তত্ত্ব তালাশ
-কোত্থেকে এসেছো তুমি, বলো?
-যেখানে ঝর্ণার জলে রূপসীর লাশ ভাসে,
গোধূলি বেলায় খুরে নির্জনতা ভেঙে তৃষিত হরিণ আসে
এসেছি সেখান থেকে, যদিও নিবাস ঝলোমলো
শহরের ধোঁয়াআটে গলিতে।
-কেন এত ন্যাতা জোবড়া পোশাক তোমার এই শীতে?
-তাই বুঝি?
পোশাকের দিকে নেই মন। আমি অন্য কিছু খুঁজি।
-কোন্ তত্ত্বতালাশে এমন মগ্ন তুমি?
-দূর দিগন্তকে বনভূমি
কী জপায় অন্তরালে, নদীতে কোথায় নুড়ি নড়ে
কীরকমভাবে, গাঢ় অন্ধকারে ঢিবির ওপরে
পিপঁড়ে পা ফেলে কোন্ ছন্দে, অচিন পাখির ভাষা
বোঝার উদ্দেশ্যে দূর দূরান্তরে আমার এমন যাওয়া-আসা
তিনটি কিশোরী
প্রায়শই জানালার ধারে এসে দাঁড়াই খানিক
বহুক্ষণ শুয়ে ব’সে একঘেয়ে লাগলে, এদিক
ওদিক আমার দৃষ্টি যায়
শ্রমণের মতো, দেখি দৃশ্যাবলি। একদিন বিকেল বেলায়
তিনজন কিশোরীকে একসঙ্গে নম্র হেঁটে যেতে
দেখলাম, ওরা কুল খেতে
খেতে হাসি মুখে চলে গেলো; আমি যতদূর পারি
দেখি, ভাবি কোথায় ওদের ঘরবাড়ি?
সোবহান বাগ কলোনীতে? নাকি আরো কিছু দূরে?
ওরা কি একত্রে থাকে-একই বাগানের ফুল? ঘুরে
বেড়ায় প্রসন্ন মনে সকালে বিকেলে?
অকস্মাৎ ঝড় বৃষ্টি এলে
কোথায় আশ্রয় নেবে? হয়তোবা আলাদা আলাদা
বাড়িতে ওদের বসবাস। খেলাধুলা, হাসাকাঁদা
আছে, তবু তিনটি রাগিনী মৃদু বাজে
অন্তরালে, তিনজন তিনভাবে সাজে।
জনালার ধারে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ
ওদের কথাই ভাবি। মন
এ সময় পেরিয়ে স্বতন্ত্র কালে চলে যায়। দেখি
লহমায় এ-কি
তিনটি কিশোরী গায়ে যৌবন নিয়ে আছে
তিনটি সংসারে। কীরকমভাবে বাঁচে
ওরা তিনজন, আমি দেখে নিতে চাই আগে ভাগে,
যেরকম পুরাণের গোলকে বিভিন্ন ছবি জাগে,
ভাসে ভবিষ্যত।
ওরা কি হয়েছে সুখী সকলেই? অপরাহ্নে একই পথ
চলে গেছে বহুদূরে, ওরা
এখন হাঁটে না আর একসঙ্গে। তিনটি জীবন আগাগোড়া
তিন-ছাঁদে তৈরি, কেউ সুখী, কেউবা অসুখী খুব। চুপচাপ
একজন, অন্যজন ছড়ায় কথার ফুলঝুরি। পদচ্ছাপ
কারো পড়ে শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় জীবিকার টানে,
কেউ খামকাই ঘোরে এখানে সেখানে
স্ফুর্তির জোয়ারে ঢেলে মন, স্বামীর সংসারে শোভা
কেউ, যেন ত্র্যাকুরিয়ামের মাছ, কেউবা বিধবা।
জানালার ধারে আমি তিনটি অপরিচিতা কিশোরীর
কথা ভেবে নিরর্থক বুএক নিই যন্ত্রণার তীর।
দীপিতার জন্যে পংক্তিমালা
মিশে গেছে অনেক শতাব্দী মরুভূমির হাওয়ায়,
বঙ্গোপসাগরে বয়ে গেছে বহু শতকের ঢেউ,
তোমার আমার দেখা হয়নি দীপিতা! কতকাল
আরব উদ্বাস্তু হ’য়ে শহরের আনাচে-কানাচে
ঘুরেছি ভীষণ অনাশ্রয়ে,
বিস্মৃতির বাগানের ঘ্রাণ মাঝে মাঝে
চোখের পাতায় রুয়ে দিয়েছে ধূসর
নিদ্রা কাতরতা,
কখনো কান্নায় চোখ বেরিয়ে এসেছে। হৃদয়ের
জখমের নীরবতা কতবার হয়েছে বাঙময় গানে গানে।
মনে পড়ে, কাগজের চাঁদ বানিয়েছি অমাবস্যা
রাতে আর মনোনীত জ্যোৎস্না দিয়ে রচেছি হরিণ
পদ্যের ভেতর,
একটানা ডেকে যাওয়া কোকিলের বুকে
নির্ভুল দিয়েছি গেঁথে আমার নিজস্ব পংক্তিমালা,
টাঙিয়ে দিয়েছি কত গাথা পরিত্যক্ত বাড়িটার
দেয়ালে দেয়ালে, তুমি ‘কী সুন্দর’ ব’লে
দিয়েছো বাহবা। শীত রাতে
ফুটেছে কদম ফুল বালিশের ওয়াড়ে আমার,
যখন এসেছো তুমি রঙধনু সাঁকোটা পেরিয়ে
চুপিসাড়ে স্বপ্নের কী স্বচ্ছ অপরূপ
শাল মুড়ি দিয়ে।
কেউ না বল্লেও হৃদয়ের তন্তজাল জেনে গেছে
কখন এসেছো তুমি ফিরে। দেখছো না
শহরের চেহারা কেমন পাল্টে গেছে লহমায়?
দ্যাখো, লালবাগের কেল্লার
অতি পুরাতন জীর্ণ দেয়াল মায়াবী
গলায় গাইছে দীপিতার শুদ্ধ প্রত্যাবর্তনের রূপময়
খেয়াল, মাঘের শীতে ফুটেছে কনকচাঁপা আর
অন্ধ ভিখিরির
এনামেল পাত্তরের দশ পয়সাসমূহ পেয়ে
গেছে সুলতানী আমলের দিনারের
বর্ণচ্ছটা, রেডিও এবং টেলিভিশনের খুব
নিষ্ঠাবান সংবাদ পাঠক, ভাষ্যকার
আজ সত্য প্রচারে অত্যন্ত মশগুল,
ব্যর্থ কবি অকস্মাৎ লিখে ফেলেছেন দৈববলে
অমরতা-ছোঁয়া পংক্তিমালা, কারাগার থেকে সব
রাজবন্দী শেকল ভাঙার গান গাইতে গাইতে
ভায়োলিন হাতে
রাঙা মেঘে বেড়াচ্ছেন ভেসে, পাথরের সিংহগুলো
কী ক্ষিপ্র দৌড়াচ্ছে, পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে
বাহারী ফ্যাশন্ন শো’তে দিয়েছেন যোগ ঢাকাই বস্তির যুবতীরা।
পুঁজিবাদী সমাজের নাকের তলায় অশ্বারুঢ়
লাল কমলের মতো অসি ঘোরাতে ঘোরাতে
কী দৃপ্ত সমাজতন্ত্র এসে গেছে কাঁধে
ঝুলিয়ে রঙিন লোকশ্রুত সূর্যোদয়।
কতকাল পরে
দীপিতা এসেছে ফিরে স্বপ্ন-স্মৃতিময় এ শহরে?
না হয় আমি ঘুমের ঝোঁকে
না হয় আমি ঘুমের ঝোঁকে বলেইছিলাম,
‘বিদায় বলি, কথা হবে কাল সকালে’।
‘সকাল বেলা?’ প্রশ্নে তোমার কী যে ছিলো,
তারপরে তো শুনি না আর তোমার গলা।
নাম জানি না, ধাম জানা নেই, কেবল চিনি
জ্যোৎস্না-জ্বলা কণ্ঠস্বরের ঢেউয়ের খেলা।
কোন নিবাসে তোমাকে আজ খুঁজবো বলো?
কাকে শুধাই, ‘তুমিই কি সেই স্বরময়ী?
যখন পথে চলে আমার আসা-যাওয়া,
তখন যাকে লাগে ভালো, নেচে ওঠে
চোখের তারা, হঠাৎ ভাবি- এই তো তুমি।
ভীষণ উদাস দৃষ্টি হেনে যায় সে চলে।
তোমার স্বরের জলতরঙ্গ শোনার আশায়
কাক-ডাকা ভোর, দুপুর এবং সন্ধেবেলা
টেলিফোনের ধারে আমার সময় কাটে;
ঘুমছুট কতো রাত্রে লাগে ভোরের আবীর।
সাধ ছিলো দূর নদীর বুকে ভাসবো ভেলায়,
সঙ্গে আমার থাকবে তুমি মুখোমুখি।
অস্তগামী সূর্য তোমার চোখে মুখে,
খোলা চুলে বুনবে অসীম কল্পকথা।
সেই দূরাশা এক পলকে অস্তমিত,
ধসে-পড়া বাড়ির মতো প’ড়ে আছি,
আমার ওপর মরা চাঁদের কান্না ঝরে,
নিষ্ঠুরতা বুঝি তোমার সহোদরা।
বিস্মরণের ডোবায় যদি ছুড়েই দেবে,
তবে কেন রাত দুপুরে জাগিয়েছিলে?
শুধু আমার সত্তা-ভিতে ছুঁইয়ে দিতে
ভুল প্রহরের মধুর স্বরের ক্ষণিক মায়া?
রাতের শিরায় কী আছে এক মদিরতা,
যার তাড়না যোগায় ভাষা তোমার প্রাণে।
দিন-দুপুরে কুলুপ এঁটে রাখো মুখে,
এখন দেখি রাতও দগ্ধ কথার খরায়।
আমার স্মৃতি দেয় কি হানা তোমার মনে
কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে? কিংবা যখন
খাতার পাতায় খামখেয়ালি আঁচড় কাটো?
অথবা টিপ বাছাই করার ব্যস্ত বেলায়?
আমার বুকে আর্ত কোকিল নীড় বেঁধেছে;
কণ্ঠে রক্ত তুলে বলে বারে বারে,
‘টেলিফোনে উঠুক বেজে তোমার গলা,
কেবল আমি এটুকু চাই, আর কিছু নয়?’
হৃদয় জুড়ে স্বেচ্ছাচারী অস্থিরতা
ওড়ায় ধূলো; কোথাও আমার মন বসে না।
গ্যালী-দাসের মতোই আমি আষ্টেপৃষ্ঠে
বন্দী হয়ে দাঁড় টেনে যাই স্মৃতির জলে।