কোথায় লুকিয়ে থাকো
কোথায় লুকিয়ে থাকো নিঃসঙ্গতা নিয়ে? শুয়ে আছো
বিষাদের ঘরে?
আজো কি তোমার মনে অগোচরে জমেছে হে মেয়ে
মন-খারাপের মেঘ? আমার সকল
ভালো-লাগা সিংহাসনচ্যুত; একটি কুঠার, রোদে
তুমুল ঝলসে ওঠা, বার বার করছে প্রহার
আমাকে, তোমাকে
দেখতে পাই না বলে। এরকম হয় না কি, মাঝে-সাঝে তুমি
বসে আছো বই হাতে, হঠাৎ আমার
নিঃশ্বাস তোমার
গ্রীবায় অধরে, পিঠে, স্তনে, নাভিমূলে চুমো খায়
চুপিসাড়ে? আমার শীতল দীর্ঘশ্বাসে বড় বেশি
এলোমেলো হয়ে যায় না কি সমাজতত্ত্বের খাতা,
আধ-পড়া জরুরী বইয়ের পাতা, তোমার চুলের নিঃস্তব্ধতা,
হৃদয়তন্ত্রীর সুর? যখন ঘুমিয়ে থাকো, তখন তোমাকে
যে-দ্যাখে গোপনে বিছানার পাশে একা
দাঁড়িয়ে, সে নয় আমি, আমার ভেতর
থেকে বের-হ’য়ে-যাওয়া কোনো ছায়া; দ্যাখে, শুধু দ্যাখে।
এ শহরে এ ভীষণ অসুখী শহরে
তুমি আছো, খুব কাছে আছো হে অপ্রাপনীয়া,
জ্বলছো হিরের মতো নিত্যদিন, অথচ দেখি না
তোমাকে, যদিও আমার অনেক স্বপ্ন, ঝ’রে যাবে জেনেও সর্বদা
বিনিদ্র কুসুম হয়ে ফোটে তোমাকে ঘিরেই। তারাজ্জলা রাতে
বলেছো, সত্বর তুমি চলে যাবে দূরে;
আমার একান্ত অনুরোধ, অন্ততঃ যাবার আগে
দেখে যাও কী রকম আছি। অন্তর্গত
ব্যাকুলতা গাছপালা, নদীনালা, নিশান্তের হাওয়া
বর্ষার আকাশ আর ময়ূরকে বলে-
আমাদের দু’জনের যে-দূরত্বে ধুধু মরুভূমি
প্রসারিত তাতে
একবার মিলনের মরূদ্যান উপহার দাও। নাটকের
টাঙ্গানো দৃশ্যের মতো হোক তা ক্ষণিক
রঙিন, কখনো অনুতাপে পোড়াবো না হৃদয়ের শস্যাগার।
তোমার এখন
প্রকৃত দেখার জন্যে জ্বলন্ত অঙ্গারময় ক্রোশ
ক্রোশ পথ হেঁটে যেতে পারি,
তোমাকে দেখার জন্যে, হে নবীনা, আরো
কিছুকাল জীবনের ঘনিষ্ঠ উত্তাপে প্রৌঢ়তাকে
উল্টে পাল্টে সেঁকে নিতে চাই
ধুক ধুক বুকে।
তোমাকে দেখার জন্যে শুকনো ডালে চব্বিশটি বসন্ত-গোলাপ
সহজে ফোটাতে পারি, তোমার উদ্দেশে
খুনীদের আস্তানায় দ্বিধাহীন ঢুকে পড়া আজ
কী এমন অসম্ভব কাজ? তোমাকে একটিবার
প্রকৃত দেখার জন্যে প্রাণ বাজি রেখে
স্বৈরাচারীদের
লৌহমুষ্টি থেকে আমাদের একালকে ছিনিয়ে আনতে পারি।
কোল ছাড়া করতে চায় না
তারপর চোখে জ্বালা-ধরানো দুপুরে
জিবনের মাতৃক্রোড়ে মৃত্যু ঘুমিয়ে রয়েছে দুগ্ধতৃষ্ণাহীন।
বাতাসের চুমো তার গালে, বুজে-থাকা
চোখের পাতায় দূর মেঘপল্লী-পেরুনো রোদের
আঙুল চিকন ঘোরে, মৃত্যু কী নিঃসাড়
ঘুমন্ত, ছড়ানো ছ’টি হাত,
নাক জীবনের স্তনে গোঁজা! চতুর্দিকে অবিরাম
খোঁজাখুঁজি। যেন সব পুঁজি
খুইয়ে ঘুরছে
কতিপয় অতিশয় পরিশ্রান্ত উদ্ভ্রান্ত মানুষ।
ঢেউয়ে ছিলো ঘোড়া, শত শত, চোখে শীতল আগুন,
ক্ষমাহীন ছোবলের মতো, ঘোড়সওয়ারের
ঘূর্ণি-দড়ি ছুঁড়েছিলো, তাদের গ্রীবায়
প্রতিষ্ঠিত কী নগ্ন করোটি।
একজন লোক এক সারি অমৃতের সন্তানের পাশে
দূরগামী জাহাজের মালের ধরনে পড়ে আছে
স্তব্ধতায় মোড়া, চোখ জোড়া
প্রাচীন পাথর, কী-যে তার
নাম, কোথায় বা ধাম?
লোকটার পায়ের পাতায় খাদ্যাম্বেষী
পিঁপড়ের দঙ্গল,
নাক তার নীলিমার দিকে।
হঠাৎ জীবন তার কোলে মৃত্যুশিশু নিয়ে ছুটে
আসে লোকটার কাছে, ধুলোয় লুটোয়
মলিন আঁচল,
চোখ-ফেটে-পড়া অশ্রুজল, সত্তাময়
হাহাকার। অকস্মাৎ লোকটার হাত কী প্রবল
টেনে ওকে জাগিয়ে তুলতে চায় এক তাল কাদার মতন
ঘুম থেকে শুধু
মৃত্যু জীবনের আকর্ষণে
কিছুতে নড়ে না এতটুকু, ঠোঁট তার
নিথর নিশ্চুপ নুড়ি।
এখন শুইয়ে দেয়া প্রয়োজন, তবুও জীবন গোধূলিতে
মৃত্যু-বাছাটিকে কোল ছাড়া করতে চায় না।
কোহিনূর রেস্তারাঁয়
কিছুকাল থেকে
কোহিনূর রেস্তোরাঁয় ক’জন যুবক জড়ো হয়
নিয়মিত, ষড়ঋতু জড়ায় সত্তায়,
তাদের ক’জন চেনা এবং অচেনা কেউ কেউ
আমার নিকট, কেউ লোকগাথার মলিন কাঁথা থেকে মুখ
বের ক’রে শহরের
কাসিদা রচনা করে, কেউ কেউ টেবিলকে
হঠাৎ ষোড়শ শতকের গ্লোব থিয়েটার ভেবে
নিয়ে হ্যামলেট ভেবে নিজেকে কবোষ্ণ রক্তধারা
হাতে মাখে, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, ভীষণ তুষারাবৃত বৃক্ষের মতন
নীয়ারের চুলে হাওয়া লাগে, পর্দা নেমে আসে।
একজন যুবা, যে বৃষ্টির অগণিত নখ
ভালোবেসে, ভিজতে ভিজতে অকস্মাৎ
ঝোড়ো বেগে ঢুকে পড়ে, হাসি মুখে চায়ের অর্ডার দেয়,
সঙ্গে চাই একটি কি দু’টি উদ্ভিন্ন সিঙাড়া।
এক পীস ফ্রুট কেক হ’লে
আরো ভালো হয়, যার হাত টেবিলে খাটুনিজব্দ মজুরের
মতো স্রেফ ক্লান্তির ডানার
নিচে শুয়ে আছে, তার দিকে স্বপ্ন হেঁটে
আসে ক্রাচে ভর দিয়ে। যে ক’মাস ধরে কবিতার
একটি পংক্তিও
সাজাতে পারেনি তার ডায়েরির পাতায়, হুতুশে
চেহারা নিয়ে সে ব’সে আছে, যেন তাকে
ছেড়ে গেছে বাঁচবার। সাধ। একজন মনে-মনে
কল্পনার খাল দ্রুত ছাড়িয়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছে শত।
রঙিন ঘুড়ির মতো শব্দ স্বপ্নিল সুতোয় আর
কেউবা অনূঢ়া বড় আপার ভীষণ
হুহু যৌবনের ব্যর্থতায়
গোপন কান্নায় ভেঙে পড়ে, অথচ বাইরে তাকে
কেমন লড়াকু মনে হয়। অন্যজন,
পার্টির একাগ্র কর্মী, গোয়েন্দার সতর্ক নজর
এড়িয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ, মাঝে-মাঝে দেখা দেয়
বন্ধুদের একান্ত ডেরায়।
অনেক পুরানো ডাকটিকেটের মতো
কিছু স্মৃতি-পাতা ওড়ে কারো কারো মনে। ‘কার জন্যে ঘন্টা বাজে
বলে এক বেকার যুবক
আচানক কোহিনূর রেস্তোরাঁয় বিবর্ণ চেয়ার থেকে উঠে
পা বাড়ায় পথে, ভেসে যায় জনস্রোতে।
রাত তিনটের পর
নির্জন রাস্তার ধারে কুয়াশার শাল মুড়ি দিয়ে
কোহিনূর রেস্তারাঁ দাঁড়িয়ে আছে ঠায়
অতিশয় পরিশ্রমে অবসন্ন বেশ্যার ভঙ্গিতে,
যার কোঠা ছেড়ে চলে গেছে ফূর্তিবাজ
সকল নাগর।