নিশিডাক
নিশীথে আমাকে নিশিতে পেয়েছে ফের,
এ কার হস্তে বন্দী আমার ঘাড়?
মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে টিবিটায় ব’সে;
পালাতে পারি না, এমন শক্তি তার।
গিলে খায় রাতে, দিবসে উগরে দ্যায়;
জারক রসের পিচ্ছিল কিছু দাগ
সত্তায় আঁকা, কশে তার হলাহল;
শয্যায় আজ উদ্যত কালনাগ।
অন্ধের মতো হেঁটে যাই অজ্ঞাতে,
ডাইনীর কটু পাচনের মতো নিশা।
রক্তে হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যায়,
অমবস্যায় পাই না কোথাও দিশা।
মাটি ফুঁড়ে যেন বেরোয়া ঘুর্ণিঝড়,
ঝাঁকুনি ধরায় দেহের দেয়ালে চিড়।
ভেঙে চৌচির দিগন্ত- দর্পণ,
আকাশে আকাশে লাল সর্পের ভিড়।
মনে হয় কেউ সীমাহীন আক্রোশে
মাথাটা আমার কাদায় ফেলছে পুঁতে;
পাঁজরের খাঁচা ভাঙছে শাবল ঠুকে,
হাঁস ফাঁস শুধু, ভাসি বিচ্ছিরি মুতে।
চৌদিকে চলে ধ্বস্তাধ্বস্তি খুব,
কৌলীণ্যের ল্যাঠা গ্যাছে কবে চুকে;
বিলাসী ডিভানে গৌরী শায়িত একা,
পাহাড়ি শকুন চঞ্চু শানায় বুকে।
আমার আয়ুর মেয়াদ বৃদ্ধি হ’লে
ক্ষতি নেই শত নিশিডাক শুনলেও;
তার উদ্দেশে যাত্রা অব্যাহত,
আমার নিকটে কখনো আসবে সে-ও।
অদূরে মৃত্যু চাটছে নিজের ছায়া,
আঁধারে হীরক চির-ক্ষুধার্ত চোখ;
দীপ নেভানোর প্রতিভা মজ্জাগত,
সবার প্রাণেই গেঁথে দ্যায় গাঢ় শোক।
শহর ঘুমায়, কবির স্বস্তি নেই;
নিশীথে আমাকে পেয়েছে নিশিতে ফের,
রক্ত শোষণে মত্ত বাদুড় ঝোলে,
আমার শিরায় উৎপীড়নের জের।
৪।৩।৯০
নিয়ত স্পন্দিত
আমাকে টপ্কে তুমি যাও হে কোথায়? খাও টক
কুল ভর সন্ধ্যেবেলা। বই মেলায় যাবে বুঝি আজ
বাসন্তী রঙের শাড়ি প’রে? চায়ের দোকানে ব’সে
গল্মগুজবের স্রোতে ভেসে-যাওয়া, ফুচ্কা খাওয়া,
কখনও একটি দু’টি বই কেনা ফিরতি পথে, তুমি
জানবে না একজন কবি তোমাকে না দেখে দুঃখে
একা ঘরে কাটায় সময় বোদলেয়ারের সঙ্গে,
কখনও বা উদাস তাকিয়ে থাকে নক্ষত্রের দিকে,
বুকে তার এক রাশ অন্ধকার, সেখানে ফোটে না
এমুহূর্তে কিছুতেই ফুল কিংবা তারা। দাঁড়াশের
ছোবলে কাতর তার বিবাগী অন্তর; ঘরে ফিরে
জামা টামা খুলবে যখন পড়বে কি মনে তাকে,
যে তোমাকে হৃদয়ে রেখেছে ভ’রে অত্যন্ত গোপনে,
প্রতিটি নিঃশ্বাসে যার তুমি নিয়ত স্পন্দিত, মেয়ে।
১৯।২।৯০
নিয়ন্ত্রণ
সন্ত্রাসে বসন্ত কম্পমান; হনুমান লম্ফ ঝম্প দিয়ে
নিমেষে বাগান লন্ড ভন্ড করে, সন্ত ভীত, ম্ফীত
অন্ডকোষে পড়ে চাপ। প্রাণ যায়, মুত্রাশয় ফেটে
যাবে বুঝি পাইপের মতো; আকাঙ্খারা ছাই হ’য়ে
ওড়ে চতুর্দিকে, পুনরায় জড়ো করা অসম্ভব।
এখন কবন্ধদের গুঁতো খেতে খেতে কাঁটাবনে
হাঁটা ছাড়া উপায় কি আর? অন্ধকার দশদিক,
হাড়মাস গলে, চঞ্চু-নখরের ঘায়ে জব্দ চোখ।
স্ববশে কিছুই নেই। নিয়ন্ত্রণ, শুধু নিয়ন্ত্রণ
যত্রতত্র, বাল্যকাল, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব কন্টকিত
নিয়ন্ত্রণে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করা, মুখ খুলে, হায়,
স্পর্ধিত এগিয়ে যাওয়া প্রবল বারণ। জিভ টেনে
ছিঁড়ে ফেলে দেয়ার উদ্দেশ্যে কত সান্ত্রী মোতায়েন।
নিয়ন্ত্রিত কত কিছু, এমনকি স্বপ্নও নিয়ন্ত্রিত।
১৭।২।৯০
নেকড়ের পালে একজন
অত্যস্ত নিঃসঙ্গ, নগ্ন; কম্পমান, কবচকুণ্ডল
হারিয়ে ফেলবে নাকি, দেখছে সে দন্ত-নখরের
অব্যাহত আঘাতে নিজের শরীরের খন্ডগুলি
এখানে সেখানে, দরদর রক্তপাত। শক্ত হাতে
মাটি আঁকড়ে রোখে ক্রমাগত হিংস্রতার স্বেচ্ছাচার,
দাঁড়বার জায়গা খোঁজে, উদ্ভাসিত নতুন স্ট্বাটেজি
অকস্মাৎ; নেকড়ের পাল যত পারে লাফ ঝাঁপ
দিক, দাঁত ভেঙে যাবে, চুর্ণ হবে সকল নখর।
নশ্বরতা চোখে নিয়ে বর্মহীন কোথায় সে যায়
ক্লান্ত নয়; যন্ত্রণা কর্পূর, একরত্তি ভয় নেই
বুকে, শুধু একটি চিবুক, ছলছলে দু’টি চোখ
ধ্যান ক’রে পথ চলে। দ্যাখে ধুলি ওড়ে, ইতস্তত
ছাগ-খুরে নাচে কত প্রতিভাবানের খুলি আর
সে প্রত্যহ বৈঠা বায় খরশান গহন নদীতে।
২৭।৩।৯০
পাখি
একটি পাখিকে খুঁজছি সেই কবে খেকে
শহরের গালিঘুঁজিতে আনাচে কানাচে সবখানে
তন্ন তন্ন করে খুঁজছি
কী সুন্দর দেখতে সেই পাখি আর গলায় স্বর্গীয় গান
পাখিটাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার মাথায়
আলাস্কার এক স্তূপ বরফ
একটা নেকড়ে বরফ চিবিয়ে চিবিয়ে
খাওয়ার জন্য খাটিয়ে দেয় হিংস্রতার পাল
শহুরে গাছের পাতায় পাতায় রাখি কড়া নজর
প্রতিটি জানলায় বুলাই চোখ
দীর্ঘ ঘাস সরিয়ে দেখতে চাই সেই পাখির নাচানাচি
হায় আমার মনেই পড়েনি সে মৃত অনেক আগেই
১৫।১২।৮৯
বুদোয়ারে
আর কত করবো আমি নিভৃতে তোমার ইস্তেজার
সারাবেলা প্রতিদিন? এখন তোমাকে খুঁজে ফিরি
প্রষ্ফুটিত গোলাপ এবং গন্ধরাজে, ঝিরিঝিরি
হাওয়ার হেরেমে মেঘে নদীবক্ষে বেকারার
হৃদয়ে প্রকৃত পক্ষে। তবু আজো তোমার দিদার
স্থগিত, অথচ দেখি তোমাকেই বাসের ভিতরে
বসে-থাকা, দুপুরে রিকশায় অপরাহ্নে স্মিত ঘরে
ক্ষণিকের জন্য লুপ্ত মাতলামি সকল দ্বিধার।
এ-তুমি প্রকৃত তুমি নও কিছুতেই, যদি হতে
তাহলে হৃদয় পরবাসে কাটতো না এতকাল
বিভ্রমবশত সত্যি। যে হাত আমার দুষ্ট ক্ষতে
নিরাময় ছড়াবে রেণুর মতো, সে-হাত নাকাল
কেন হবে মারীবৎ স্বেচ্ছাচারে? প্রতিক্ষণ যাকে
চাই একাকিনী শান্ত বুদোয়ারে, সে কোথায় থাকে?
২৭।৪।৯০
বড়দিনের গাছ
কাঠ ছুঁয়ে রাখাই ভালো
প্রথমবারের মতো এই বিরতিহীন ষ্ফূরণ
নয় চকমকি ঠোকা প্রজাপতির অনুসরণও নয়
আমার ভেতর থেকে অজস্র পুঁতি আর
হীরের ঠিকরে-পড়া যেন মাটিতে লেগে বৃষ্টির লাফ
তাক-লাগানো রশ্মির বিচ্ছুরণ
আমি কি রঙিন কোনো ফোয়ারা
দিনরাত্তির জ্যোৎস্নাকণার মতো উৎক্ষিপ্ত
জলধারার উৎস নীল রঙের পাখি
আর জলকপোত চমৎকার স্নাত
সুস্থ সবল যুবক খঞ্জ প্রৌঢ় ঘাটের মড়া সবাই
অঞ্জলি পেতে নিচ্ছে তো নিচ্ছেই
যে দানোর দখলে আমি সে কখন এক ঝটকায়
আমার ঘাড় মটকায়
এই দুর্ভাবনার ফেউ আমার সঙ্গ ছাড়ে না
পবিত্রতার ঝলকময় মৌমাছিদের প্রশ্রয় চারপাশে
চিরন্তনতার মঞ্জীর ঝনঝনিয়ে
আমাকে বানায় ঘূর্ণ্যমান দরবেশ
হাওয়ায় হাত বাড়ালেই পাওয়া
পেয়ে যাই গাছের পাতা ছুঁলে
ঝিলে আলগোছে পা ভিজিয়ে নিলে
নিঃশ্বাস নিলে জানালার দিকে মুখ রেখে
দরজা খুলে দাঁড়ালে তার কথা ভাবলে
ক্যালেন্ডারের দোলখাওয়া পাতা থেকে পেয়ে যাই
এ কেমন ষ্ফূরণ তখন
সত্তা থেকে জ্যোতির্ময় নিঃসরণে বিস্মিত
নিজেই পারি না চোখ ফেরাতে
আমার চোখ থেকে দোয়েল পাঁজর থেকে বুলবুল এবং কান থেকে মুঠো মুঠো নক্ষত্র নিঃসৃত
এখন আমি বড়দিনের ঝলমলে গাছ
২২।৪।৯০