- বইয়ের নামঃ গন্তব্য নাই বা থাকুক
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপরূপ এক আস্তানার দিকে
আমাকে একরাশ কাঁটার ওপর ক’জন চটজলদি
শুইয়ে দিলো। আমার মৃত্যু হয়নি তখনো, অথচ
তড়িঘড়ি ওরা গুমোট অন্ধকারে অসহায় আমাকে
অনেকটা পথ টেনে-হিঁচড়ে
নিয়ে এলো বিয়াবান প্রান্তরে। কারা যেন
দূর থেকে হিংস্র কৌতূহলে দেখছে
দৃশ্যটি; আমি না পারছি চিৎকার করতে,
না কান্নায় ভাসতে। একটা চাপা ক্রোধে
তছনছ হয়ে যাচ্ছি। আকাশ যদি আমাকে
গিলে ফেলে এই মুহূর্তে, মেনে নেবো আপত্তিহীন।
ওরা আমাকে হেলায় একদিকে ঠেলে দিয়ে ছুটলো
ফেরার পথে কিংবা গায়েব
হয়ে গেলো অজানা কোথাও। গা ঝেড়ে
উঠে পড়ি, সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে প্রতিফলিত শূন্যতা।
হেঁটে চলেছি ক্রমাগত; বেয়াড়া ক্লান্তি দখল
করে নিচ্ছে আমাকে, ভীষণ শুকনো
হয়ে আসছে গলা, যেন কেউ আমার
মুখের ভেতর গুঁজে দিয়েছে একরাশ বালি, এখুনি
দম বন্ধ হয়ে আসবে ভেবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি
নিজের অজান্তেই ধূসর আকাশের দিকে
বিহ্বল তাকিয়ে থাকি। ঘাড় ফিরিয়ে
তাকাতেই আজগবি সব ছবি মুখ ভেঙচাতে থাকে আমাকে।
শরীরকে যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম, খানিক
পরেই চমকে, থমকে দাঁড়াই। এ কি! সামনে
পথ রুখে দাঁড়ায় তিনটি করোটি,
ওদের মুখ-গহ্বর থেকে
বেরিয়ে আসে নিষেধের ভাষা। আমার
মাথার ধূসর চুলের গুচ্ছ দাঁড়িয়ে যায় কাঁটার ধরনে।
এগুতে পারবো কি? উপরে তাকাতেই
চাঁদের বাঁকা হাসি যেন ভীষণ
হিংস্রতায় আমাকে খুবলে খেতে চায়। হঠাৎ
তিনটি করোটি নেচে চৌদিকে
ঘুরতে ঘুরতে আমার গলা জুড়ে সেঁটে থাকে! শিউরে
ওঠার মতো শক্তিটুকুও যেন সম্পূর্ণ লুট হয়ে গেছে।
ঝটকা খেতেই বামে তাকিয়ে দেখি অচেনা
কে যেন আমাকে হাত ধ’রে অপরূপ
এক আস্তানার দিকে নিয়ে চলেছেন। প্রশান্ত
কজন সাধক ‘স্বাগতম’ ব’লে আমাকে ডেকে নেন এবং
সঙ্গে সঙ্গে আমার গলায় লটকে-থাকা করোটিত্রয় উধাও,
পরিবর্তে আসমানি তারাপুঞ্জের মালা দুলছে।
১১-১০-২০০৩
অপরূপ গালিভার
ঘোর অমাবস্যাতেও মধ্যদিনের সূর্যালোক
ছড়িয়ে দেন যিনি, কে তিনি? কে তিনি?
তাঁকে দেখার
সৌভাগ্য ঝলসে উঠেছিল জীবনে একবারই
ভিনদেশে এক খরখরে দুপুরে। সত্যি কি তাঁকেই
দেখেছিলাম না কি অন্য কাউকে?
যাঁর কথা পড়েছি সোৎসাহে মেধাবী
পণ্ডিতদের রচনায় , শুনেছি বিজ্ঞজনদের ভাষণে, তাঁকেই
দেখেছি, কী করে বলি? মূক, নির্বাক, ভ্যাবাচ্যাকা
মাংসপিণ্ড কী করে হতে পারেন সেই উদ্দাম পুরুষ!
একদা যাঁর মায়াবী আঙুলের স্পর্শে এক লহমায় হারমোনিয়ামের রীডগুলো
নেচে উঠতো পরীদের মতো, যাঁর কণ্ঠস্বরের
মায়ায় খুলে যেতে চাইতো
কারার লৌহ কপাট, দুরন্ত লস্ফে যিনি
ছুঁতে পারতেন জ্যৈষ্ঠের ঝোড়ো মেঘদল,
কী করে বলি তাঁকেই দেখছি? কোথায়
সেই বাবরি, যার ঝাঁকুনিতে ঝরতো রাশি রাশি অগ্নিকণা?
একদা যাঁর অগ্নিবীণা নিদ্রা হরণ করতো জালিমদের,
যাঁর চেতনায় সামুদ্রিক মাছের মতো খেলা করতো
সত্য, সুন্দর আর সাম্যের স্বপ্ন, তিনি আমার
এই জন্মশহরে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ কয়েকটি দিন,
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! সত্যি কি সেই
অপরূপ গালিভার ছিলেন লিলিপুটদের দঙ্গলে?
২১-৫-২০০৩
অরূপ নক্ষত্রলোকে
যখণ একলা নিজ ঘরে বসে থাকি
গভীর তন্ময়তায়, নানা ভাবনার
বুদ্ধুদ মনের জলাশয়ে, কখনো বা কুয়াশায়
চকিতে মিলিয়ে যায় কোন্ অজানায়।
কখনো গভীর রাতে সত্তা থেকে নিদ্রা মুছে গেছে
চোখে পড়ে কে এক নিভৃত ছায়া যেন
বারান্দায় পায়চারি করে। ছায়াময় আগন্তুক
ঘরে এসে দাঁড়ার দু’হাত পিছনে রেখে খানিক সম্মুখে
ঝুঁকে, দেখে যেন মনে হয় চেনা। শয্যা ছেড়ে উঠে
পড়ি নিমেষেই আজ অজান্তে আমার ছুঁই তাঁর পদযুগ।
উদ্ভাসিত আলোমালা, সেই আগন্তুক
আর বাক্যহারা অবনত আমি নিঃস্পন্দ দাঁড়িয়ে
থাকি, ভাবি- তবে কি আমার এই দীন আস্তানায়
পথ ভুলে এসেছেন কোনো দেবদূত?
কোনো কথা না বলেই তিনি মৃদু হেসে
দু’হাত পিছনে রেখে, ঈষৎ সম্মুখে ঝুঁকে ধীরে
হেঁটে দূরে দীপ্ত বৃত্তে করেন প্রবেশ। ‘জয় হোক রবীন্দ্রের’
ধ্বনি গুঞ্জরিত হতে থাকে অরূপ নক্ষত্রলোকে!
৪-৫-২০০৩
অসম্পূর্ণ বাগানের কথা
না, তোমাদের কারো সঙ্গেই কোথাও
কোনোদিন দেখা হয়নি আমার। তোমাদের কথা
ভুলেও এতদিন কেউ বলেনি আমাকে। মেঘের আড়ালে
উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ঢাকা পড়েছিলে। হঠাৎ
একদিন ডানে বামে ঘুরতে ঘুরতে আমার
মতোই এক পথিকের সৌজন্যে আবছা দুটি
অসম্পূর্ণ ফুলের চারা দৃষ্টিগোচর হলো গোধূলিবেলায়।
কাছে গিয়ে দেখি সৌন্দর্য মাথা তুলে রয়েছে আকাশের দিকে।
ঔদ্ধত্য ছিলো কি ওদের সেই ভঙ্গিতে? এমনই মুগ্ধ
ছিলাম ওদের খণ্ডিত উপস্থিতিতে, তেমন ভাবার
ইচ্ছেই হয়নি। আমার খুব সাধ হলো চারা দুটির আধফোটা
ফুলগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে। একজন কবি
আমাকে তোমাদের দু’জনকে
আংশিক সৌন্দর্য দেখিয়েছিলেন তার এক বর্ণনায়।
তারপর থেকেই অচেনা তোমাদের অসম্পূর্ণ বাগান
দেখার পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ি। আজো
কখনো খাঁখাঁ দুপুরে, কখনো-বা মধ্যরাতে। এই যে
কোনো কোনো দিন হঠাৎ ক’টি আধফোটা ফুলের
সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এ রকমই কি হতে থাকবে বহুদিন?
০৪-১০-২০০৩