ঘুরপাক খাই
তার পথ চেয়ে দিনভর রাতভর
একা একা থাকা, এ আমার বিধিলিপি
আঁশটে গন্ধ নিয়ে কালো সংশয়
কাঁকড়ার মতো মন্থর হেঁটে যায়।
ভেবেছিলাম সে আমাকেই ভালোবাসে।
অন্তত তার চোখের ভাষায় ছিল
নির্ভুল এক প্রেমের অঙ্গীকার।
প্রতারণা থাকে নিবিড় আলিঙ্গনে?
তার প্রতি জানি আস্থা অটুত আজো,
সেই অনুসারে হাত ধরি, চুমো খাই;
কানে কানে বলি জ্যোৎস্না মাখানো কথা,
যে কথা তাকেই দ্বিধাহীন বলা যায়।
তবু কেন কাঁটা খচ খচ করে মনে?
কেন বৈশাখী ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়?
গোধূলি বেলায় খুব সাজগোজ করে
সে যখন যায়, আমি অনিবার জ্বলি।
সাধ হয় দিই নিভিয়ে সকল বাতি,
সারাটা শহর তছনছ করে ফেলি।
কিন্তু সে বড় উদাসীন আচরণে,
ভ্রূক্ষেপ নেই তখন আমার প্রতি।
যদি সে চাইতো আমাকে পারতো দিতে
মর্ত্যভূমিতে স্বর্গের সন্ধান।
কী এক আগুনে জীবন ঝলসে দিয়ে
কেবলি ঠেলছে নরকে সারাক্ষণ।
কম কথা বলে ইদানীং কাটে বেলা।
গোপন মৎস্য ধরবার বাসনায়।
তার অন্তরে জাল ফেলি অবিরত,
অথচ আসলে কিছুই পড়ে না ধরা।
শিহরিত হই কুৎসিত কীট দেখে
অপরূপ এক ফুলের মর্মমূলে।
যে আমাকে আজ বিভ্রমে ঢেকে রাখে,
তারই ধ্যানে ক্ষয়ে যাচ্ছি ভীষণ দ্রুত।
আমাকে এখন শিকারি কুকুরগুলো
টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে চায়।
কৃষ্ণপক্ষে ঘোরে চৌদিকে ফেউ,
কী করে হৃদয় যাবে অজ্ঞাতবাসে?
যে ভেলা ভেসেছে উত্তাল তটিনীতে,
তার ফাঁকে ফাঁকে কত যে ফস্কা গেরো;
খল তরঙ্গে বৈঠা গিয়েছে খোওয়া,
ঘুরপাক খাই হিংস্র ঘূর্ণিজলে।
চিরকাল শুধু
খুব বেশি কিছু চাই কি আমার? আমি কি এতই
লোভাতুর শুধু চাই বলে কাটাই প্রহর?
সত্যি বলছি, বিশ্বা করো, কখনো আমার
তেমন কিছুর দরকার নেই। সাজানো গোছানো
ঝকমকে বাড়ি, ঘুরে বেড়ানোর চকচকে গাড়ি
চাই না কিছুই। পথে যেতে-যেতে আচমকা পাবো
ফুলের গন্ধ, গ্রামে ফেলে-আসা পূর্ণিমা-রাতে
হীরের দ্যুতির মতো পুকুরের হাসি-হাসি পানি
ছলকে উঠবে স্মৃতির কিনারে, ছোট বোনটিকে
মেলায় হারিয়ে পুনরায় ফিরে পাবার চমক,
দূর থেকে ভেসে ঢেউ-হয়ে-আসা বাঁশির রাগিণী,
আমার সাহসী বন্ধুর কারাবাসের অন্তে
তাকে বুকে চেপে ইতিহাস পুরে হাতের মুঠোয়
ঘরে ফিরে আসা, শুধু এটুকুর আছে প্রয়োজন।
এটা কি তেমন বেশি কিছু চাওয়া? মাথার ভেতর
চাঁদের মধুর মদির আগুন নিয়ে প্রাণ ভরে
শব্দ ছন্দ বানানোর খুশি, মায়ের পুরানো
শালের বাইরে ফুটে থাকা দুটি কল্যাণী হাত
দেখার তৃপ্তি, মধ্য রাতের বিজন প্রহরে
ঘুম ভাঙা চোখে জানালার ধারে নিঝুম দাঁড়ানো,
একটু আগেই তোমাকে স্বপ্নে ছুঁয়ে, প্রীত হওয়া,
সন্ধ্যার মতো দুপুরে হঠাৎ বৃষ্টিতে স্নান,
পাতায় পাতায় ফেরেশতাদের মৃদু করতালি,
শ্মশানের পাশে বন কুসুমের ফিক করে হাসা;
আর কিছু নয়, তোমার বাসার সিঁড়ি ভেঙে ওঠা,
চিরকাল শুধু তোমাকে পাবার ব্যাকুলতা থাকা।
ঝরা পাতা
এ আমি কোথায় এসে পড়েছি হঠাৎ? ঘাটে নৌকো
বাঁধা ছিল; কী খেয়াল হলো
খুঁটি থেকে দড়ি খুলে চেপে বসলাম
গলুইয়ে, ভাসলো নৌকো ঘন
কুয়াশায়। কিছুটা কুয়াশা
কী করে আলতোভাবে যেন মাথার ভেতরে ঢুকে
গেল, শুধু মনে পড়ে, আসার সময়
আমার পায়ের নিচে শুকনো পাতাগুলো
খসখসে স্বরে
পুরানো দিনের কোনো কাহিনীর মতো কিছু একটা বলছিল।
কুয়াশায় চতুর্দিক মতিচ্ছন্ন খুব,
কিছুতেই সম্মুখের দিকে কোনো কিছু
দেখা যাচ্ছিল না; যদি বলি, সে মুহূর্তে অন্ধকারে
একটুও ভয়ডর ছিল না আমার,
বুকের ভেতর কোনো প্যাঁচা হুম্ হুম্ ডেকে
ওঠেনি, বরং এই কুয়াশায় যদি
লুপ্ত হই, তাহলে কিছুই এসে যাবে না আমার।
কেবল পড়বে মনে পায়ের তলায়
ঝরা পাতা কী যেন শোনাতে চেয়েছিল।
তাবু ছেড়ে ছুটে আসে
আকাশে উটে কুঁজ, বাঁকা ছোরা হয়ে ঝোলে
চাঁদ, চোখে ঘুমের নাছোড় আঠা, তাঁবু কাঁপে অশান্ত হাওয়ায়।
“এ কিসের শব্দ শুনি? এ কেমন গান,
যা সুরেলা বুলবুলও পারে না গাইতে, আসে ভেসে
আমার তাঁবুতে? এরকম আর্তস্বরে
কে ডাকছে লায়লা লায়লা বলে? আমার কায়েস ছাড়া, হায়,
কে আর ডাকতে পারে আমাকে এখানে? এরকম
মর্মমূল-ছেঁড়া ডাক কার হতে পারে আর বলে
ব্যাকুল লায়লা তাঁবু ছেড়ে ছুটে এসে
দাঁড়ায় প্রশস্ত পথে। নেকাব ছিল না মুখে তার।
যেনো সে হরিণী এক, গায়ে যার লেগেছে আগুন
অকস্মাৎ বেখেয়ালে। শিশির-ঝরানো
আওয়াজে লায়লা করে উচ্চারণ, আমার উন্মাদ
যে-জন তোমরা তার দিকে কেন ছুঁড়ছো পাথর
বার বার? কী ওর কসুর, বলো? তোমাদের কারো
কোনো ক্ষতি করেনি যে, তাকে
কেন দিচ্ছো সাজা মিছেমিছি? দ্যাখো কী হাল করছো তার।
মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, অথচ
একেবারে বেখবর সে এখন, শুধু লায়লার
নামে গান বাঁধে,
যে গান মুদ্রিত হয় ধু ধু মরুভূতে, পান্থপাদপে, নহরে
এবং হরিণ শাবকের পিঠে। দ্যাখো কায়েসের
বিলাস-ছোপানো
পোশাক হয়েছে আজ মজনুর শতচ্ছিন্ন মলিন লেবাস।
দোহাই খোদার, ওকে কোরো না পীড়ন,
বরং আমাকে দাও জুলুমের রূঢ় দাগ, যত দিতে চাও।
লায়লা কাতর কণ্ঠে আরো কিছু কথা
বলে সেই প্রস্তর নিক্ষেপকারীদের উদ্দেশে, ‘সেদিন এক
নামাজীর সেজদার সামনে দিয়ে কায়ক্লেশে হেঁটে
গিয়েছিল ফোস্কাময় পায়ে
যে-মজনু তাকে সে ধার্মিক জোরে সোরে
শাসালেন, “হে নাদান, দেখছো না পড়ছি নামাজ?’
হে প্রবীণ, মাফ চাই আমি,
এই অভাজন একজন মানবীর প্রেমে মশগুল হয়ে
তাকে ছাড়া অন্য কিছু দ্যাখে না দু’চোখে,
অথচ আপনি ত্রিলোকের মালিকের এবাদতকালে এই
নগণ্য লোকের ছায়া দেখে
এলেন বিদ্বেয়ে তেড়ে এবাদত ছেড়ে? মজনুর
জবাবে লজ্জিত বর্ষীয়ান
আবার গেলেন ফিরে জায়নামাজের মখমলে।
“এ রকম যে মানুষ, তাকে কেন হানছো আঘাত”,
বলে কায়েসকে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুপাত করে
লায়লা এবং মজনুর বুক হয় দীর্ঘশ্বাস,
“মিনতি কোরো না আর হে লায়লা আমার, হানুক
নিষ্ঠুর আঘাত ওরা, যত ইচ্ছে ছুঁড়ুক পাথর,
লায়লা তোমার নাম উচ্চারণ করলেই পাথর নিমেষে
রূপান্তরে বেহেশতের ফুল! প্রিয়তমা,
ক্ষমা কর তোমার এ প্রেমিকের বেহদ উদ্ভ্রান্ত আচরণ।
বন্দনায় মুড়ে দিতে গিয়ে অখ্যাতির কালো তাজ
দিয়েছি পড়িয়ে তোমাকেই; নিজেই নিজের বৈরী এ কায়েস।
“কী আর করার আছে ক্ষমা ভিক্ষা ছাড়া? যদি আমি
লায়লা লায়লা ডেকে এ মরুর বুকে,
কখনো ঘুরে না বেড়াতাম রাত্রিদিন ঘুমহীন, খাদ্যহীন,
তাহলে মতোনা
কখনো তোমার বদনার। দুই কাবীলার ঘোর রেষারেষি
কলহ বিবাদ আজ আমাদের দুজনকে বিপন্ন করেছে।
আমার হৃদয় যদি কণ্ঠ হয়ে করে উচ্চারণ
তোমার মধুর নাম, তবে আমি তাকে
কী করে থামাবো, বলো? ঘোড়ার কংকালময় বালিয়াড়ি আর ফণিমনসায়
সর্বদা থাকবে লেগে আমার নিজস্ব হাহাকার।
মৃত্যুর পরেও তুমি হেঁটে যাবে কবরের ওপারে, কাঙ্ক্ষিত
অমরতা নামক সঙ্গীর হাত ধরে,
এখানে প্রতিটি ফুল বাতাসের কানে রটাবে তোমার নাম।
জীবন তো দীর্ঘশ্বাস হয়ে রইলো, বিচ্ছেদ মলিন;
মৃত্যুর দরজা ছাড়া মিলনের স্বতন্ত্র প্রবেশদ্বার নেই।