চলার পথে হেঁটে হেঁটে
চলার পথে হেঁটে হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে গাছের তলায় বসে পড়ি;
ফের এগোবার ইচ্ছাটুকু
পুষে রাখতে ঝিমিয়ে-পড়া মনোভাবে।
আচ্ছা যদি এখন ঝড়ে
কেঁপে ওঠে কোমল জমি, বৃক্ষগুলো
কোন্ ভরসা জাগবে মনে?
থাকব না কি কামড়ে ধরে সোঁদা মাটি?
দিন ফুরোলে সন্ধ্যা নামে,
আঁধায় হয়ে আসে শহর আর পাড়া গাঁ।
এই তো আমার জীবন দ্রুত
যাচ্ছে ডুবে নুড়ির মতো অগাধ জলে!
হঠাৎ মনে ভয় জাগে কি?
কোন্ ক্ষণে যে বুনো পশুর মতো চিন্তা লাফায় এবং
শীতল বুকে মৃত্যু যেন
কালো হাসি ছুড়ে আমায় চেপে ধরে।
২১-১০-২০০৩
ছাড়বো নাকো মধ্যপথে
নিত্য আমি যাচ্ছি ক্ষয়ে,
চোখের আলো নিভে যাওয়ার
ভাবনা শুধু শুভ্র ভোরে, রাত-বিরেতে
প্রবলভাবে দিচ্ছে হানা, উঠছি কেঁপে।
স্বপ্ন দেখার সাধে রোজই
দু’চোখ বুজি, ভেসে বেড়াই মেঘের সঙ্গে,
আড্ডা জুড়ি তারার পাড়ায়,
তবু আমার ঘুম আসে না কোনো মতে।
মধ্যরাতে লেখার খাতা
খুলে বসি, আঁচড় কাটি ইচ্ছে মতো, কিন্তু লেখা
হয় না কিছুই। হতাশ হয়ে লেখনীকে
থামাই এবং বসে থাকি কলম রেখে।
তবে কি এই বৃদ্ধকালে
চাষের জমি বন্ধ্যা হলো? তবে কি, হায়, কাব্য আমায়
ঘেন্না ক’রে ধু-ধু মরুর বুকে হঠাৎ
ফেলে গেলো? অমাবস্যা আমায় ঘিরে ধরলো শেষে?
কিন্তু আমি নিচ্ছি শপথ,
কাব্যলোকের নিঠুর দেবী যতই তার সাধকটিকে
দিক সরিয়ে হেলা ভরে, তবু আমি
কিছুতে এই সুন্দরীকে ছাড়বো নাকো মধ্যপথে।
২৯-১০-২০০৩
ছড়ায় না ঘ্রাণ আন্দোলিত যূথি
ছিলাম আপন মনে, যেমন উড়ন্ত পাখি থাকে
আসমানে। বাতাসের ঢেউ, মনে হয়,
নিয়ে যাবে নক্ষত্রের এলাকায়। চাঁদ
করবে আদর ভেবে যাচ্ছিলাম উড়ে
মেঘের পাড়ায়, অকস্মাৎ মেঘদল
গলে গিয়ে রূপান্তরে বৃষ্টিধারা হয়।
ঝরে, বৃষ্টি ঝরে আমি
ক্রমশ ভিজতে থাকি বৃষ্টির আদরে।
দেখি এক নিঃসঙ্গ যুবক জানালার
শিক ধ’রে বাইরে তাকিয়ে আছে আর
কী গভীর মনোযোগে যেন
করছে মুখস্থ বৃষ্টি ধারা। হয়তোবা চোখে তার
কারো বেদনার্ত মুখচ্ছবি
গভীর উঠেছে ভেসে, বুক জুড়ে নাছোড় ধোঁয়াশা।
মনে পড়ে, একদা আমিও
এমন বাদল দিনে কল্পনায় কারো মুখ বুকে
নিভৃতে ধারণ ক’রে কত না প্রহর
কাটিয়েছি, গড়েছি স্বর্গীয় বাসরের প্রতিচ্ছবি।
দিন তো থাকে না কারো এক ছাঁচে গড়া;
গহন সজল দিন কখন যে রুক্ষ,
ধু-ধু হয়ে যায় আর বুকের ভেতর
হয়তো ছড়ায় না ঘ্রাণ সিক্ত, আন্দোলিত যূথি।
১৫-৬-০৩
জনহীন অনন্য আশ্রমে
শহরের হট্ররোল থেকে দূরে, বহুদূরে জ্যোৎস্নাস্নাত এক
জনহীন অনন্য আশ্রমে মাঝে মাঝে
গানের স্বর্গীয় সুর ধ্বনি প্রতিধ্বনি
হয়ে যেন অমরাবতীকে স্পর্শ করে বার বার।
যখন আবার নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়
আশ্রমের অপরূপ অপরূপ অস্তিত্বে, জ্যোৎস্নায় একজন
দীর্ঘকায় দেবতুল্য পুরুষ করেন পায়চারি ঘাসময়
উঠোনের বুকে, তার শ্বেত শ্মশ্রু আর
মাথার সফেদ চুল কী মোহন নড়ে
নিশীথের রুপালিহাওয়ায় আর মাঝে মাঝে তাকে
গাছের পাতারা নুয়ে প্রণতি জানায়। তিনি
কৃতজ্ঞতাবশত করেন উচ্চারণ সদ্যসৃষ্ট কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
বহু পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় মধ্যরাতে
পৌঁছে যাই সে আশ্রমে একান্ত একাকী। অকস্মাৎ
ডাগর জ্যোৎস্নায় দেখি, একজন ঋষি ঈষৎ সমুখে ঝুঁকে
হাঁটছেন বড় একা। মনে হলো, চিনি তাকে, তবুও কেমন
অন্য কোনো গ্রহের দেবতা বলে ভ্রম হয়। তিনি
অকস্মাৎ তাকান আমার দিকে। একি সত্য? নাকি কালো মিথ্যা!
সত্য, মিথ্যা যা-ই হোক, দৃষ্টি তার আমাকে করেছে
ধন্য, ভেবে যদি নিমেষের জন্যে আনন্দের পেয়ালায়
ক্ষণকাল চুমো খাই, তা হ’লে এ বিশ্বে ক্ষতি কার?
অন্তত আমাকে করবেন ক্ষমা জানি বিশ্বকবি।
১আগস্ট ২০০৩
জ্যোৎস্নামাখা মধ্যরাতে
জ্যোৎস্না-মাখা মধ্যরাতে নিঝুম-পথে
একলা আমি যাচ্ছি হেঁটে।
আগে পিছে দৃষ্টি রাখি, কিন্তু কোনো
আদম কোথাও দেয় না দেখা।
এই যে আমি বিজন পথে বড় একা
খুঁজছি ডেরা একটু শুধু ক্লান্তিকণা মুছে নিতে
কিংবা ঘুমের মেঘে ভেসে জড়িয়ে কোনো
সোহাগিনীর দীপ্ত শরীর উধাও হতে।
হেঁটে হেঁটে পথের ধারে একটি গাছের
কাছে গিয়ে ছায়ার আদর গায়ে মেখে
ঋষির ঢঙে বসে পড়ি। হঠাৎ দেখি, সামনে আমার
দাঁড়ানো এক বাউল হাতে একতারাটা ঝুলিয়ে নিয়ে।
দেখেই তাকে উঠে দাঁড়াই, শ্রদ্ধা জানাই নুইয়ে মাথা।
চেহারা তার চেনা খুব, সাধক তিনি লালন সাঁই-
মাথায় আমার হাত রেখে তার স্নেহ বুলিয়ে,
একটি চোখের আলোয় তিনি দেন ভাসিয়ে পথিকটিকে।
একতারাকে সুর বানিয়ে লালন এক লালনগীতি
গাইতে গাইতে গেলেন মিশে জ্যোৎস্না-ধোওয়া
চক্রবালে। আমি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে থাকি
ধূসর পথে; সাগর মেতে ওঠে মনে, পা চালিয়ে এগিয়ে যাই।
জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্তিরে
জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্তিরে মাটির নিচে নিঃসাড়, নীরব
ঘুমের কুয়াশা শুষে নিয়ে সত্তায় এমন ভাষাহীন
থাকা এত একা বছরের পর বছর সাজে কি
আপনার? কী করে নিলেন মেনে এই
পরিস্থিতি? কেন গর্জে উঠে আসমানি
বাজের মতোই প্রতিবাদে দেননি কাঁপিয়ে ত্রিভূবন?
যখন এ-পথে হেঁটে যায় জনসাধারণ, তারা
কখনো কীভাবে
এখানে এ মাটি আর রোদ-পোড়া ঘাসের তলায়
আছেন গভীর ঘুমে মগ্ন একজন
প্রায় চিহ্নহীন, দীপ্র নাম যার আজো উচ্চারিত দিগ্ধিদিক।
কেউ কেউ ভাবে হয়তো-বা, পরমুহূর্তেই খিস্তিতে বিভোর।
হয়তো-বা প্রায়শই ভুলে থাকে তাকে নানা জন; কোনো কোনো
উপলক্ষে পুস্তকের ধুলোবালি ঝেড়ে ঝুড়ে কিছু
আবৃত্তির অনুষ্ঠানে মাতে। তবে গীতিমালা তার
ফুলের মতোই পরিস্ফুট নিত্য স্মৃতির বাগানে।
ভাগ্যিস গানের ডালি তিনি সাজিয়েছিলেন মেতে
শব্দ আর সুরে নিত্য সৃজনের কুহকী আহ্বানে।
কবি, ক্ষমা করবেন এই অধমকে। যতদিন
আছি নক্ষত্রের নিচে ধুলোবালি গায়ে নিয়ে আর
কবিতার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার সাধনায় মগ্ন,
আপনাকে করবো স্মরণ শ্রদ্ধাভরে। এও জানি
এতে আপনার কণামাত্র কিছু এসে যাবে না কখনো। তবু
কবরের ঘাসগুলো অনুরাগে নড়বে হাওয়ায় পূর্ণিমায়।
২৪-৮-২০০৩