খবরে প্রকাশ
সত্য বলিতে, প্রকৃতির গুণগান আমি আর কি করিব?
আমার জন্য
কিছু আর অবশিষ্ট নাই। যুগ-যুগ ধরিয়া কবিগণ
প্রকৃতির বিস্তর পদলালিত্যময় স্তব করিয়া আসিতেছেন, ফলত
কেহ-কেহ প্রকৃতির দুলাল
আখ্যাও লাভ করিয়াছেন এতসংক্রান্ত ব্যাপারে, অর্থাৎ
প্রকৃতির বিপুল বৈচিত্র্যপুর্ণ রূপ লোকসমক্ষে স্বীয় স্বীয়
দৃষ্টিকোণ হইতে তুলিয়া ধরিতে
চিত্রকরগণও পিছাইয়া থাকেন নাই। অতএব,
এই বিষয়ে কোনো ঘাটতি রহিয়াছে,
এমত অভিযোগ কেহ করিবেন বলিয়া
আমরা বিশ্বাস করি না।
পদ্মের ন্যায় প্রস্ফুটিত প্রভাতে সূর্য দশদিকে
আবীর ছড়াইয়া দেয়, সায়াহ্নে স্বর্ণথালা রূপে
পশ্চিম গগন হইতে কোথায় চলিয়া যায়,
পৃথিবীতে মৃদু মন্দ সমীরণ বহিতে থাকে আর পূর্ণিমায়
কী মনোহর চন্দ্রোদয় হয়, ফেরেশতাগণ
শাল তমালের বনে বৃক্ষশীর্ষে দাঁড়াইয়া সেই শোভা
নিরীক্ষণ করিয়া যারপরনাই
পুলকিত হয়েন, লোক পরস্পরায় এবম্প্রকার
সংবাদ দিকে দিকে রটনা করা হইয়াছে। নদীতে জোয়ার আসে,
পর্বতের শৃঙ্গে বৃদ্ধের স্মশ্রুর ন্যায়
তুষার জমাট বাঁধে, স্বর্গের নৃত্যপটীয়সী সুন্দরীদের নূপুরের
ধ্বনির অনুরূপ বৃষ্টিপাত হয়। অবশ্য মাঝে মাঝে সমগ্র দেশ
ডুবাইয়া বান ডাকে, ঘরে ঘরে
কান্নার রোল ওঠে, কঙ্কালী দুর্ভিক্ষের তাণ্ডব দেখিয়া
আর কখনো সখনো বাসুকির ফণাস্থিত
দুনিয়ার কম্পন অনুভব করিয়া দানেশমন্দগণ বলিয়া থাকেন-
নাফরমান, গোমরাহ বান্দাদিগের উপর খোদার গজব নাজেল হইয়াছে।
এইমতো পরিস্থিতিএ তাঁহারা প্রচুর দোয়া-দরূদ পড়িয়া থাকেন।
উপরন্ত প্রকৃতি যে কীরূপ খেয়ালী
তাহাও মক্ষিকা স্বরূপ ভন্ভন্কারী সংবাদপত্রের সৌজন্যে আমরা অবগত রহিয়াছি
কোন কোন মহিলা একসঙ্গে ছয় সাতটি সন্তান
প্রসব করেন, কোনো কোনো
নব্জাতক দুইটি মাথা লইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, আবার
দুইটি শিশুর অঙ্গ পরস্পর অবিচ্ছিন্নভাবে
গ্রথিত থাকে। কখনো কখনো এরকমও শ্রুত হয়,
পুকুরের মাছ গাছে বাসা বাঁধে, পাখি
নীড় রচনা করে জলাশয়ে, বটবৃক্ষে নাকি শজারু
পয়দা হয়। এইরূপও জনশ্রুতি আছে যে,
সেক্রেটারিয়াট টেবিলের ওপারে সুদর্শন চেয়ারে
উপবিষ্ট হইয়া গদ্ধমুষিকেরা
অনর্গল সিগারেটের ধোয়া উদ্গীরণ করেন এবং মর্জি হইলে
নথিপত্র ঈষৎ নাড়িয়া দেখিয়া থাকেন। এবং
আরো শ্রুত হয়, কতিপয় শাখামৃগ, যাহাদের মুখমণ্ডলে
প্রকৃতি সাদরে বিমর্ষতা বুলাইয়া দিয়াছে, উহারা
আবার দিব্য ভেংচি কাটিয়া থাকেন,
পদ্য লিখিয়া নাম কিনিয়াছেন এবং ইনাম
হাসিল করিয়াছেন। কেহ কেহ লাঙুল
নিজের গলায় জড়াইয়া কারো কারো পদশোভায়
অতীব বিমোহিত হইয়া
আহলাদে মৃত্তিকায় গড়াগড়ি যাইতেছেন আর আঙুল চুষিতেছেন।
তবে সর্বাপেক্ষা তাজ্জবের ব্যাপার হইল-
কিছুকাল হইতে আমাদিগের দেশের বিভিন্ন এলাকায়
কতিপয় লোকের স্ত্রীগণ ক্রমাগত
অশ্বতর প্রসব করিয়া আসিতেছেন। সম্প্রতি অত্র প্রবণতা
অত্যধিক বৃদ্ধি লাভ করিয়াছে, এই মর্মে বাঘা পরিসংখ্যানবিদ
এক সহস্র নয়শত সপ্তাশীতি পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিবরণ
সদাশয় সরকারের নিকট পেশ করিয়াছেন,
খবরে প্রকাশ।
খুব বেশি ভালো থাকতে নেই
সংগীত সাধক, কবি; চিত্রকর অথবা ভাস্কর, কাউকেই
খুব বেশি ভালো থাকতে নেই।
খুব বেশি ভালো থাকা মানে
মোহের নাছোড় লতাগুল্মসমেত স্নোতের টানে
সেখানেই অনিবার্য খর ভেসে-যাওয়া,
যেখানে কস্মিনকালে বয় না শিল্পের জলহাওয়া।
যদি শিল্পী প্রতিদিন ঝলমলে মদির, ফেনিল
পার্টিতে বেড়ায় ফুলবাবু সেজে, ক্রমশ আবিল
হয়ে ওঠে যদি আত্মা সোনাদানা হীরকের বশে,
যদি দ্রুত খসে
একে একে গোপন পালক সব তার, নুয়ে আসে
দেহমন কুর্নিশের ভারে আর সারাক্ষণ রমণীবিলাসে
মজে থাকে, তবে খাতা শুধু
অত্যন্ত বিরান মরুভূমি বুকে নিয়ে করবে ধুধু
আর চির প্রতীক্ষা-কাতর
পাথর থাকবে হায়, কেবলি পাথর।
অসুয়া, অবজ্ঞা, হেলা মাথা
পেতে নিয়ে, জলকষ্টে ভুগে কুড়িয়ে কাঁঠাল পাতা
গোধূলির মতো বস্ত্র গায়ে বাউলের সঙ্গে গলা
মিলিয়ে উদাস হেঁটে চলা
ছিলো ভালো, কখনো কখনো কোনো নারীকে জড়ানো
উষ্ণ বুকে অবিবাহে, পথপার্শ্বে উনুন ধরানো,
নৌকো বাঁধা ঘাটে ঘাটে, পাটাতনে শুয়ে
তুচ্ছতার বুদ্ধুদ উড়িয়ে দিয়ে ফুঁয়ে
ভোরবেলাকার কচি আলো,
খঞ্জনার নাচ, জেলে-বৌয়ের ভাসানো ঘড়া দেখা ছিলো ভালো।
আজো কায়মনোবাক্যে চাই
শিল্পীর সত্তায় থাক লেগে ত্যাগময় কিছু ছাই।
সামাজিক সকল ভড়ং
আমূল খারিজ ক’রে তীব্র সে বরং
সহজে করুক মনে পেলিক্যান কালি শহীদের
রক্তের চেয়েও ঢের
বেশি পূত পবিত্র এবং হাতুড়ি ও বাটালির
ঘায়ে ওড়া শাদা পাথরের হাঁট-টুকরোর ঘ্রাণ পৃথিবীর
সবচে’ সুরভিময় ফুলের চেয়েও
অধিক সুগন্ধী, ওর মনের নানান স্তরে ছেয়ে
থাক সর্বক্ষণ
সত্তাক্ষয়ী অমোঘ দহন।
রঙিন পালকে নিয়ে ভোর
নেচে নেচে বলে যায় দূরাগত একটি চন্দনা-
‘ওরে, পড়ে না কি মনে তোর
নক্ষত্রপল্লীতে একা জেগে থাকা মাইকেল এঞ্জেলোর অগাধ যন্ত্রণা?
ঝড়
সবকিছু এরকম শান্ত আশেপাশে, আসমানে
রেশমি মেঘের আনাগোনা, যেন ফুলবাবু; পাখি
বাগানকে সাজায় মধুর সুরে, সুঘ্রাণ বিলায়
গোলাপ, মালতী, জুঁই। পথিকেরা যে যার ডেরায়
পৌঁছে যায় ঠিকঠাক। কোথাও বাজে না বিসম্বাদী
কোনো সুর; ঘরে ঘরে আলো জ্বলে, ক্যাসেট প্লোয়ারে
রবীন্দ্রনাথের গান পূর্বপুরুষের আশ্নীর্বাদ,
কবি তার শেষ পঃক্তি রচনার তৃপ্তি পেয়ে যায়।
অকস্মাৎ আকাশের মুখে কালি ঢেলে ঝড় আসে
দিগন্ত কাঁপিয়ে লণ্ড ভণ্ড চতুর্দিক, গেরস্তের
ঘর ভাঙে তাসের বাড়ির মতো, বুড়ো বট মুখ
থুবড়ে মাটিতে পড়ে শেকড়সমেত, যেন কোনো
স্বৈরাচারী শাসকের সিংহাসন ধুলায় লুটায়
দিগ্ধিদিক রাজপথ-উপচানো গণ অভ্যুত্থানে।