- বইয়ের নামঃ খুব বেশি ভালো থাকতে নেই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অস্ত্রোপচারের পরে
কী বলতে কী বলি? কীভাবে যে শুরু করি! সমস্যাটা
খোলাখুলি বলা যায়, এখানেই। বিকেল পাঁচটা
বেজে পাঁচ মিনিটে অপারেশান থিয়েটারে আমি
হেঁটে যাই শাদা ঢোলা জামা গায়ে বন্দীর ধরণে।
স্মিতমুখ সার্জন, আরোগ্যাশিল্পী, কান্তিমান; ফিকে
হল্দে দস্তানায় মোড়া হাত তাঁর খানিক পরেই
হবে রাঙা হেমোরয়েড রক্তে। লুকিয়ে ভয়ের নীলা
বুকে জননী স্ত্রী কন্যা, ভাইবোন কারুর দিকেই
তাকাইনি ফিরে, তবু একটি মুখের রেখাবলি
আমাকে, চমকে দেয় সৌন্দর্যের গহন পীড়নে।
সবুজ গাউন-পরা তিনজন ধরাধরি ক’রে
আমাকে শুইয়ে দেয় লম্বাটে টেবিলে; মুখ জুড়ে
কালো মাস্ক হাপরের মতো ব্যবহার করে, কোনো
রূপকথা শোনাবার ছলে সন্ধ্যার ঘোমটাময়
জনশূন্য ফুটপাতে ঘুম খুব সহজে পাড়ায়
চন্দনাবিহীন, দিঘি নেই আশেপাশে। তখন আসেনি কানে
বন দোয়েলের শিস। শুধু আর্কল্যাম্পের তলায়
অচৈতন্যে আমার শরীর স্বপ্নহীন স্মৃতিছুট
স্বপ্নময়তায় যেন ভাস্কর্য নিথর। চুপিসাড়ে
অন্য কেউ আমাকে দখল ক’রে নিয়েছে সহসা।
অস্ত্রোপচারের পরে কুয়াশার চিক আলগোছে
সরিয়ে দেখার মতো মনে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ
মীন রূপে সাঁতার কেটেছি অবচেতনের জলে।
ঠিক সঞ্চরণশীল নয় হয়তো; পানি থেকে মাথা
তোলা, ফের অগাধ তলিয়ে যাওয়া, এরকম
আচরণ করেছে আমার সত্তা। চিৎ হ’য়ে, কাৎ
হ’য়ে ভেসে যাচ্ছিলাম ক্লিনিকের বেডে, কিছু মুখ,
স্রোতে ভেসে-যাওয়া ফুল, আমাকে ঈষৎ ছুঁয়ে কার
ফুঁয়ে উড়ে যায় দূরে। স্যালাইন নল দ্রাক্ষালতা,
মদির জীয়নরস চুঁইয়ে পড়ে শিরায়; কে আছে
দাঁড়িয়ে শিয়রে নাগা সন্ন্যাসীর মতো? মেঘে মেঘে
শব্দহীন ঘন্টা বাজে; চোতের হাওয়ায় তৈরি এক
বালিশে গচ্ছিত মাথা। সফেদ ত্র্যাপ্রন গায়ে; চোখে
নীল চশ্মা গলায় স্টেথিস্স্কোপ, সে কি চেনা কেউ?
নার্সময়তায় চতুর্দিকে হংসীদল। ফিস্ফিসে
কথা ভাসে, দ্রুত পদধ্বনি, কারো ছবি কাছে এসে
চিহ্নহীন। দরজার পাশে জবাগাছ কে রেখেছে
পুঁতে এরকম ছন্দোময়? অক্ষরবঞ্চিত বই,
পত্রহীন লেফাফা এবং বীতরাগ গীত ঢোকে
আমার ভেতরে আর পানিমগ্ন ক্যাফেটারিয়ায়
দক্ষকন্যাদের ভিড়। কার কী যে নাম দীপিতার
সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছিলো নিঝুম সন্ধ্যায়?
মাথার ভেতরকার মেঘদল ছিঁড়ে যন্ত্রণার
স্খলিত নক্ষত্র ছাই হয়, বড় বেশি ধবধবে
দেয়ালে চঞ্চল ঘাসফড়িঙেরা ক্ষীণ পরমায়ু
নিয়ে করে ওড়াউড়ি। দিকে দিগন্তরে তৃষ্ণার্তের
ওষ্ঠ জেগে থাকে সর্বক্ষণ; কখনো দুলছি খুব
ঢেউলাগা, নৌকো, কখনো বা কৃষকের হাত থেকে
ক্রমাগত ঝ’রে যেতে থাকি,গুঁড়ো হই শস্যবীজ।
তন্দ্রার হরিণ বেডে নিদ্রার বিবাদ রেখে যায়।
আঁধার ঘরে বন্দী এখন
আকাশজোড়া মেঘ দেখি না দুপুরবেলা,
চৈত্রদিনে হাওয়ায় ধুলোয় পত্রঝরা,
তা-ও দেখি না।
মাঝে-মধ্যে মুক্ত পাখির-সুর বয়ে যায়,
কানে ভাসে।
আঁধার ঘরে বন্দী এখন একলা আমি
একলা থাকি সারা বেলা, রৌদ্র থেকে
জ্যোৎস্না থেকে নির্বাসিত।
প্রহরীদের বুটের শব্দ মগজ কাঁপায়,
অন্ধকারের রোমশ হাতে জব্দ হয়ে
হাঁপাই শুধু ক্লান্ত মনে
অবহেলার ঠেলে-দেয়া রুটি ছিঁড়ি
প্রহর গুণি
এবং শুনি ভবঘুরে কুকুর কাঁদে মধ্যরাতে।
কখনো এই হতচ্ছাড়া কম্বলেরই ফুটোয় ফোটে
সাতটি তারা,
কখনো ফের অপদুতের স্বপ্ন দেখে রাত্রি কাটে,
অব্দ কতো যায় চলে যায় অস্তাচলে,
কোন্ আগুনে দগ্ধ, হয়ে ভস্মমূর্তি
হচ্ছি কেবল রূপান্তরে?
আঁধারে ঘরে বন্দী এখন একলা আমি।
একলা আমি? নাকি আমার মতোই এখন
বহুজনের বন্দীদশা?
এই পাথুরে দেয়ালটাতে হাত-পা আমার
আটকে আছে-
নড়লে আমি শেকল নড়ে, শকুনেরা
আমার শরীর ঠুকরে ছেঁড়ে টুকরো টুকরো
মাংস ঝরে যখন তখন।
অট্রহাসি আমার ক্ষতে নুন ছিটিয়ে
হা-হা শব্দে নিলায় দূরে।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি
ভুল পথে সেই কবে থেকে চলছি আমি?
দ্বিধায় পাথর সরিয়ে দূরে মন উড়ে যায়
যজ্ঞ ডুমুর, রাঙা শালুক দিঘির কাছে।
ঘাড়-কাটা এক মৃতদেহ ঘুরছে ঘরে অবিরত,
বসিয়ে তাকে চাইলে হতে আলাপচারী,
হাত দু’টি তার আমার দিকে
এগিয়ে আসে হুকের মতো লৌহ কঠিন।
হতাশ্বাসে কণ্ঠনালী মরা ঘাসে
ভরাট হতে থাকে কেবল। সমাধি তার কোন্ বিজনে?
থাকতে বুঝি চায় না শুয়ে মাটির নিচে
কীটের রাজ্যে অমন একা
আঁধার ঘরে দীর্ঘ সময় বন্দী থেকে
মাথার ভেতর ভাসে প্রেতের ফিস্ফিসানি,
হঠাৎ কাউকে মনে পড়ার মতোই খানিক আলোর আশায়
চার দেয়ালে চেয়ে থাকি।
আমাকে কোথায় পাবে?
আমাকে কোথায় পাবে? ডাক পিয়নের
চিঠি বিলি করবার মতো
নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। পৃথিবীর কোনো ভৌগোলিক
সীমানা মানি না আমি; না, আমার কোনো
নির্ধারিত দেশ নেই, সেই কবে পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেছি।
হাওয়ার মতন আর রোদ্দুরের মতো
ব্যাপ্ত আমি দেশে দেশে। তাই পোষ্টম্যান
ধন্দে পড়ে প্রতিবার, ভুল করে কর্তব্য পালনে।
আমাকে কখনো
খুঁজে পেতে হলে, হে দীপিতা,
আমার তোমাকে ভালোবেসে না-পাওয়ার
মধ্যে তত্ত্বতালাশ চালাতে হবে। যে-গোলাপ কস্মিনকালেও
ফুটবে না তার শূন্যতায়, কখনো যে-মোমবাতি
তোমার টেবিলে জ্বলে লোড শেডিং-এর
রাতে, তার নিভে যাওয়ার ধোঁয়ায়,
পাকা ধান খেতে এসে যে বাদামি হাঁস
শিকারীর গুলীর আঘাতে
সঙ্গিনীকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলে খোলা চরে, তার আর্তনাদে,
মুক্তিযুদ্ধে যে যুবার খোয়া গেছে একটি পা,
তার ক্রাচে, মেশিনে নিহত শ্রমিকের বিধবার
অশ্রুজলে, অত্যন্ত বিষণ্ন জেলেদের প্রতীক্ষায়
আমার ঠিকানা পেয়ে যাবে সুনিশ্চিত।
অনিদ্রার অতিশয় তীক্ষ্ণ ছুরি সেই কবে থেকে
আমাকে খোঁচাচ্ছে ক্রমাগত। মাঝে মাঝে কায়ক্লেশে
জেগে থাকবার ক্লান্তি চোখে অবেলায়
ঘুমের কুয়াশা টেনে আনে,
দুঃস্বপ্ন দেখার ভয়ে ঘুমোতে পারি না স্বাভাবিক।
আমাকে কোথায় পাবে? হে দীপিতা, শোনো,
আমার ভুরুতে আর চোখের পাতায় অতীতের
ধুলো জমে আছে, বর্তমান পাঁজরের
প্রতিটি হাড়ের মধ্যে দুন্দুভি বাজায়,
আঙুলে নিয়ত ফোটে ভবিষ্যৎ, যেন স্বর্ণচাঁপা।
আমার ঠিকানা তুমি খুঁজে পাবে দেশ-দেশান্তরে
ভুখ মিছিলের পদ শব্দে, ফাঁসির মঞ্চের মতো
ভীষণ কর্কশ বিরানায় আর কয়েদখানায়
রাজবন্দীদের শিক-পেরুনো দৃষ্টিতে। যে জোরালো
হাত অকস্মাৎ অন্যায়ের মাথা থেকে
মুকুট ছিনিয়ে নেয়, সে-হাতের মুঠোয় এবং
জ্ঞানীর নিশ্বাসলাগা গ্রন্থের পাতায়,
ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়ানো
ঋজু দেশপ্রেমিকের বুকে,
বিপ্লবী কবির আগুনের স্ফুলিঙ্গখচিত, চোখ
ধাঁধানো মালার মতো কবিতায়, যারা
বারুদের গন্ধভরা পথে ও প্রান্তরে
ওড়ায় পায়রা ঝাঁক ঝাঁক
তাদের মিছিলে আর কৃষ্ণকায় কবি পুরুষের
ফাঁসির দড়িতে আমার ঠিকানা জ্বলে নক্ষত্রের মতো।