কে একজন ঘরের এক কোণে
কে একজন ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসে আছেন চুপচাপ,
আপাদমস্তক তার খবরের কাগজে তৈরি। আমি ওর
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কাগুজে দুটি চোখ
তাকালো আমার দিকে। বড় নিঃস্পৃহ সেই দৃষ্টি,
যেন কোনও কিছুই কে বিন্দু গুরুত্ব বহন করে না কাগুজে
সেই দৃষ্টির কাছে। কাগজ, কালি আর টেলিপ্রিন্টারের ঘ্রাণ
বাষ্পের মতো ভাসছে সারা ঘরে, মনে হলো ঘর
এবং আমি নিজেও খবরের কাগজে তৈরি।
অথচ আমি, এই আমি সংবাদপত্রে রূপান্তরিত হতে
চাই না কোনও মতে। এই আমার মানবিক সত্তাকে
বজায় রাখার জন্যেই তো আমার সাধনা। সংবাদের
গুরুত্বকে এতটুকু খাটো ক’রে দেখছি না, খবরের
সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দুনিয়াসুদ্ধ লোকেরই কাম্য। সংবাদপত্র
সভ্যতারই অব্দান। তবু আমার অবয়ব, আমার চোখমুখ
সংবাদপত্রে রূপান্তরিত হোক, এ আমার কাম্য নয়। এমন
পরিণতির আগে আমি আত্মহনের লিপ্ত হবো।
সভ্যতার কসম, আমি ফুলের সুরভি, নদীর ঢেউয়ে জ্যোৎস্নার
চাঞ্চল্য, মায়ের কোলে শিশুর হাসি, নারীর রূপ, কবিতার
হরেক রকম চিত্রকল্প, ফসলের ঢেউ ভালবাসি, প্রিয়তমার
ভালবাসার খবরও চাই, কিন্তু খবরের কাগজ হতে চাই না, চাই না!
১৫-৩-২০০৩
কোন দুঃস্বপ্ন তাকে
এইতো ক’দিন আগেও তাকে আমার দু’টি চোখ দেখেনি,
অথচ বড় বেশি গভীর দেখেছে
পোড়-খাওয়া অন্তর। আমি ভিড়ঘেরা
তার মৃত্যুশয্যা অথবা নিঃসঙ্গ, নিস্তব্ধ কবর দেখিনি,
কোন দুঃস্বপ্ন তাকে নিয়ে গেলো বড় শীতল,
অন্তহীন অন্ধকারে? কে ওকে
দিয়েছিলো চিরপ্রস্থানের মন্ত্রণা
জীবনের বসন্তকালে? কে সেই অন্তরালের
নির্দয় বিভীষিকা? কোন সেই ছদ্মবেশী দিশারি,
যে মধুর বাক্যের আড়ালে বিধ্বংসী পথ দেখিয়ে চলে?
কবিতার প্রেম তাকে চালনা করেছে
সুন্দরের পথে, আরো ভিন্ন পথে। কখনো
কোনো পথ মোহন রূপে বড় নিকটে
নিয়ে গেছে, কখনো অমৃতের পাত্রের ছলে দু’হাতে
দিয়েছে তুলে গরলের গ্লাস। সোৎসাহে
করেছে পান বিশ্বসের কাঁধে কাঁধ রেখে!
যে কবিতার খাতা সযত্নে রাখতো সে দেরাজে,
যার পাতাগুলো এখন দিনরাত করবে
মাতম রূপময় শব্দাবলীর অভাবে, বড় মলিন
হতে থাকবে ধুলোয়। কারো চোখ কি অশ্রুসজল
হয়ে উঠবে দেখে পুরোনো
পঙ্ক্তিমালা, কবিতার খসড়া আর অনেক পাতার শূন্যতা?
উপমা, উৎপ্রেক্ষা অথবা অন্ত্যমিল, কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে
উদ্বেগ কিংবা সংসারের বিবেচনা-কিছুই
করবে না আর বিচলিত তাকে। সে কি এখন
উড়ছে মেঘে নাকি জনহীন, জ্যোৎস্নাশোভিত
অনন্য হ্রদে কাটছে সাঁতার? তার পায়ের
ছন্দে উড়ছে মুক্তপ্রতিম জলকণা-কেউ কি ভাববে?
কোন্ কালবেলায়
ইট, পাথর, লোহা, সিমেন্ট, সিমেন্ট, লোহা,
পাথার, ইট ডানে বামে
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ সব দিকে
চেপে বসেছে। গাছ-গাছালির বুকে ইট, পাথর, লোহা
জেঁকে বসেছে আর সহজে সবুজ পাতা
কিংবা ফুল চোখে পড়ছে না কারও। কোকিল
গান গাওয়ার মতো ঠাঁই পাচ্ছে না কোথাও, ঘরে ঘরে
শিশুরা বড় বেশি ধুঁকছে শ্বাসকষ্টে।
মানুষের সাধের তৈরি মেকি, ঠুনকো সভ্যতার
তর্জন গর্জনে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে
নাগরিকদের। নিজেদের কীর্তির
বড়াই তাদের পাঁড়মাতাল ক’রে তুলেছে; অনেকে
আমাকে গাড়ল ভেবে ড্রইংরুমের জম্পেশ
আড্ডায় ভাবনায় ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছেন।
এমনও হতে পারে, অনুমান করি, আমার
কথাবার্তা শুনে অনেকে মনে মনে
আমাকে পাগলা গারদে ঠেলে দেয়ার
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মানব মানবীর কথা না ব’লে
আমি কেন কোয়েল, দোয়েল, গাছগাছালি, ফুল, টিয়া,
বুলবুল, ময়ূর ময়ূরী, চড়ই- এদের দিকে
থাকি মনোযোগী। এদের প্রতি যত্নবান না হ’লে
হয়তো দরদালান থাকবে, কিন্তু মানুষ থাকবে না।
অমনোযোগের এই মহামারী কায়েম থাকলে
সর্বনাশ আমাদের করবে গ্রাস। ফুল, পাখি, উদ্ভিদ-
এদের অভিশাপে হয়তো আচানক একদিন
আমাদের উপর হিংস্র পশুর মতোই
ঝাঁপিয়ে পড়বে রুদ্রমূর্তি প্রকৃতি। চতুর্দিকে
পড়ে থাকবে বহুতল সব দালানের ধ্বংসস্তূপ। সর্বনাশ
ড্রাগনের মতো মহানন্দে কাঁটাময় লেজ নাড়বে
জনহীনতায়। কে জানে কখন কোন্ কালবেলায়?
১৬-৩-২০০৩
কোন্ দিকে আজ
(শাহমান মৈশান প্রিয়বরেষু)
কোন্দিকে আজ পা বাড়াবো?
পথ যে বড় উঁচু-নিচু, পিছল খুব।
তাছাড়া এই পথের বাঁকে
ঝোপে ঝাড়ে হিংস্র কিছু পশু থাকে;
সুযোগ বুঝে পথচারীর ঘাড়ে হঠাৎ
লাফিয়ে পড়ে। শরীরটিকে জখম ক’রে
মাংস ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে।
ঝোপে রক্ত লেগে থাকে।
আচ্ছা, যদি পথ মিশে যায় দূর আকাশে,
তখন আমি পারবো কি সেই পথটি বেয়ে
নীল আকাশে পৌঁছে যেতে?
পৌঁছে গেলে চাঁদের মুখে খাবো চুমো,
হাঁটবো সুখে ঝলমলে ঐ
তারার মেলায়, কুড়িয়ে নেবো রত্ন কিছু।
কিন্তু আমি নিজেই মাটির ঘ্রাণে মুগ্ধ হতে খুবই
ভালোবাসি। গাছের সারি, নদী এবং
নীল আকাশে পাখির মালা সকল সময় দেখতে চাই।
এই যে আমার দেয়াল-ভরা বইয়ের সারি,
লেখার ছোট্র টেবিলখানা, পুরোনো এক
চেয়ার সবই আজো আমার প্রিয় খুবই।
কোথায় যাবো সন্ধেবেলা, আঁধার ঘিরে
ধরছে আমায় এবং একটি কালো পাখি আমার দিকে
আসছে ধেয়ে লালচে চোখের ধমক নিয়ে
আসছে আমার লেখার কলম কেড়ে নিতে।
২০-১০-২০০৩
কয়েকটি শকুনের হতাশা
লোকটা তৃষ্ণার্ত খুব, এদিক সেদিক হন্যে হয়ে
ঘুরছে, তাকাচ্ছে চারদিকে, যদি কোনো
জলাশয় চোখে পড়ে যায়। ধু-ধু, শুধু
ধু-ধু সব দিক; হায়, তৃষ্ণায় বিশুষ্ক বুক ফেটে যাবে না তো!
আচানক সেই লোক পড়ে যায় একটি গাছের
নিচে এসে, মুখের বিশুষ্ক কষ বেয়ে
কিছু ফেনা খানিক স্ফুরিত হয়, লোকটার চোখ
দুটো বোজা। মৃত্যু কি ভীষণ লোভে অতিদ্রুত
চেটে নিচ্ছে তার পরমায়ু? কয়েকটি লাল
পিঁপড়ে সারি বেঁধে মৃতপ্রায় লোকটির শরীরে উঠছে।
প্রাত্যহিক রীতি অনুসারে এই ব্যক্তি ভোরবেলা ঠিক
শয্যাত্যাগ করেছিলো, দাঁত মাজা, হাত-মুখ ধোওয়া,
কবোষ্ণ চায়ের পেয়ালায় মুখ রাখা, সংবাদপত্রের পাতা
ওল্টানো, খবরে ডুবে থাকা কিছুক্ষণ-সবই তার
চলছিলো প্রথামতো। তাকালো সে নীল আসমানে,
অতঃপর আচমকা কী-যে হলো, লোকটা বেরিয়ে গেলো একা।
যাত্রা ছিলো তার কোন দিকে, নিজেই সে
জানতো না, হেঁটে গেছে, হেঁটে গেছে শুধু
হেঁটে গেছে একাকীত্বে ডুবে-থাকা, বেপরোয়া কিংবা
সব কিছুকেই তুড়ি মেরে ওড়ানোপ্রবণ একজন,
নাকি ধ্বংসলীলা চেখে দেখার মতোই
একরোখা, বেয়াড়া পুরুষ।
সূর্য মধ্যাকাশ ছেড়ে নেমে আসতেই নড়ে ওঠে
লোকটার নিস্তেজ শরীর, কয়েকটি
শকুন কাছেই ছিলো বসে আহারের প্রতীক্ষায়। তবে
নিস্তেজ মানুষটির নড়াচড়া দেখে
কিয়দ্দূরে উড়ে গিয়ে গাছের শাখায় বসে, যেন
হতাশা ওদের কিছু ম্লান করেছিলো লোকটির মৃদু জাগরণে।
০৩-১১-২০০৩