সত্যি কি গিয়েছিলাম
আচানক ডাগর চাঁদ জ্বরতপ্ত রোগীর মতো
কাঁপতে থাকে, নক্ষত্রমালা ঢাকার মধ্যরাতের ঘুমন্ত
বাড়িগুলোর ছাদে, সকল চৌরাস্তার
মোড়ে, অলিতেগলিতে, ময়দানের বুকে
থুবড়ে পড়ছে। ঘুম-জড়ানো চোখ দুটো জলদি
মুছতে মুছতে বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই চৌদিকে।
কিসের আহ্বান আমাকে ঘর থেকে সরিয়ে
নিয়ে আসে রাস্তায় আর আমি
নিজের অজান্তেই যেন হাঁটতে থাকি ডান-বাম
না ভেবে অজানা দিকে। হু হু বাতাস
আমাকে ঘিরে ধরে চারদিক থেকে। হঠাৎ
বিদঘুটে এক পাখি আমার কাঁধে এসে বসে পড়ে।
পাখিটিকে হটিয়ে দিতে কেন যেন ইচ্ছে হয় না;
হাঁটতে হাঁটতে সম্মুখে চেয়ে দেখি তিনজন কঙ্কাল
কাঁধে কোদাল ঝুলিয়ে হেঁটে যেন যাচ্ছে কোথায়।
ওদের গোরখোদক হিশেবে শনাক্ত করতে খুব
বেশি কষ্ট হয়নি। তিনজন গোরখোদক অর্থাৎ কঙ্কাল
আমাকে উপেক্ষা করেই যেন চলে যাচ্ছে। ওদের
অট্রহাসি এসে আমার কানে প্রবল ধাক্কা দেয়,-
কাঁপতে থাকি, না থেমে প্রায় অন্ধের ধরনে
এগোতে থাকি, প্রচণ্ড শীত যেন
দখল করে নিয়েছে আমার দেহমন।
নিজেকে দেখতে পাই হু হু শূন্যতায়, খানিক
পরে দৃষ্টিপথে আবছা ভেসে ওঠে একটি
চমকে-দেয়া দৃশ্য। ধোঁয়াশা ফুড়ে বেরিয়ে
এসেছে এক কবরের বাসিন্দা। চোখ-জুড়ানো
তরুণী সে; রূপ ঝরছে যেন কবরে
তার শরীর থেকে। তার সত্তা ইঙ্গিতে আমাকে ডাকছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি কী করি কী করি
ভেবে মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি এবং সে চকিতে
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো নাকি প্রবেশ
করলো আবার মৃত্যু-শীতল কবরে, ঠিক
বোঝা গেলো না। আগে কখনো আসিনি এই কবরের কাছে।
সত্যি কি নিকট অতীতে গিয়েছিলাম সেখানে?
১৬-১০-২০০৩
সাগরতুল্য সবার দিকে
বন্ধু, খানিক দাঁড়াও এই
ঝোপের ধারে। পরে না হয় পা চালিয়ে
যাওয়া যাবে অন্যপথে,
যেখান থেকে আখেরে ঠিক পৌঁছে যাবো
অভীষ্ট সেই সাগরতুল্য সভাস্থলে।
এখানে এক মুক্তিযোদ্ধা চিরনিদ্রা
নিয়েছিলেন আলিঙ্গনে যুদ্ধ ক’রে বিদেশী সব শক্রসেনা
এবং নিজের দেশের কিছু ঘৃণ্য লোকের ঘোর বিরুদ্ধে।
বন্ধু, এমন স্থানে খানিক নত মাথায়
না দাঁড়ালে ভুলের বোঝা বইতে হবে।
ঝোপের পাশে অবহেলায় শুয়ে-থাকা
মুক্তিযোদ্ধা এখনো কি এই এলাকার কিছুলোকের
স্মৃতিতে খুব ঝলসিত? না কি সবাই
অবহেলার আঁস্তাকুড়ে কবর দিয়ে আছে সুখে?
বন্ধু এবং আমি নানা ভাবনা বয়ে নিয়ে
যাচ্ছি হেঁটে অভীষ্ট সেই সাগরতুল্য সভার স্থলে।
যাচ্ছি হেঁটে, সূর্য ডোবার আগেই হেঁটে
যেতে হবে সবার মাঝে মুক্ত মনে, যেতেই হবে।
দেরি করা চলবে না আর,
কোথাও আর থামলে এখন চলবে না ভাই,
সূর্য ডোবার আগেই আশা জাগিয়ে রেখে
চলতে হবে, চল বন্ধু, এগোই চল ভবিষ্যতের খোলা পথে।
১৬-১০-২০০৩
সাতটি কবরে নুয়ে চুমো খায়
দু’তিন মাইল জুড়ে সারাদিন শুধু রোদ্দুরের
তাপ আর গাছপালা, ঘাসহীন ধু-ধু
জ্বালাময় হাহাকার। সেখানে ভুলেও
আসে না গায়ক পাখি কোনো, এমন কি
হাড়গিলা, শকুনও কখনো মাড়ায় না এই পথ। জ্যোৎস্নাময়
রাতে শুধু ভিন্ন শোভা সৃষ্টি হয় ধূসর প্রান্তরের।
প্রান্তরের হৃদয়ের কিছু অঃশ জুড়ে বাতাসের
আদরে সাতটি গাছ দোলে। গাছগুলো
সাতটি কবরে নুয়ে চুমো খায়, নিবেদন করে
শ্রদ্ধা প্রতি রাতে জ্যোৎস্না আর মৃদু বাতাসের সাথে।
কাদের কবর এই সাতটি গাছের নিচে? কেন
প্রকৃতির শ্রদ্ধা ঝরে এ রকম বিয়াবানে? কারা
এই নির্জনতা প্রিয় মানব সন্তান? কী এমন
অনন্য সাধক তারা, যার গুণ গাছপালা, হাওয়া,
জ্যোৎস্না জেনে গেছে? কোথায় নিবাস ছিলো
এই সাতজন মানুষের, কী নাম তাদের কে বলবে আজ?
যতই অজানা থাক সাতটি গাছের
নিচের মাটির কবরের বাসিন্দাদের নাম ধাম,
এই সত্য রোদ, জ্যোৎস্না আর মানবের
কীর্তির মতোই যাকে কখনো যাবে না মোছা, কেননা তারাও
মুক্তিযুদ্ধে শক্রকে তাড়িয়ে মাতৃভূমির কাঙ্ক্ষিত
স্বাধীনতা জ্বলজ্বলে রাখার জন্যেই দিয়েছে নিজ প্রাণ।
১-৯-২০০৩
সৃজনের আভা জেগে থাকে
পেলব গজায় পাতা গাছের শাখায় শব্দহীন, ক্রমান্বয়ে
একে একে বাতাসের বুকে ভেসে ভেসে
অবশেষে পেয়ে যায় ঠাঁই মৃত্তিকার
উদার হৃদয়ে। অন্তরালে সময়ের
কাঁটা ঘোরে অবিরাম। কাঁটার দংশনে কত ক্ষত
জন্ম নেয়, তবুও নিবিড় শুশ্রূষায় সৃজনের আভা জেগে থাকে।
কেউ কি পেছনে খুব ঠেলে দিতে চায় কূট চালে?
চায় কি মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে ফেলতে
কোনও ছলে? নানা ঢঙে কালো কিংবা ধূসর মেঘের
ছলনা খেলায় মেতে ওঠে, অথচ সকল বাধা
ছিঁড়ে ফুঁড়ে ঝকঝকে মুদ্রার মতই জেগে উঠে
ডাগর চাঁদের মুখ রটায় সর্বত্র আজ প্রগাঢ় সংবাদ।
সোনালি টেবিল আর রুপালি চেয়ার
(শহীদ প্রহ্লাদচন্দ্র সাহাকে নিবেদিত)
জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে আসমানে একটি সোনালি
টেবিল এবং চার পাঁচটি রুপালি
চেয়ার মেঘের পর মেঘ পেরিয়ে যাচ্ছিলো। সেই
অপরূপ চেয়ারে ক’জন
তরুণ ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিমায় উপবিষ্ট, অতিশয়
মশগুল বাক্যালাপে। ওরা
জ্যোৎস্না-মদিরায় বুঁদ হয়ে কতিপয়
ফরাসি কবির কবিতার পঙ্ক্তিমালা আওড়ায়।
আজকের কথা নয়। ক্যালেন্ডার থেকে ঢের ঢের
তারিখ-চিহ্নিত পাতা খসে গেছে কত যে বছর আর সেই
আসমানে সোনালি টেবিল-ঘেঁষে-বসা
তরুণেরা যৌবনের আভা-হারানো প্রবীণ আজ-
চৌদিকে ছিটকে-পড়া নক্ষত্রের মতো! ভাসমান টেবিলের,
চেয়ারের ঈষদুষ্ণ স্মৃতি কোনোদিন
চকিতে পড়ে কি মনে যৌবন-হারানো
সেই সব উন্মাতাল আড্ডাপ্রেমীদের? এখন তো
চাঁদ ঘুম-ছড়ানো জ্যোৎস্নার আভা মাখে
বয়সের ধুলোময় কর্কশ জমিনে, তুষারের কণা ওড়ে!
সোনালি টেবিল আর রুপালি চেয়ার এতকাল
পরেও আমার কাছে এসে কী মধুর
কণ্ঠস্বরে কত কথা বলে আর শোনায় কবিতা
নানা ছন্দে করে অনুরোধ
খাতার পাতায় যেন নতুন কবিতা লিখি এই
নিদ্রাহীন মধ্যরাতে বলে, ‘আমরা তো
বিউটি বোর্ডিং-এর স্বপ্নময় প্রহরের মায়া
নিয়ে এই তোমার নিবাসে এসে গেছি, কবি, জাগাতে তোমাকে।
৩০.৬.২০০৩