Site icon BnBoi.Com

খুব বেশি ভালো থাকতে নেই – শামসুর রাহমান

খুব বেশি ভালো থাকতে নেই - শামসুর রাহমান

অস্ত্রোপচারের পরে

কী বলতে কী বলি? কীভাবে যে শুরু করি! সমস্যাটা
খোলাখুলি বলা যায়, এখানেই। বিকেল পাঁচটা
বেজে পাঁচ মিনিটে অপারেশান থিয়েটারে আমি
হেঁটে যাই শাদা ঢোলা জামা গায়ে বন্দীর ধরণে।
স্মিতমুখ সার্জন, আরোগ্যাশিল্পী, কান্তিমান; ফিকে
হল্‌দে দস্তানায় মোড়া হাত তাঁর খানিক পরেই
হবে রাঙা হেমোরয়েড রক্তে। লুকিয়ে ভয়ের নীলা
বুকে জননী স্ত্রী কন্যা, ভাইবোন কারুর দিকেই
তাকাইনি ফিরে, তবু একটি মুখের রেখাবলি
আমাকে, চমকে দেয় সৌন্দর্যের গহন পীড়নে।

সবুজ গাউন-পরা তিনজন ধরাধরি ক’রে
আমাকে শুইয়ে দেয় লম্বাটে টেবিলে; মুখ জুড়ে
কালো মাস্ক হাপরের মতো ব্যবহার করে, কোনো
রূপকথা শোনাবার ছলে সন্ধ্যার ঘোমটাময়
জনশূন্য ফুটপাতে ঘুম খুব সহজে পাড়ায়
চন্দনাবিহীন, দিঘি নেই আশেপাশে। তখন আসেনি কানে
বন দোয়েলের শিস। শুধু আর্কল্যাম্পের তলায়
অচৈতন্যে আমার শরীর স্বপ্নহীন স্মৃতিছুট
স্বপ্নময়তায় যেন ভাস্কর্য নিথর। চুপিসাড়ে
অন্য কেউ আমাকে দখল ক’রে নিয়েছে সহসা।

অস্ত্রোপচারের পরে কুয়াশার চিক আলগোছে
সরিয়ে দেখার মতো মনে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ
মীন রূপে সাঁতার কেটেছি অবচেতনের জলে।
ঠিক সঞ্চরণশীল নয় হয়তো; পানি থেকে মাথা
তোলা, ফের অগাধ তলিয়ে যাওয়া, এরকম
আচরণ করেছে আমার সত্তা। চিৎ হ’য়ে, কাৎ
হ’য়ে ভেসে যাচ্ছিলাম ক্লিনিকের বেডে, কিছু মুখ,
স্রোতে ভেসে-যাওয়া ফুল, আমাকে ঈষৎ ছুঁয়ে কার
ফুঁয়ে উড়ে যায় দূরে। স্যালাইন নল দ্রাক্ষালতা,
মদির জীয়নরস চুঁইয়ে পড়ে শিরায়; কে আছে
দাঁড়িয়ে শিয়রে নাগা সন্ন্যাসীর মতো? মেঘে মেঘে
শব্দহীন ঘন্টা বাজে; চোতের হাওয়ায় তৈরি এক
বালিশে গচ্ছিত মাথা। সফেদ ত্র্যাপ্রন গায়ে; চোখে
নীল চশ্‌মা গলায় স্টেথিস্‌স্কোপ, সে কি চেনা কেউ?

নার্সময়তায় চতুর্দিকে হংসীদল। ফিস্‌ফিসে
কথা ভাসে, দ্রুত পদধ্বনি, কারো ছবি কাছে এসে
চিহ্নহীন। দরজার পাশে জবাগাছ কে রেখেছে
পুঁতে এরকম ছন্দোময়? অক্ষরবঞ্চিত বই,
পত্রহীন লেফাফা এবং বীতরাগ গীত ঢোকে
আমার ভেতরে আর পানিমগ্ন ক্যাফেটারিয়ায়
দক্ষকন্যাদের ভিড়। কার কী যে নাম দীপিতার
সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছিলো নিঝুম সন্ধ্যায়?
মাথার ভেতরকার মেঘদল ছিঁড়ে যন্ত্রণার
স্খলিত নক্ষত্র ছাই হয়, বড় বেশি ধবধবে
দেয়ালে চঞ্চল ঘাসফড়িঙেরা ক্ষীণ পরমায়ু
নিয়ে করে ওড়াউড়ি। দিকে দিগন্তরে তৃষ্ণার্তের
ওষ্ঠ জেগে থাকে সর্বক্ষণ; কখনো দুলছি খুব
ঢেউলাগা, নৌকো, কখনো বা কৃষকের হাত থেকে
ক্রমাগত ঝ’রে যেতে থাকি,গুঁড়ো হই শস্যবীজ।
তন্দ্রার হরিণ বেডে নিদ্রার বিবাদ রেখে যায়।

আঁধার ঘরে বন্দী এখন

আকাশজোড়া মেঘ দেখি না দুপুরবেলা,
চৈত্রদিনে হাওয়ায় ধুলোয় পত্রঝরা,
তা-ও দেখি না।
মাঝে-মধ্যে মুক্ত পাখির-সুর বয়ে যায়,
কানে ভাসে।
আঁধার ঘরে বন্দী এখন একলা আমি
একলা থাকি সারা বেলা, রৌদ্র থেকে
জ্যোৎস্না থেকে নির্বাসিত।

প্রহরীদের বুটের শব্দ মগজ কাঁপায়,
অন্ধকারের রোমশ হাতে জব্দ হয়ে
হাঁপাই শুধু ক্লান্ত মনে
অবহেলার ঠেলে-দেয়া রুটি ছিঁড়ি
প্রহর গুণি
এবং শুনি ভবঘুরে কুকুর কাঁদে মধ্যরাতে।
কখনো এই হতচ্ছাড়া কম্বলেরই ফুটোয় ফোটে
সাতটি তারা,
কখনো ফের অপদুতের স্বপ্ন দেখে রাত্রি কাটে,
অব্দ কতো যায় চলে যায় অস্তাচলে,
কোন্‌ আগুনে দগ্ধ, হয়ে ভস্মমূর্তি
হচ্ছি কেবল রূপান্তরে?

আঁধারে ঘরে বন্দী এখন একলা আমি।
একলা আমি? নাকি আমার মতোই এখন
বহুজনের বন্দীদশা?
এই পাথুরে দেয়ালটাতে হাত-পা আমার
আটকে আছে-
নড়লে আমি শেকল নড়ে, শকুনেরা
আমার শরীর ঠুকরে ছেঁড়ে টুকরো টুকরো
মাংস ঝরে যখন তখন।
অট্রহাসি আমার ক্ষতে নুন ছিটিয়ে
হা-হা শব্দে নিলায় দূরে।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি
ভুল পথে সেই কবে থেকে চলছি আমি?
দ্বিধায় পাথর সরিয়ে দূরে মন উড়ে যায়
যজ্ঞ ডুমুর, রাঙা শালুক দিঘির কাছে।

ঘাড়-কাটা এক মৃতদেহ ঘুরছে ঘরে অবিরত,
বসিয়ে তাকে চাইলে হতে আলাপচারী,
হাত দু’টি তার আমার দিকে
এগিয়ে আসে হুকের মতো লৌহ কঠিন।
হতাশ্বাসে কণ্ঠনালী মরা ঘাসে
ভরাট হতে থাকে কেবল। সমাধি তার কোন্‌ বিজনে?
থাকতে বুঝি চায় না শুয়ে মাটির নিচে
কীটের রাজ্যে অমন একা
আঁধার ঘরে দীর্ঘ সময় বন্দী থেকে
মাথার ভেতর ভাসে প্রেতের ফিস্‌ফিসানি,
হঠাৎ কাউকে মনে পড়ার মতোই খানিক আলোর আশায়
চার দেয়ালে চেয়ে থাকি।

আমাকে কোথায় পাবে?

আমাকে কোথায় পাবে? ডাক পিয়নের
চিঠি বিলি করবার মতো
নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। পৃথিবীর কোনো ভৌগোলিক
সীমানা মানি না আমি; না, আমার কোনো
নির্ধারিত দেশ নেই, সেই কবে পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেছি।
হাওয়ার মতন আর রোদ্দুরের মতো
ব্যাপ্ত আমি দেশে দেশে। তাই পোষ্টম্যান
ধন্দে পড়ে প্রতিবার, ভুল করে কর্তব্য পালনে।

আমাকে কখনো
খুঁজে পেতে হলে, হে দীপিতা,
আমার তোমাকে ভালোবেসে না-পাওয়ার
মধ্যে তত্ত্বতালাশ চালাতে হবে। যে-গোলাপ কস্মিনকালেও
ফুটবে না তার শূন্যতায়, কখনো যে-মোমবাতি
তোমার টেবিলে জ্বলে লোড শেডিং-এর
রাতে, তার নিভে যাওয়ার ধোঁয়ায়,
পাকা ধান খেতে এসে যে বাদামি হাঁস
শিকারীর গুলীর আঘাতে
সঙ্গিনীকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলে খোলা চরে, তার আর্তনাদে,
মুক্তিযুদ্ধে যে যুবার খোয়া গেছে একটি পা,
তার ক্রাচে, মেশিনে নিহত শ্রমিকের বিধবার
অশ্রুজলে, অত্যন্ত বিষণ্ন জেলেদের প্রতীক্ষায়
আমার ঠিকানা পেয়ে যাবে সুনিশ্চিত।

অনিদ্রার অতিশয় তীক্ষ্ণ ছুরি সেই কবে থেকে
আমাকে খোঁচাচ্ছে ক্রমাগত। মাঝে মাঝে কায়ক্লেশে
জেগে থাকবার ক্লান্তি চোখে অবেলায়
ঘুমের কুয়াশা টেনে আনে,
দুঃস্বপ্ন দেখার ভয়ে ঘুমোতে পারি না স্বাভাবিক।
আমাকে কোথায় পাবে? হে দীপিতা, শোনো,
আমার ভুরুতে আর চোখের পাতায় অতীতের
ধুলো জমে আছে, বর্তমান পাঁজরের
প্রতিটি হাড়ের মধ্যে দুন্দুভি বাজায়,
আঙুলে নিয়ত ফোটে ভবিষ্যৎ, যেন স্বর্ণচাঁপা।
আমার ঠিকানা তুমি খুঁজে পাবে দেশ-দেশান্তরে
ভুখ মিছিলের পদ শব্দে, ফাঁসির মঞ্চের মতো
ভীষণ কর্কশ বিরানায় আর কয়েদখানায়
রাজবন্দীদের শিক-পেরুনো দৃষ্টিতে। যে জোরালো
হাত অকস্মাৎ অন্যায়ের মাথা থেকে
মুকুট ছিনিয়ে নেয়, সে-হাতের মুঠোয় এবং
জ্ঞানীর নিশ্বাসলাগা গ্রন্থের পাতায়,
ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়ানো
ঋজু দেশপ্রেমিকের বুকে,
বিপ্লবী কবির আগুনের স্ফুলিঙ্গখচিত, চোখ
ধাঁধানো মালার মতো কবিতায়, যারা
বারুদের গন্ধভরা পথে ও প্রান্তরে
ওড়ায় পায়রা ঝাঁক ঝাঁক
তাদের মিছিলে আর কৃষ্ণকায় কবি পুরুষের
ফাঁসির দড়িতে আমার ঠিকানা জ্বলে নক্ষত্রের মতো।

আমার স্বভাবদোষে

অকস্মাৎ
হাত
আমাকে সরিয়ে নিতে হলো তাড়াতাড়ি
নারী,
তোমার আঙুলে হোমশিখা তীব্র জ্বলে,
কোনো ছলে
এর আগে জানতে পারিনি। তবু ভুলে
আমার স্বভাবদোষে আঙুল জড়াতে চাই তোমার আঙুলে।

আমি ছাড়া কে জানে

সোফায় এলানো তার শরীরের বাঁক দেখে ভাবি-
কী আশ্চর্য, নিজের ভেতরে
কেমন নিশ্চপ কত জটিল কাহিনী, কল্পকথা, শোকগাথা,
স্বপ্নের নিবিড় ভাষা লুকিয়ে রেখেছে।

ক্ষণিক বিশ্রামে তার গূঢ় রহস্যের বর্ণচ্ছটা
শুয়ে আছে। কে বলবে যে এখন পিঠে এক রাশ কালো চুল
ছড়িয়ে রয়েছে বসে, সে এমন শক্তি ধরে যাতে
আমার বুকের মধ্যে কালবৈশাখী তুফান ওঠে,
ভয়ংকর মনোহর
বিদ্যুল্লতা খেলা করে বারবার নীড়সুদ্ধ গাছ অগোচরে
পুড়ে খাক হয়,
এই মধ্যবয়সীরও শিরায় শিরায় জ্বলে প্রখর দেয়ালি।
আমি ছাড়া কে জানে এখন
যে এমন ভীরু দৃষ্টি মেলে দ্যায় হরিণীর মতো, তার চোখে
চকিতে ঝলসে ওঠে স্বেচ্ছাচারী কাতিলের ধারালো খঞ্জর?

 একটি চিঠির জন্যে

আজকের ডাকেও আসেনি ওর চিঠি পিয়নের
পায়ে-চলা পথে রোজ
দু’চোখ বিছিয়ে রাখি। কখনো দূরের
অচেনা ব্যক্তির লেখা কোনো
চিঠি, কোনো পার্সেল অথবা
কবিতার বই আসে, কিন্তু আমি যার
হস্তাক্ষরময় অন্তরঙ্গ পত্র পেতে চাই,
সে কেমন নিঃসাড় এখন। সে কি তবে শয্যাগত
অসুস্থতা হেতু? নাকি কোনো অবসাদ,
প্রাগৈতিহাসিক,
এ নবীন হৃদয়কে তার
করেছে প্রবাস ধু ধু? ঘরে ফিরে যাই, ভয় হয়।

এত অন্ধকার, হায়েনার গায়ের রঙের মতো,
কখনো হয়নি জড়ো আমার এ ঘরে। হিস হিস শব্দ শুনি
সারাক্ষণ, মেঝেতে অতল গর্ত পদে
পদে, মনে হয়। এই পত্রহীন প্রহর আমাকে
তলোয়ার মাছের মতন কাটে, শুধু রক্ত ঝরে বুক থেকে।

এইতো ক’দিন আগে পেয়েছি সান্নিধ্য তার, ফুল্ল
হাসি তার ভেসে আসে, যেন এইমাত্র সোফা ছেড়ে
কোনো কাজে অন্য ঘরে গেছে। শূন্যতাকে
চুমো খেলে পাবো তার নিঃশ্বাসের, ত্বকের সুঘ্রাণ। আজ শুধুউ
রুশ পুতুলের মতো
স্মৃতির ভেতরে স্মৃতি নানা স্তরে জমে।

একজন স্বেচ্ছাচারী নিষাদ ছুঁড়েছে
হঠাৎ বিষাক্ত তীর আমার উদ্দেশে অবেলায়।
কতিপয় লোক, ফিচেল দৃষ্টিতে
তাকায় আমার দিকে, কান্নি মারে, যেমন আহত
ঈগলের প্রতি ঠারে ঠোরে দৃষ্টি হানে
হাড়গিলে, কাদাখোঁচা, কাক।
আজকের ডাকেও আসেনি ওর চিঠি। এলে আমি
আমার ডাগর ক্ষতে প্রলেপ পেতাম,
কী সহজে সকল ভ্রকুটি,
অট্রহাসি উপেক্ষায় হাওয়ায় উড়িয়ে
দিতে পারতাম; এতদিনে জেনে গেছি-
বস্তুত জগতে
মানুষের কাছে যখন যা সবচেয়ে কাঙ্খণীয়,
সেটাই অপ্রাপনীয় থেকে যায় নিশ্চিত তখন।

কবেকার হাহাকার

তারপর দিগন্তে বেদনা
ঘন চুল এলিয়ে জমাট,
ইলেকট্রিকের দীর্ঘ তারে হুহু কাক, জলকণা
কী ব্যাপক জাল; সারি সারি ঘরবাড়ি মাঠঘাট
জব্দ, বন্দী আকাশে মেঘের মোষ কিংবা, মেষ
মাঝে-মধ্যে বিদ্যুল্লেখা, বইছে হাওয়ার
দীর্ঘশ্বাস শহরকে ঘিরে, রবীন্দ্র সঙ্গীত শেষ
ক্যাসেট প্লেয়ারে, বসে আছি একা ঘরে,
আকাশের চোখ ফেটে
ঝরে শুধু ঝরে
অশ্রুজল, ইচ্ছে নেই কোথাও যাওয়ার।
কেউ কি দাঁড়ালো এসে গেটে?
যূথীর বিধুর গন্ধে কী যেন হঠাৎ মনে পড়ে
হৃদয়ের ঘোর মন্বন্তরে।

অন্ধকার দিন
গাঢ়, কালো চোখের মতন
তাকায় আমার দিকে, একলা পথিক, উদাসীন,
ধূসর বর্ষাতি-পরা, ভেজা পথে হাঁটে,
হৃদয়ে যক্ষের নিবেদন,
পানিডোবা মাঠে
ব্যাঙের কোরাস, দূরে বেহালার ছড়ে
কে বজায় মেঘ? আরো বেশি অন্ধকার
নেমে আসে হৃদয়ের চৌদিকে এমন দ্বিপ্রহরে,
আকাশে মাটিতে কবেকার হাহাকার।

কার কী ক্ষতি হতো?

পাশের বাড়ির অনুঢ়াকে কখনো সখনো দেখি
আমি ঝুল বারান্দায় পায়চারি করার সময়। তার চোখ
জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় ছাদে, কখনো ঘরের
মধ্যে, কখনো বা সাঁজ-ফেরানো বাগানে।

কোনো কোনো দিন কাঁখে
শিশু নিয়ে হাঁটে, শিশুটিকে গাছ, চাঁদ, ফুল পাখি
দেখায় ইঙ্গিতে মুগ্ধাবেশে, কখনো সে
চকিতে শরীরে হরিণীর ছায়া নিয়ে ছুটে যায়।

নিতম্ব অবধি নেমে-আসা একরাশ অসিত শিখার মতো
চুলে একটি কি দু’টি রঙিন পতঙ্গ উড়ে এসে
বসে পুড়ে মরার আশায়, চুমো খায়, যেন ঘোর
অমাবস্যা রাত্তিরের ঠোঁটে
টুকরো, টুকরো জ্যোৎস্না। তরুণীটি এক গাল
হেসে লন থেকে
সযত্নে কুড়িয়ে নেয় খড়কুটো; আমার ভেতরে
কবিতার জন্মজল অলৌকিক কোলাহল করে বারংবার।

শুধু দূর থেকে দেখি তাকে,
কখনো শুনি না কণ্ঠস্বর তার, কান পেতে থাকি
প্রায়শঃ তবুও নিস্তব্ধতার সরোবরে ঢেউ
জাগে না কখনো। সে যখন
ফুলের চারাকে বুকে নিবিড় জড়ায়
তখন শরীরে ওর কী জমাট একরোখা নীরবতা। সূর্যাস্তের দিকে
টলটলে একজোড়া চোখ নিয়ে তাকায় যখন,
মনে হয় তার রূপপ্লাবিত শরীর
গহন ভাষায় কথা বলে
গোধূলির ছোপলাগা মেঘেদের সঙ্গে আর ছায়া
ছায়া পাখিদের ওড়া আর
সদ্য ফুটে-ওঠা নক্ষত্রের সঙ্গে, যদিও কখনো ওষ্ঠে তার
মঞ্জুরিত নয় কোনো ভাষা।
নাম তার জানি না, জানার বাসনাও
করি না প্রকাশ
সঙ্কোচ বশত, শুধু হীরের কুচির মতো কিছু
ভাবনা আমার ঘিরে থাকে
ওকে, মনে হয় সে আমার সে কোন্‌ সুদুর কালে
বিপর্যয়ে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া প্রিয় সহোদরা।

আমার পুরনো সহকর্মী সাদেকিন, এখন সে
পরবাসে, এক ভোরবেলা
গরম চায়ের কাপে নিবিড় চুমুক দিতে দিতে গল্পচ্ছলে
বললো তার গাঁয়ের সুন্দরী এক অনূঢ়ার কথা।
নাম ওর বোধ হয় অঞ্জলি, চোখে দেখে না অথচ
গলার আওয়াজ শুনে নির্ভুল শনাক্ত করে কার
সঙ্গে বলছে সে কথা, পাখপাখালির
সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়, ওরা তাকে
ডেকে নিয়ে যায় খোলা সবুজ ছাতার মতো গাছের ছায়ায়।
ঝোপঝাড়ে, বাঁশবনে, ইঁদারার কাছে।

প্রকৃতি কখন তার শাড়ি পাল্টাবে সে আগেভাগে
বলে দিতে পারে ঘ্রাণ নিয়ে,
ঘাসে পা রেখে সে বলে দেয় কবে পূজো হবে আর
একটা সামান্য কিছু নিয়ে
অসামান্য খুশি হয়ে উঠবার আশ্চর্য ক্ষমতা
সে কোত্থেকে পায় ভেবে সাদেকিনের গাঁয়ের
লোকজন সারা। সেই কখনো না-দেখা অঞ্জলির
কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতর চর খুব ধু ধু করে।

কখনো কখনো ভাবি যদি
আমার পাশের বাড়িটার অনবোলা
তরুণী এবং সাদেকিনের গাঁয়ের
অঞ্জলি দু’জন দু’টি আলাদা অনূঢ়া
না হয়ে কেবল একজন সুন্দরী রমণী হতো,
শান্তি আর কল্যাণ ছড়ানো চোখ মেলে
দেখতো পারতো দৃশ্যাবলী আর তার ওষ্ঠ থেকে ঝরে যেতো
কথার বকুল জুঁই বেলী
তাহলে কার কি ক্ষতি হতো?

কোথায় লুকিয়ে থাকো

কোথায় লুকিয়ে থাকো নিঃসঙ্গতা নিয়ে? শুয়ে আছো
বিষাদের ঘরে?
আজো কি তোমার মনে অগোচরে জমেছে হে মেয়ে
মন-খারাপের মেঘ? আমার সকল
ভালো-লাগা সিংহাসনচ্যুত; একটি কুঠার, রোদে
তুমুল ঝলসে ওঠা, বার বার করছে প্রহার
আমাকে, তোমাকে
দেখতে পাই না বলে। এরকম হয় না কি, মাঝে-সাঝে তুমি
বসে আছো বই হাতে, হঠাৎ আমার
নিঃশ্বাস তোমার
গ্রীবায় অধরে, পিঠে, স্তনে, নাভিমূলে চুমো খায়
চুপিসাড়ে? আমার শীতল দীর্ঘশ্বাসে বড় বেশি
এলোমেলো হয়ে যায় না কি সমাজতত্ত্বের খাতা,
আধ-পড়া জরুরী বইয়ের পাতা, তোমার চুলের নিঃস্তব্ধতা,
হৃদয়তন্ত্রীর সুর? যখন ঘুমিয়ে থাকো, তখন তোমাকে
যে-দ্যাখে গোপনে বিছানার পাশে একা
দাঁড়িয়ে, সে নয় আমি, আমার ভেতর
থেকে বের-হ’য়ে-যাওয়া কোনো ছায়া; দ্যাখে, শুধু দ্যাখে।

এ শহরে এ ভীষণ অসুখী শহরে
তুমি আছো, খুব কাছে আছো হে অপ্রাপনীয়া,
জ্বলছো হিরের মতো নিত্যদিন, অথচ দেখি না
তোমাকে, যদিও আমার অনেক স্বপ্ন, ঝ’রে যাবে জেনেও সর্বদা
বিনিদ্র কুসুম হয়ে ফোটে তোমাকে ঘিরেই। তারাজ্জলা রাতে
বলেছো, সত্বর তুমি চলে যাবে দূরে;
আমার একান্ত অনুরোধ, অন্ততঃ যাবার আগে
দেখে যাও কী রকম আছি। অন্তর্গত
ব্যাকুলতা গাছপালা, নদীনালা, নিশান্তের হাওয়া
বর্ষার আকাশ আর ময়ূরকে বলে-
আমাদের দু’জনের যে-দূরত্বে ধুধু মরুভূমি
প্রসারিত তাতে
একবার মিলনের মরূদ্যান উপহার দাও। নাটকের
টাঙ্গানো দৃশ্যের মতো হোক তা ক্ষণিক
রঙিন, কখনো অনুতাপে পোড়াবো না হৃদয়ের শস্যাগার।
তোমার এখন
প্রকৃত দেখার জন্যে জ্বলন্ত অঙ্গারময় ক্রোশ
ক্রোশ পথ হেঁটে যেতে পারি,
তোমাকে দেখার জন্যে, হে নবীনা, আরো
কিছুকাল জীবনের ঘনিষ্ঠ উত্তাপে প্রৌঢ়তাকে
উল্টে পাল্টে সেঁকে নিতে চাই
ধুক ধুক বুকে।
তোমাকে দেখার জন্যে শুকনো ডালে চব্বিশটি বসন্ত-গোলাপ
সহজে ফোটাতে পারি, তোমার উদ্দেশে
খুনীদের আস্তানায় দ্বিধাহীন ঢুকে পড়া আজ
কী এমন অসম্ভব কাজ? তোমাকে একটিবার
প্রকৃত দেখার জন্যে প্রাণ বাজি রেখে
স্বৈরাচারীদের
লৌহমুষ্টি থেকে আমাদের একালকে ছিনিয়ে আনতে পারি।

কোল ছাড়া করতে চায় না

তারপর চোখে জ্বালা-ধরানো দুপুরে
জিবনের মাতৃক্রোড়ে মৃত্যু ঘুমিয়ে রয়েছে দুগ্ধতৃষ্ণাহীন।
বাতাসের চুমো তার গালে, বুজে-থাকা
চোখের পাতায় দূর মেঘপল্লী-পেরুনো রোদের
আঙুল চিকন ঘোরে, মৃত্যু কী নিঃসাড়
ঘুমন্ত, ছড়ানো ছ’টি হাত,
নাক জীবনের স্তনে গোঁজা! চতুর্দিকে অবিরাম
খোঁজাখুঁজি। যেন সব পুঁজি
খুইয়ে ঘুরছে
কতিপয় অতিশয় পরিশ্রান্ত উদ্ভ্রান্ত মানুষ।

ঢেউয়ে ছিলো ঘোড়া, শত শত, চোখে শীতল আগুন,
ক্ষমাহীন ছোবলের মতো, ঘোড়সওয়ারের
ঘূর্ণি-দড়ি ছুঁড়েছিলো, তাদের গ্রীবায়
প্রতিষ্ঠিত কী নগ্ন করোটি।

একজন লোক এক সারি অমৃতের সন্তানের পাশে
দূরগামী জাহাজের মালের ধরনে পড়ে আছে
স্তব্ধতায় মোড়া, চোখ জোড়া
প্রাচীন পাথর, কী-যে তার
নাম, কোথায় বা ধাম?
লোকটার পায়ের পাতায় খাদ্যাম্বেষী
পিঁপড়ের দঙ্গল,
নাক তার নীলিমার দিকে।
হঠাৎ জীবন তার কোলে মৃত্যুশিশু নিয়ে ছুটে
আসে লোকটার কাছে, ধুলোয় লুটোয়
মলিন আঁচল,
চোখ-ফেটে-পড়া অশ্রুজল, সত্তাময়
হাহাকার। অকস্মাৎ লোকটার হাত কী প্রবল
টেনে ওকে জাগিয়ে তুলতে চায় এক তাল কাদার মতন
ঘুম থেকে শুধু
মৃত্যু জীবনের আকর্ষণে
কিছুতে নড়ে না এতটুকু, ঠোঁট তার
নিথর নিশ্চুপ নুড়ি।
এখন শুইয়ে দেয়া প্রয়োজন, তবুও জীবন গোধূলিতে
মৃত্যু-বাছাটিকে কোল ছাড়া করতে চায় না।

 কোহিনূর রেস্তারাঁয়

কিছুকাল থেকে
কোহিনূর রেস্তোরাঁয় ক’জন যুবক জড়ো হয়
নিয়মিত, ষড়ঋতু জড়ায় সত্তায়,
তাদের ক’জন চেনা এবং অচেনা কেউ কেউ
আমার নিকট, কেউ লোকগাথার মলিন কাঁথা থেকে মুখ
বের ক’রে শহরের
কাসিদা রচনা করে, কেউ কেউ টেবিলকে
হঠাৎ ষোড়শ শতকের গ্লোব থিয়েটার ভেবে
নিয়ে হ্যামলেট ভেবে নিজেকে কবোষ্ণ রক্তধারা
হাতে মাখে, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, ভীষণ তুষারাবৃত বৃক্ষের মতন
নীয়ারের চুলে হাওয়া লাগে, পর্দা নেমে আসে।

একজন যুবা, যে বৃষ্টির অগণিত নখ
ভালোবেসে, ভিজতে ভিজতে অকস্মাৎ
ঝোড়ো বেগে ঢুকে পড়ে, হাসি মুখে চায়ের অর্ডার দেয়,
সঙ্গে চাই একটি কি দু’টি উদ্ভিন্ন সিঙাড়া।
এক পীস ফ্রুট কেক হ’লে
আরো ভালো হয়, যার হাত টেবিলে খাটুনিজব্দ মজুরের
মতো স্রেফ ক্লান্তির ডানার
নিচে শুয়ে আছে, তার দিকে স্বপ্ন হেঁটে
আসে ক্রাচে ভর দিয়ে। যে ক’মাস ধরে কবিতার
একটি পংক্তিও
সাজাতে পারেনি তার ডায়েরির পাতায়, হুতুশে
চেহারা নিয়ে সে ব’সে আছে, যেন তাকে
ছেড়ে গেছে বাঁচবার। সাধ। একজন মনে-মনে
কল্পনার খাল দ্রুত ছাড়িয়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছে শত।

রঙিন ঘুড়ির মতো শব্দ স্বপ্নিল সুতোয় আর
কেউবা অনূঢ়া বড় আপার ভীষণ
হুহু যৌবনের ব্যর্থতায়
গোপন কান্নায় ভেঙে পড়ে, অথচ বাইরে তাকে
কেমন লড়াকু মনে হয়। অন্যজন,
পার্টির একাগ্র কর্মী, গোয়েন্দার সতর্ক নজর
এড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ, মাঝে-মাঝে দেখা দেয়
বন্ধুদের একান্ত ডেরায়।
অনেক পুরানো ডাকটিকেটের মতো
কিছু স্মৃতি-পাতা ওড়ে কারো কারো মনে। ‘কার জন্যে ঘন্টা বাজে
বলে এক বেকার যুবক
আচানক কোহিনূর রেস্তোরাঁয় বিবর্ণ চেয়ার থেকে উঠে
পা বাড়ায় পথে, ভেসে যায় জনস্রোতে।

রাত তিনটের পর
নির্জন রাস্তার ধারে কুয়াশার শাল মুড়ি দিয়ে
কোহিনূর রেস্তারাঁ দাঁড়িয়ে আছে ঠায়
অতিশয় পরিশ্রমে অবসন্ন বেশ্যার ভঙ্গিতে,
যার কোঠা ছেড়ে চলে গেছে ফূর্তিবাজ
সকল নাগর।

খবরে প্রকাশ

সত্য বলিতে, প্রকৃতির গুণগান আমি আর কি করিব?
আমার জন্য
কিছু আর অবশিষ্ট নাই। যুগ-যুগ ধরিয়া কবিগণ
প্রকৃতির বিস্তর পদলালিত্যময় স্তব করিয়া আসিতেছেন, ফলত
কেহ-কেহ প্রকৃতির দুলাল
আখ্যাও লাভ করিয়াছেন এতসংক্রান্ত ব্যাপারে, অর্থাৎ
প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র্যপুর্ণ রূপ লোকসমক্ষে স্বীয় স্বীয়
দৃষ্টিকোণ হইতে তুলিয়া ধরিতে
চিত্রকরগণও পিছাইয়া থাকেন নাই। অতএব,
এই বিষয়ে কোনো ঘাটতি রহিয়াছে,
এমত অভিযোগ কেহ করিবেন বলিয়া
আমরা বিশ্বাস করি না।

পদ্মের ন্যায় প্রস্ফুটিত প্রভাতে সূর্য দশদিকে
আবীর ছড়াইয়া দেয়, সায়াহ্নে স্বর্ণথালা রূপে
পশ্চিম গগন হইতে কোথায় চলিয়া যায়,
পৃথিবীতে মৃদু মন্দ সমীরণ বহিতে থাকে আর পূর্ণিমায়
কী মনোহর চন্দ্রোদয় হয়, ফেরেশতাগণ
শাল তমালের বনে বৃক্ষশীর্ষে দাঁড়াইয়া সেই শোভা
নিরীক্ষণ করিয়া যারপরনাই
পুলকিত হয়েন, লোক পরস্পরায় এবম্প্রকার
সংবাদ দিকে দিকে রটনা করা হইয়াছে। নদীতে জোয়ার আসে,
পর্বতের শৃঙ্গে বৃদ্ধের স্মশ্রুর ন্যায়
তুষার জমাট বাঁধে, স্বর্গের নৃত্যপটীয়সী সুন্দরীদের নূপুরের
ধ্বনির অনুরূপ বৃষ্টিপাত হয়। অবশ্য মাঝে মাঝে সমগ্র দেশ
ডুবাইয়া বান ডাকে, ঘরে ঘরে
কান্নার রোল ওঠে, কঙ্কালী দুর্ভিক্ষের তাণ্ডব দেখিয়া
আর কখনো সখনো বাসুকির ফণাস্থিত
দুনিয়ার কম্পন অনুভব করিয়া দানেশমন্দগণ বলিয়া থাকেন-
নাফরমান, গোমরাহ বান্দাদিগের উপর খোদার গজব নাজেল হইয়াছে।
এইমতো পরিস্থিতিএ তাঁহারা প্রচুর দোয়া-দরূদ পড়িয়া থাকেন।
উপরন্ত প্রকৃতি যে কীরূপ খেয়ালী
তাহাও মক্ষিকা স্বরূপ ভন্‌ভন্‌কারী সংবাদপত্রের সৌজন্যে আমরা অবগত রহিয়াছি
কোন কোন মহিলা একসঙ্গে ছয় সাতটি সন্তান
প্রসব করেন, কোনো কোনো
নব্জাতক দুইটি মাথা লইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, আবার
দুইটি শিশুর অঙ্গ পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে
গ্রথিত থাকে। কখনো কখনো এরকমও শ্রুত হয়,
পুকুরের মাছ গাছে বাসা বাঁধে, পাখি
নীড় রচনা করে জলাশয়ে, বটবৃক্ষে নাকি শজারু
পয়দা হয়। এইরূপও জনশ্রুতি আছে যে,
সেক্রেটারিয়াট টেবিলের ওপারে সুদর্শন চেয়ারে
উপবিষ্ট হইয়া গদ্ধমুষিকেরা
অনর্গল সিগারেটের ধোয়া উদ্‌গীরণ করেন এবং মর্জি হইলে
নথিপত্র ঈষৎ নাড়িয়া দেখিয়া থাকেন। এবং
আরো শ্রুত হয়, কতিপয় শাখামৃগ, যাহাদের মুখমণ্ডলে
প্রকৃতি সাদরে বিমর্ষতা বুলাইয়া দিয়াছে, উহারা
আবার দিব্য ভেংচি কাটিয়া থাকেন,
পদ্য লিখিয়া নাম কিনিয়াছেন এবং ইনাম
হাসিল করিয়াছেন। কেহ কেহ লাঙুল
নিজের গলায় জড়াইয়া কারো কারো পদশোভায়
অতীব বিমোহিত হইয়া
আহলাদে মৃত্তিকায় গড়াগড়ি যাইতেছেন আর আঙুল চুষিতেছেন।

তবে সর্বাপেক্ষা তাজ্জবের ব্যাপার হইল-
কিছুকাল হইতে আমাদিগের দেশের বিভিন্ন এলাকায়
কতিপয় লোকের স্ত্রীগণ ক্রমাগত
অশ্বতর প্রসব করিয়া আসিতেছেন। সম্প্রতি অত্র প্রবণতা
অত্যধিক বৃদ্ধি লাভ করিয়াছে, এই মর্মে বাঘা পরিসংখ্যানবিদ
এক সহস্র নয়শত সপ্তাশীতি পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিবরণ
সদাশয় সরকারের নিকট পেশ করিয়াছেন,
খবরে প্রকাশ।

খুব বেশি ভালো থাকতে নেই

সংগীত সাধক, কবি; চিত্রকর অথবা ভাস্কর, কাউকেই
খুব বেশি ভালো থাকতে নেই।

খুব বেশি ভালো থাকা মানে
মোহের নাছোড় লতাগুল্মসমেত স্নোতের টানে
সেখানেই অনিবার্য খর ভেসে-যাওয়া,
যেখানে কস্মিনকালে বয় না শিল্পের জলহাওয়া।

যদি শিল্পী প্রতিদিন ঝলমলে মদির, ফেনিল
পার্টিতে বেড়ায় ফুলবাবু সেজে, ক্রমশ আবিল
হয়ে ওঠে যদি আত্মা সোনাদানা হীরকের বশে,
যদি দ্রুত খসে
একে একে গোপন পালক সব তার, নুয়ে আসে
দেহমন কুর্নিশের ভারে আর সারাক্ষণ রমণীবিলাসে
মজে থাকে, তবে খাতা শুধু
অত্যন্ত বিরান মরুভূমি বুকে নিয়ে করবে ধুধু
আর চির প্রতীক্ষা-কাতর
পাথর থাকবে হায়, কেবলি পাথর।

অসুয়া, অবজ্ঞা, হেলা মাথা
পেতে নিয়ে, জলকষ্টে ভুগে কুড়িয়ে কাঁঠাল পাতা
গোধূলির মতো বস্ত্র গায়ে বাউলের সঙ্গে গলা
মিলিয়ে উদাস হেঁটে চলা
ছিলো ভালো, কখনো কখনো কোনো নারীকে জড়ানো
উষ্ণ বুকে অবিবাহে, পথপার্শ্বে উনুন ধরানো,
নৌকো বাঁধা ঘাটে ঘাটে, পাটাতনে শুয়ে
তুচ্ছতার বুদ্ধুদ উড়িয়ে দিয়ে ফুঁয়ে
ভোরবেলাকার কচি আলো,
খঞ্জনার নাচ, জেলে-বৌয়ের ভাসানো ঘড়া দেখা ছিলো ভালো।

আজো কায়মনোবাক্যে চাই
শিল্পীর সত্তায় থাক লেগে ত্যাগময় কিছু ছাই।
সামাজিক সকল ভড়ং
আমূল খারিজ ক’রে তীব্র সে বরং
সহজে করুক মনে পেলিক্যান কালি শহীদের
রক্তের চেয়েও ঢের
বেশি পূত পবিত্র এবং হাতুড়ি ও বাটালির
ঘায়ে ওড়া শাদা পাথরের হাঁট-টুকরোর ঘ্রাণ পৃথিবীর
সবচে’ সুরভিময় ফুলের চেয়েও
অধিক সুগন্ধী, ওর মনের নানান স্তরে ছেয়ে
থাক সর্বক্ষণ
সত্তাক্ষয়ী অমোঘ দহন।

রঙিন পালকে নিয়ে ভোর
নেচে নেচে বলে যায় দূরাগত একটি চন্দনা-
‘ওরে, পড়ে না কি মনে তোর
নক্ষত্রপল্লীতে একা জেগে থাকা মাইকেল এঞ্জেলোর অগাধ যন্ত্রণা?

 ঝড়

সবকিছু এরকম শান্ত আশেপাশে, আসমানে
রেশমি মেঘের আনাগোনা, যেন ফুলবাবু; পাখি
বাগানকে সাজায় মধুর সুরে, সুঘ্রাণ বিলায়
গোলাপ, মালতী, জুঁই। পথিকেরা যে যার ডেরায়
পৌঁছে যায় ঠিকঠাক। কোথাও বাজে না বিসম্বাদী
কোনো সুর; ঘরে ঘরে আলো জ্বলে, ক্যাসেট প্লোয়ারে
রবীন্দ্রনাথের গান পূর্বপুরুষের আশ্নীর্বাদ,
কবি তার শেষ পঃক্তি রচনার তৃপ্তি পেয়ে যায়।

অকস্মাৎ আকাশের মুখে কালি ঢেলে ঝড় আসে
দিগন্ত কাঁপিয়ে লণ্ড ভণ্ড চতুর্দিক, গেরস্তের
ঘর ভাঙে তাসের বাড়ির মতো, বুড়ো বট মুখ
থুবড়ে মাটিতে পড়ে শেকড়সমেত, যেন কোনো
স্বৈরাচারী শাসকের সিংহাসন ধুলায় লুটায়
দিগ্ধিদিক রাজপথ-উপচানো গণ অভ্যুত্থানে।

 তত্ত্ব তালাশ

-কোত্থেকে এসেছো তুমি, বলো?
-যেখানে ঝর্ণার জলে রূপসীর লাশ ভাসে,
গোধূলি বেলায় খুরে নির্জনতা ভেঙে তৃষিত হরিণ আসে
এসেছি সেখান থেকে, যদিও নিবাস ঝলোমলো
শহরের ধোঁয়াআটে গলিতে।
-কেন এত ন্যাতা জোবড়া পোশাক তোমার এই শীতে?
-তাই বুঝি?
পোশাকের দিকে নেই মন। আমি অন্য কিছু খুঁজি।
-কোন্‌ তত্ত্বতালাশে এমন মগ্ন তুমি?
-দূর দিগন্তকে বনভূমি
কী জপায় অন্তরালে, নদীতে কোথায় নুড়ি নড়ে
কীরকমভাবে, গাঢ় অন্ধকারে ঢিবির ওপরে
পিপঁড়ে পা ফেলে কোন্‌ ছন্দে, অচিন পাখির ভাষা
বোঝার উদ্দেশ্যে দূর দূরান্তরে আমার এমন যাওয়া-আসা

তিনটি কিশোরী

প্রায়শই জানালার ধারে এসে দাঁড়াই খানিক
বহুক্ষণ শুয়ে ব’সে একঘেয়ে লাগলে, এদিক
ওদিক আমার দৃষ্টি যায়
শ্রমণের মতো, দেখি দৃশ্যাবলি। একদিন বিকেল বেলায়
তিনজন কিশোরীকে একসঙ্গে নম্র হেঁটে যেতে
দেখলাম, ওরা কুল খেতে
খেতে হাসি মুখে চলে গেলো; আমি যতদূর পারি
দেখি, ভাবি কোথায় ওদের ঘরবাড়ি?
সোবহান বাগ কলোনীতে? নাকি আরো কিছু দূরে?
ওরা কি একত্রে থাকে-একই বাগানের ফুল? ঘুরে
বেড়ায় প্রসন্ন মনে সকালে বিকেলে?
অকস্মাৎ ঝড় বৃষ্টি এলে
কোথায় আশ্রয় নেবে? হয়তোবা আলাদা আলাদা
বাড়িতে ওদের বসবাস। খেলাধুলা, হাসাকাঁদা
আছে, তবু তিনটি রাগিনী মৃদু বাজে
অন্তরালে, তিনজন তিনভাবে সাজে।

জনালার ধারে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ
ওদের কথাই ভাবি। মন
এ সময় পেরিয়ে স্বতন্ত্র কালে চলে যায়। দেখি
লহমায় এ-কি
তিনটি কিশোরী গায়ে যৌবন নিয়ে আছে
তিনটি সংসারে। কীরকমভাবে বাঁচে
ওরা তিনজন, আমি দেখে নিতে চাই আগে ভাগে,
যেরকম পুরাণের গোলকে বিভিন্ন ছবি জাগে,
ভাসে ভবিষ্যত।
ওরা কি হয়েছে সুখী সকলেই? অপরাহ্নে একই পথ
চলে গেছে বহুদূরে, ওরা
এখন হাঁটে না আর একসঙ্গে। তিনটি জীবন আগাগোড়া
তিন-ছাঁদে তৈরি, কেউ সুখী, কেউবা অসুখী খুব। চুপচাপ
একজন, অন্যজন ছড়ায় কথার ফুলঝুরি। পদচ্ছাপ
কারো পড়ে শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় জীবিকার টানে,
কেউ খামকাই ঘোরে এখানে সেখানে
স্ফুর্তির জোয়ারে ঢেলে মন, স্বামীর সংসারে শোভা
কেউ, যেন ত্র্যাকুরিয়ামের মাছ, কেউবা বিধবা।

জানালার ধারে আমি তিনটি অপরিচিতা কিশোরীর
কথা ভেবে নিরর্থক বুএক নিই যন্ত্রণার তীর।

দীপিতার জন্যে পংক্তিমালা

মিশে গেছে অনেক শতাব্দী মরুভূমির হাওয়ায়,
বঙ্গোপসাগরে বয়ে গেছে বহু শতকের ঢেউ,
তোমার আমার দেখা হয়নি দীপিতা! কতকাল
আরব উদ্বাস্তু হ’য়ে শহরের আনাচে-কানাচে
ঘুরেছি ভীষণ অনাশ্রয়ে,
বিস্মৃতির বাগানের ঘ্রাণ মাঝে মাঝে
চোখের পাতায় রুয়ে দিয়েছে ধূসর
নিদ্রা কাতরতা,
কখনো কান্নায় চোখ বেরিয়ে এসেছে। হৃদয়ের
জখমের নীরবতা কতবার হয়েছে বাঙময় গানে গানে।

মনে পড়ে, কাগজের চাঁদ বানিয়েছি অমাবস্যা
রাতে আর মনোনীত জ্যোৎস্না দিয়ে রচেছি হরিণ
পদ্যের ভেতর,
একটানা ডেকে যাওয়া কোকিলের বুকে
নির্ভুল দিয়েছি গেঁথে আমার নিজস্ব পংক্তিমালা,
টাঙিয়ে দিয়েছি কত গাথা পরিত্যক্ত বাড়িটার
দেয়ালে দেয়ালে, তুমি ‘কী সুন্দর’ ব’লে
দিয়েছো বাহবা। শীত রাতে
ফুটেছে কদম ফুল বালিশের ওয়াড়ে আমার,
যখন এসেছো তুমি রঙধনু সাঁকোটা পেরিয়ে
চুপিসাড়ে স্বপ্নের কী স্বচ্ছ অপরূপ
শাল মুড়ি দিয়ে।

কেউ না বল্লেও হৃদয়ের তন্তজাল জেনে গেছে
কখন এসেছো তুমি ফিরে। দেখছো না
শহরের চেহারা কেমন পাল্টে গেছে লহমায়?
দ্যাখো, লালবাগের কেল্লার
অতি পুরাতন জীর্ণ দেয়াল মায়াবী
গলায় গাইছে দীপিতার শুদ্ধ প্রত্যাবর্তনের রূপময়
খেয়াল, মাঘের শীতে ফুটেছে কনকচাঁপা আর
অন্ধ ভিখিরির
এনামেল পাত্তরের দশ পয়সাসমূহ পেয়ে
গেছে সুলতানী আমলের দিনারের
বর্ণচ্ছটা, রেডিও এবং টেলিভিশনের খুব
নিষ্ঠাবান সংবাদ পাঠক, ভাষ্যকার
আজ সত্য প্রচারে অত্যন্ত মশগুল,
ব্যর্থ কবি অকস্মাৎ লিখে ফেলেছেন দৈববলে
অমরতা-ছোঁয়া পংক্তিমালা, কারাগার থেকে সব
রাজবন্দী শেকল ভাঙার গান গাইতে গাইতে
ভায়োলিন হাতে
রাঙা মেঘে বেড়াচ্ছেন ভেসে, পাথরের সিংহগুলো
কী ক্ষিপ্র দৌড়াচ্ছে, পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে
বাহারী ফ্যাশন্ন শো’তে দিয়েছেন যোগ ঢাকাই বস্তির যুবতীরা।
পুঁজিবাদী সমাজের নাকের তলায় অশ্বারুঢ়
লাল কমলের মতো অসি ঘোরাতে ঘোরাতে
কী দৃপ্ত সমাজতন্ত্র এসে গেছে কাঁধে
ঝুলিয়ে রঙিন লোকশ্রুত সূর্যোদয়।
কতকাল পরে
দীপিতা এসেছে ফিরে স্বপ্ন-স্মৃতিময় এ শহরে?

 না হয় আমি ঘুমের ঝোঁকে

না হয় আমি ঘুমের ঝোঁকে বলেইছিলাম,
‘বিদায় বলি, কথা হবে কাল সকালে’।
‘সকাল বেলা?’ প্রশ্নে তোমার কী যে ছিলো,
তারপরে তো শুনি না আর তোমার গলা।

নাম জানি না, ধাম জানা নেই, কেবল চিনি
জ্যোৎস্না-জ্বলা কণ্ঠস্বরের ঢেউয়ের খেলা।
কোন নিবাসে তোমাকে আজ খুঁজবো বলো?
কাকে শুধাই, ‘তুমিই কি সেই স্বরময়ী?

যখন পথে চলে আমার আসা-যাওয়া,
তখন যাকে লাগে ভালো, নেচে ওঠে
চোখের তারা, হঠাৎ ভাবি- এই তো তুমি।
ভীষণ উদাস দৃষ্টি হেনে যায় সে চলে।

তোমার স্বরের জলতরঙ্গ শোনার আশায়
কাক-ডাকা ভোর, দুপুর এবং সন্ধেবেলা
টেলিফোনের ধারে আমার সময় কাটে;
ঘুমছুট কতো রাত্রে লাগে ভোরের আবীর।

সাধ ছিলো দূর নদীর বুকে ভাসবো ভেলায়,
সঙ্গে আমার থাকবে তুমি মুখোমুখি।
অস্তগামী সূর্য তোমার চোখে মুখে,
খোলা চুলে বুনবে অসীম কল্পকথা।

সেই দূরাশা এক পলকে অস্তমিত,
ধসে-পড়া বাড়ির মতো প’ড়ে আছি,
আমার ওপর মরা চাঁদের কান্না ঝরে,
নিষ্ঠুরতা বুঝি তোমার সহোদরা।

বিস্মরণের ডোবায় যদি ছুড়েই দেবে,
তবে কেন রাত দুপুরে জাগিয়েছিলে?
শুধু আমার সত্তা-ভিতে ছুঁইয়ে দিতে
ভুল প্রহরের মধুর স্বরের ক্ষণিক মায়া?
রাতের শিরায় কী আছে এক মদিরতা,
যার তাড়না যোগায় ভাষা তোমার প্রাণে।
দিন-দুপুরে কুলুপ এঁটে রাখো মুখে,
এখন দেখি রাতও দগ্ধ কথার খরায়।

আমার স্মৃতি দেয় কি হানা তোমার মনে
কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে? কিংবা যখন
খাতার পাতায় খামখেয়ালি আঁচড় কাটো?
অথবা টিপ বাছাই করার ব্যস্ত বেলায়?

আমার বুকে আর্ত কোকিল নীড় বেঁধেছে;
কণ্ঠে রক্ত তুলে বলে বারে বারে,
‘টেলিফোনে উঠুক বেজে তোমার গলা,
কেবল আমি এটুকু চাই, আর কিছু নয়?’

হৃদয় জুড়ে স্বেচ্ছাচারী অস্থিরতা
ওড়ায় ধূলো; কোথাও আমার মন বসে না।
গ্যালী-দাসের মতোই আমি আষ্টেপৃষ্ঠে
বন্দী হয়ে দাঁড় টেনে যাই স্মৃতির জলে।

 নাম

জাঁদরেল সভাসদদের তিনি সুদূর কালের
সমাসীন মহারাজ ক্যান্যুটের মতো আচরণে
বল্লেন জলদমন্ত্র স্বরে, ‘মুছে ফেলো তার নাম।
কার নাম? একটি বিনীত প্রশ্ন সমুদ্রের ঢেউয়ের ধরনে
সন্ত্রমে লুটিয়ে পড়ে তাঁর চকচকে
জুতমোড়া পায়ে।

‘কেন, সেই বেয়াড়া কবির, রাত্রিদিন আজেবাজে বকা যার
মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়েছে সম্প্রতি; তাড়াও
নাম তার দেশের উত্তর
দক্ষিণ পশ্চিম পূর্ব কোণ থেকে’ ব’লে
কফির পেয়ালা তিনি আয়েশী ভঙ্গিতে
ঠোঁটে ছোঁয়ালেন।

শক্তিধর যিনি, দশ দিকব্যাপী যাঁর রবরবা
হুকুম তামিল হ’তে তাঁর
হয় না বিলম্ব ক্ষণকাল। ঢাকঢোল না পিটিয়ে
সাজিয়ে সহিস ঘোড়া খুব চুপিসাড়ে
শুরু হলো কাজ,
যেমন দেয়াল থেকে রাত্রির রোমশ অন্ধকারে
মুছে ফেলা হয়
সাত তাড়াতাড়ি দ্রোহী অমোঘ লিখন।

অথচ শহরে গাছপালা ঘন ঘন মাথা নেড়ে
করে প্রতিবাদ,-
‘এ কবি করেছে স্তব আমাদের কতদিন। নাম
তার আমাদের ডালে ডালে
পাতায় পাতায়
থাকবে প্রবল লেখা, রোদে পুড়বে না,
যাবে না বর্ষার জলে ধুয়ে।
ফুটপাত বলে,
এ পথে হেঁটেছে কবি দীর্ঘকাল, তার নাম থাকবে আমার
বুকে আঁকা। আহত কোকিল
ভীষণ চমকে দিয়ে পথচারীদের ডেকে ওঠে-
‘পারো তো আমার কণ্ঠ থেকে
উত্তপ্ত সাঁড়াশি দিয়ে এক্ষুণি উপড়ে ফেলো তার
নাম, যে আমার সুর খাতার পাতায়
তুলে নিয়ে বাজায় স্বতন্ত্র সুর নিদ্রাহীন রাতে বড় একা।
কতিপয় নাগরিক, বিভিন্ন বয়েসী, পৌরপথে
আলাপ করেন পরস্পর, ‘আচ্ছা, বলো দেখি, জনসাধারণ
যে কবির পথে হৃদয়ের সূর্যোদয়ের গালিচা পেতে
রাখে, তার নাম মুছে দেবে,
কে এমন শক্তি ধরে আমাদের এই পৃথিবীতে?’

পথভ্রষ্ট কোকিল

হে পৃথিবী তোমাকে সাজাতে আমি বসন্ত সম্ভারে
এসেছি তোমার দ্বারে,
ব’লে এক পথভ্রষ্ট আহত কোকিল
সত্তার গহনে, কণ্ঠে নিলো মেখে আকাশের নীল।

‘দ্যাখো, এ কেমন অলংকার
এনেছি তোমার জন্যে, যার
নাম গান, মর্মমূল-ছেঁড়া,
যা শুনে চমকে ওঠে কী ব্যস্ত শহুরে পথিকেরা,
তৃপ্ত হয় গ্রাম্যজন।
মাঝে মাঝে নিষাদের মত্ততায় তছনছ কী সুরেলা ক্ষণ।

কে দেখাবে লয় ও তানের
কারুকাজ? সহজে ফোটে না আর এখানে, গানের
ঝর্ণাস্নাত কুঁড়ি,
কোকিলের কণ্ঠে কারা দিয়েছে প্রবল ঠেসে নুড়ি।
ঝরে যায়, দিন ঝরে যায়,
অবিরল রক্ত তুলে গলায় কোকিল আজ নিয়েছে বিদায়।

পুনরুত্থান

বৃহস্পতিবার রাতে যখন আমার কব্জি ঘড়িতে
কবুতরের চোখের মতো
থরথর করছে দেড়টার সংকেত, যখন আমি
নির্ঘুম চোখে তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে বেড়াচ্ছি
অবচেতনের গহন কুয়াশাচ্ছন্নতায়
একটি চিত্রকপ্ল, যা কাঠবাদামি সমালোচকদের মাথাকে
ক’রে দেবে ঘূর্ণ্যমান লাটিম, অত্যন্ত ঈর্ষুক ক’রে তুলবে
ধামাধরা পেটমোটা ইঁদুর আর মিরকুট্র
গন্ধমূষিকদের মতো কবিকুলকে,
তখন হঠাৎ আমার দৃষ্টির পক্ষে অবিশ্বাস্য
এক দৃশ্যের অবতারণা হ’লো আর আমি ফ্যাল ফ্যাল
তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে।
একে উপক্রমনিণকা হিশেবে বিবেচনা করাই শ্রেয়,
কোথাও না কোথাও
শুরু তো করতেই হয়। তবে হলফ ক’রে বলতে পারি,
ব্যাপারটা ঘটেছিলো বৃহস্পতিবার ঠিক কাঁটায় কাঁটায়
রাত দেড়টায়, যখন আমি…

সত্যি বলতে, যে দৃশ্যের কথা বলছিলাম
তা’ দেখে আমার দুটো চোখই পাথর,
বুকের হাড়, মাংস আর ত্বক ভেদ ক’রে বেরুতে চাইলো
হৃৎপণ্ড, আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নামলো
এমন শৈত্যপ্রবাহ বা’ আমি ইহজীবনে
অনুভব করিনি, যেন কেউ আমাকে চালান ক’রে দিয়েছে
সুদূর হিমযুগে।

আরে বাবা, দেখি কি আজিমপুর, বনানী, জুরাইন
আর মীরপুরের গোরস্তান থেকে
কবর ফুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছে মৃতের মিছিল।
খৃষ্টান সিমেট্রি
থেকেও দলে দলে বেরিয়ে এসেছে ওরা, যারা
লোকান্তরিত হয়েছে।
ধীমান, বিদ্বান, নিরক্ষর, শিক্ষক, নবাব, বিদূষক,
কুলি, কামিন, ওস্তাগার,
ভিস্তি কোচোয়ান, কসাই, সোনারু, কুরূপা, সন্দুরী-
একজনকে দেখে মনে হলো, একদা ছিলেন তিনি
শহরে সুন্দরীতমা, যদিও এখন গালে তার মাটি
লেগে আছে।
এমনকি সেকেলে দালালরাও
উঠে এসেছে পুরানো কবর ছেড়ে।
ওরা আসছে তো আসছেই,
শহর-উপচানো এই মৃতদের দুরু দুরু বুকে, ভয়ার্ত
কন্ঠে প্রশ্ন করি-
আজ রাতে আপনাদের এই
ভয়ানক ভিড় কেন আমাদের শহরে? কী এমন ঘটলো যে
আপনারা সবাই শান্তিময় চিরনিদ্রা ত্যাগ ক’রে
আবার আবির্ভুত হয়েছেন জীবিতের রূপে? তবে কি আজ
অভিশপ্ত এই শহর, আমার প্রিয় শহর,

ওরা গর্জে উঠে বললেন সমস্বরে-
এ শহরে জীবিত কেউ নেই আর, মৃতদের চেয়েও অধিক মৃত
বাসিন্দ্য ভ’রে গেছে ঘরের পর ঘর। তাই, তোমাদের
ঠাঁই হোক গোরস্তানে এবং
তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি জীবিত ব’লে
আমরা দখল করবো তোমাদের ঘরদোর।

আমি বোবার ধরনে আর্তনাদ ক’রে আমার নিঃসাড়
পাড়ায় সাড়া জাগাতে চেষ্টা করলাম সবার
ঘুম ভাঙানোর জন্যে অস্বাভাবিক উঁচু পর্দায়
বাঁধলাম কণ্ঠস্বর, বলতে চাইলাম-
এক্ষুণি আবার দাফন করো ওদের,
ওদের দাফন করো,
দাফন করো। কিন্তু কারো ঘুমের সর এতটুকু
রেখায়িত হলো না এবং আমিও
গোঙাতে গোঙাতে মড়ার মতো ঢলে পড়লাম নীরন্ধ্র ঘুমে।

পৌঁছে দিচ্ছি

গ্রীষ্মের বিকেলে বেশ কিছুক্ষণ ধ’রে
একজন বুড়ো, শীর্ণকায়, ছিলেন নিঃসঙ্গ ব’সে চুপচাপ
পার্কের বেঞ্চিতে। কিছু গুঢ়
কথা তাঁর মনে
বুড়বুড়ি কাটছিলো হয়তো; তাঁর হাতে
খাবারের ঠোঙা, ধুর্ত কাক হঠাৎ ছোঁ মেরে নিয়ে
যায় শুক্‌নো রুটি। বৃদ্ধ যেন কোনোকালে
শেখেননি বাধা দিতে, এরকম অসহায় রইলেনু ব’সে
নিজের জায়গায়। রঙচটা লাঠি পাশে ছিলো থিতু
দরিদ্রের নির্ভরের মতো।

স্মৃতির পায়রাগুলো তাঁর
সত্তার কার্ণিশে গম খুঁটে খায়। কখনো কি তিনি
কারো ভালোবাসা চেয়ে ব্যর্থতার
কাঁটার মুকুট প’রে পথভ্রষ্ট একাকী পথিক
ঘুরেছেন বিরান প্রান্তরে? তখন কি দোয়েলী শিসের চেয়ে
কুকুরের ডাক
অধিক মধুর মনে হয়েছিলো তাঁর? নাকি তিনি
নিজেই কাউকে ছলনার জালে জড়িয়েছিলেন নির্বিকার?

হঠাৎ দুরস্ত একদল বালকের কোলাহল
কানে আসে; দেখি ওরা বুড়ো লোকটার খাবারের
ঠোঙা নিয়ে করে লোফালুফি। একজন
হাতে তুলে নেয় লাঠি, কেউ কেউ খোঁচায় বৃদ্ধকে,
কেউবা ঈষৎ সুড়সুড়ি দিয়ে হো হো হেসে ওঠে,
লাঠির উদ্দেশে বৃদ্ধ আশপাশে হাতড়ে বেড়ান
উদ্বেগতাড়িত; আমি প্রায়
দৌড়ে যাই, শাসাই বালকদের আর
দেখি সে বুড়োর চোখ দুটো অন্ধত্বের গাঢ়তম ছায়াময়।
দৃষ্টিহীন চোখে তাঁর, মনে হলো, সুদূর কালের
বিষণ্নতা জড়ো হয়ে আছে
কী নিথর! ট্রাউজারে পেশাবের দাগ, বুড়োদের
যে রকম হয়ে থাকে; কয়েকটি ক্ষয়া
ফলের বীচির মতো দাঁত মাড়িতে আটকে আছে,
মুখের দু’কর বেয়ে লালা, বোবা আর্তনাদ ঝরে,
বাতিল সারিন্দা তাঁর আস্তিত্বের ভার।

আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে
বেশ বিচলিত আর ঈষৎ বিব্রত উঠে দাঁড়ালেন তিনি,
লাঠিটা কুড়িয়ে ঘাস থেকে
দিলাম বিশীর্ণ কম্পমান হাতে। বালকেরা দূরে
চলে গেলে প্রশ্ন করি, ‘কোথায় যাবেন?
কোন্‌ দিকে?’ বল্লেন, ‘এই তো
সামনের রাস্তাটা যদি পার হতে পারি, তাহলেই
আস্তে সুস্তে পৌঁছে যাবো গন্তব্যে আমার। সম্ভ্রমকে
তাঁর হাতে সহজে সোর্পদ ক’রে কিয়দ্দূর হেঁটে
যেতে যেতে ভাবি, যেন
রোদপোড়া বৃষ্টি ভেজা জীর্ণ জুতো-পরা এই আমি
নিজেকেই সন্তর্পণে পৌঁছে দিচ্ছি কে জানে কোথায়!

বন্দীরও মুহূর্ত আছে

বন্দীরও মুহূর্ত আছে চার দেয়ালের গণ্ডি ছেড়ে
মেঘের রঙিন গালিচায় উড়ে যাবার এবং
গ্রীক দেবতার মতো সরোবরে সাঁতার কাটার।
সে মুহূর্ত আটকাবে তাকে, সাধ্য নেই সর্বোত্তম
প্রহরীর।এমন মুহূর্ত আসে, যখন নিঃসঙ্গ
কয়েদীন শিকল, গায়ের বেড়ি সরোদের মতো
বেজে ওঠে অতীতের কোনো সুখদ স্মৃতির টানে,
স্বাধীন চাঁদের ফালি নেমে আসে করতলে তার।

উৎপীড়নে জর্জরিত, বুকে পিঠে ক্রুর কালসিটে;
কখনো দুঃস্বপ্ন তাকে বন্য কুকুরের পাল হয়ে
করে তাড়া বারবার। মুক্তির সোপান উদ্ভাসিত
মাঝে-মধ্যে পুনরায় শূন্যে চকিতে মিলিয়ে যায়।
তবু সে বন্দীর মনে হয় কোনো একদিন তার
একলার নয়, শোষিতের একতার হবে জয়।

বস্তুত স্বপ্নই

বস্তুত স্বপ্নই বলা যায় একে, স্বপ্নে জাগরণ
কিংবা জাগরণে স্বপ্ন, ফুটে থাকে দাবির মাধবী,
সম্পূর্ণত এ আমার ব্যক্তিগত, অথচ আবার
এতে মুটে মজুর, কৃষক, ছাত্র, বিমর্ষ কেরাণী,
পাকাচুল পণ্ডিত এবং কলোনীর বারান্দায়
দাঁড়ানো তম্বীর ভাগ আছে, নিতে পারে যার যত
খুশি, যদি ডিঙিয়ে আসতে পারে প্রাথমিক বেড়া,
যদি হে নিদ্রিতা, চোখ মেলো তুমি তাদের উদ্দেশে।

ঘুমের ভেতরে প্রতীক্ষায় আছো সেই কবে থেকে।
দিনক্ষণ জানা নেই কখন উঠবে তুমি জেগে
অবচেতনের গূঢ় স্তর থেকে, পাতালপুরীতে
যেমন পাথুরে মূর্তি প্রাণ পায় স্নিগ্ধ মন্ত্রপুত
জলের ছিটায়; আমি ছাড়া অন্য কেউ পারবে না
জাগাতে স্পন্দন স্তব্ধ, শিলীভূত তোমার শিরায়।

 বেশ ভালোই তো

পারো তো কাদায় ধৈর্য ধ’রে প’ড়ে থাকো
আরো কিছুকাল, ওরা লাথি ছুঁড়ুক বেদম বেশুমার, ঢাকো
ঢেকে রাখো মুখে থুতু-ছিটানো লোকেরা চ’লে
যাক দূরে ক্লান্ত হয়ে ঢ’লে
মাতাল মোষের মতো, নইলে কিছু অতিশয় কাছের চেহারা
দেখে দুঃখ পাবে। দিশেহারা
হ’লে চলবে না আজ, যারা ভাবে তোমাকে বেহদ অপমান
ক’রে নিজেদের শান
সোজা সাত আসমানে পৌঁছে দিলো তরতর, নিজেদের ওরা
ত্বরিত ঠাউরে নেয় তালেবর, নিত্যদিন হাতে পেয়ে বশম্বদ তোড়া
রঙ বেরঙের তাজা ফুলের এবং
আহলাদে আটখানা হয় সামনে দেখে শত শত চমৎকার সঙ।

ছলছুতো ক’রে
বহুরূপী মন্ত্রণার ছমছমে কর্কশ প্রহরে
একজন শব্দ শ্রমিকের মুখ ঘোর অন্ধকার
ক’রে দেয়া কী এমন শক্ত কাজ আর
একালে? এমন হ’য়ে এসেছে সুদূর অতীতের
দরবার থেকে বারবার দেশে দেশে, তারই জের
চলছে, চলছে নিরন্তর। যার ঠোঁটে বাঁশি রাগ রাগিনীর
বিস্তার ফুটিয়ে তোলে তারই বুকে বিঁধে যায় জহরিলা তীর।

কী তোমার অপরাধ? ঘুমের মতন
নিমগ্ন জীবন থেকে তুলে আনো যখন তখন
লতাগুল্ম, চিত্রিত ঝুনুক
রাশি রাশি এবং দেখতে চাও হিরন্ময় মুখ
সত্যের, দিয়েছো পেতে জীবন কাঁটার বিছানায়। অলৌকিক
পাথরের জন্যে দশদিক
তন্ন তন্ন ক’রে খোঁজা, স্বপ্নে-জাগরণে খুশনুমা দ্বীপে একা
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবো, পাও কিনা দেখা
সুন্দরীতমার কিংবা দাও সাড়া তখনই যখনই, আর্তনাদ
করে ওঠে দেশ বন্দী প্রমোথিউসের মতো। নিজের অগাধ
দুঃখেও চকিতে বেজে ওঠো
গুণীর বাদ্যের মতো বারবার, ছোটো তুমি ছোটো,
যেন দূর পাল্লার নিঃসঙ্গ দৌড়বাজ, পায়ে ক্ষত
ফোটে ক্রমাগত।
কী আশ্চর্য, দানেশমন্দিতে দড়, অথচ কিছুতে এ সহজ
সত্য ওরা মেনে নিতে পারে না, মগজ
নিখুঁত ধোলাই করলেও কিছু লোক
থেকে যায়, যাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে দ্রোহের দুর্বার ঝোঁক।
কে না জানে বুদ্ধের হাতের পদ্ম ফুল পায়ের তলায় ফেলে
চটকালে কিংবা রেগে মেগে এলেবেলে
সাত তাড়াতাড়ি
কোকিলের ঘাড় মটকালে কৃতিত্বের পাল্লা ভারি
হয় না মোটেই বাস্তবিক,
বরং চৌদিকে দিনরাত্রি রব ওঠে ধিক ধিক।
মেনী মেনী থ্যাঙ্কস ওদের, ওরা যা যা করেছেন তার ঋণ
শোধ করা অসম্ভব। তাদের অশেষ বদৌলতে অন্তরীণ
কবিতা তোমার
ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকড়া চুল বেরিয়ে এসেছে খুলে দ্বার
এক ঝটকায় আর তোমার কবিতা ফের গোইয়ার ছবির মতো ফোটে
ঘন ঘোর তমিস্রায়, তোমার কবিতা ঠোঁটে ঠোঁটে
নাচে, যেন মত্ত নটরাজরূপী উদয়শঙ্কর। করো শুকুর আদায়,
বেশ ভালোই তো, নির্দ্ধিধায়
সেসব বিবেচকের, যাদের অশেষ কৃপা বিনা তুমি এই
তালিম পেতে না-অবরুদ্ধ খাঁচা ছাড়া হারাবার কিছু নেই।

যখন গোধূলি মেঘে

যখন গোধূলি মেঘে মায়াবী গালিচা পেতে যাচ্ছিলাম ভেসে
বড় একা, দেখি দূর দ্রাক্ষাবন থেকে
একজন বুজুর্গ এলেন উঠে, ঢুলু ঢুলু চোখ,
ঠোঁট ভেজা, যেন এইমাত্র পানপাত্র এসেছেন
রেখে কুঞ্জে, মৃত্যু তাঁর পেছনে পেছনে
তুখোড় গোয়েন্দা, ঘোরে সারাক্ষণ কিংবা মিশে থাকে
বয়েসী শরীরে, তিনি শান্ত মেঘদল উড়ে উড়ে
বললেন প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে-

‘ইতিহাস খচিত সুদূর অতীতের বাগদাদ
শহরে একদা
জ্যোৎস্নাপ্রিয় স্বপ্নশ্রিত ঘাস খেকো ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তাঁরা
কতিপয় কবি,
মুল্যবান সওদার মতো
ক্রমশ হলেন জড়ো সুলতানের দরবারে। একে
একে কবিকুল গলা খেলিয়ে করেন পাঠ চম্পু, কত
কাসিদা, গজল, ঝকমকে
সুলতানের হাসিতে কবিতা
অধিক জাজ্বল্যমান হয়ে শোভা পায়
দেয়ালে দেয়ালে, নক্সাময় গালিচায়,
তখ্‌তে পায়ায়,
সভাসদদের ঝলমলে
লেবাসে, কবিতাবলী চঞ্চল চড়ুই হয়ে ঢুকে
পড়ে অবলীলাক্রমে জেবের ভেতর, ঢলাঢলি
করে খুব লাস্যময়ী রমণীর কোলে।

যখন কবিতাবলী দিনারের মতো ওহো হাঃ হাঃ
অত্যস্ত ঝিকিয়ে ওঠে শাহী দরবারে,
তখন রাস্তার ধারে বহু
অনাথ দাঁড়িয়ে থাকে অনাশ্রয়ে, ভিখিরি জটলা
করে পথে রুটির আশায়,
ক্ষুধা চাবুকের তাড়া খেয়ে ফেরে শহরের আনাচে কানাচে
এবং বিপজ্জনক রাজন্দিগণ টিমটিমে
নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে প্রত্যহ শোনেন।
প্রহরীর পদশব্দ, কয়েদখানার রুক্ষ দেয়ালে আঁচড়
কেটে দিন যাপনের হিসেব রাখেন, মাঝে মাঝে
কানে আসে কবে কার ফাঁসি হলো, অন্ধকারে বসে
তম্ময় ভাবেন প্রিয় মুখ আর তারাজ্বলা আকাশের কথা।

 রাতের ক্লিনিক

বাঁচা গেলো, অবশেষে শল্যপর্ব হলো শেষ।
চল্লিশ বছর ধরে যে বিষাক্ত ফুল
পরেছি গোপনে
মুলে ভুল ক’রে তা নির্মল হলো এতদিনে ভেবে
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি। অবলীলাক্রমে এক জোড়া
শব্দ বাঁচা গেলো’ উচ্চারণ
করলাম বটে, তবে তার কোনো মানেই হয় না। একবার
যার ভাগ্যে জোটে
বন্য কুকুরের তাড়া, তার
প্রকৃত নিস্তার নেই কোনোদিন। হলদে রবারের হাত
নিপুণ শিল্পের সহযোগিতায় দ্রুত
পচনপ্রবণ অতিরিক্তি মাংসপিণ্ড আমার এ শরীরের
উপড়ে ফেলেছে কিন্তু তার
ধকল চলেছে সাতদিন পরও, হয়তো
চলবে অধিককাল। ক্ষত সারাবার জন্যে আরো কিছু
কারুকার্য বাকি আছে, অবশিষ্ট আরো কিছু আঁচ।

যে গন্ধ আমাকে খুব দূরে
সরিয়ে রেখেছে হাসপাতালের থেকে রবাবর,
সে গন্ধ এখন
আমার ভেতর থেকে, মনে হয়, বেরুচ্ছে সর্বদা।
প্যাথেড্রিন শিরাপুঞ্জে ঘুমপাড়ানিয়া
গান গায়, তবু মাঝে-মাঝে দূরতম
পূর্বপুরুষের
যন্ত্রণা জাগিয়ে রাখে। উঠে দাঁড়ালেই হাঁটু কাঁপে,
দু’পা এগোলেই ভাবি আবার নতুন করে যেন
হাঁটতে শিখছি, এ রকম
নড়বড়ে আপাতত আমার চলন,
এখন আমার পথ্য তরল আহার্য কতিপয়।
কখনো কখনো গীতবিতানের আছে মৃত্যু আছে
দুঃখ এই শব্দগুচ্ছটিকে সাময়িকভাবে
মিথ্যে করে দিয়ে ডেকে ওঠে শহুরে কোকিল।

এই সে সময়
যখন কাঁচের গ্লাসে টলটলে জল
দেখে, হরলিক্সভরা পেয়ালায় খানিক চুমুক
দিলে, ভিজিটিং আওয়ারের
উপহারগুলি বাদশাহ সুলেমানের খনির
রাশি রাশি রত্নের চেয়েও দামী মনে হয় বলে
কপালে অথবা চুলে কারো স্পর্শ পেলে
সিস্টারের হাত থেকে ক্যাপসুল, নিদ্রাবড়ি
তুলে নিলে ভালো-লাগা নূপুরের মতো
বেজে ওঠে। এই সে সময়
যখন ক্লিনিক বড় তন্দ্রাতুর। তরতাজা যে যুবক
বেহালা-বাদক
অন্ত্রে দুষ্ট ক্ষত নিয়ে এসেছে এখানে,
এখন কেবিন তার কবরের মতো
অত্যন্ত নিশ্চুপ। শাদা ত্র্যাপ্রনের জুতোর ঈষৎ
শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই-
না বৃদ্ধের গোঙানি না নব্জাতকের
চিৎকার, কিছুই নেই। দূরে
সিস্টার আলোয় মিশে বলপেন দিয়ে
লিখছেন রুগীর রিপোর্ট, কাকে কোন্‌ বেলা
কী কী ওষুধ খাওয়াবেন, সযত্নে মিচ্ছেন টুকে।
আমি নিদ্রাহীন অলক্ষ্যে বেরিয়ে আসি শূন্য বারান্দায়
আরোগ্যশালার নানা রুগীময় কেবিন পেরিয়ে
বারান্দায় এসে
অকস্মাৎ দেখি দূরবর্তী মিনারের কিনারায়
ডাগর ক্ষতের মতো চাঁদ,
বিশদ আবৃত্তি করে ক্ষুধা, ব্যাণ্ডেজে লুকানো ক্ষত
নিয়ে ভাবি সারা দেশ আমার মতোই খুব অসুস্থ অসুখী।

 ল্যাম্পপোস্ট

তুমি কি আমাকে ভাবো ল্যাম্পপোস্ট কোনো,
যার গায়ে পথের কুকুর ঠ্যাঙ তুলে
পথচারী ছুঁড়ে দ্যায় নিষ্ঠীবন যখন তখন? যার গায়ে
ঠেস দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে, ফিল্মি গান গায়
পাড়ার মাস্তান? ল্যাম্পপোস্ট কারো দিকে ছুটে যেতে
ধ’রে হেঁটে বেড়ানোর শখ নেই তার,
অকস্মাৎ কাউকে জড়িয়ে ধ’রে বেয়াড়া অবেগে চুমো খাবে,
এরকম সাধ তাকে কখনো করে না বিচলিত;
ল্যাম্পপোস্ট বড় বেশি স্থানু,
রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাত্রিবেলা সারাক্ষণ
জ্বলে, শুধু জ্বলে।

শূন্য চেয়ার

পরিতোষ সেন শ্রদ্ধাস্পদেষু

ঐন্দ্রজালিকের ভোজবাজি নয় আদৌ বাস্তবিকই
আছে, জলজ্যান্ত, বসে আছে
বড় একাকিত্বে মাথা উঁচিয়ে নিশ্চুপ। ছুঁতে পারি
হাত বাড়ালেই, গৃহকোণে
অনেক পুরোনো
কাঠের চেয়ার ধ্যানী, কে আসে কে যায় লক্ষ নেই,
নিত্যদিন বসে থাকে
নিজস্ব সম্ভ্রম নিয়ে। ভাবি খুব ঝাঁকে
তাজিমে কুর্ণিশ করি তাকে বার বার; মনে হয়
আমাকে পছন্দ করে, কোনো কোনোদিন হাত নেড়ে কাছে ডাকে।

কখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি কবেকার
আহত স্বপ্নেরা
তার কাছে যায় ক্রাচে ভর দিয়ে কিংবা হুইল চেয়ারে।
তার সঙ্গে আছি বহুকাল
একই ঘরে, কত স্মৃতি টাঙিয়ে দিয়েছি
তার গায়ে, তাকে
বোঝার আশায় আমি কাছে যাই, খানিক দাঁড়াই
নিরিবিলি, অথচ বসি না কোনোকালে।

একটি রুমাল, দেশলাই, মোমবাতি, বলপেন
চেয়ারে রয়েছে, যেন কেউ এই মাত্র উঠে গেছে
শূন্যতা গচ্ছিত রেখে, হয়তো আবার বসবে এসে
চুপচাপ, টানবে পাইপ,
রুমাল বুলিয়ে মুছে নেবে
কপালের ঘাম আর কাটাবে সময় অন্তর্গত
কত সুর্যমুখী, কাকময় শস্যক্ষেত,
গহন সন্ধ্যার স্পর্শলাগা পাখি, গাছগাছালির ভাবনায়।

মনে নেই, কতকাল এ চেয়ার বাশিন্দাবিহীন
পাখির বাসার মতো আছে
গৃহকোণে, আছে
আমার আত্মার অভিভাবকের মতো,
কখনো কখনো যেন অতিশয় গাঢ় কণ্ঠস্বরে
শুধায় আমাকে ‘সারারাত
নির্ঘুম কাটিয়ে ফের ভোরবেলা সাত তাড়াতাড়ি
কোথায় চলেছো?

কোথায় চলেছি আমি? কী দেবো জবীব?
কোন্‌ চোরাবালি গিলে খাবে
আমাকে, কেমন
গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলবো
যাত্রা শুরু না হতেই? কোন্‌ শত্তুরের
গলা আমি জড়িয়ে ধরবো নির্দ্ধিধায় মিত্র ভেবে?
দেখবো কি গুপ্তহত্যা, গণহত্যা? বুকের পাঁজর
কখনো কি ঝলসে উঠবে অস্ত্র হয়ে?

জানা নেই, শুধু জানি,
কোনো কোনো এমন চেয়ার আছে শূন্য থাকে, থাকে চিরদিন।

 সে আমাকে বললো

কেমন রহস্যময় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
দোহাই তোমার
চুপ থাকো, পেরিয়ে এসেছি মেঘপথ, কতিপয়
নক্ষত্রের সাঁকো আর খবদ্দার তোমার চেয়ার ছেড়ে উঠে
এসে এই আমাকে ছুঁয়ো না
ভুল ক’রে লটের নারীর মতো নুনে তৈরি আমি।

তোমার কপাল থেকে খুব সহজেই
বেবাক কষ্টের দাগ মুছে
দিতে পারতাম,
এই যে তোমার চারপাশে অতিদ্রুত পরগাছা
গজিয়ে উঠেছে, লহমায়
সেগুলো উপড়ে ফেলে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে
পা দোলাতে পারতাম ঝুল বারান্দায়। ইদানীং
তোমার উদ্দেশে যারা থুতু
ছিটোচ্ছে বিস্তর, সেই নিষ্ঠীবন ওদের আবার
চেটে নিতে বাধ্য করা সাধ্যাতীত নয়
আমার। তোমার যত ব্যর্থতার তাল তাল কাদা আশেপাশে
ছড়ানো রয়েছে
তা’ দিয়ে অনিন্দ্য এক প্রতিমা বানিয়ে দিন্দুকের
মুখে সেঁটে কুলুপ তোমার
সত্তা উদ্যানের
সুগন্ধি আভায় মুড়ে দেয়া কী এমন
কঠিন আমার পক্ষে? আমার কীর্তির বর্ণচ্ছটা সুনিশ্চিত
তোমাকে রাঙিয়ে দিতো স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে হে প্রবীণ।

তোমার কালের
অনেক মেধাবী পুরুষের মগজের কোষে কোষে দিনরাত
নোংরা নর্দমার কাথ জমতে দেখেছি,
তোমার কালের
ভীষণ পতিতদের সকল ঋতুতে নেপো সেজে
দই মেরে যেতে দেখে দেখে
ক্লান্ত আমি তোমার কালের
বিখ্যাত পণ্ডিতদের চমৎকার লেজনাড়া
কেড়েছে আমার দৃষ্টি বার বার, যারা
মিথ্যাকে গয়নাগাঁটি আর শাড়ি কাঁচুলি পরিয়ে
জমকালো সত্যের আদলে ঝাড়লন্ঠন শোভিত
বাগান বাড়ির
নাচের আসরে দিব্যি নামায় মোচ্ছবে
মেতে ওঠে ইয়ার বক্সির সংগে, তাদের পিচ্ছিল ফিচলেমি
লক্ষ ক’রে বিবমিষা জাগে,
তোমার কালের বাছা বাছা
পতিত কবিরা
যখন পুরানো সারিন্দায় স্বৈরাচারী নায়কের
ঝলমলে সব বুট পালিশের বসন্তবাহার
বাজায় সোৎসাহে, বেলেহাজ
সেই উম্মত্ততা দেখে উম্মাদেরও নিছক লজ্জায়
মাথা হেঁট হয়ে যায়।

না, আমাকে স্পর্শ করবার চেষ্টা তুমি
করো না কখনো,
কেননা এখনো আমি ভূমিষ্ঠ হইনি, তবু বলি
একদিন তেজস্ক্রিয় ছাইয়ের গাদায়
তলিয়ে যাবার আগে পৃথিবীর নিসর্গ নারীর
জয়গান গেয়ে যেতে পারি
যাকে পেলে তোমার বয়েসী বুক হাওয়ালাগা পালের মতন
স্ফীত হতো গৌরবে, আমি সে
অজাত আত্মজ
তোমার দাঁড়িয়ে আছি রহস্যের মসলিন ঢাকা।

 হাসপাতালে ভর্তি হবার আগে

বন্ধুরা যে যার ঘরে যথারীতি চলে
গেলেন একটু বেলা ক’রে। দেদার চুট্‌কি ব’লে
আসর মাতিয়ে রাখা যার স্বভাব, বিষন্ন মুখে
নিলেন বিদায় তিনি। যেন আজই চুকে
বুকে যাবে জীবনের হিশেব নিকেশ ভেবে যার
চেহারায় গাঢ় অন্ধকার
ওৎ পেতে ছিলো, তার ঠোঁটে
যাবার সময় অকস্মাৎ এক রাশ জুঁই ফুটে ওঠে।
‘পুস্তকেও রয়েছে জীবন
স্বতন্ত্র আদলে’-এই প্রিয় বাক্য যখন তখন
আউড়ে বিস্তর ধোঁয়া ছেড়ে
চুরুটের যিনি মাঝে-মাঝে কিছু ভয়ঙ্কর তেড়ে
আসা বায়বীয় কুকুরের ডাক শুনে
ওঠেন আমূল কেঁপে, তিনি আরো কিছুক্ষণ গূঢ় কথা বুনে
শুভেচ্ছা জানিয়ে পথে নেমে হেঁটে যান
ভ্রষ্ট পথিকের মতো। শূন্যতায় পেতে রাখি কান।

নর্দমার ধারে ব’সে একজন গুমনাম হাভাতে ভিখিরী
ফেলে-দেয়া লাঞ্চ বক্স থেকে কেমন বিচ্ছিরি
ঢঙে তুলে নিয়ে প্রায় পচে-যাওয়া একটি কমলালেবু খায়,
পাশে তার খাদ্যাম্বেষী কুকুর হাঁপায়।
মনে হয়, আপাতত দু’জনের ক্ষুধা ছাড়া কোনো
ভীষণ অসুখ নেই। ভুলবো না এ দৃশ্য কখনো।

আমি নিজে ঘরে বড় একা ব’সে থাকি
চুপচাপ; এমন একাকী
নিজেকে লাগোনি এর আগে। কতিপয়
ছবি উঠে আসে একে একে অত্যন্ত গহন থেকে, মনে হয়
সুমেরীয় সভ্যতার ছাপ
আছে লেগে সেসব ছবিতে কিছু। অন্তরঙ্গ তাপ
টের পাই কোনো এক মহিলার। অনেক শতাব্দী কারো ডাকে
যেন সে দেয়নি সাড়া, তাকে

টগবগে লাভাস্রোত থেকে লাফিয়ে উঠতে দেখে
তন্দ্রাবেশ থেকে
এতকাল পরে
কেমন চমকে উঠি। আমাকে থাকতে বুঝি দেবে না এ ঘরে
রূপের অনল তার। ভুলে থাকি কাল সন্ধেবেলা
আমার অস্ত্রোপচার হবে, রক্তে বীজাণুর খেলা।
ভুলে থাকা যায়? নাকি এ-ও কানামাছি
খেলা এক চুপিসাড়ে নিজের মনের সঙ্গে? আছি
অনেক কিছুর কাছাকাছি, তবু দূরে,
সবকিছু থেকে বেশ দূরে স’রে বসে থাকি ঝিমোনো দুপুরে
মনের গহনে চার ফেলে
এলেবেলে,
অন্তরালে যেখানে অনেক ছায়া ঘোরে,
কফির রঙের মতো ডানা মেলে ওড়ে
ছোট পাখি এবং আমাকে ঘিরে উডুক্কু সাপেরা
লতায়িত, যেন এই ডেরা
আমার অত্যন্ত চেনা দিকচিহ্নগুলি থেকে পুরোপুরি
যোগসূত্রহীন; যেন চুরি
ক’রে নিয়ে গেছে কেউ আজকের আমিকে, যেখানে
নিঃসময়ে সুকান্ত ‘বাঘের প্রতি বাঘিনীর টান নেই, গানে
রাগিনীর তেমন সম্ভ্রম নেই, ভাবলেশহীন
পাহাড়ের চূড়ায় ঈগল দৃষ্টিহীন

ত্র্যাম্বুলেন্স? প্রয়োজন নেই, অথচ কাঁপিয়ে বুক মধ্যরাতে
প্রায়শই ত্র্যাম্বুলেন্স চ’লে যায় সাথে
নিয়ে কী পবিত্র, আর্ত, নিঃসীম গোপনীয়তা। নাকি
লাল কম্বলের নিচে স্ট্রেচারে চলেছে শুয়ে যন্ত্রণা একাকী?
গাছের একটি পাতা মৃদু খসলো কি খসলো না,
কখনো যায় না শোনা
বাস্তবিক; খুব কোলাহলের মধ্যেও শোনে শুধু
কবি, যন্ত্রণার সহোদর, মন যার অনন্তে উধাও, ধুধু।

এ কীসের ঘোরে কাকে দেখি দরজার পাশে? কার
নিশ্বাস আমার মুখে লাগে? অন্ধকার
কেন নেমে আসে দ্বিপ্রহরে? মনে পড়ে, কোনো কোনো প্রিয় মুখ
বহু দূরে; দেখা হবে? না-লেখা কবিতাগুলি আমার অসুখ
সত্ত্বেও এমন দিনে প্রচ্ছন্ন গুপ্তচরের মতো
অবচেতনের স্তরে স্তরে দিচ্ছে উঁকি ক্রমাগত।
একটি জরুরি চিঠি এখনো হয়নি লেখা। ভেসে
ওঠে শাদা হাঁস, রেডক্রশ, নার্স, লম্বাটে টেবিল, স্লান হেসে
জানলার কাছে যাই। দূর মেঘদল, মনে হয়,
জবার আভায়, কারো মৃদু স্পর্শে গচ্ছিত আমার নিরাময়।

 ২০নম্বর ওয়ার্ডে

ইদানীং দিনান্তে স্বপ্নের সঙ্গে নিরিবিলি বহু
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যাই বিশ নম্বর ওয়ার্ডে
আমার গোপন ক্ষতে ড্রেসিৎ করাতে। মাঝে-মাঝে
দৈবাৎ কুড়িয়ে নিই কিছু চন্দ্রমল্লিকা এবং
জুঁই করিডোরে, অভ্রে-গড়া ঘোড়ার নিশ্বাস
লাগে গায়ে, আলোর কলপ-লাগা মেঘ ক্রমাগত
মাথার ভেতর জমে, কেমন একটা গন্ধ এসে
আমাকে দখল করে; যেন আমি নিশি-পাওয়া কেউ।
ভিজিটিং আওয়ারের ভিড় নেই। কতিপয় রোগী
ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। কালো চিতাবাঘের মতন
মৃত্যু ক্ষিপ্র করে পায়চারি। কেউ কেউ চোখ বুজে
আকাশ পাতাল কি যে ভাবে। কারো হাতে
স্যালাইন নল, কারো নাকে আর কেউবা গোঙায়
যন্ত্রণায়। একজন রোদপোড়া পৌঢ়, গ্রাম্যজন,
উদরে ব্যাণ্ডেজ নিয়ে টিকে আছে কোমোমতে, কানে
তার খুব আস্তে সুস্থে তরুণী সিস্টার কিছু বলে।
ফুলের স্তবক নেই তার শিয়রে, আসেনি কোনো
আত্মীয় দর্শনপ্রার্থী, আসবে না বুঝি কোনোদিন।

নাম জানা নেই, পাকা বাঁশে তৈরি তার শরীরের
খাঁচায় প্রবেশ করি, দুঃসহ যন্ত্রণা পাই, শ্বাস
টানি অতিশয় ক্লেশে বাঁচার আশায়। লোকটার
মুখে দেখি আমার নিজেরই মুখ, ঈষৎ বিকৃত।
দিনান্তে স্বপ্নের সঙ্গে এসে বিশ নম্বর ওয়ার্ডে
দেখি বেডে সে লোকটা নেই, লাল কম্বলের নিচে
অন্য একজন শুয়ে আছে, অস্ত্রোপচারের পালা
তার কাল। তুলো, গজ, হিবিটেন নিয়ে স্বপ্ন তার
ফোটায় সহজ শিল্প আমার জখমে। সে লোকটা
তেইশ নম্বর বেডে ছিলো, সে কি বাড়ি গেলো তবে?

মারা গেছে। শব্দহীন প্রতিধ্বনি পাখির ধরনে
বলে যায়, মারা গেছে। আজরাইলের ডানা তাকে
নিয়ে গেছে দূরতম তারার ওপারে। টলটলে
দিঘি, ভাঙা বাবুই পাখির বাসা, স্বপ্নের মতন
পথরেখা, ফসলসজ্জিত মাঠ, যৌবনখচিত
কোনো ঢেউখেলানো শরীর বহু আগেকার চোখে
ডেকেছিলো অম্ভিম মুহূর্তে? স্বপ্ন হেসে ইশারায়
আমাকে নিকটে ডাকে, তেইশ নম্বর বেডটির
দিকে চোখ রেখে ভাবি-প্রকৃতই বাড়ি যাচ্ছি আমি?
নাকি যন্ত্রচালিতের মতো চলেছি মৃত্যুরই দিকে?

Exit mobile version