একটি বাগান, তিনটি কোকিল
হঠাৎ আমাকে মধ্যরাতের সুনসান পথ গূঢ় ইশারায়
ডেকে নিয়ে যায়। কী ক’রে যে আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে
নেমে এসে এই খাঁখাঁ রাস্তায় হেঁটে যেতে শুরু করলাম ভেবে
পাইনি মোটেই। হেঁটে যেতে-যেতে দূরে দেখি একি
বড় ঝুঁকে-থাকা একটি বৃক্ষ মাথা নেড়ে কাকে
স্বাগত জানায়। আমি নই সেই শ্রদ্ধেয় জন, নিশ্চিত জানি।
তবে কাকে এই গূঢ় নিবেদন? কোন সে মানব
অথবা মানবী, বলবে কি কেউ? বাঁ দিকে তাকিয়ে
দেখি একজন বেখাপ্পা লোক রয়েছে দাঁড়িয়ে
শীর্ণ শরীরে জড়িয়ে জীর্ণ ধূসর চাদর। চোখ দুটো তার
জ্বলজ্বলে তারা, ঘাড়-বেয়ে-নানা তুমুল কেশর। কাঁধে তার এক
নীরব কোকিল যেন-বা স্থাপিত। লোকটার চোখ পুষ্প ঝরায়।
হঠাৎ রাতের নীরবতা চিরে কাঁধের কোকিল
গান গেয়ে ওঠে। বেখাপ্পা লোক দু’হাতে দূরের
তারার বাজনা বাজিয়ে নাচের ছন্দে দুলতে
দুলতে চকিতে আকাশের নীল ছড়ায় বাতাসে। স্বপ্নের ঘোর
ছেয়ে যায় কবি, ঘুমন্ত দু’টি ভিখিরির চোখ কখন যে কার
ঘরে মৃত্যুর থাবা হানা দেবে, জানা নেই কারো।
এখনো লোকটা নেচেই চলেছে, হঠাৎ কোকিল তার কাঁধ ছেড়ে
উড়ে যায় দূরে ধু-ধু অজানায়। লোকটার হাত
ছুঁড়ে দেয় তারা ডানে বামে আর আখেরে হঠাৎ
নিজেই সে ঘুরে পড়ে যায় দূরে। নিষ্প্রাণ তার
শরীর লুটোয় শুষ্ক মাটিতে, সেখানে চকিতে গড়ে ওঠে এক
ফুলের বাগান, গান গেয়ে যায় তিনটি কোকিল।
৯-১১-২০০৩
এত পথ পেরুনোর পর
এত পথ পেরুনোর পর যদি মোটরকার বিগড়ে যায়, তাহ’লে
মাথায় হাত দিয়ে ব’সে পড়া ছাড়া
উপায় কী? মাথা চাপড়ে
বিলাপ করলেই সমস্যার হিল্লে হবে, এমনও তো নয়। পেছনে
প’ড়ে থেকে যে কোনও ফায়দা নেই, এই সহজ
সত্যটি উপলব্ধি করতে খুব বেশি দেরি হয়নি আমার।
চলেছি জংলি পথে বড় একা, মাথা তুলে
আকাশের দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো কুষ্ঠ রোগীর
মুখের মতো চাঁদ। তবু সান্ত্বনা খুঁজে পাই খানিক,
হাঁটি, হেঁটে চলি। মাঝে মাঝে নিজের
অজান্তেই কেঁপে উঠি জ্বরাক্রান্ত রোগীর মতো। মনে হয়,
পেছন থেকে কে যেন
অনুসরণ করছে আমাকে। বড় কষ্টে নিজেকে
বিরত রাখি ঘুরে দাঁড়ানোর স্পৃহা থেকে।
হঠাৎ তারার ফুলঝুরি আমাকে ঘিরে ধরে
চৌদিক থেকে। আশ্চর্য অনুরণন
আমার সত্তায়; নিজেকে কেন জানি পুরাকালের
কোনও গ্রীক দেবতার মতো মনে হয়, যেন এখুনি
আকাশ থেকে আমার উপর বর্ষিত হবে স্বর্গীয়
পুষ্পবৃষ্টি। অথচ আমি স্বদেশের সোঁদা মাটিতেই রয়েছি।
হাঁটছি, ক্রমাগত হেঁটে চলেছি অথচ কিছুতে
পুরোচ্ছে না পথ। যেন এই বন সুদৃঢ়
আটকে রেখেছে সবদিক থেকে পথটিকে। কিছুতে
শেষ হওয়ার নয় এর পরিধি। আমি আর ধূলিঝড়ে কত ঘুরবো?
২১-৩-২০০৩
কখন থেকে এলোমেলো
কখন থেকে এলোমেলো
ঘুরছি শুধু বড় একা,
কখনো পথ সোজা বটে,
কখনো ফের আঁকাবাঁকা।
গায়ে কাঁটা দেয়ার মতো অনেক কিছু
ভেংচি কাটে।
ঘুরছি শুধু, লাটিম যেন দিগ্বিদিক।
কে যেন ঠিক ছায়ার মতো পেছনে এই
হতভাগার হেঁটে বেড়ায়,
থামে, যখন আমি থামি।
পদ্য লিখি বলেই এমন দশা আমার?
ঘুম আসে না রাত্রিবেলা,
দিনের বেলা। মনের মাঠে
যখন তখন ছুটে বেড়ায় পাগলা ঘোড়া।
কখনো ফের সন্ধেবেলা
হঠাৎ দেখি অনেক দূরে
পুকুরঘাটে রূপ-ঝরানো
কে এক নারী বসে আছে
পা ভিজিয়ে শীতল জলে। আমার দিকে
ডাগর চোখে দৃষ্টি দিতেই
কেমন আমি অতীত যুগের
মূর্তি হয়ে অনড় থাকি সারাবেলা
হঠাৎ দেখি, একি কোথায়
গায়েব হলো পুকুর ঘাটের সেই রূপসী?
পুকুর উধাও, একলা আমি
পদ্য লেখার খাতায় মাথা গুঁজে ঘুমের
আবছা ছায়ায় পড়ে আছি!
পুকুর ঘাটে
দেখা নারীর মুখে মায়া
কী করে এই একটুকুতেই ভুলতে পারি?
১৮-৬-২০০৩
কবিতার একটি পঙ্ক্তির সন্ধানে
বেশ কিছুদিন থেকে আমার কলম আলস্যে
মজে রয়েছে। আকাশ পাতাল কতবার যে এক করেছি,
মাথার চুল টেনে ধরেছি বারবার, তাকিয়ে রয়েছি
জানালার বাইরে কবিতার একটি পঙ্ক্তির সন্ধানে।
শুধু ধু-ধু বালি ওড়ে চৌদিকে; চাপা পড়ে যাই বেজায়
খরার থাবার নিচে। নিজেকে ভীষণ অনাবশ্যক মনে হয়।
লেখার টেবিল, টেবিলে গচ্ছিত কতিপয় জরুরি,
অপরিহার্য বই, লেখার সরঞ্জাম আমার দিকে করুণা
ছড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। হয়তো-বা আমার
ব্যর্থতা এতই ব্যথার্ত করে ওদের যে, তাদের চোখ ফেটে
অশ্রু ঝরার উপক্রম। আমি অসহায় একাকী
বসে থাকি নিষ্ফলা ক্ষেতের মতো, আমাকে গ্রেপ্তার করে হতাশা।
এমন তো নয় আমার কবিতা প্রত্যাখ্যাত এখন
পাঠকসমাজে। এমন তো নয় জাঁদরেল সমালোচক কেউ
আমার পদাবলী দেখে নাক সিঁটকোন, তবে কেন কবিতা
হেলায় আমাকে ত্যাগ করবে গোধূলি বেলায়?
সম্প্রতি অভীষ্ট শব্দাবলী খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খাই বড়,
হাতড়ে-পাওয়া শব্দ হারিয়ে যায় অন্ধকারে বেখবর,
পাই না সন্ধান ক’রে কিছুতেই। স্মৃতি খুব বিভ্রান্ত করে ইদানীং,
এমনকি নিজের পাড়ার নামসুদ্ধ ভুলে যাই, সেই নাম জানার
উৎকণ্ঠায় অন্যদের কাছে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা মেলে ধরি। তবে কি
উন্মাদ হয়ে চলেছি? না কি স্মৃতিহীন, কবিতাছুট হয়ে থাকবো!
১৪-৩-২০০৩
কে এক পাখি আমার খুব কাছে এসে
বুঝতে পারছি না, কোথায় এই গা-এ কাঁটা –দেয়া আন্ধারে
ওরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। না, আমি তো এখনও
নিষ্প্রাণ নই, এখনও আমার হৃৎপিণ্ড
ধুকধুক করছে। নিজের শরীরে চিমটি কাটলে
টের পাবো না, এমন তো নয়।আমাকে
ওরা কি কাঁটাময় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়ে চলেছে কোথাও?
হাত ছুঁয়ে টের পাচ্ছি, পুরো হাত, গলা, বুক, মুখও
খুব ভেজা, রক্তের গন্ধ বেজায়
উত্যক্ত করছে আমাকে। ওরা যে চাবুক কষে
মেরেছিলো সারা গায়ে, সেই উৎপীড়নেই
আমার শরীরের, বলা যেতে পারে,
অসহায় অস্তিত্বের বটে, তবে তিল তিল ক’রে ক্ষইয়ে
আমার জীবনকে ছেঁড়া, ছিনভিন্ন ন্যাকড়া বানিয়ে ছাড়বে।
ক’দিন পর প্রায় জাদুবলে যেন বন্দিদশা থেকে
মুক্তির উন্মুক্ত উপত্যকায় পৌঁছে যাই। নিমেষে
আমার শরীর থেকে রক্তধারার নাছোড় দাগ
গায়েব। কেমন ফুরফুরে আমেজ
আমার দেহমনে। অথচ প্রকৃত আশ্রয় নেয়ার মতো
গাছপালা আর জলাশয় আর ভব্য জনগণময়
জায়গা তো দৃষ্টিগোচর নয় এখনও। হাঁটছি, হাঁটছি, হাঁটছি;
তবে কি ক্লান্তির কুয়াশায় ডুবে ঘুমিয়ে পড়বো আখেরে?
কে এক পাখি আমার খুব কাছে এসে মানবিক
কণ্ঠস্বরে বলে, ‘হে পথিক, এখনই যাত্রা থামিও না।
যাও, এগিয়ে যাও। ভয়কে জয় ক’রে, সকল
বাধা, বিপদ ডিঙিয়ে , হতাশা মুছে ফেলে যাও, এগিয়ে যাও।
২১-৩-২০০৩