ভয় হয়
মনে হয়, কতকাল প্রেরণার আলোড়ন নেই
মনের গহনে, স্থবিরতা বসে আছে
মুখোমুখি, শব্দেরা গুঞ্জন তুলে চকিতে উধাও। কবিতার
খাতার উম্মুখ পাতা বিধবার শাদা
থানের মতোই থাকে। হঠাৎ তোমার মুখ জেগে
ওঠে, যেন তুমি এলে হৃদয়ে তরঙ্গ তুলে অলৌকিক কোন
হেমবর্ণ দ্বার খুলে। কী আশ্চর্য আমার সম্মুখে
উম্মোচিত কবিতার স্তন, নাভিমূল। ভয় হয়,
যদি সে হারিয়ে যায় কুয়াশায় তবে
কাকে খুঁজে বেড়াবো সর্বদা?
১৪।১২।৮৯
মিলনের মুখ
গুলিবিদ্ধ শহর করছে অশ্রুপাত অবিরত,
কেননা মিলন নেই। দিন দুপুরেই নরকের
শিকারী কুকুর তার বুকে বসিয়েছে দাঁত, বড়
নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ।
মিছিলে আসার আগে মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে
তাড়াতাড়ি সরে এসে, স্ত্রীর প্রতি হাত নেড়ে, চুমো
খেয়ে শিশুকন্যাটিকে নেমেছিল পথে শুভ্রতায়
শহরের বন্দীদশা ঘোচাবার দুর্নিবার টানে।
এ শহর ছিল শৃঙ্খলিত, ভয়ংকর শৃঙ্খলিত
প্রতিটি মানুষ, ঘরদোর, গাছপালা পশুপাখি;
শেকল ভাঙার গানে কণ্ঠ মেলাতে মিলন নিজে
আগুন-ঝরানো গান হয়েছিল তপ্তজনপথে।
অকস্মাৎ আকাশে কে যেন দিল ঢেলে কালো কালি,
দুপুর সন্ধ্যার সাজ প’রে বিধবার মতো চোখ
মেলে চেয়ে থাকে আর আঁচলে সংগ্রামী স্মৃতি জ্বলে,
মিলনের মুখে বৃষ্টি নয়, বাংলার অশ্রু ঝরে।
১৪।১২।৯০
ম্যাগাজিনে আমার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার প’ড়ে
ভাবতেই পারিনি, এমন গুছিয়ে-গাছিয়ে
বলতে পারবেন তিনি
এত কথা, যেন হাতের চেটোয়
মেহেদীর নক্শা। আমার বিষয়ে যা-যা
বলেছেন তাতে মনে হ’তে পারে
আমি প্রায় ফেরেশ্তা আর
যে-সারল্য আরোপ করা হ’য়েছে এই
বান্দার ওপর তা-ও
ষোলআনা ঠিক নয়। যুগ-সংকটের
জটিলতা আমার দোসর।
কোনো কিছু লেখার সময, গদ্য পদ্য যাই হোক,
আমি বার বার কাগজ দলামোচা ক’রে
ছুঁড়ে ফেলি বাজে কাগজের
ঝুড়িতে, তিনি বলেছেন। কী ক’রে অস্বীকার
করি, বলুন? কিন্তু এটাই
সব নয়, এ খবর যদি তিনি রাখতেন। তখন,
মানে, যখন টেবিলে ঝুঁকে
লিখি, আমার ভেতরে কত হাওয়াই সেতু
গুঁড়িয়ে যায়, টগবগানো লাভা
ক্রমাগত পোড়াতে থাকে আমাকে,
কেউ এই হতচ্ছাড়াকেই ব্যর্থ কাগজের মতো
দলামোচা করে প্রহরে প্রহরে।
আমার গৃহিণীর কি কখনো মনে হয় যে,
রতিবিহারের কালে ওর মুখে
অন্য কারো মুখ স্থাপন ক’রে সুখের সরোবরে
ডুবে যাই? না, ফেরেশতা টেরেশতা
আমি নই, পাক্কা শয়তানের শিরোপাও
আমার লভ্যনয়।
আমি নিজের মধ্যে এক দাউ দাউ মশাল
ব’য়ে বেড়াচ্ছি দিনরাত্রি, এ-ও
তার অজানা। জায়নামাজে ব’সে তিনি আমার
মঙ্গল কামনা করেন প্রত্যহ দু’হাত তুলে,
তখন ওর কাপড়-ঢাকা মাথা
নীলিমাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। আমি কি
তার এই নিষ্কলুষ ভঙ্গির যোগ্য? তিনি
প্রকৃত আমাকে পুরোপুরি চেনেন না আজো।
আমাকে নিয়ে নানা মুনির নানা মত,
কত জল্পনা কল্পনা। ওদের
প্রত্যেকের বলাবলি উপেক্ষা ক’রে, ব্যাঙআচিদের
অগুণতি লাথি অগ্রাহ্য ক’রে
আমার অস্তিত্ব বিদ্যমান হাই-রাইজ
দালানের ধরনে। সবার আন্দাজের বাইরে আমি।
এতকাল অন্তর্গত দ্রোহ, ক্ষোভ, বিষাদ,
আনন্দ আর ভালোবাসার
সান্নিধ্যে বেঁচে-বর্তে আছি গেরিলার মতো,
অথচ নিজেই সবচেয়ে কম জানি নিজেকে।
২৩।৩।৯০
যুদ্ধ সংবাদ
কখনো মৃত্যুই শ্রেয় মনে হয়; এই বেঁচে থাকা
বুকে পেসমেকার বসানো প্রৌঢ়বৎ নিরর্থক।
নিজেকে প্রত্যহ দেখি তীক্ষ্ণতায় আপাদমস্তক
ঝানু রেফারির মতো; ঘেন্না ধরে, সবকিছু ফাঁকা,
ফাঁপা, ঢোলা, যেন বালিশের ওয়ার বেঢপ; বাঁকা
চোখে দ্যাখে অনেকেই। বুঝি বা দ্রাবিড় যুগে ত্বক
ছেড়ে যৌবনের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরময়তা পলাতক;
মৃত্যু তার ন্যায্য অধিকার ক্রমশ করছে পাকা।
এখনো রয়েছি লিপ্ত যুদ্ধে অনিচ্ছায়। শক্তিধর
শক্ররা ছুঁড়ছে নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র অবিরত,
আমার নিজস্ব অবস্থান জেনো তবুও অনড়।
কী আশ্চর্য, কখনো খড়িশ শক্র, কখনো বা চেনা
বান্ধব সাজায় ব্যুহ একযোগে। বিভ্রমবশত
ভাবি হয়তো এই রক্তপায়ী যুদ্ধ আর চলবে না।
২৮।৩।৯০
যেখানেই হাত রাখি
যেখানেই হাত রাখি, হাত পুড়ে যায়
একটু বাড়ালে মুখ, মুখ ঝলসে যায়।
এমনকি লেখার টেবিল যেন গলানো
লোহার গনগনে পাত।
এখন কোথাও হাত রেখে স্বস্তি নেই। শহরের
গাছপালা ভীষণ উগরে দিচ্ছে তাপ,
জনপথ ফুটন্ত কড়াই, বাড়িগুলি
ড্রাগনের মতো দশদিকে
কেবলি ছড়িয়ে দিচ্ছে তরল আগুন।
তবে আমি কোন দিকে যাবো আজ?
কোথায় রাখবো হাত? মুখ
কী ক’রে বাঁচাবো আগুনের হল্কা থেকে?
তোমার হাতের নীড় খুঁজে পেলে, মেয়ে,
তোমার সুন্দর মুখ ঝুঁকে এলে মুখের উপর,
যোজন যোজনব্যাপী আগুনের দারুন আজাব
থেকে রক্ষা পেয়ে যাবো।
১২।২।৯০
লোকগুলোর কী হয়েছে
লোকগুলোর কী হয়েছে বলোতো
মুখে কুচকুচে অথবা ধবধবে দাড়ি দেখলেই
অথর্ব মোল্লা ঠাউরে নেয় আর
উশকো খুশকো চুল ময়লা ট্রাউজার
হলুদ উদাসীনতা-ছাওয়া
চোখ দেখলেই ছন্নছাড়া পদ্যলিখিয়ে
কী যে বোঝাতে চায় এই নিদ্রাচারীরা
ওরা নিজেরাই তার মর্মেদ্ধার
করতে পারবে কি না তা’ নিয়ে
বিস্তর জল্পনা কল্পনা করা যেতে পারে
ঘুমের জঠরে ক্ষণিক বসবাসকালীন সময়ে কী কী বলা হয়
জেগে ওঠার পর অবোধ্য তন্ত্র মন্ত্র
ওরা বলছে সমাজতন্ত্র কফিনে শায়িত
শেষ পেরেক ঠোকা খতম হয়ে এলো ব’লে
গির্জার পথেই মুক্তি হতে পারে সাবলীল
আমি বলি ব্যান্ডেজবাঁধা মাথা নিয়ে মার্কস এবং লেনিন
আকিদা আর মমতায় আগলে রাখছেন সমাজতন্ত্রকে
কবরের উপর সূর্যমুখী আশ্বাসের আভা
যা বলে বলুক লোকগুলো
ওদের কথামালাকে পাথর চাপা দেওয়া নিরর্থক
এক ঝটকায় সুন্দরের ঘাড় মটকে দেওয়া
সত্য-শিবের পশ্চাদ্দেশে কালি মেখে উদ্বাহু নৃত্য
কুবাক্যসমূহকে সুসমাচারের আদলে
পেশ ক’রে হাওয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া ওদের পেশা
ওদের প্রত্যেকের হাতে বিষঝরানো তীরধনুক
আমি কি ক্ষমা করতে পারবো ওদের
যাদের বাক্যশলাকায়
আমার কবিতা জর্জরিত ছটফটানো দুলদুল
যেভাবে হোক আগলে রাখা চাই
কবিতা আর পবিত্র সব লক্ষ্যবস্তুকে
লোকগুলোর যে কী হয়েছে
সূর্যের মুখে ওরা আলকাতরা লেপে দিতে উদ্যত
নক্ষত্রগুলো উপড়ে ফেললে ওরা হৈ হৈ মরদ
লোকগুলোর মুদ্রা আমি ওদেরই ফিরিয়ে দেবো
অসম্ভব নিশ্চুপ থাকা এই কালবেলায়
আমার কণ্ঠস্বর আজ ঈগলের উড়াল সবখানে
২৪।৪।৯০