তার আগমন এবং প্রস্থান
কিছুক্ষণ ঘরে ব’সে থাকার পরেই জাঁহাবাজ অন্ধকার
আমাকে গ্রেপ্তার করে ওয়ারেন্ট ছাড়াই, বেজায়
ধমকাতে থাকে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ারের
হাতল আঁকড়ে ধরি। এ রকম বিদঘুটে আঁধার কখনো
নজরে পড়েনি বাস্তবিক। অকস্মাৎ কিয়দ্দূরে
অপরূপ আলোচক্র সৃষ্টি হয়। তিমির কাঁপতে থাকে খুব।
আলোচক্র থেকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে আসেন
নিঃশব্দে মহিমময় সুদীর্ঘ পুরুষ আর আমি
ইন্দ্রজাল-সম্মোহিত মানুষের মত
নিমেষে চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়াই। দীর্ঘদেহী
পুরুষের, লক্ষ করি, পাঞ্জবি, বুকের
এলাকা ভীষণ রক্তময়, চোখ দুটি সমুজ্জ্বল ইতিহাসে।
একটিও শব্দ তিনি করেন না উচ্চারণ, শুধু
সুদৃঢ় তর্জনী তার উত্তোলিত আসমানে, যার
বুকে ফুটে আছে সংখ্যাহীন
জ্বলজ্বলে তারার মিছিল। সত্তা তার
মহান কবির মত একান্তে করছে উচ্চারণ
অনুপম পদাবলী সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর প্রগতির।
ব্যাকুল জিজ্ঞাসু আমি কিছু জবাব পাওয়ার জন্যে
খানিক এগিয়ে যাই, কিন্তু তিনি আচানক উজ্জ্বলতা থেকে
ধোঁয়াটে কোথায় তার রক্তাক্ত চওড়া বুক আর মিনারের
মত উঁচু সাহসী শরীর নিয়ে চলে যান কোন্ অজানায়!
১৩-৮-২০০৩
তিরস্করণী হাতের শুশ্রূষায়
যখন একা বসে থাকি ঘরে, হঠাৎ
চেয়ার, টেবিলে, বুক-শেল্ফ দাঁত খিঁচিয়ে
আমার দিকে এগিয়ে
আসতে থাকে। বারান্দার রেলিং
ভীষণ ভেংচি কাটে আর চার দেয়াল
নোংরা বমি উগরে দেয় ঘন ঘন।
গা গুলিয়ে আসে আমার।
তৎক্ষণাৎ ঘর ছেড়ে চলে যাবো অন্য কোথাও,
তার জো নেই, পা দুটো যেন কেউ বেজায়
শক্ত করে আটকে দিয়েছে মেঝেতে।
নিরুপায় আমি নিজেকেই খুব ধিক্কার
দিতে থাকি। আমি কি অভিশপ্ত কেউ? নইলে এমন বেহাল
কেন আমার? কত আর নিজের চুল ছিঁড়বো এভাবে?
আচমকা দেখি, সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, উঠছি, উঠছি,
কিন্তু কোথায়? জানা নেই। এখুনি
পা ফসকে নিচে ধুলো আর বিকট কাঁটাময় বিরান অঞ্চলে
অচেতন পড়ে থাকবো কি ক্ষতবিক্ষত শরীরে?
এই তো নিজেকে দেখতে পাচ্ছি পুষ্পময় বাগানে
তিনজন রূপসীর সঙ্গে আলাপরত। আমার
দিকে ওরা ছুড়ে দিচ্ছে অজস্র রক্তগোলাপ। তৎক্ষণাৎ নিজেকে
প্রশ্ন করি- এ কি বাস্তব না কি ছলনাময় মায়াবীর চমক?
হঠাৎ এক লহমায় গলা-ডোবনো কুৎসিত কাদা আমাকে
গ্রাস করছে অট্রহাসিতে মশগুল হয়ে, আমি ডুবছি, ডুবছি, ডুবছি।
দুঃস্বপ্নের জাল থেকে ছিটকে পড়ি সুশান্ত
জমিনে। দেখি, আমার দিকে প্রসারিত দুয়ালু
এক হাত আশ্বাসে ঝলসিত। নিজের
হাত রাখি সে-হাতে। চৌদিকে সঙ্গীত ধ্বনিত
হতে থাকে। প্রসারিত তিরস্করণী হাতে শুশ্রূষায় এখন
আমি সুস্থতায় প্রফুল্ল, সমুদ্র পাড়ি দিতে প্রস্তুত।
১৯-১০-২০০৩
ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে
ভীষণ ঘুরছে মাথা, হাত-পা টলছে, যেন ঢেউয়ে
নৌকা, তবু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, উদ্যম হারালে
চলবে না। আমাদের চোখের সামনে চাঁদটিকে
গিলে খাচ্ছে দূরন্ত খবিশ, শহরের
সবগুলো বাগিচার নানাবিধ ফুল
কীটের সন্ত্রাসে নিমেষেই ঝরে পড়ছে লোলুপ মৃত্তিকায়।
যে-ভাবে কাঁপছে জমি, মনে হয়, নিমেষেই দরদালানের,
কাতার পড়বে ধ্বসে তাসের ধরনে। চেয়ে দ্যাখো,
কেমন নড়ছে সব-গাছগাছড়া এবং খসে
পড়ছে পাখির নীড়। অথচ অদূরে মেতে আছে বেপরোয়া
ক’জন জুয়াড়ি তিন তাসের খেলায়। কালবেলা
কী দ্রুত আসছে ধেয়ে বারবার, তবুও টনক নড়ছে না।
অতিদূর কোথাও কে যেন অতিশয়
নিবিড় করুণ সুর তুলছে বাঁশিতে, সেই সুরে
ভবিষ্যৎ কালের ধ্বংসের পূর্বাভাস সদ্য-বিধবার কান্না
হয়ে ঝরে যাচ্ছে অবিরত। পদতলে বারবার
মাটি কম্পমান আর কোন্ দিক থেকে যেন ঘন
ঘন ভেঙে-পড়া ফ্ল্যাটদের আর্তনাদ ভেসে আসে।
বিপদের কালো মেঘে ছেয়ে যাবে আমাদের সুনীল আকাশ-
কোনও কোনও জ্ঞানী বলেছিলেন আগেই,-
প্রাসাদ, কুটির সবই ভুগর্ভে বিলীন হবে, যদি না মানব
আগেভাগে সুন্দর, কল্যাণ-প্রদর্শিত পথে হেঁটে
মহত্ত্বের সাধনায় মনেপ্রাণে সদা
ব্রতী হয়। হিংসা, দ্বেষ ঘৃণা সৃষ্টি নয় ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে।
পাগলের প্রলাপ এসব, বলে হো-হো হেসে ওঠে
জুয়াড়ির ঝাঁক আর মদিরার স্রোতে ভেসে কোমর দুলিয়ে
রাম্ভা সাম্ভা নেচে নিজেদের সমাজ সংসার মিছে সব ভেবে,
আপদ বিপদ ভুলে বস্তুত আপনকার পকেট হাতড়ে
শূন্যতাকে পেয়ে দিব্যি ঢলে পড়ে ইয়ারের কাঁধে আর হিন্দি
ফিল্মের চটুল সুর টেনে আনে জিভের ডগায়।
ওদিকে ক্ষুধার্ত জমি খাদ্য চাই বলে ভয়ানক গর্জে ওঠে
চৌদিকে, পাখিরা নীড় ছেড়ে অতিদূর আসমানে উড়ে যায়।
১০-০৯-০২
নক্ষত্রের মানব কলোনি
পা হড়কে পড়তে পড়তে কোনওমতে নিজেকে
সামলে নিই এই গা-ছমছমে অমাবস্যা-রাতে। মনে
হলো, কে যেন পিছন থেকে
আচনকা ধাক্কা দিলো, অথচ
পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না। সারা
শরীরে ছমছমে অনুভূতি; এ কোথায় চলেছি?
ইচ্ছে হলো, গলা ছেড়ে কাউকে ডাকি, ভীতি
এবং উৎকণ্ঠা গলায় যেন
মুঠো মুঠো শুষ্ক বালি গুঁজে দিলো। এক হাত
দূর থেকে অতিশয় কর্কশ কোনও কণ্ঠস্বর আমাকে
বেয়াড়া চড় বসিয়ে দেয়, ‘কে রে তুই আমাদের এলাকায়
বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছিস? এখুনি দূর হ।
মাছি-মারা কেরানির মতো খুব ভড়কে গিয়ে
লেজ গুটিয়ে তক্ষুনি দিক পরিবর্তন করি। হাঁটতে হাঁটতে
মাথার ঘাম পায়ে লুটিয়ে পৌঁছে যাই
এক হ্রদের কিনারে। নজর কাড়ে হ্রদেরর জলে পা ডুবিয়ে
বসে-থাকা, সব ভুলিয়ে-দেয়া হৃদয় হরণকারী
এক রূপসী, যার সত্তায় অপ্রতিরোধ্য আহ্বান।
আমার বয়সের ধূসরিমা বিস্মৃত হয়ে এগিয়ে যাই
ওর দিকে সম্মোহিত পথিকের ধরনে। আচমকা
বিকট এক আওয়াজ ওকে মুছে ফেলে সেই
দৃশ্য থেকে, যেমন রাগী চিত্রকর ক্যানভাস থেকে নিশ্চিহ্ন
করে তার সৃষ্টি। আশাহত, বিব্রত আমি
হাহাকার হ’য়ে ঘুরতে থাকি সরোবরের চারদিকে। নিমেষে
এক ধরনের উন্মত্ততা আমাকে
দখল ক’রে নেয়। আমি খোরাক হবো হিংস্র বিরানার?
অকস্মাৎ মধ্যরাতে দূর থেকে ভেসে-আসা
বস্তি উজাড়ের বুক-কাঁপানো আর্তনাদ আমাকে
ছিনিয়ে আনে ছেঁড়াখোঁড়া ঘুম থেকে। কেমন
অবাস্তব মনে হয় ঘরের চেয়ার, টেবিল, বুক শেল্ফ, দেয়ালে
সাজানো রবীন্দ্রনাথের ছবি; নিজের অস্তিত্ব প্রতিভাত
পদচারী ছায়ারূপে। হ্রস্ব এক মোমবাতি টেবিলে
গলে গলে পড়ছে। নানা ধরনের ছায়ার কণ্ঠে করুণ কোরাস।
কখনও কখনও ইচ্ছে হয়, ঘরপোড়া দুঃখীদের
বসবাসের জন্যে আকাশ থেকে
ছিঁড়ে আনি অগণিত জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, একটি
বাড়ি নির্মাণ করি নক্ষত্রমালা দিয়ে, নাম রাখি ‘মানব কলোনি’।
যদি ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে আনি আকাশের পুষ্পরাজি,
আসমান করবে না প্রতিবাদ, সুনিশ্চিত জানি।
২২-০১-২০০৩