মৃত্যুহীন তালে তালে
ঘরে দুপুর জাজ্বল্যমান হলদে রত্ন, মাথার ওপর
বন্ বন্ ফ্যান
আর আমরা দু’জন সোফায়। তোমার চুল
উডু উডু দুরন্ত হাওয়ায়, চুলের অবাধ্যতা সামলাতে
তুমি লবেজান, চিকন ভুরুতে উড়ন্ত পাখির গান।
তোমার ঠোঁটে হাসি ঝরছে, ঝর্ণার
রোদের ঝলক-লাগা পানি তৃষ্ণাতাড়িত
চিতাবাঘের মতো করছিলাম পান। দিগন্ত চিরে,
পেরিয়ে দ্বীপ দ্বীপান্তর, পর্দার অন্তস্থল ভেদ করে
ভেসে এল আমাদের ভালোবাসার ডাক নাম।
ব্লাউজের ওপার থেকে যুগল ফলের আভা
বিচ্ছুরিত হচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। তোমার কোমরে উচ্চকিত
একটা ভাঁজ, নদীর বাঁক। চোখে অপরূপ সরোবরের স্মৃতি;
সোফার হাতলে তুমি ঝুঁলিয়ে দিয়েছিলে পা,
পায়ের অনাবৃত অংশটি
পাখির ছড়িয়ে-দেয়া ডানা। হঠাৎ
গাঢ় চুমো দিলাম এঁকে
তোমার পায়ের উজ্জ্বল নগ্নতায়। এই প্রথমবারের মতো
কারো পায়ে খেলাম চুমো,
পবিত্রতায় স্নাত। হয়তো প্রাচীনকালে
কোনো রূপসী রানীর পায়ে এরকম চুম্বনের অর্ঘ্য
অর্পণ করতো তার গোপন প্রেমিক
কখনো প্রভু, কখনো বা ক্রীতদাস হয়ে
প্রহরীদের নেকড়ে-চোখ আর তরবারির ঝলসানি এড়িয়ে।
চুমো খেলাম তোমার পায়ে,
যে পায়ে ভর দিয়ে চুপিসারে তুমি আসো
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে,
জড়িয়ে ধরো আমাকে, আমার চোখে মুখে
চুল ছড়িয়ে চুমো খাও আমাকে
সবকিছু ভুলিয়ে-দেয়া তীব্রতায়। যখন তোমার ঠোঁট
স্পর্শ করে আমার ওষ্ঠ,
তখন জন্ম হয় কতিপয় নতুন নক্ষত্রের। তখন
তোমার পায়ে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ এবং আমার
কবিতা পংক্তিমালা, বঙ্গোপসাগরের ঢেউ।
যখন আমরা বিচ্ছিন্ন হই চুম্বন থেকে, দেখি
ব্যানারের বাণীর মতো
আমার নাম জ্বলজ্বল করছে
তোমার চুলে, চোখে, ঠোঁটে, সূর্যোদয়-রাঙা বুকের টিলায়,
হাতে, কোমরে, ঊরুতে, নিতম্বে,
পায়ের দশটি নখে। ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়িতে
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে
ছাব্বিশটি বসন্তে ছুঁয়ে মনে হলো
তোমার গা থেকে উৎসারিত অলৌকিক
জলজ উদ্ভিদের সুগন্ধ। ফেনিল পানিতে ধুয়ে যায়
আমার বয়সের পুরু ধুলো; আমাদের যে-সন্তান
কখনো দেখবে না পৃথিবীর আলো,
তার অজাত কচিকণ্ঠের চিৎকার আমার আর তোমার
শিরা উপশিরায়
জাগিয়ে তোলে আফ্রিকার কোনো আদিম
গোত্রের নাচ, মৃত্যুহীন তালে তালে।
যখন ওরা
যখন ওরা আপিশে যায় কিংবা চালায়
তুমুল দোকানদারি,
তখন আমি ঢেউ সাজানো নদীর বুকে
দিব্যি জমাই পাড়ি।
যখন ওরা মন্ত্রী পাড়ায় চেয়ার নিয়ে
করে কাড়াকাড়ি,
তখন পাখির মন্ত্র শুনে দূর আকাশে
রঙিন সুতো ছাড়ি।
যখন ওরা রাজা উজির মারে বসে,
হাঁকায় মোটর গাড়ি,
তখন আমি তারার গানে, হাওয়ার কথায়
আস্তে পাতি আড়ি।
যখন ওরা একনায়কের সঙ্গে পড়ে
পদ্য গোটা চারি,
তখন ওহো হিজড়েগুলো দোলায় পাছা,
মাতে পুলিশ ফাঁড়ি।
যখন ওরা রেখে মেগে হাওয়ায় ঘোরায়
তীক্ষ্ম তরবারি,
তখন আমার ওষ্ঠে গোলাপ-কুঁড়ি
মনের মতো নারী।
যখন ওরা ধড়াচূড়ো পরে ওড়ায়
টাকা কাঁড়ি-কাঁড়ি,
তখন মেঘের জামা গায়ে গহন ছন্দে
দুলতে আমি পারি।
যখন ওরা দাঁতাল শুয়োর, নেকড়ে নিয়ে
আসর জমায় ভারি,
তখন আমি প্রবাল সিঁড়ির হীরের বাড়ির
স্বর্ণ কড়া নাড়ি।
যদি না লিখি প্রেমের পদাবলী
আমার সকল শব্দছন্দ আজকাল সারাক্ষণ
তোমার নিবাসে ধরনা দেয়, বসে থাকে
সিঁড়তে অথবা
ঘরের চোকাঠে নগ্ন হাঁটুতে চিবুক রেখে, কখনো হঠাৎ
সাজানো ড্রইং রুমে ঢুকে পড়ে, কখনো শোবার ঘরে আর
নীলচে চিরুনি তুলে নিয়ে চুল আঁচড়ায়, তোমার বালিশে
খুব ঝুঁকে কুস্তুরীর ঘ্রাণ নিতে চায়,
কী ব্যাকুল খোঁজে
সদ্য শাড়ি পরা রাঙা তোমার কৈশোর। ছুঁতে চায়
তাকে,যে তোমার মধ্যে অন্তরালে আছে
সবুজ পাতার ভিড়ে মুখ
লুকিয়ে, ভোরের কুয়াশায় মিশে সুদূর উদ্যানে।
ইদানীং প্রেমের কবিতা লিখি বলে শক্রপক্ষ ঢাক ঢোল
করতাল বাজিয়ে খুব উৎসব মুখর
মেথর পট্রির নরনারীদের মতো গোল করে,
এমনকি প্রিয়তম বন্ধু বলে, ‘বড় বাড়াবাড়ি
হয়ে যাচ্ছে; এখন তোমার শব্দাবলী
শুধু একজন রমণীর চতুর্দিকে ভ্রমরের মতো ওড়ে
এবং “তোমাকে মনে হয় ভিক্ষু কোনো, যে কখনো
এক মুঠো চাল কিম্বা দশ পয়সা নয়,
নিবিড় অঞ্জলি পেতে প্রহরে প্রহরে ভিক্ষা চায় ভালোবাসা
বরং এখন তুমি চন্দ্রমল্লিকাকে কাছে ডাকো,
জ্যোৎস্নাঝলসিত
মধ্যরাতে জলকন্যাদের গান শোনো কান পেতে। সেই সুর
গহীন গাঙের ঢেউদের কম্পমান তরুণীর মতো
তরণীর দোলা কবিতার পর্বে পর্বে জুড়ে দাও।
তাহলে কী করি? তুমিহীন এক দণ্ড
চলে না আমার আর না গেলে তোমার কাছে শুধু
মনে হয়, এক্ষুনি ভীষণ ভূমিকম্প হবে আর
লাভা স্রোতে ভেসে যাবো, আমার কংকাল
কোথাও থাকবে পড়ে বিপুল ধ্বংসের ভস্মীভূত
বনকুসুমের পাশে। লোকটা কে ছিল জানবে না
কেউ কোনো দিন আর; সে কি
ছুঁয়েছিল কারো হাত অথবা অধর?
যদি আমি না লিখি প্রেমের পদাবলী, ঘাট থেকে
নৌকা ছাড়বে না,
গাংচিল ছড়িয়ে ডানা নদীর ঢেউয়ের
ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়বে না, কোকিলেরা
ভুলে যাবে গান, কোনো রমণীর কাছে
কোনো পুরুষকে মানবে না আর, ‘চলন্তিকা’ থেকে
ভালোবাসা নামক শব্দটি
প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবে মেঘময় নিরুদ্দেশে।
জনক জননী
শিশুর মাথায় ঘ্রাণ নেবে না কখনো।
তখন মানুষ বদ্ধ জলাশয়ে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে
এ ওর গলায় গেঁথে দেবে
জহর মেশানো ছোরা আর দলে দলে অন্ধ আতঙ্কের চাপে
ব্যাপক আগুনে দেবে ঝাঁপ।