কীভাবে ছিলাম বেঁচে
কীভাবে ছিলাম বেঁচে তোমাকে ছাড়াই পরবাসে
এতদিন? বিপন্নতা, বিভীষিকা আমার আকাশে
ছিল ব্যেপে, তোমার অনুপস্থিতি বসাতো সুতীক্ষ্ণ দাঁত আর
আমার ভেতরে স্তরে স্তরে বেদনার
দাগ লেগে থাকতো, যেমন ফসিলের গায়ে মাটি
এবং পড়তো মনে দুজনের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর খুঁটিনাটি।
পথ চলি মৃত্যুর অধিক অন্ধকারে সম্বলবিহীন একা;
যখন তোমার সঙ্গে দেখা
হয় না, তখন ভাবি, সূর্যোদয়, বসন্তবাহার, মিথ্যা সবই
এবং কেবলি মনে হয় আমি নির্বাসিত কবি
নিজ বাসভূমে, অন্তর্গত অভিমান
যদি পারতাম দ্রুত করতে চালান
উড়ে যাওয়া দোয়েলের গীতে,
পাতার মর্মর আর শ্রাবণের নদীর ধ্বনিতে।
যতই পুড়ি না কেন চিতার কাঠের মতো, তোমাকে প্রতিমা
বলে জানি; পাবো কি তোমার দেখা এই মর্ত্যসীমা
পেরিয়ে আবার?
ভাবি শুধু,-আমি কি প্রেমিক নাকি একনিষ্ঠ পূজারী তোমার
যায় প্রত্যাবর্তনের গানের বিভূতি অস্তিত্বের খাঁচা থেকে
নিভৃতে ছড়িয়ে পড়ে, তোমার হৃদয় দেয় ঢেকে।
ক্ষমা নেই
আমি কি গিয়েছি ভুলে কীরকমভাবে লেখা হয়
নিত্য নতুনের ছোঁয়া লাগা
প্রেমের কবিতা? ইদানীং শুধু তুমি
খুব স্বতঃস্ফূর্ততায় এসে যাচ্ছো আমার প্রতিটি কবিতায়।
তোমার শ্রীমন্ত ওঠা-বসা, আসা-যাওয়া,
হাঁসা-কাঁদা, মান-অভিমান আর উষ্মার রঙিন ক্যাকটাস-
সবকিছু আমন্ত্রিত অতিথির মতো
আমার কবিতা জুড়ে বসে থাকে আরামে পা তুলে।
তোমার উদ্দেশে পংক্তিমালা না সাজালে
আমার রচনা আর কবিতার মধ্যে সীমাহীন দূরত্বের কুয়াশা জড়ানো
থেকে যায়; জানি না এমন কোনো উপমার খোঁজ,
যা সহজে দেয় ধরা, যেমন অভিজ্ঞ
ধীবরের জালে বহু চকচকে মাছ।
নিজেকে উজাড় করে বার বার করেছি অর্পণ
তোমাকে উৎপ্রেক্ষা কত, অন্তরঙ্গ অনুভূতিমালা
আমি কি এখন
আত্মানুকরণে তৃপ্ত হবো দিনভর, রাতভর?
কখনো কখনো ভাবি, তোমাকে আমার
কবিতার চতুঃসীমা থেকে
দেবো নির্বাসন, তা হলে তো কবিতাও যাবে দ্রুত
বনবাসে খরায় চৌচির কোনো জমিনে আমাকে ফেলে রেখে।
কোকিল কি দোয়েলকে কেউ অপবাদ
দেয় না কখনো চিরকাল চরাচরে একই সুর
ঝরাবার জন্য, কবিদের
ক্ষমা নেই, যদি তারা বন্দি থাকে অভিন্ন ভঙ্গিতে।
গর্জে ওঠো স্বাধীনতা
কী করবো সে বসন্ত দিয়ে যাতে আছে শুধু ধু ধু
কোকিলের ডুকরে ওঠা, নেই
ফুলের বাহার? সে বাগানে কী কাজ আমার, বলো,
যেখানে আসে না পাখি কোনোদিন? কী রুক্ষ কঠিন
মাটি আর দাঁড়ানো প্রেতের মতো সারি সারি গাছের কংকাল।
কী দরকার সে প্রেমের যা কেবলি কাঁটার
মুকুট
পরায় মাথায় আর বিষপাত্র তুলে দেয় হাতে?
কোন্ কাজে লাগে সেই পথ,
যেখানে হাঁটে না কেউ, যেখানে অদৃশ্য
রঙীন আইসক্রিমঅলা, শহর-ভাসানো মিছিলের ঢেউ?
তোমাকে ডেকেছিলাম, প্রিয়তমা, যখন সূর্যের সূর্যোদয়ের দিকে
মুখ রেখে যাত্রা ছিল আমাদের, বুর্জোয়া মোহের
পিছুটান আনেনি তোমার কানে জনগণমন-জাগানিয়া গান।
জাঁহাবাজ ঈগলের নখরের ভীষণ আক্রোশে
এখনো বন্দিনী তুমি, হাঁটতে পারো না রংধনুর গালিচামোড়া পথে।
তুমি বিনে কী দুরূহ এই পথ চলা।
চৌদিকে আঁধার করে বিকট দানব আসে পায়ের তলায়
নিমেষে গুঁড়িয়ে নব্য সভ্যতার বুনিয়াদ,
ফাঁসিতে লটকে দেয় পূর্ণিমা চাঁদকে, আর নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সব
পদ্ম আর গোলাপের উন্মীলন, দোয়েলের শিসঃ
নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আমার পদ্যের পর্বে পর্ব্যে নিরিবিলি
তোমার নিঃশ্বাস আর চুলের সৌরভ।
সুদিনের প্রতীক্ষায় যে কিশোরী বাঁকানো শরীরে
বসে আছে বার্ধক্যের বিজন দাওয়ায়,
তাই এই বয়সের ভারের দোহাই,
নেলসন মান্দেলার দীর্ঘ কারাবাসের দোহাই,
বীর যুবা নূর হোসেনের শাহাদাতের দোহাই,
দিগন্ত কাঁপিয়ে ক্রুদ্ধ টাইটানের মতোই আজ
হাতের শেকল ছিঁড়ে ফেলে
গর্জে ওঠো, গর্জে ওঠো তুমি স্বাধীনতা।
গৃহযুদ্ধের আগে
চাঁদটা কি আরকে-ডোবানো অকালজাত শিশুর মতো
দলাপাকানো? হাওয়ায় কী একটা প্রেতগন্ধ ঘোরাফেরা
করে সর্বক্ষণ, অনবরত
গুমরে উঠছে দেয়ালগুলো, গলা-চেরা
অদ্ভুত চিৎকারে ঘুম
ভেঙে যাচ্ছে সব্বার, এ শহর আর
বাসযোগ্য নয়, মাঝে মধ্যে কী নিঃঝুম
লাগে, যতক্ষণ জেগে না ওঠে আবার হাহাকার।
ঝাড়লণ্ঠনের আলো, টুংটাং আওয়াজ,
নূপুর ধ্বনি, চেনা
গুঞ্জন, কিছুই তাকে আজ
পেছনে আটকে রাখতে পারছে না।
তার গায়ে লেগে প্রতিটি শব্দ পিছলে পড়ে, এক ঝটকায়
বেরিয়ে যায় পুরানো দালান ছেড়ে। কে কাকে
কোথায় লটকায়?
চোরকুঠুরিতে না কি গাছে?
কে যেন ডাকে
তারানা বাঈ-এর গলায়; সে কি আছে
এখনো মাইফেলে এই খাঁ খাঁ দুপুরে?
পিছু ডাকে কাজ হবে না, নেমে
এসেছে সে রাস্তায়, বাসি রাতের এস্রাজি সুরে
দিনের পথিক হঠাৎ থেমে
যাবে না; তার জন্য কোনো পালকি-বেহারা
অথবা মোটরকারের দরকার নেই।
হারিয়ে ফেলেনি খেই।
তোমরা কেউ জিগ্যেম কোরো না, ইতিমধ্যে কারা
দেশান্তরী হয়েছে, কাদের ঘর
ছারখার, কে কে মারা
গেছে অর্থাৎ নিহত; কারা পায়নি আশ্রয় কিংবা কবর।
চলছে সে কোন দিকে? উত্তরে না দক্ষিণে?
পূর্বে? পশ্চিমে? অবান্তর এসব প্রশ্ন। নিঃশ্বাসে
যতক্ষণ জোর আছে হাঁটবে, দৌড়ুবে, পথ নেবে চিনে,
দম ফুরুলেই উঠে পড়বে দূরগামী বাসে।
বসে বসে ওর কি আসছে ঢুলুনি?
এরকম হলে নাস্তানাবুদ। গন্তব্যে এসে
চলে গেলে সে দাঁড়াবে কোথায়? গন্তব্যই বা
কোথায়? ‘শুনি,
বন্দুকের আওয়াজ’, বলে কেশে
থুতু ফেলে আশেপাশে দৃষ্টি বুলোয়।
না, এখনো সময় হয়নি নামার।
চোখ অন্ধ হয়ে আসে ধুলোয়,
রঙ বদলে যায় জামার।