হাসপাতালে ভর্তি হবার আগে
বন্ধুরা যে যার ঘরে যথারীতি চলে
গেলেন একটু বেলা ক’রে। দেদার চুট্কি ব’লে
আসর মাতিয়ে রাখা যার স্বভাব, বিষন্ন মুখে
নিলেন বিদায় তিনি। যেন আজই চুকে
বুকে যাবে জীবনের হিশেব নিকেশ ভেবে যার
চেহারায় গাঢ় অন্ধকার
ওৎ পেতে ছিলো, তার ঠোঁটে
যাবার সময় অকস্মাৎ এক রাশ জুঁই ফুটে ওঠে।
‘পুস্তকেও রয়েছে জীবন
স্বতন্ত্র আদলে’-এই প্রিয় বাক্য যখন তখন
আউড়ে বিস্তর ধোঁয়া ছেড়ে
চুরুটের যিনি মাঝে-মাঝে কিছু ভয়ঙ্কর তেড়ে
আসা বায়বীয় কুকুরের ডাক শুনে
ওঠেন আমূল কেঁপে, তিনি আরো কিছুক্ষণ গূঢ় কথা বুনে
শুভেচ্ছা জানিয়ে পথে নেমে হেঁটে যান
ভ্রষ্ট পথিকের মতো। শূন্যতায় পেতে রাখি কান।
নর্দমার ধারে ব’সে একজন গুমনাম হাভাতে ভিখিরী
ফেলে-দেয়া লাঞ্চ বক্স থেকে কেমন বিচ্ছিরি
ঢঙে তুলে নিয়ে প্রায় পচে-যাওয়া একটি কমলালেবু খায়,
পাশে তার খাদ্যাম্বেষী কুকুর হাঁপায়।
মনে হয়, আপাতত দু’জনের ক্ষুধা ছাড়া কোনো
ভীষণ অসুখ নেই। ভুলবো না এ দৃশ্য কখনো।
আমি নিজে ঘরে বড় একা ব’সে থাকি
চুপচাপ; এমন একাকী
নিজেকে লাগোনি এর আগে। কতিপয়
ছবি উঠে আসে একে একে অত্যন্ত গহন থেকে, মনে হয়
সুমেরীয় সভ্যতার ছাপ
আছে লেগে সেসব ছবিতে কিছু। অন্তরঙ্গ তাপ
টের পাই কোনো এক মহিলার। অনেক শতাব্দী কারো ডাকে
যেন সে দেয়নি সাড়া, তাকে
টগবগে লাভাস্রোত থেকে লাফিয়ে উঠতে দেখে
তন্দ্রাবেশ থেকে
এতকাল পরে
কেমন চমকে উঠি। আমাকে থাকতে বুঝি দেবে না এ ঘরে
রূপের অনল তার। ভুলে থাকি কাল সন্ধেবেলা
আমার অস্ত্রোপচার হবে, রক্তে বীজাণুর খেলা।
ভুলে থাকা যায়? নাকি এ-ও কানামাছি
খেলা এক চুপিসাড়ে নিজের মনের সঙ্গে? আছি
অনেক কিছুর কাছাকাছি, তবু দূরে,
সবকিছু থেকে বেশ দূরে স’রে বসে থাকি ঝিমোনো দুপুরে
মনের গহনে চার ফেলে
এলেবেলে,
অন্তরালে যেখানে অনেক ছায়া ঘোরে,
কফির রঙের মতো ডানা মেলে ওড়ে
ছোট পাখি এবং আমাকে ঘিরে উডুক্কু সাপেরা
লতায়িত, যেন এই ডেরা
আমার অত্যন্ত চেনা দিকচিহ্নগুলি থেকে পুরোপুরি
যোগসূত্রহীন; যেন চুরি
ক’রে নিয়ে গেছে কেউ আজকের আমিকে, যেখানে
নিঃসময়ে সুকান্ত ‘বাঘের প্রতি বাঘিনীর টান নেই, গানে
রাগিনীর তেমন সম্ভ্রম নেই, ভাবলেশহীন
পাহাড়ের চূড়ায় ঈগল দৃষ্টিহীন
ত্র্যাম্বুলেন্স? প্রয়োজন নেই, অথচ কাঁপিয়ে বুক মধ্যরাতে
প্রায়শই ত্র্যাম্বুলেন্স চ’লে যায় সাথে
নিয়ে কী পবিত্র, আর্ত, নিঃসীম গোপনীয়তা। নাকি
লাল কম্বলের নিচে স্ট্রেচারে চলেছে শুয়ে যন্ত্রণা একাকী?
গাছের একটি পাতা মৃদু খসলো কি খসলো না,
কখনো যায় না শোনা
বাস্তবিক; খুব কোলাহলের মধ্যেও শোনে শুধু
কবি, যন্ত্রণার সহোদর, মন যার অনন্তে উধাও, ধুধু।
এ কীসের ঘোরে কাকে দেখি দরজার পাশে? কার
নিশ্বাস আমার মুখে লাগে? অন্ধকার
কেন নেমে আসে দ্বিপ্রহরে? মনে পড়ে, কোনো কোনো প্রিয় মুখ
বহু দূরে; দেখা হবে? না-লেখা কবিতাগুলি আমার অসুখ
সত্ত্বেও এমন দিনে প্রচ্ছন্ন গুপ্তচরের মতো
অবচেতনের স্তরে স্তরে দিচ্ছে উঁকি ক্রমাগত।
একটি জরুরি চিঠি এখনো হয়নি লেখা। ভেসে
ওঠে শাদা হাঁস, রেডক্রশ, নার্স, লম্বাটে টেবিল, স্লান হেসে
জানলার কাছে যাই। দূর মেঘদল, মনে হয়,
জবার আভায়, কারো মৃদু স্পর্শে গচ্ছিত আমার নিরাময়।
২০নম্বর ওয়ার্ডে
ইদানীং দিনান্তে স্বপ্নের সঙ্গে নিরিবিলি বহু
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যাই বিশ নম্বর ওয়ার্ডে
আমার গোপন ক্ষতে ড্রেসিৎ করাতে। মাঝে-মাঝে
দৈবাৎ কুড়িয়ে নিই কিছু চন্দ্রমল্লিকা এবং
জুঁই করিডোরে, অভ্রে-গড়া ঘোড়ার নিশ্বাস
লাগে গায়ে, আলোর কলপ-লাগা মেঘ ক্রমাগত
মাথার ভেতর জমে, কেমন একটা গন্ধ এসে
আমাকে দখল করে; যেন আমি নিশি-পাওয়া কেউ।
ভিজিটিং আওয়ারের ভিড় নেই। কতিপয় রোগী
ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। কালো চিতাবাঘের মতন
মৃত্যু ক্ষিপ্র করে পায়চারি। কেউ কেউ চোখ বুজে
আকাশ পাতাল কি যে ভাবে। কারো হাতে
স্যালাইন নল, কারো নাকে আর কেউবা গোঙায়
যন্ত্রণায়। একজন রোদপোড়া পৌঢ়, গ্রাম্যজন,
উদরে ব্যাণ্ডেজ নিয়ে টিকে আছে কোমোমতে, কানে
তার খুব আস্তে সুস্থে তরুণী সিস্টার কিছু বলে।
ফুলের স্তবক নেই তার শিয়রে, আসেনি কোনো
আত্মীয় দর্শনপ্রার্থী, আসবে না বুঝি কোনোদিন।
নাম জানা নেই, পাকা বাঁশে তৈরি তার শরীরের
খাঁচায় প্রবেশ করি, দুঃসহ যন্ত্রণা পাই, শ্বাস
টানি অতিশয় ক্লেশে বাঁচার আশায়। লোকটার
মুখে দেখি আমার নিজেরই মুখ, ঈষৎ বিকৃত।
দিনান্তে স্বপ্নের সঙ্গে এসে বিশ নম্বর ওয়ার্ডে
দেখি বেডে সে লোকটা নেই, লাল কম্বলের নিচে
অন্য একজন শুয়ে আছে, অস্ত্রোপচারের পালা
তার কাল। তুলো, গজ, হিবিটেন নিয়ে স্বপ্ন তার
ফোটায় সহজ শিল্প আমার জখমে। সে লোকটা
তেইশ নম্বর বেডে ছিলো, সে কি বাড়ি গেলো তবে?
মারা গেছে। শব্দহীন প্রতিধ্বনি পাখির ধরনে
বলে যায়, মারা গেছে। আজরাইলের ডানা তাকে
নিয়ে গেছে দূরতম তারার ওপারে। টলটলে
দিঘি, ভাঙা বাবুই পাখির বাসা, স্বপ্নের মতন
পথরেখা, ফসলসজ্জিত মাঠ, যৌবনখচিত
কোনো ঢেউখেলানো শরীর বহু আগেকার চোখে
ডেকেছিলো অম্ভিম মুহূর্তে? স্বপ্ন হেসে ইশারায়
আমাকে নিকটে ডাকে, তেইশ নম্বর বেডটির
দিকে চোখ রেখে ভাবি-প্রকৃতই বাড়ি যাচ্ছি আমি?
নাকি যন্ত্রচালিতের মতো চলেছি মৃত্যুরই দিকে?