একজন প্রবীণ বিপ্লবী
বদলে যাচ্ছে, চোখের সামনে
পৃথিবীটা খুব বদলে যাচ্ছে।
যা কিছু প্রবল আঁকড়ে ছিলাম,
সেসব কিছুই মায়া মনে হয়।
এ কী প্রতারণা চৌদিকে আজ!
কোনটা আসল কোন্টা যে মেকি,
এই ডামাডোলে বোঝা মুশকিল।
নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে।
আমি কি তাহলে অতীতের কোনো
বিস্মৃত প্রাণী? অগ্নিগিরির
ব্যাপক বমনে হয়েছি বিলীন?
মহা তাণ্ডবে খুঁজি উদ্ধ্বার।
নয়া প্রজন্ম নানা অছিলায়
মুখ ভ্যাংচায়; ভয়ে-ভয়ে থাকি।
আজকে নিজকে কাকতাড়ুয়ার
ভূমিকায় দেখে শিহরিত হই।
নারীর প্রণয়, শিশুর আদর
থেকে ছুটি নিয়ে ছদ্মনামের
আড়ালে লুকিয়ে বেড়িয়েছি একা,
করেছি লড়াই আপোষহীন।
শিকারি কুকুর-তাড়িত জীবন
কেটেছে একদা সকল সময়,
মৃত্যুর মুখে ধুলো ছুঁড়ে দিয়ে
নানা ঘাটে ঘুরে বয়ে গেছে বেলা।
জটিল তত্ত্বে আস্থা রেখেই
প্রগতি-মৃগের পেছনে ছুটেছি।
আজ কেন তবে বেলাশেষে দেখি
স্বপ্নের চোখে হানা দেয় ছানি?
কোথায় যাবার কথা ছিল আর
এ কোথায় এসে থমকে দাঁড়াই?
বন্দি মনের শৃংখল ছিঁড়ে
এসো ছুটে যাই খোলা প্রান্তরে।
যদি ফের কোনো নতুন তত্ত্ব
হাত ছানি দেয় কৃষ্ণপক্ষে,
তবে কি তাকেও পিছুটান মজে
ধু ধু মরীচিকা মনে হবে শুধু?
একজন হরিণীর গল্প
ভূয়োদর্শী গাছগাছড়ার খোঁজে ঢুকেছি জঙ্গলে
কতবার অনাপন পথে শোলা-হ্যাটে বিশুদ্ধ শিশির জমে,
বুটে লেপ্টে থাকে খড়কুটো অবসাদে
কখনো ঘুমিয়ে পড়ি লতাগুল্ম ছাওয়া
ঝোপের আড়ালে, স্বপ্নে দেখি,
হাত মুঠোয় নাচে বিশল্যকরণী, আর নয় অসম্ভব
হৃদয়ের বিষণ্ন ক্ষতের নিরাময়। অকস্মাৎ একটি পতঙ্গভূক
গাছ গঙ্গা ফড়িং-এর অস্থির যৌবন শুষে নেয়।
জঙ্গলের পথে যেতে যেতে একজন তরঙ্গিত
হরিণীকে দেখে
চমকে উঠেছিলাম। অন্য কিছু চোখে পড়েছিল
কিনা আজ আর মনে নেই, শুধু তার
বিদ্যুচ্চমকের মতো রূপ, চোখের মণির গহনতা আঁকা
হয়ে গিয়েছিল বুকে। কিছুতেই তাকে
বিস্মৃতির খাদে ঠেলে দিয়ে ফেলে দিতে
পারিনি এখনো, কত সূর্যাস্তের রূপ মুছে গেল!
একজন হরিণীর কথা ভাবি নিজের ভেতরে
ডুব দিয়ে, বহুক্ষণ এক-একা আছি,
চোখে ঘুম নেই এক ফোটা। শুধু সেই হরিণীর
স্মৃতি চোখ হয়ে চেয়ে থাকে। কস্তুরীর ঘ্রাণে ছুটে
গিয়েছিল, পড়েছে জটিল ফাঁদে। তাকে ঘিরে সব
বাঘসিঙ্গি উৎসবের
আওয়াজ তুলবে সমস্বরে, তারপর মাংস তার
খুবলে খুবলে খাবে, রেণুগুলো ওড়াবে হাওয়ায়।
আমি হরিণীকে সেই ফাঁদ থেকে দূরে
বহুদূরে সরিয়ে নেবার
চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নিজের নির্জনতায় ফিরে
এসেছি, কেননা যতবার
খুলেছি বন্ধন তার ততবারই মাতালের মতো
আবার গিয়েছে ছুটে ফাঁদের নিকটে
নানা ছুঁতো ধরে,
নিজের মাথায় তার ভাঙ্গুক আকাশ, চেয়েছিল।
ভূয়োদর্শী গাছগাছড়ার খোঁজ মেলেনি এখনো। কায়ক্লেশে
ঘুরে ফিরি হরিণীকে একবার দেখার আশায়
তাকে ডেকে আনবার ভাষা
অহঙ্কারী
বট পাকুড়ের পাহাড়, বিনীত ঝর্ণাতলা, পাকদণ্ডী,
নিকট প্রার্থনা করি গলা পেতে। কী জানি কিসের
যোগে আজ কেবলি উপচে পড়ে ওষ্ঠ থেকে
ভুল ভাষা, ভুল প্রতিধ্বনি ঘোরে গহন জঙ্গলে।
জঙ্গলে যে গল্প শুরু হয়েছিল তা শেষ হবার
আগেই কেমন খাপছাড়া
পূর্ণচ্ছেদ হয়ে যাবে? একটি ঘটনা
থেকে অন্য কোনো ঘটনার জট খোলা কী কঠিন।
এ নিয়ে আক্ষেপ নেই তিলমাত্র। ইচ্ছে হয়
আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠি,
তবু কেন চোখে জলছাপ
জেগে ওঠে বার বার, শূন্যতা শোনায় হাহাকার?
একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায়
কোনো জাঁকজমক পূর্ণ ভোজসভায় রকমারি
সুস্বাদু খাবার
কাবার করতে চাই না। রাস্তার ধারে ধুলোমাখা
যে শিশুটি একটু আগে
আকাশের গলায় ঝুলে-থাকা
মাদুলির মতো আধখানা চাঁদ ছিঁড়ে এনে
খেলনা বানাতে চেয়েছিল,
এখন সে খিদেয় কাঁদছে, আমি
তার জন্যে এক সান্কি গরম ভাত চাই।
আমি ওয়ার্ডরোবে থরে থরে সাজানো
পোশাক চাই না। যে যুবতী তার একমাত্র
আবরণ অন্ধকারে মেলে দিয়ে
পানির ঝাপটা লাগা পাখির চোখের মতো
কাঁপছে নগ্নতায়, তার আব্রুকে মুকুট পরাবো বলে
আপাতত একটি শাড়ি চাই।
সর্বদা খর পাহারায় থাকা
কোনো রক্তপিপাসু একনায়কের
করমর্দন করতে আগ্রহী নই। ঐ যে স্বৈরাচার-বিরোধী
শ্লোগানের তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে
সাহসী মানুষগুলো এগিয়ে চলেছে জনপথে
মানুষের অপমান চিরদিনের জন্যে
মুছে ফেলবে বলে, আমি তাদের
মিছিলে সামিল হতে চাই।
প্রিয়তমা, এই বন্ধ্যা সময় আমার স্বীকৃতি
পাবার যোগ্য নয়। বরং চুমোয় চুমোয়
আর আলিঙ্গনে আর প্রাক-প্রভাতের সঙ্গমে তোমাকে
করে তুলবো সন্তান সম্ভবা। ফুটফুটে নবজাতক
দুলবে দোলনায় নিটোল শান্তিতে, তুমি দেখবে
সন্ত্রাসমুক্ত দৃষ্টিতে। একদিন সে কৈশোরে
ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্রের ছায়া মেখে
দৃপ্তপদক্ষেপে প্রবেশ করবে
একবিংশ শতাব্দীতে, তুমি দেখবে মুখাবেশে,
তোমার ঠোঁট থেকে হাসির কুঁড়ি
ঝরতে থাকবে ক্রমাগত
লালকমলের বিজয়ে।
কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেলে, এক ঝটকায়
লোপাট করে মুক্তি দেবো
স্বৈরাচার-পীড়িত
রাজনৈতিক বন্দিদের; কেননা, কোনো
দেশভক্ত জেলে পচতে থাকুক,
এ আমার কাম্য নয়।
যারা অমরতার বাদ্যরব শুনতে চায়
দিনভর, রাতভর, তাঁদের তালিকায় আমার নাম
খুঁজে পাবে না কেউ। প্রিয়তমা, যে কবিতায়
তোমার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ
আর পুরুষ্ট, সতেজ ফলের মতো স্তনাভা থাকবে,
শিশুর সদ্য-দুধ-খাওয়া মুখের ঘ্রাণ
আর কোকিলের ডাকের মতো ব্যাকুলতা
আর মেঘনা নদীর মাঝির
গোধূলিবেলার হাঁক থাকবে, থাকবে
আগামীর অগণিত মানুষের
স্বপ্নের মতো পদধ্বনি,
তেমন কবিতা আমি লিখতে চাই
ধ্যানে নিমগ্ন,
একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।