পরনে সফেদ শাড়ি, মুখে চন্দ্রাভা
সাত বছর ধরে মা আমার দুনিয়াদারির
ঝুটঝামেলায় অনুপস্থিত। মাথা খুঁড়ে
মরলেও তাঁকে আর একটিবারও
দেখতে পাবো না। বড়ই অনুপস্থিত তিনি।
মাঝে মাঝে তার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
ইচ্ছে থাকলেও কখনো কখনো
বড় বেশি দেরি হয়ে যায় জিয়ারত করার
দিন। ধিক্কার দিই নিজেকে গাফেলতির দরুন।
লেখার টেবিলে কলম নিয়ে বসলেই হঠাৎ
মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। এই তো
তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার পাশে,মাথা বুলিয়ে
দিচ্ছেন, তাঁর দোয়ার ঝরনা ঝরছে সন্তানের মাথায়।
এই তো কোনার ঘরে জায়নামাজে
দাঁড়িয়ে, বসে তিনি নিজেকে সমর্পণ ক করতেন
খোদার দরবারে। আজো সেই দৃশ্য
সুস্পষ্ট ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে, বড় সাধ হয়
চুম্বন করি অপরূপ দৃশ্যটিকে। মনে হয়, অদূরে
নক্ষত্ররাজির গোলাকার অপার্থিব আলোয়
মা আমার দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চুপ,
নিবেদিতা, আলোকিত সত্তা। নুয়ে আসে আমার মাথা।
গোরস্তানে গেলেই কী এক নিস্তব্ধতা দখল
করে নেয় আমাকে। একদিন বিকেলে
মায়ের কবরের পাশে বসেছিলাম, হঠাৎ স্তব্ধতা
চিরে জেগে উঠলো কোকিলের ডাক। থেমে থেমে করুণ
সেই ডাক থেকে যেন ঝরছিলো কবোষ্ণ
রক্তের ফোঁটা। আহত কোকিলের সুন্দর
আর্তনাদ গোরস্তানকে অধিকতর নিঝুম
করে তুললো, সেই আর্তস্বরে আমি
আমার মাতৃবিচ্ছেদের বেদনা
কিছুদিন পর যেন নতুন করে অনুভব করলাম।
গোধূলি প্রগাঢ় হ’লে পর আমার পাশে কারো
উপস্থিতি অনুভব করলাম। যেন কেউ আমার
কাঁধে তার কোমল হাত স্থাপন
করলো, বড় চেনা মনে হলো সেই নির্জন
স্পর্শ; ঘুরে তাকাতেই দেখি মা আমার দাঁড়িয়ে
আছেন, পরনে তার সফেদ শাড়ি, মুখে চন্দ্রাভা। কে জানে
এই উপস্থিতি সত্যি নাকি আমার
প্রবল ইচ্ছা-প্রসূত দৃশ্যেরই অপরূপ বিভ্রম?
১-১১-২০০৩
পাথর-শাসানো পথ হেঁটে
তবে কি এখনো এত কাঁটাময়, পাথর-শাসানো
পথ হেঁটে আসার পরেও
আমাকে এমন চোখ-রাঙানি এবং রকমারি
শাস্তি ভোগ ক’রে যেতে হবে ক্রমাগত?
একদা আমার ঠোঁটে সহজে আসতো
নেমে নানা সুগন্ধি ফুলের ওষ্ঠ আর
কোকিল উঠতো ডেকে সকল ঋতুতে
আমার অনেক কাছে, এখন নীরব ওরা বহুকাল থেকে!
এখন আমার ঠোঁট বড়ই বিশুষ্ক, ফেটে গেছে
খরার তাণ্ডবে আর পা দুটো ক্ষতের দংশনে
বস্তুত অচল প্রায়। তবুও আমাকে
কাঁটাময়, পাথর-শাসানো পথ আর কত পাড়ি
দিতে হবে, জানা নেই। আমি তো ভীষণ
ক্লান্ত আজ, কত সঙ্গী ইতিমধ্যে হন্তারক ছোবলে নিশ্চিহ্ন!
আমি আর কতকাল রক্ত ঝরাতে ঝরাতে, খুব
খোঁড়াতে খোঁড়াতে এই বহুরূপী শক্রর মিছিল
দেখে যাবো? আর কতবার এই তুমুল আসরে
তুখোড় কপট সখাদের থিয়েটারি রঙবাজি দেখে যাবো?
হঠাৎ দুপুরবেলা অদূরে একটি হ্রদ চোখে
পড়ে যায়। হ্রদের কিনারে
পৌঁছে জলে নিজের মুখের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে উঠি। এ কোন্ অচেনা লোক যাকে
কখনো দেখিনি আগে? আমি কি আমার
গতায়ু সত্তাকে এই জলাশয়ে দেখছি? আমি কি মৃত তবে?
হ্রদের শীতল জলে মুখ ধুয়ে গাছের ছায়ায়
শান্তির আস্বাদ কিছু পেতে চাই। জানি
এ প্রয়াস বস্তুত ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কোনো কিছু
হতেই পারে না। সূর্য তাপ অনেকটা কমানোর
পরে ফের পথ ধরি, পঙ্গুর ধরনে হেঁটে হেঁটে
এগোই অজানা গন্তব্যের দিকে, পরিণাম যা হোক তা হোক।
৪-৮-২০০৩
বলো কোন আস্তানায় যাবো?
আমার আপনকার কণ্ঠস্বর কখনও সখনও
বড়ই অচেনা লাগে নিজেরই নিকট,
যখন দেয়ালে কিংবা আকাশের দিকে
তাকিয়ে কীসব এলেবেলে কথা বলি
বুঝিবা নিজেরই সঙ্গে। সে-সব অদ্ভুত কথা নিজেও বুঝি না
কখনও সখনও, যেন অন্য কেউ বলে যায় আমার মাধ্যমে।
এই ঢাকা, প্রিয়তম শহর আমার, একে মন
দিয়েছি বিলিয়ে অকৃপণ
দাতার ধরনে, এ শহর কত না মধুর স্মৃতি
এঁকেছে প্রাণের পটে, কেউ কি রেখেছে
হিসেব কখনও তার? কত না ঘুরেছে দিনরাত
উদ্ভ্রান্ত তরুণ কবি অলিতে গলিতে, রাজপথে! তার কাছে
বাগানের ফুল, গাছপালা, মনে হতো,
হয়েছে মাতাল যেন নিজেদেরই ঘ্রাণে।
বার্ধক্যের জীর্ণ ঘাটে পৌঁছে কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
ভাবে, প্রশ্ন করে নিজেকেই-জীবন কি মরীচিকা শেষ তক?
থাকা না-থাকার ধাঁধা কোনও? এই যে টেবিলে ঝুঁকে
এত কালো শব্দের ভরা হলো সাদা পাতা
দিবানিদ্রা ত্যাগ করে, রাত জেগে বছরের পর
বছর কাটিয়ে, বলো আখেরে কী তার পরিণতি?
অনন্যা রূপসী এক নিঠুরাই মায়াবী সঙ্কেতে প্রায়শই
ডেকে নিয়ে যায় অনুপম
হ্রদের কিনারে, প্ররোচিত করে নেমে এসে তীরে
সাঁতার কাটার জন্যে। সেই
আমন্ত্রণ পারি না উপেক্ষা
করতে বস্তুত কিছুতেই। পুলকিত নেমে পড়ি তড়িঘড়ি।
একি! তাকে স্পর্শ আর চুম্বন করার
মুহূর্তেই, হায়, ডুবে যেতে থাকি হ্রদের পাতালে,
পারি না নিশ্বাস নিতে, কখন যে কার করুণায়
নিজেকে দেখতে পাই এক বটগাছের তলায়। চোখে পড়ে,
লাল আলখাল্লা পরা সেবারত একজন সস্নেহে তাকিয়ে
আছেন আমার দিকে। কিছু না বলেই মৃদু হেসে
কে জানে কোথায় শান্ত পায়ে
মিলিয়ে গেলেন যেন অদূর দিগন্তে। সূর্য ডোবে
প্রথামতো, বলো কোন আস্তানায় যাবো?
২৮-১১-২০০৩
বৃষ্টি ধারায় দৃষ্টি মেলে
এখন আমি
কাজলা দিনে ছোটো ঘরে
ব’সে দূরে বৃষ্টি ধারায় দৃষ্টি মেলে
বসে আছি।
পাশে আমার চোখ-জুড়ানো
মন-মাতানো
এক তরুণী
হাঁটুতে মুখ রেখে ধূসর
মেঘের বুকে ডুব দিয়েছে। এখন তাকে
খুঁজলে আমি পাবো না ঠিক,
যদিও সে ঘরেই আছে।
বৃষ্টি আমায় বদলে দিয়ে
কোন্ সে সুদূর ধূসর ঘাটে
বসায় ব’লে আমার প্রাণে
লাগছে দোলা ভিন্ন তালে।
এখন আমি নইকো কোনো
পদ্য লেখক, সামান্য এক
বৃষ্টিভেজা খুব একেলা
ছন্নছাড়া জলেভেজা পথিক কোনো।
ঘুরে বেড়াই দিনদুপুরে, রাতদুপুরে
যেমন ইচ্ছে ডানে বামে।
আপন মনে যখন তখন
বুকের কাছে ঝুলাছে এই
এক তারাতে ফোটাই কিছু
অচিন পদ্ম! ফুলের ঘ্রাণে হৃদয় মাতে।
১৬-৬-২০০৩