নিজেকে নিয়ে পঙ্ক্তিমালা
আমি তো অনেক আগে একটি মাটির ঘরে ভোরে
প্রথম মেলেছিলাম চোখ মিটিমিটি,
অথচ কাঁদিনি একরত্তি গুরুজনদের শত
চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে। পরবর্তীকালে দুটি
চোখ থেকে ঢের পানি ঝরবে বলেই সম্ভবত
সে আঁতুড়ঘর ছিল বড় সুনসান।
যদিও পুরোনো এক গলির ভেতরে জন্ম আমার, ক্রমশ
সময়ের দ্রুত পদধ্বনি
আমাকে এগিয়ে নিয়ে পৌঁছে
দিয়েছে সম্মুখে, বেছে নিয়েছি সঠিক ডেরা আর
গেয়েছি দরাজ কণ্ঠে গান কত না আসরে। চোখে
ছিল স্বপ্ন ভাবীকাল এবং সফল জীবনের,
যে জীবন সৌন্দর্য এবং
শান্তির আভায় সুশোভিত।
যখন জীবন ছিল যৌবনের সতেজ আলোয় ঝলসিত
প্রগতির নিশানে শোভিত আর মিছিলের দীপ্র
আহ্বানে অধীর, একদিন নাদিরার অপরূপ
ভাষণ আমাকে রাজপথে বাহুদ্বয়
উঁচিয়ে স্লোগান দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে বারবার। আজও সেই
স্মৃতিটুকু জ্বলজ্বলে দুপুরে দূরকে নিকট করে বড়।
এখনো তো বাংলার চোখ থেকে অনিবার জল
ঝরে দিনরাত, বুক তার বর্বরের
দংশনে রক্তাক্ত অতিশয়। নতুন নাদেরা কোনো
নিয়েছে পতাকা হাতে প্রবল কাঁপাচ্ছে রাজপথ,
পুলিশের লাঠির প্রহারে তপ্ত পিচঢালা পথে
পড়ছে লুটিয়ে, ফের মাথা তুলে উঠছে দাঁড়িয়ে
অপরূপ মিনারের মতো। মিছিলে শরিক হতে
প্রৌঢ়ত্বেও কুণ্ঠাহীন এই আমি দেশ ও দশের কল্যাণের প্রয়োজনে।
আমার শরীর আজ নিরন্তর কালের প্রহারে
খুব ক্ষত-বিক্ষত, অথচ মন যুবার মতোই
সতেজ, নতুন বাগানের শোভা বাড়ানোর স্পৃহা
সর্বদা জাগ্রত-সব বাধা বিপত্তি উজিয়ে
যেতে চাই দূরে, বহুদূরে প্রগতির
পতাকা-শোভিত এক শান্তিময় জগতের দিকে-বুঝি তাই
কখনো নক্ষত্র-দীপ্ত আকাশে, কখনো মাটিতেই বেশি থাকি।
২১-১০-২০০৩
নিজের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করি
এই যে নিজের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করি, বড় বদরাগী
দুপুরের সঙ্গে চোখ রাঙাই খামোকা
বারবার, তবুও দুপুর কমায় না তাপ তার। আমি শেষে
হাল ছেড়ে বিকেলের প্রতীক্ষায় থাকি। আসবে কি আর কেউ?
বিকেল কি সত্তার সুঘ্রাণে তার বাগানের রূপ পেয়ে
দুজনের মিলনের কুঞ্জ হয়ে উঠবে চকিতে? অকস্মাৎ
একটি উন্মত্ত পশু আমাকে থাবায় বিদ্ধ করে
নীরেট আঁধারে ঘষটাতে ঘষটাতে ছিঁড়ে খাবে অবশেষে।
‘আমাকে বাঁচাও’ বলে চেঁচালেও কিছুতেই
আসবে না কেউ পশুটিকে তাড়িয়ে আমাকে দ্রুত
বাঁচাতে পাশব স্বৈরাচার থেকে আর
নির্ঘাৎ পতন থেকে। কতিপয় অমানুষ নিয়ে যাবে ক্রমে
বিদ্ধ করে আমাকেই, রক্ত অবিরত ঝরে, যেন জীবনের
আলো নিভে যায় শেষে। কৌতূহলী কিছু চোখ সে-দৃশ্য দেখবে।
কে আমি, যে হাঁটে পথে একা একা আর আচমকা
চেয়ে দ্যাখে গাছপালাহারা এবড়ো-খেবড়ো এক
জমিনে দাঁড়িয়ে আছে জনহীনতায়? এক ঝাঁক জাঁহাবাজ
ক্ষ্যাপা পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ভয়ার্ত সত্তায়।
মাঝে মাঝে যখন একলা বসে থাকি নিজ ঘরে,
প্রশ্ন জাগে, এই যে এখনও বেঁচে আছি এ শহরে
এই মাটি, এই গাছ-পালা, নদী-নালা,
এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে নিত্য দ্বিপ্রহর অমাবস্যা-রাত
মনে হয় সর্বদা যেখানে, যে-দেশের জন্য আত্মদান
করেছেন শহীদেরা।
০১-০১-২০০৩
নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন
ইদানীং এদিক সেদিক দৃষ্টি মেলে মনে হয়,
জীবনের গোধূলিবেলায় দৃশ্যাবলি
কী রকম যেন
ওলটপালট, বিদঘুটে মনে হয়। আশেপাশে গাছপালা
বেশি নেই। দু’চারটি চোখে পড়ে বটে, কিন্তু ওরা,
মনে হয়, কী ভিষণ ক্ষেপে আছে, যেন বা এখুনি
দাঁত, নখ খিঁচিয়ে আসবে তেড়ে। মানুষের অবহেলা,
উৎপীড়ন, সীমাহীন অত্যাচার সহ্যাতীত ঠেকছে এখন
বৃক্ষ-সমাজের। বৃক্ষহীনতায় মনুষ্যসমাজ লুপ্ত হবে-
এই সত্য বিস্মৃতির ধোঁয়াশায় দ্রুত ঠেলে দিয়েছে মানুষ।
যদি বলি, বহুদিন থেকে হারাম রাতের ঘুম
আমার, দিনেও নিদ্রাহীন রক্তচক্ষু নিয়ে থাকি
বহুমুখী সমস্যার খোঁচা খেতে খেতে,
তা’হলে হবে না সত্যকথনের এতটুক অপলাপ। চোখ
জ্বালা করে সারাক্ষণ, কী এক বেজায় হিংস্র পাখি
ক্রমাগত ঠোকরাতে থাকে
বিভিন্ন প্রহরে; মগজের, হৃৎপিণ্ডের
রক্তক্ষরণের চাপে ম্রিয়মাণ হতে থাকি।
দর্পণে দেখি না মুখ ইদানীং, পাছে কোনওদিন
নিজেরই চেহারা দেখে ভয়ের খপ্পরে
পড়ে যাই। প্রতিদিন নিজের সঙ্গেই লুকোচুরি
খেলি বাস্তবের মুখ-ভেঙচি এড়ানোর প্রত্যাশায়
স্মৃতি আজকাল বড় বেশি প্রতারণা করে, ধু-ধু
মরুভূমি রূপে এই আজকের আমাকে নিয়ত
নিয়ে যায় শূন্যতায়। ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি শুধু
এদিক সেদিক, কোথায় যে
আছি, নিজ আস্তানায় না কি কখনও না-দেখা অন্য
কোনও স্থানে, বুঝতে পারি না। এক ঝাঁক কালো পাখি
মাথার উপরে বহুক্ষণ ঘুরপাক খেতে খেতে
অতি দ্রুত কখন যে কোথায় হঠাৎ
নিমেষে মিলিয়ে যায়, বুঝতে না পেরে
ধন্দে পড়ে যাই; হায়, কেমন অচেনা লাগে নিজেকে তখন।
মাঝে মাঝে এমন বিহ্বল হয়ে পড়ি,
বিছানায় গড়াগড়ি কিংবা টেবিলের পাশে চেয়ারের কোলে
বসে থাকা বড়ই অসহ্য বোধ হয়। আচানক
উঠে পড়ি, পায়চারি করি কিছুক্ষণ, ভাবনার
এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। শেল্ফে সাজানো
বইগুলো আমার ব্যর্থতা পাঠ করতে করতে এ রকম
মূক হয়ে থাকে, যেন শব্দের ভাণ্ডার
সব লুট হয়ে গেছে সুচতুর তস্করের গায়েবি কৌশলে।
বহুরূপী বঞ্চনার ঘূর্ণিবাতে পড়েও যে টিকে
আছি, মাঝে মাঝে অকস্মাৎ
সুরের ঝলক এসে আমাকে করায় স্নান আর কোনও
কবিতার পঙ্ক্তিমালা পৌঁছে দেয় কোনও অলৌকিক
ঠিকানায়, তখন ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা
জানাই নীরবে, চেয়ে থাকি বেধড়ক
কাটা-পড়া বৃক্ষ-সমাজের দিকে। আমার জানালা
দিয়ে ক্ষয় রোগীর মতোই চাঁদ প্রবেশের পথ
কিছুতে পায় না খুঁজে। আমি নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন রাত
কাটাই নিজের ছোট ঘরে খুব পায়চারি করে।
২৫-৩-২০০৩