আমার স্বভাবদোষে
অকস্মাৎ
হাত
আমাকে সরিয়ে নিতে হলো তাড়াতাড়ি
নারী,
তোমার আঙুলে হোমশিখা তীব্র জ্বলে,
কোনো ছলে
এর আগে জানতে পারিনি। তবু ভুলে
আমার স্বভাবদোষে আঙুল জড়াতে চাই তোমার আঙুলে।
আমি ছাড়া কে জানে
সোফায় এলানো তার শরীরের বাঁক দেখে ভাবি-
কী আশ্চর্য, নিজের ভেতরে
কেমন নিশ্চপ কত জটিল কাহিনী, কল্পকথা, শোকগাথা,
স্বপ্নের নিবিড় ভাষা লুকিয়ে রেখেছে।
ক্ষণিক বিশ্রামে তার গূঢ় রহস্যের বর্ণচ্ছটা
শুয়ে আছে। কে বলবে যে এখন পিঠে এক রাশ কালো চুল
ছড়িয়ে রয়েছে বসে, সে এমন শক্তি ধরে যাতে
আমার বুকের মধ্যে কালবৈশাখী তুফান ওঠে,
ভয়ংকর মনোহর
বিদ্যুল্লতা খেলা করে বারবার নীড়সুদ্ধ গাছ অগোচরে
পুড়ে খাক হয়,
এই মধ্যবয়সীরও শিরায় শিরায় জ্বলে প্রখর দেয়ালি।
আমি ছাড়া কে জানে এখন
যে এমন ভীরু দৃষ্টি মেলে দ্যায় হরিণীর মতো, তার চোখে
চকিতে ঝলসে ওঠে স্বেচ্ছাচারী কাতিলের ধারালো খঞ্জর?
একটি চিঠির জন্যে
আজকের ডাকেও আসেনি ওর চিঠি পিয়নের
পায়ে-চলা পথে রোজ
দু’চোখ বিছিয়ে রাখি। কখনো দূরের
অচেনা ব্যক্তির লেখা কোনো
চিঠি, কোনো পার্সেল অথবা
কবিতার বই আসে, কিন্তু আমি যার
হস্তাক্ষরময় অন্তরঙ্গ পত্র পেতে চাই,
সে কেমন নিঃসাড় এখন। সে কি তবে শয্যাগত
অসুস্থতা হেতু? নাকি কোনো অবসাদ,
প্রাগৈতিহাসিক,
এ নবীন হৃদয়কে তার
করেছে প্রবাস ধু ধু? ঘরে ফিরে যাই, ভয় হয়।
এত অন্ধকার, হায়েনার গায়ের রঙের মতো,
কখনো হয়নি জড়ো আমার এ ঘরে। হিস হিস শব্দ শুনি
সারাক্ষণ, মেঝেতে অতল গর্ত পদে
পদে, মনে হয়। এই পত্রহীন প্রহর আমাকে
তলোয়ার মাছের মতন কাটে, শুধু রক্ত ঝরে বুক থেকে।
এইতো ক’দিন আগে পেয়েছি সান্নিধ্য তার, ফুল্ল
হাসি তার ভেসে আসে, যেন এইমাত্র সোফা ছেড়ে
কোনো কাজে অন্য ঘরে গেছে। শূন্যতাকে
চুমো খেলে পাবো তার নিঃশ্বাসের, ত্বকের সুঘ্রাণ। আজ শুধুউ
রুশ পুতুলের মতো
স্মৃতির ভেতরে স্মৃতি নানা স্তরে জমে।
একজন স্বেচ্ছাচারী নিষাদ ছুঁড়েছে
হঠাৎ বিষাক্ত তীর আমার উদ্দেশে অবেলায়।
কতিপয় লোক, ফিচেল দৃষ্টিতে
তাকায় আমার দিকে, কান্নি মারে, যেমন আহত
ঈগলের প্রতি ঠারে ঠোরে দৃষ্টি হানে
হাড়গিলে, কাদাখোঁচা, কাক।
আজকের ডাকেও আসেনি ওর চিঠি। এলে আমি
আমার ডাগর ক্ষতে প্রলেপ পেতাম,
কী সহজে সকল ভ্রকুটি,
অট্রহাসি উপেক্ষায় হাওয়ায় উড়িয়ে
দিতে পারতাম; এতদিনে জেনে গেছি-
বস্তুত জগতে
মানুষের কাছে যখন যা সবচেয়ে কাঙ্খণীয়,
সেটাই অপ্রাপনীয় থেকে যায় নিশ্চিত তখন।
কবেকার হাহাকার
তারপর দিগন্তে বেদনা
ঘন চুল এলিয়ে জমাট,
ইলেকট্রিকের দীর্ঘ তারে হুহু কাক, জলকণা
কী ব্যাপক জাল; সারি সারি ঘরবাড়ি মাঠঘাট
জব্দ, বন্দী আকাশে মেঘের মোষ কিংবা, মেষ
মাঝে-মধ্যে বিদ্যুল্লেখা, বইছে হাওয়ার
দীর্ঘশ্বাস শহরকে ঘিরে, রবীন্দ্র সঙ্গীত শেষ
ক্যাসেট প্লেয়ারে, বসে আছি একা ঘরে,
আকাশের চোখ ফেটে
ঝরে শুধু ঝরে
অশ্রুজল, ইচ্ছে নেই কোথাও যাওয়ার।
কেউ কি দাঁড়ালো এসে গেটে?
যূথীর বিধুর গন্ধে কী যেন হঠাৎ মনে পড়ে
হৃদয়ের ঘোর মন্বন্তরে।
অন্ধকার দিন
গাঢ়, কালো চোখের মতন
তাকায় আমার দিকে, একলা পথিক, উদাসীন,
ধূসর বর্ষাতি-পরা, ভেজা পথে হাঁটে,
হৃদয়ে যক্ষের নিবেদন,
পানিডোবা মাঠে
ব্যাঙের কোরাস, দূরে বেহালার ছড়ে
কে বজায় মেঘ? আরো বেশি অন্ধকার
নেমে আসে হৃদয়ের চৌদিকে এমন দ্বিপ্রহরে,
আকাশে মাটিতে কবেকার হাহাকার।
কার কী ক্ষতি হতো?
পাশের বাড়ির অনুঢ়াকে কখনো সখনো দেখি
আমি ঝুল বারান্দায় পায়চারি করার সময়। তার চোখ
জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায় ছাদে, কখনো ঘরের
মধ্যে, কখনো বা সাঁজ-ফেরানো বাগানে।
কোনো কোনো দিন কাঁখে
শিশু নিয়ে হাঁটে, শিশুটিকে গাছ, চাঁদ, ফুল পাখি
দেখায় ইঙ্গিতে মুগ্ধাবেশে, কখনো সে
চকিতে শরীরে হরিণীর ছায়া নিয়ে ছুটে যায়।
নিতম্ব অবধি নেমে-আসা একরাশ অসিত শিখার মতো
চুলে একটি কি দু’টি রঙিন পতঙ্গ উড়ে এসে
বসে পুড়ে মরার আশায়, চুমো খায়, যেন ঘোর
অমাবস্যা রাত্তিরের ঠোঁটে
টুকরো, টুকরো জ্যোৎস্না। তরুণীটি এক গাল
হেসে লন থেকে
সযত্নে কুড়িয়ে নেয় খড়কুটো; আমার ভেতরে
কবিতার জন্মজল অলৌকিক কোলাহল করে বারংবার।
শুধু দূর থেকে দেখি তাকে,
কখনো শুনি না কণ্ঠস্বর তার, কান পেতে থাকি
প্রায়শঃ তবুও নিস্তব্ধতার সরোবরে ঢেউ
জাগে না কখনো। সে যখন
ফুলের চারাকে বুকে নিবিড় জড়ায়
তখন শরীরে ওর কী জমাট একরোখা নীরবতা। সূর্যাস্তের দিকে
টলটলে একজোড়া চোখ নিয়ে তাকায় যখন,
মনে হয় তার রূপপ্লাবিত শরীর
গহন ভাষায় কথা বলে
গোধূলির ছোপলাগা মেঘেদের সঙ্গে আর ছায়া
ছায়া পাখিদের ওড়া আর
সদ্য ফুটে-ওঠা নক্ষত্রের সঙ্গে, যদিও কখনো ওষ্ঠে তার
মঞ্জুরিত নয় কোনো ভাষা।
নাম তার জানি না, জানার বাসনাও
করি না প্রকাশ
সঙ্কোচ বশত, শুধু হীরের কুচির মতো কিছু
ভাবনা আমার ঘিরে থাকে
ওকে, মনে হয় সে আমার সে কোন্ সুদুর কালে
বিপর্যয়ে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া প্রিয় সহোদরা।
আমার পুরনো সহকর্মী সাদেকিন, এখন সে
পরবাসে, এক ভোরবেলা
গরম চায়ের কাপে নিবিড় চুমুক দিতে দিতে গল্পচ্ছলে
বললো তার গাঁয়ের সুন্দরী এক অনূঢ়ার কথা।
নাম ওর বোধ হয় অঞ্জলি, চোখে দেখে না অথচ
গলার আওয়াজ শুনে নির্ভুল শনাক্ত করে কার
সঙ্গে বলছে সে কথা, পাখপাখালির
সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়, ওরা তাকে
ডেকে নিয়ে যায় খোলা সবুজ ছাতার মতো গাছের ছায়ায়।
ঝোপঝাড়ে, বাঁশবনে, ইঁদারার কাছে।
প্রকৃতি কখন তার শাড়ি পাল্টাবে সে আগেভাগে
বলে দিতে পারে ঘ্রাণ নিয়ে,
ঘাসে পা রেখে সে বলে দেয় কবে পূজো হবে আর
একটা সামান্য কিছু নিয়ে
অসামান্য খুশি হয়ে উঠবার আশ্চর্য ক্ষমতা
সে কোত্থেকে পায় ভেবে সাদেকিনের গাঁয়ের
লোকজন সারা। সেই কখনো না-দেখা অঞ্জলির
কথা মনে পড়লেই বুকের ভেতর চর খুব ধু ধু করে।
কখনো কখনো ভাবি যদি
আমার পাশের বাড়িটার অনবোলা
তরুণী এবং সাদেকিনের গাঁয়ের
অঞ্জলি দু’জন দু’টি আলাদা অনূঢ়া
না হয়ে কেবল একজন সুন্দরী রমণী হতো,
শান্তি আর কল্যাণ ছড়ানো চোখ মেলে
দেখতো পারতো দৃশ্যাবলী আর তার ওষ্ঠ থেকে ঝরে যেতো
কথার বকুল জুঁই বেলী
তাহলে কার কি ক্ষতি হতো?