অসহায় পঙ্ক্তিমালা
অবসন্ন কবি কি নিঝুম বসে ছিলো নিজ ঘরে এক কোণে
বেতের চেয়ারে মধ্যরাতে। আচানক
কে কবিকে চটকানা মারলো নিশীথে? হুড়মুড়ে
শব্দ কী দাপট
দেখায় চৌদিকে! আসমান যেন অনেক নিচুতে
নেমে এসে ভেঙচি কাটে। রাতজাগা শায়ের পড়ন্ত
তারাদের লুফে নিতে হাতের তালুতে
বেজায় তৎপর হয়। অন্তরালে ক্ষুধার্ত ইঁদুর
কবির সাধের পাণ্ডুলিপি চেটেপুটে খেতে থাকে। পাণ্ডুলিপি
নিমেষে মিলায় শূন্যে, কবি করতলে নক্ষত্রের মালা নাড়ে!
উদাসীন শায়েরর দৃষ্টি শুধু ক্ষ্যাপা আসমানে
সেঁটে থাকে বহুক্ষণ, যেন মুখস্থ করছে সব
খুঁটিনাটি প্রতিক্রিয়া নক্ষত্র এবং
ভীষণ পীড়িত চন্দ্রমার। এ কেমন
গজব পড়ছে চতুর্দিকে বহুকাল ধরে, ভেবে
অতল বিষাদে ডোবে কবি হাহাকার বুকে নিয়ে!
কে যেন প্রবল ঠেলে দিতে থাকে তাকে বড় কণ্টকিত পথে
এ গহন রাতে। মেঘ চিরে ফুঁড়ে খাপছাড়া এক
মুখ করে উচ্চারণ, ‘জনহীন পথে একা হেঁটে যাওয়া ছাড়া তোর
মুক্তি নেই। অন্তরাল থেকে কেউ নাড়ছে নাছোড়
কলকাঠি-‘চল মুসাফির, এই পথে চল’ বাক্য
হতবাক শায়েরের একান্ত পরিচালক যেন।
ধীরে হেঁটে যেতে যেতে বহুদূর শায়ের নিজেকে পেয়ে যায়
বিয়াবান এক
এলাকায়; ‘এসো, এসো’ ব’লে কারা তাকে
কাছে টানে, অথচ সেখানে থমথমে
জনহীন স্তব্ধতাই উটের ধরনে
বাড়িয়ে রয়েছে গলা। স্পন্দমান প্রাণীর অস্তিত্ব নেই কোনো।
অকস্মাৎ শায়ের নিজেকে মানবরূপী অন্ধ পশুদের
দঙ্গলে ভীষণ একা দেখে নিমেষেই
বড় হিম হয়ে যায়। আসমানে ভাঙাচোরা চাঁদ
বাঁকা হাসি হেসে ভীত কবির পুরোনো এক
কবিতার কতিপয় পঙ্ক্তি ছুঁড়ে দেয় নিচে-
অসহায় পঙ্ক্তিমালা কী বিধুর ধুলোয় গড়ায়।
২৩-৫-২০০৩
আমার কলমটিকে বেশ কিছুদিন
আমার কলমটিকে বেশ কিছুদিন টেবিলের
এক কোণে অন্ধকারে ফেলে
রেখে প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম বস্তুত। ওর গায়ে
কিছু ধুলো জমেছিল স্পর্শহীনতায়।
কী ক’রে ছিলাম এতদিন ওকে একটুও না ছুঁয়ে?
কী ক’রে সম্ভব হলো আমার এ আচরণ, ভেবে
আজ এই গোধূলিতে কেমন বিপন্ন,
অসহায় মনে হয়। আমি তো নিজেরই কাছে অচেনা এখন।
এখন আমার বন্ধ্যা মনের প্রান্তরে অকস্মাৎ
কতিপয় পুষ্পময় হাওয়ার-দোলানো
ছোট গাছ যেন বা আনন্দে আত্মহারা,
গানে মশগুল, আমি অন্য কেউ হয়ে গানে মিশে যাই।
তাহ’লে কি আমার কলম অভিমান-মুক্ত হয়ে
এই ডান হাতের পাঁচটি আঙুলকে
বন্ধ্যাত্বের খরাত্বকে অপরূপ জলসেচে ফের
নতুন ফসলে ধনী করবে এমন অবেলায়?
কলম, তুমি তো ঢের পথ পেরিয়ে এসেছো
এতদিনে, কখনো সখনো
খেয়েছো হোঁচট খুব, শক্র শিবিরের বাঁকা দৃষ্টি,
মশকরা করেছে তোমাকে বিদ্ধ, তবু আজো ছাড়ি নি তোমাকে।
যে যা-ই বলুক, যত অবহেলা আমার সত্তাকে
ছিন্নভিন্ন করুক নিয়ত, তবু আমি
সন্তের মতোই এই কাগজের পাতায় পাতায়, যতদিন
বেঁচে আছি, শব্দের মিছিল ভালোবেসে সাজাবোই।
এই তো এখন এই গোধূলিতে কতিপয় শব্দ এসে
আমার নিষ্ক্রিয় কলমকে
কল্পনা এবং বাস্তবের মিলনকে অর্থময় করে
তোলার তাগিদে বড় ব্যাকুল হয়েছে বেশ কিছুকাল পর।
১৬-৭-২০০৩
আসমানে উড়বে পায়রা
পুতুলের মতো
ফুটফুটে, ছোট মেয়েটির কথা ছিল
সুন্দর খেলনা নিয়ে ঘরের ভেতর
খেলায় নিমগ্ন থাকা। অথচ সে পথে
ধুলোবালি আর পাশে মায়ের লাশের
দিকে কান্নাময় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। হন্তারক
বুলেটের সন্ত্রাসে মহিলা নিমেষেই জীবনের
শাখা থেকে পরিপক্ব ফলের মতোই খসেছেন!
কী-যে হবে মাতৃহীন শিশুটির পরিণাম, বলা
মুশকিল। ভয়াবহ যুদ্ধপীড়িত সময়ে এই
পিতৃমাতৃহীন বালিকার ভবিষ্যৎ ঠিক কোন রূপ নেবে
এ প্রশ্নের জবাব এখন পাওয়া যাবে কার কাছে?
উড়োজাহাজের
গর্ভ কিংবা ট্যাঙ্কবাহী কামানের গলা
সোৎসাহে উগরে দেয় মৃত্যুময় গোলা।
নিমেষেই মাটি গিলে খায় কত তরতাজা প্রাণ!
সেই সব অগ্নিকুণ্ড জানে না, বোঝে না প্রতিপক্ষ
খৃস্টান, মুসলমান নাকি
অন্য কোনও ধর্মীয় বিশ্বাসে নিবেদিত-
মৃত্যুর মুহূর্তে কেউ জানে না কোথায় তার লাশ পাবে ঠাঁই।
এই দুনিয়ায়
ন্যায়ের নেই কি কোনও বিজয়ের আশা?
‘আছে, আছে’ ব’লে ধূমায়িত মেঘ থেকে
কে পাখি আশার সুরে গান গেয়ে যায়।
একদিন বাগদাদ, বসরার গুলবাগ থেকে
হবে দূর অশুভের ছায়া, মানব মানবী ফের
সাজাবে সংসার ভালোবেসে প্রশান্তির ছায়াতলে;
আসমানে উড়বে পায়রা শত শত উৎসবের দীপ্ত তালে।
৬-৪-২০০৩
আসমানে শারদীয় চাঁদ
কারো সাতেপাঁচে নাক গলাবার প্রবণতা
আদপে গায়েব ছিলো। নিজের মামুলি
গণ্ডির ভেতরে বিচরণে
কাটিয়েছি দিন, মাস এবং বছর।
যদিও নিজেকে মাঝে মাঝে
ভাসিয়ে দিয়েছি মেঘে এবং উড়েছি
বিচিত্র রঙের পাখিদের পেছনে এবং হাত
বাড়িয়ে ধরার ফাঁদ গড়তে চেয়েছি।
সাফল্য জোটেনি, তবু খেলার নেশায় প্রতিবার
পরাজয় মেনে নিয়ে আনন্দের গুঁড়ো
কুড়িয়েছি এদিক সেদিক। ঝকঝকে ভবিষ্যের
আশায় অনেক হেঁটে অন্ধকারে এবড়ো-খেবড়ো
কত পথে খেয়েছি কামড় ঢের পোকা-মাকড়ের;
তবুও জীইয়ে রেখে স্বপ্ন হাত দিয়েছি বাড়িয়ে।
কারা যে আমাকে আচানক এক কবন্ধ গুহায়
ঠেলে দিলো অমাবস্যা রাতে,
ঠাওর করার কোনো সুযোগ পাইনি
কিছুতেই। আঁধার যে এরকম ভীষণ ভঙ্গিতে
কামড়ে ধরতে পারে, ধারণা ছিলো না
কোনো দিন। অন্ধকার এ প্রকার হিংস্রতা পেয়েছে কোন দেশে?
মাংস ছিঁড়ে খাবে নাকি এই বিরানায়? হায়,
আমি কি অদৃশ্য হয়ে যাবো
সাততাড়াতাড়ি আঁধারের নিপীড়নে? অকস্মাৎ
ভয়ানক হাসির আওয়াজ
গুহাকে কাঁপিয়ে তোলে। কে জানে কোত্থেকে
এক অর্ধ মানব এবং অর্ধ পশু গুহায় লাফিয়ে পড়ে।
আমার শিরায় রক্তধারা তুষারের মতো জমে
আমাকে মৃত্যুর খুব কাছে অতি দ্রুত
নিয়ে যেতে থাকে। আমি প্রায় হাল ছেয়ে
চোখ বুজে ফেলি। কী-যে হলো, আচমকা
বিকট শব্দের এক ধমকে গুহায় পুরো মাথা উড়ে গিয়ে
জেগে ওঠে গুহার জ্বলজ্বলে আসমানে শারদীয় চাঁদ
অপরূপ হাসি তার ছড়িয়ে চৌদিকে
আমাকে অভিবাদন জানিয়ে প্রফুল্ল অতিশয়।
১৪-৯-২০০৩