে থাকে, নক্ষত্রমালা ঢাকার মধ্যরাতের ঘুমন্ত
বাড়িগুলোর ছাদে, সকল চৌরাস্তার
মোড়ে, অলিতেগলিতে, ময়দানের বুকে
থুবড়ে পড়ছে। ঘুম-জড়ানো চোখ দুটো জলদি
মুছতে মুছতে বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই চৌদিকে।
কিসের আহ্বান আমাকে ঘর থেকে সরিয়ে
নিয়ে আসে রাস্তায় আর আমি
নিজের অজান্তেই যেন হাঁটতে থাকি ডান-বাম
না ভেবে অজানা দিকে। হু হু বাতাস
আমাকে ঘিরে ধরে চারদিক থেকে। হঠাৎ
বিদঘুটে এক পাখি আমার কাঁধে এসে বসে পড়ে।
পাখিটিকে হটিয়ে দিতে কেন যেন ইচ্ছে হয় না;
হাঁটতে হাঁটতে সম্মুখে চেয়ে দেখি তিনজন কঙ্কাল
কাঁধে কোদাল ঝুলিয়ে হেঁটে যেন যাচ্ছে কোথায়।
ওদের গোরখোদক হিশেবে শনাক্ত করতে খুব
বেশি কষ্ট হয়নি। তিনজন গোরখোদক অর্থাৎ কঙ্কাল
আমাকে উপেক্ষা করেই যেন চলে যাচ্ছে। ওদের
অট্রহাসি এসে আমার কানে প্রবল ধাক্কা দেয়,-
কাঁপতে থাকি, না থেমে প্রায় অন্ধের ধরনে
এগোতে থাকি, প্রচণ্ড শীত যেন
দখল করে নিয়েছে আমার দেহমন।
নিজেকে দেখতে পাই হু হু শূন্যতায়, খানিক
পরে দৃষ্টিপথে আবছা ভেসে ওঠে একটি
চমকে-দেয়া দৃশ্য। ধোঁয়াশা ফুড়ে বেরিয়ে
এসেছে এক কবরের বাসিন্দা। চোখ-জুড়ানো
তরুণী সে; রূপ ঝরছে যেন কবরে
তার শরীর থেকে। তার সত্তা ইঙ্গিতে আমাকে ডাকছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি কী করি কী করি
ভেবে মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি এবং সে চকিতে
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো নাকি প্রবেশ
করলো আবার মৃত্যু-শীতল কবরে, ঠিক
বোঝা গেলো না। আগে কখনো আসিনি এই কবরের কাছে।
সত্যি কি নিকট অতীতে গিয়েছিলাম সেখানে?
১৬-১০-২০০৩
সাগরতুল্য সবার দিকে
বন্ধু, খানিক দাঁড়াও এই
ঝোপের ধারে। পরে না হয় পা চালিয়ে
যাওয়া যাবে অন্যপথে,
যেখান থেকে আখেরে ঠিক পৌঁছে যাবো
অভীষ্ট সেই সাগরতুল্য সভাস্থলে।
এখানে এক মুক্তিযোদ্ধা চিরনিদ্রা
নিয়েছিলেন আলিঙ্গনে যুদ্ধ ক’রে বিদেশী সব শক্রসেনা
এবং নিজের দেশের কিছু ঘৃণ্য লোকের ঘোর বিরুদ্ধে।
বন্ধু, এমন স্থানে খানিক নত মাথায়
না দাঁড়ালে ভুলের বোঝা বইতে হবে।
ঝোপের পাশে অবহেলায় শুয়ে-থাকা
মুক্তিযোদ্ধা এখনো কি এই এলাকার কিছুলোকের
স্মৃতিতে খুব ঝলসিত? না কি সবাই
অবহেলার আঁস্তাকুড়ে কবর দিয়ে আছে সুখে?
বন্ধু এবং আমি নানা ভাবনা বয়ে নিয়ে
যাচ্ছি হেঁটে অভীষ্ট সেই সাগরতুল্য সভার স্থলে।
যাচ্ছি হেঁটে, সূর্য ডোবার আগেই হেঁটে
যেতে হবে সবার মাঝে মুক্ত মনে, যেতেই হবে।
দেরি করা চলবে না আর,
কোথাও আর থামলে এখন চলবে না ভাই,
সূর্য ডোবার আগেই আশা জাগিয়ে রেখে
চলতে হবে, চল বন্ধু, এগোই চল ভবিষ্যতের খোলা পথে।
১৬-১০-২০০৩
সাতটি কবরে নুয়ে চুমো খায়
দু’তিন মাইল জুড়ে সারাদিন শুধু রোদ্দুরের
তাপ আর গাছপালা, ঘাসহীন ধু-ধু
জ্বালাময় হাহাকার। সেখানে ভুলেও
আসে না গায়ক পাখি কোনো, এমন কি
হাড়গিলা, শকুনও কখনো মাড়ায় না এই পথ। জ্যোৎস্নাময়
রাতে শুধু ভিন্ন শোভা সৃষ্টি হয় ধূসর প্রান্তরের।
প্রান্তরের হৃদয়ের কিছু অঃশ জুড়ে বাতাসের
আদরে সাতটি গাছ দোলে। গাছগুলো
সাতটি কবরে নুয়ে চুমো খায়, নিবেদন করে
শ্রদ্ধা প্রতি রাতে জ্যোৎস্না আর মৃদু বাতাসের সাথে।
কাদের কবর এই সাতটি গাছের নিচে? কেন
প্রকৃতির শ্রদ্ধা ঝরে এ রকম বিয়াবানে? কারা
এই নির্জনতা প্রিয় মানব সন্তান? কী এমন
অনন্য সাধক তারা, যার গুণ গাছপালা, হাওয়া,
জ্যোৎস্না জেনে গেছে? কোথায় নিবাস ছিলো
এই সাতজন মানুষের, কী নাম তাদের কে বলবে আজ?
যতই অজানা থাক সাতটি গাছের
নিচের মাটির কবরের বাসিন্দাদের নাম ধাম,
এই সত্য রোদ, জ্যোৎস্না আর মানবের
কীর্তির মতোই যাকে কখনো যাবে না মোছা, কেননা তারাও
মুক্তিযুদ্ধে শক্রকে তাড়িয়ে মাতৃভূমির কাঙ্ক্ষিত
স্বাধীনতা জ্বলজ্বলে রাখার জন্যেই দিয়েছে নিজ প্রাণ।
১-৯-২০০৩
সৃজনের আভা জেগে থাকে
পেলব গজায় পাতা গাছের শাখায় শব্দহীন, ক্রমান্বয়ে
একে একে বাতাসের বুকে ভেসে ভেসে
অবশেষে পেয়ে যায় ঠাঁই মৃত্তিকার
উদার হৃদয়ে। অন্তরালে সময়ের
কাঁটা ঘোরে অবিরাম। কাঁটার দংশনে কত ক্ষত
জন্ম নেয়, তবুও নিবিড় শুশ্রূষায় সৃজনের আভা জেগে থাকে।
কেউ কি পেছনে খুব ঠেলে দিতে চায় কূট চালে?
চায় কি মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে ফেলতে
কোনও ছলে? নানা ঢঙে কালো কিংবা ধূসর মেঘের
ছলনা খেলায় মেতে ওঠে, অথচ সকল বাধা
ছিঁড়ে ফুঁড়ে ঝকঝকে মুদ্রার মতই জেগে উঠে
ডাগর চাঁদের মুখ রটায় সর্বত্র আজ প্রগাঢ় সংবাদ।
সোনালি টেবিল আর রুপালি চেয়ার
(শহীদ প্রহ্লাদচন্দ্র সাহাকে নিবেদিত)
জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে আসমানে একটি সোনালি
টেবিল এবং চার পাঁচটি রুপালি
চেয়ার মেঘের পর মেঘ পেরিয়ে যাচ্ছিলো। সেই
অপরূপ চেয়ারে ক’জন
তরুণ ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিমায় উপবিষ্ট, অতিশয়
মশগুল বাক্যালাপে। ওরা
জ্যোৎস্না-মদিরায় বুঁদ হয়ে কতিপয়
ফরাসি কবির কবিতার পঙ্ক্তিমালা আওড়ায়।
আজকের কথা নয়। ক্যালেন্ডার থেকে ঢের ঢের
তারিখ-চিহ্নিত পাতা খসে গেছে কত যে বছর আর সেই
আসমানে সোনালি টেবিল-ঘেঁষে-বসা
তরুণেরা যৌবনের আভা-হারানো প্রবীণ আজ-
চৌদিকে ছিটকে-পড়া নক্ষত্রের মতো! ভাসমান টেবিলের,
চেয়ারের ঈষদুষ্ণ স্মৃতি কোনোদিন
চকিতে পড়ে কি মনে যৌবন-হারানো
সেই সব উন্মাতাল আড্ডাপ্রেমীদের? এখন তো
চাঁদ ঘুম-ছড়ানো জ্যোৎস্নার আভা মাখে
বয়সের ধুলোময় কর্কশ জমিনে, তুষারের কণা ওড়ে!
সোনালি টেবিল আর রুপালি চেয়ার এতকাল
পরেও আমার কাছে এসে কী মধুর
কণ্ঠস্বরে কত কথা বলে আর শোনায় কবিতা
নানা ছন্দে করে অনুরোধ
খাতার পাতায় যেন নতুন কবিতা লিখি এই
নিদ্রাহীন মধ্যরাতে বলে, ‘আমরা তো
বিউটি বোর্ডিং-এর স্বপ্নময় প্রহরের মায়া
নিয়ে এই তোমার নিবাসে এসে গেছি, কবি, জাগাতে তোমাকে।
৩০.৬.২০০৩