প্রেমপত্র
কথা দিয়েছিলে
একটি প্রকৃত প্রেমপত্র লিখবে আমাকে তুমি
কোনো একদিন
হৃদয়ের নক্ষত্রের হরফে; বেসেছো ভালো একাধিক বার
অথচ প্রেমের চিঠি নাকি
কস্মিনকালেও
তোমার কলম থেকে হয়নি নিঃসৃত!
তোমার না-লেখা চিঠি পায়রার মতো
পৌঁছবে আমার হাতে, এ বিশ্বাস সেদিন আমাকে
নিয়ে গিয়েছিল সেই সরোবর তীরে,
যেখানে প্রত্যাশা
জলচর পাখি হয়ে অবাধ সাঁতার কাটে। তার
গলায় তোমার
চিঠির আবছা সম্বোধন পাঠ করে
আমার ভেতরকার শূন্যতাকে
দিই ছুঁড়ে রাতের হাওয়ায়।
প্রতিশ্রুত চিঠি
আসেনি আমার কাছে আজো।
এড়িয়ে গিয়েছো
সে-প্রসঙ্গ বারবার, আমিও ছিলাম চুপচাপ
অপেক্ষার কুশে ক্ষত বিক্ষত হৃদয়
নিয়ে কাটিয়েছি কতকাল।
কী তোমাকে, বলো,
দূরে রাখে সে উদ্যম থেকে
যা বসাতে পারে
সহজেই অক্ষরের মেলা শাদা প্যাডের পাতায়?
কাছে পিঠে গাছ
লাগানো অথবা ভদ্রাসনে
পুকুর খনন, পুল তৈরী,
ফুল তোলা, বইপড়া কিংবা চিঠি লেখা
সব কিছুতেই কমবেশি উদ্যোগের প্রয়োজন।
কোনো বাধা তোমাকে দেয় না
লিখতে প্রকৃত প্রেম্পত্র? সেকি আহারের পরে
দুপুরের আলসেমি? নাকি
দুর্জ্ঞেয় অনীহা
কিংবা অবসরের অভাব?
হঠাৎ কখনো
প্রেমপত্র ভুলে লিখে ফেলো যদি আমার উদ্দেশ্যে
যদি পোস্টম্যান
নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে সে চিঠি ফেলে যায়
শূন্য ডাকবাক্সো কোনো দিন,
তবে জেনো কাঙ্ক্ষিত সে-পত্র থরথর
হৃদয়ে পড়ার
মতো কেউ থাকবেনা।
তখন আমার
না আছে ব্যাকুল চোখ, না মুখ, না ঠোঁট
দুরু দুরু বুক,
কিছু নেই, কিচ্ছু নেই আর
বন্যাবিলাপ
গভীর রাত্রে অনেকে ধড়ফড়িয়ে জেগে দ্যাখে মহানগরে
বানের পানির হামলা,
যেন বর্গী এল দেশে। হঠাৎ একি উৎপাত-
খাট পালঙ্ক, ঘটিবাটি, সোফা সেট, বাক্সপেটরা আলমারি
রেফ্রিজেরেটর ডোবে। মাল যায় যাক,
কোনো মতে দারা পুত্র পরিবার নিয়ে
নিরাপদ পাড়ায়
পালিয়ে জান বাঁচানো ধ্রুব সত্য বলে মানি।
বন্যার তোড় শোরগোল করে এক ঠেলায়
চালান করে দ্যায় ঘরের চালে। কী দুঃসহ
থাবার প্রহারে দিন যায় ত্রাণআমগ্রীর আশায়
দুঃস্বপ্ন সংকুল রাত কাটে। অস্থায়ী ত্রাণশিবিরে
ঘরে ফেরার টান উৎকণ্ঠিত চোখে
আনে কতো এলোমেলো ছবি। মাথার
ভেতর একপাল শেয়াল
তুলছে খুঁড়ে ক্রমাগত কবেকার হাড়গোড়।
জাতীয় বিপর্যয়। সারাদেশ
কী বিশাল জলাশয়। অনেক গ্রামে
জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই, পাখিদের কণ্ঠে নেই গান।
কোটি কোটি মানুষের দুর্গতি
জলমগ্ন কুটিরের জেগে-থাকা চলের মতো
জ্বালা ধরায় চোখে। শকুনেরা
ডানা ঝাপটায় ক্ষণে ক্ষণে, বাড়ায় গলা।
প্রেতলোক থেকে ছাড়া-পাওয়া
কংকালেরা আবার
জমাবে কি ভিড় নগরে ও গ্রামে? ‘ফ্যান দাও’
হাহাকারে ধূসর হবে কি বাতাস?
কারা অনাহারে, কারা কলেরায়, থুড়ি, উদরাময়ে
প্রাণ হারায়, কে তার হিসেব রাখে?
শুনি নানা জায়গায় পানিতে ভাসে লাশ। কে আর
প্রশ্ন করে নিরুত্তর ভাসমান লাশকে?
টেলিভিশনে ক্ষণিকের বাহারী খয়রাত, সঙ্গীন পরিস্থিতিতে
রঙ্গিন বিজ্ঞাপনী তৎপরতা এখানে সেখানে। হেলিকপ্টারে
চড়ে উলঙ্গিনী বন্যার রূপ বিহঙ্গ দৃষ্টিতে দ্যাখেন
ভিনদেশী সাংবাদিক মন্ত্রীর পাশে বসে
প্রত্যহ অতি মনোহর ধোঁয়াটে সাফাই গান কেউ কেউ,
হতাশ্বাস, ন্যূজদেহ মানুষকে শোনান
মৌতের চোয়াল থেকে ছিনিয়ে
আনার আশ্বাসবাণী।
দিনগত পাপক্ষয়; ক্লান্ত, ছা-পোষা কেরানীরা
দলে দলে বিকেলে নৌকোয় ফিরে আসেন
কলোনীতে আশাহীন, ভাষাহীন। জীনস-পরা চোস্ত মস্তানদের
কেউ কেউ দোস্তসমেত
শরীরের বেয়াড়া আগুন নেভাতে
বেপাড়ায় যায় হাতে জড়িয়ে
বেল ফুলের মালা। অকস্মাৎ নোংরা পানিতে
আলোর আল্পনা দেখে তোমার কথা মনে পড়লো।
তুমি কি সোফায় গা এলিয়ে
কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ পড়ছো?
না কি স্বেচ্ছাসেবিকা হয়ে
খাদ্য বিতরণ করছো নিরন্নদের ভিড়ে?
ধ্বংস কর্কশ ডাকে মধ্যদিনের কাকের ধরনে। আমাদের
বিশীর্ণ বংশধর
বুক ডোবা পানি ভেঙে বিষণ্ন হেঁটে যায়
ভবিষ্যতের দিকে। এরই মধ্যে সূর্য
আবীর ছড়ায় ফুঁসে-ওঠা বেনো জলে।
টিমটিমে গোধূলিতে প্রায় তলিয়ে যাওয়া
মুদির দোকানে বাঁশীতে
অপরূপ ভাটিয়ালী সুর। স্খলিত স্মৃতি বৃদ্ধ
ভবের ভাঙা হাটে খোঁজে লাঠি যৌবনের দিনগুলি;
আপাতত প্রতিটি নিশ্বাসে তার,
নিরানন্দ অক্ষরে লেখা ‘ক্ষুধা’। আশ্রয় শিবির থেকে
বিতাড়িত হলে কোন চুলোয় পাবে ঠাঁই?
আকাশে ওঠে বুভুক্ষ চাঁদ,
সুকান্ত বেঁচে থাকলে বলতেন রিলিফের রুটি।
চৌদিকে শবভুক প্রাণীদের আনাগোনা,
শিশুর কান্না, নারীর বিলাপ
যন্ত্রণা বিদ্ধ, দুর্গত চোখে সূর্যাস্তের দিকে
চেয়ে থাকে পুরুষ। মৃত্যুর গন্ধ ভাসে
জুঁই চামেলীর বনে, কোকিলের গানে, নড়বড়ে মাচায়
সত্তায় মৃত্যুগন্ধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পশু এবং মানুষ,
বারে বারে প্রশ্ন জাগে, তাদের চোখ থেকে কেন
ঠিকরে পড়ে না ক্রোধের আঙ্গার?
মতিচ্ছন্নতায়
আমার এ হাত ভগ্নকণ্ঠ গায়কের
রাগিণীর মতো
গহন বিলাপ করে তার দুটি স্তনের উদ্দেশে,
আমার সতৃষ্ণ ওষ্ঠ মাতলামো শুরু করে তার
গোলাপি ঠোঁটের জন্য। চঞ্চল পাখির
মতো উঠছে আমার নাক ক্রমাগত ওর নাভিমূল
ছোঁবে বলে, যার
দু’পায়ের আঙুলে দেখেছি আমি নক্ষত্রমণ্ডলী।
সে নেই আমার পাশে বিছানায়, তার সঙ্গে তবু
মিলিত হয়েছি স্তব্ধ জ্যোৎস্নারাতে মতিচ্ছন্নতায়!