বন্দীরও মুহূর্ত আছে
বন্দীরও মুহূর্ত আছে চার দেয়ালের গণ্ডি ছেড়ে
মেঘের রঙিন গালিচায় উড়ে যাবার এবং
গ্রীক দেবতার মতো সরোবরে সাঁতার কাটার।
সে মুহূর্ত আটকাবে তাকে, সাধ্য নেই সর্বোত্তম
প্রহরীর।এমন মুহূর্ত আসে, যখন নিঃসঙ্গ
কয়েদীন শিকল, গায়ের বেড়ি সরোদের মতো
বেজে ওঠে অতীতের কোনো সুখদ স্মৃতির টানে,
স্বাধীন চাঁদের ফালি নেমে আসে করতলে তার।
উৎপীড়নে জর্জরিত, বুকে পিঠে ক্রুর কালসিটে;
কখনো দুঃস্বপ্ন তাকে বন্য কুকুরের পাল হয়ে
করে তাড়া বারবার। মুক্তির সোপান উদ্ভাসিত
মাঝে-মধ্যে পুনরায় শূন্যে চকিতে মিলিয়ে যায়।
তবু সে বন্দীর মনে হয় কোনো একদিন তার
একলার নয়, শোষিতের একতার হবে জয়।
বস্তুত স্বপ্নই
বস্তুত স্বপ্নই বলা যায় একে, স্বপ্নে জাগরণ
কিংবা জাগরণে স্বপ্ন, ফুটে থাকে দাবির মাধবী,
সম্পূর্ণত এ আমার ব্যক্তিগত, অথচ আবার
এতে মুটে মজুর, কৃষক, ছাত্র, বিমর্ষ কেরাণী,
পাকাচুল পণ্ডিত এবং কলোনীর বারান্দায়
দাঁড়ানো তম্বীর ভাগ আছে, নিতে পারে যার যত
খুশি, যদি ডিঙিয়ে আসতে পারে প্রাথমিক বেড়া,
যদি হে নিদ্রিতা, চোখ মেলো তুমি তাদের উদ্দেশে।
ঘুমের ভেতরে প্রতীক্ষায় আছো সেই কবে থেকে।
দিনক্ষণ জানা নেই কখন উঠবে তুমি জেগে
অবচেতনের গূঢ় স্তর থেকে, পাতালপুরীতে
যেমন পাথুরে মূর্তি প্রাণ পায় স্নিগ্ধ মন্ত্রপুত
জলের ছিটায়; আমি ছাড়া অন্য কেউ পারবে না
জাগাতে স্পন্দন স্তব্ধ, শিলীভূত তোমার শিরায়।
বেশ ভালোই তো
পারো তো কাদায় ধৈর্য ধ’রে প’ড়ে থাকো
আরো কিছুকাল, ওরা লাথি ছুঁড়ুক বেদম বেশুমার, ঢাকো
ঢেকে রাখো মুখে থুতু-ছিটানো লোকেরা চ’লে
যাক দূরে ক্লান্ত হয়ে ঢ’লে
মাতাল মোষের মতো, নইলে কিছু অতিশয় কাছের চেহারা
দেখে দুঃখ পাবে। দিশেহারা
হ’লে চলবে না আজ, যারা ভাবে তোমাকে বেহদ অপমান
ক’রে নিজেদের শান
সোজা সাত আসমানে পৌঁছে দিলো তরতর, নিজেদের ওরা
ত্বরিত ঠাউরে নেয় তালেবর, নিত্যদিন হাতে পেয়ে বশম্বদ তোড়া
রঙ বেরঙের তাজা ফুলের এবং
আহলাদে আটখানা হয় সামনে দেখে শত শত চমৎকার সঙ।
ছলছুতো ক’রে
বহুরূপী মন্ত্রণার ছমছমে কর্কশ প্রহরে
একজন শব্দ শ্রমিকের মুখ ঘোর অন্ধকার
ক’রে দেয়া কী এমন শক্ত কাজ আর
একালে? এমন হ’য়ে এসেছে সুদূর অতীতের
দরবার থেকে বারবার দেশে দেশে, তারই জের
চলছে, চলছে নিরন্তর। যার ঠোঁটে বাঁশি রাগ রাগিনীর
বিস্তার ফুটিয়ে তোলে তারই বুকে বিঁধে যায় জহরিলা তীর।
কী তোমার অপরাধ? ঘুমের মতন
নিমগ্ন জীবন থেকে তুলে আনো যখন তখন
লতাগুল্ম, চিত্রিত ঝুনুক
রাশি রাশি এবং দেখতে চাও হিরন্ময় মুখ
সত্যের, দিয়েছো পেতে জীবন কাঁটার বিছানায়। অলৌকিক
পাথরের জন্যে দশদিক
তন্ন তন্ন ক’রে খোঁজা, স্বপ্নে-জাগরণে খুশনুমা দ্বীপে একা
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবো, পাও কিনা দেখা
সুন্দরীতমার কিংবা দাও সাড়া তখনই যখনই, আর্তনাদ
করে ওঠে দেশ বন্দী প্রমোথিউসের মতো। নিজের অগাধ
দুঃখেও চকিতে বেজে ওঠো
গুণীর বাদ্যের মতো বারবার, ছোটো তুমি ছোটো,
যেন দূর পাল্লার নিঃসঙ্গ দৌড়বাজ, পায়ে ক্ষত
ফোটে ক্রমাগত।
কী আশ্চর্য, দানেশমন্দিতে দড়, অথচ কিছুতে এ সহজ
সত্য ওরা মেনে নিতে পারে না, মগজ
নিখুঁত ধোলাই করলেও কিছু লোক
থেকে যায়, যাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে দ্রোহের দুর্বার ঝোঁক।
কে না জানে বুদ্ধের হাতের পদ্ম ফুল পায়ের তলায় ফেলে
চটকালে কিংবা রেগে মেগে এলেবেলে
সাত তাড়াতাড়ি
কোকিলের ঘাড় মটকালে কৃতিত্বের পাল্লা ভারি
হয় না মোটেই বাস্তবিক,
বরং চৌদিকে দিনরাত্রি রব ওঠে ধিক ধিক।
মেনী মেনী থ্যাঙ্কস ওদের, ওরা যা যা করেছেন তার ঋণ
শোধ করা অসম্ভব। তাদের অশেষ বদৌলতে অন্তরীণ
কবিতা তোমার
ঝাঁকিয়ে-ঝাঁকড়া চুল বেরিয়ে এসেছে খুলে দ্বার
এক ঝটকায় আর তোমার কবিতা ফের গোইয়ার ছবির মতো ফোটে
ঘন ঘোর তমিস্রায়, তোমার কবিতা ঠোঁটে ঠোঁটে
নাচে, যেন মত্ত নটরাজরূপী উদয়শঙ্কর। করো শুকুর আদায়,
বেশ ভালোই তো, নির্দ্ধিধায়
সেসব বিবেচকের, যাদের অশেষ কৃপা বিনা তুমি এই
তালিম পেতে না-অবরুদ্ধ খাঁচা ছাড়া হারাবার কিছু নেই।
যখন গোধূলি মেঘে
যখন গোধূলি মেঘে মায়াবী গালিচা পেতে যাচ্ছিলাম ভেসে
বড় একা, দেখি দূর দ্রাক্ষাবন থেকে
একজন বুজুর্গ এলেন উঠে, ঢুলু ঢুলু চোখ,
ঠোঁট ভেজা, যেন এইমাত্র পানপাত্র এসেছেন
রেখে কুঞ্জে, মৃত্যু তাঁর পেছনে পেছনে
তুখোড় গোয়েন্দা, ঘোরে সারাক্ষণ কিংবা মিশে থাকে
বয়েসী শরীরে, তিনি শান্ত মেঘদল উড়ে উড়ে
বললেন প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে-
‘ইতিহাস খচিত সুদূর অতীতের বাগদাদ
শহরে একদা
জ্যোৎস্নাপ্রিয় স্বপ্নশ্রিত ঘাস খেকো ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তাঁরা
কতিপয় কবি,
মুল্যবান সওদার মতো
ক্রমশ হলেন জড়ো সুলতানের দরবারে। একে
একে কবিকুল গলা খেলিয়ে করেন পাঠ চম্পু, কত
কাসিদা, গজল, ঝকমকে
সুলতানের হাসিতে কবিতা
অধিক জাজ্বল্যমান হয়ে শোভা পায়
দেয়ালে দেয়ালে, নক্সাময় গালিচায়,
তখ্তে পায়ায়,
সভাসদদের ঝলমলে
লেবাসে, কবিতাবলী চঞ্চল চড়ুই হয়ে ঢুকে
পড়ে অবলীলাক্রমে জেবের ভেতর, ঢলাঢলি
করে খুব লাস্যময়ী রমণীর কোলে।
যখন কবিতাবলী দিনারের মতো ওহো হাঃ হাঃ
অত্যস্ত ঝিকিয়ে ওঠে শাহী দরবারে,
তখন রাস্তার ধারে বহু
অনাথ দাঁড়িয়ে থাকে অনাশ্রয়ে, ভিখিরি জটলা
করে পথে রুটির আশায়,
ক্ষুধা চাবুকের তাড়া খেয়ে ফেরে শহরের আনাচে কানাচে
এবং বিপজ্জনক রাজন্দিগণ টিমটিমে
নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে প্রত্যহ শোনেন।
প্রহরীর পদশব্দ, কয়েদখানার রুক্ষ দেয়ালে আঁচড়
কেটে দিন যাপনের হিসেব রাখেন, মাঝে মাঝে
কানে আসে কবে কার ফাঁসি হলো, অন্ধকারে বসে
তম্ময় ভাবেন প্রিয় মুখ আর তারাজ্বলা আকাশের কথা।