থমকে থেকো না
থমকে থেকো না; আর কতকাল এভাবে দাঁড়িয়ে
থাকবে? এগিয়ে যাও। পেছনে হটতে
চাও বুঝি? এখন সে পথ বন্ধ; প্রখর দুপুর
বিকেলের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু করে
দিয়েছে সে কবে, দেখতেই পাচ্ছো। এবার ঝাড়া
দিয়ে ওঠো, নয়তো অন্ধকার
অচিরে করবে গ্রাস তোমাকেই। তখন অরণ্যে একা-একা
কেঁদে বেড়ালেও কেউ করবে না খোঁজ।
যদি ভাবো, সময় তোমার
মুঠোয় থাকবে বন্দী সারাক্ষণ, তবে ভয়ঙ্কর
ভুল হয়ে যাবে হিসেবের
হিজিবিজি খাতার পাতায়। পা বাড়াও তাড়াতাড়ি;
তোমাকে ছাড়াই সব কিছু ঠিকঠাক
চলবে, একথা মনে ঠাঁই দিতে পারো অবশ্যই। তবু বলি,
যতদিন আছো
প্রবল আবেগ নিয়ে বাঁচো, শক্রর ব্যুহের দিকে
এগোতে করো না দ্বিধা। অভিমন্যু হলেও তোমার
খেদ থাকা অনুচিত; কেউ কেউ এভাবেই যায়,
যেতে হয়, পরিণাম ছায়া হয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন
মেফিস্টোফিলিস, মুখে হিংস্র হাসি। তোমাকে পাতালে
নিয়ে যাবে, সাধ্য কার? নিজের পাহারাদার তুমি।
সবারই কিছু না কিছু পিছুটান থাকে। পুরাকালে
নাবিকেরা গভীর সমুদ্রে নাকি কখনো সখনো
কুহকিনী মোহিনীর গান শুনে চৈতন্যরহিত
দ্রুত ভ্রমে হারাতো জীবন নিরুদ্দেশে। যতদূর
জানা আছে, তুমি নও তেমন নৌজীবী। সামনের
দিকে পা চালাও, দাও ডাক দশদিকে
এমন জোড়ালো কণ্ঠে যাতে
বজেরও লজ্জায় মুখ বন্ধ হয়ে থাকে।
১২।২।৯০
দণ্ড
‘নত হও, নত হও’ ব’লে নির্বাপিত এজলাসে
পরচুলা-পরা বিজ্ঞ বিচারক খাগের কলমে
লিখলেন রায়, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটার
ভাবলেশহীন মুখ। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, ছন্নছাড়া,
তার বুক-চেরা পথে কুহকের অচিন সঙ্গীত
তোলে ঢেউ, কেউ ডেকে-ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে; সে-তো
বোবা-কালা নয়, তবু মৌনের নিঃস্পৃহ তাঁবেদার
সর্বক্ষণ, পোকা-খাওয়া ফলের মতোই স্তব্ধ মুখ।
মনে-মনে বলে, ‘ছাগ দেবতার কাছে নত হওয়া
কী ক’রে সম্ভব?’ নইলে অনিবার্য বলি যূপকাঠে,
মন্ত্রপাঠে প্রস্তুত পুরুত, ঠেলাঠেলি অবান্তর
ঠেকে তার; কৌতূহলী জনতার কোলাহল ভেঁপু
বাজায় কিশোর, নারীদের কারো কারো কাঁখে শিশু;
অবশেষে বিচারক, অপরাধী দু’জনই দণ্ডিত।
১৪।৪।৯০
দাবানল
জাহান্নাম নাকি? নিষ্ঠুরতা বশম্বদ ভয়ানক
উৎপীড়কের, লন্ডভন্ড চতুর্দিক, পশুপাখি
ফুড়িং, মৌমাছি পোড়ে দাবানলে, অসুরের নখ
মাটি আঁচড়াচ্ছে জোরে, এখন উদ্ধারকল্পে ডাকি
কাকে? দাউ দাউ বনভূমি। ডান দিকে সাপ ছোটে,
বাম দিকে সন্ত্রস্ত নেউল, নেকড়েরা অকস্মাৎ
মেষপাল, বৃক্ষগুলি জ্বলন্ত পাথরে মাথা কোটে।
পালাতে চাই না, শাপশান্ত স্থগিত থাক আজ,
আমাকে চাটছে তপ্ত লকলকে জিভ, যাচ্ছে পুড়ে
সমস্ত শরীর, চর্ম ফাটে, চর্বি গলে, এ কেমন কারুকাজ?
শিরদাঁড়া খাড়া, হাসি মুখে অগ্নিশুদ্ধ হবো ভোরে,
শামুক আত্মা-জুড়ানো পানি ভস্মময় ওষ্ঠ জুড়ে;
আমাকে শুইয়ে দাও কবিতার নালাম্বরী ক্রোড়ে।
২০।১২।৮৯
দুঃখভোগ
যাবে যদি চ’লে যাও, কোরো না খামোকা কালক্ষেপ।
অতীত ফেলতে চাও মুছে ইরেজার দিয়ে ঘ’ষে
সাত তাড়াতাড়ি? এত বিরূপতা শুনি, কার দোষে?
আমাকে সাজালে মস্ত অপরাধী করবো না আক্ষেপ
কোনো দিন। এই যে ভুগছি নিত্য, তোমার ভ্রুক্ষেপ
নেই তাতে কিছুমাত্র। তীরে এসে নৌকা ডুবে যায়
বার বার, বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে থাকি অসহায়;
করি না প্রার্থনা আর কার্বাঙ্কলে কৃপার প্রলেপ।
কী ক’রে ফেলবে মুছে ওষ্ঠ থেকে চুম্বনের দাগ
এত শীঘ্র? রাত্রিবেলা একা যখন ঘুমাতে যাবে
নিস্তাপ বালিশে মাথা রেখে, ঝেড়ে-ফেলা অনুরাগ
আগুনের হল্কা হ’য়ে রাতভর তোমাকে পোড়াবে।
তোমার বিরুদ্ধে নেই ধিক্কার অথবা অনুযোগ,
আমার জন্যেই থাক মনস্তাপ আর দুঃখভোগ।
নখ
নিজের হাতের দিকে হঠাৎ তাকাই, নখগুলো
অতিশয় তাড়াতাড়ি বর্ধমান রিরংসার মতো
অহর্নিশ; আমি কি দূরের কোনো অসভ্য মানব,
ক্ষৌরর্কম জানা নেই যার? এইসব নখ নিয়ে
বড়ই বিব্রত থাকি। শহরের প্রধান সুন্দরী
কাছে এলে তার স্তনে, তলপেটে দাগ ক’রে দিই,
এরকম ইচ্ছে বাঁদরের মতো চুলকোচ্ছে মাথা
কিছুকাল ধ’রে; আপাতত কবিতাকে খুঁটে-খুঁটে
মর্ষকামী সুখ পাই। দেখি তার চতুর্দিকে ঘাস
গজিয়ে উঠেছে দীর্ঘ ছাঁদে, ফড়িং গভীর ক্ষতে
দ্যায় সুড়সুড়ি; তার চেয়ে ভালো নিজেকেই আজ
খাম্চে-খুম্চে ছিঁড়ে খুঁড়ে খুব খুঁতময় মুখ নিয়ে
ব’সে থাকা পেকামাকড়ের মাঝে, লোভী ভ্যাম্পায়ার
মহানন্দে শুষে নেয় প্রতারিত কবির প্রতিভা।
২৬।৩।৯০
নব্বইয়ের একজন শহীদের স্ত্রীকে দেখে
শামিয়ানার নিচে তাকে দেখলাম বিষাদাবৃতা
দুপুরবারোটায়,
যার হাতে এখন মেহেদির রঙের বদলে
জীবনসঙ্গীর বুকের জমাট রক্তের অদৃশ্য ছোপ।
তার শোকস্তব্ধ মুখ থেকে বারবার
সরিয়ে নিচ্ছিলাম দৃষ্টি;
অসম্ভব এই শোকের দিকে
নিষ্পলক চেয়ে থাকা। আমার ভেতরে রাগী এক বাজপাখির
ডানা ঝাপটানি, সেই পাখির চঞ্চু আর নখর
প্রসারিত হস্তারকদের প্রতি, যারা হেনেছে
সংকল্পের মতো একটি সতেজ মানুষকে।
লোক থই থই এই সড়ক দ্বীপে
বিষাদাবৃতা নারীর আঁচলের খুঁট ধরে দাঁড়ানো
তার তিন বছরের কন্যা,যার খেলাঘরে
এখন মহররমের মর্সিয়া।
ওদের দু’জনের পায়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের মতো
গড়িয়ে পড়ছে চারদিকের জয়োল্লাস আর
আমার হৃদয়ের স্পন্দিত হাত
ওদের জানায় অভিবাদন
দুপুর বারোটায়।
ইচ্ছে হলো এক্ষুনি রঙধনু পুরে দিই শিশুর মুঠোয়,
যার পিতার বুকে বুলেট ফুটিয়েছে রক্তগোলাপ,
যিনি আলো ছিনিয়ে আনার ব্রত নিয়ে
কবরের অন্ধকারে নিদ্রিত,
যার মৃত্যু দুঃসময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্বকে লিখে গ্যাছে
প্রতিবাদী গাথা,
যার মৃত্যু ঘোষণা করেছে স্বৈরাচারের মৃত্যু
যার মৃত্যু দুরাত্মাদের বুকে ধরিয়েছে ফাটল,
যার মৃত্যু এ মাটিতে পুঁতে দিয়েছে বিজয় নিশান।
এই নারী কার কাছে জানাবেন অভিযোগ?
রৌদ্র-জ্যোৎস্নার কাছে? বাতাসের কাছে?
বৃক্ষরাজি কিংবা আকাশের কাছে?
যারা ভরদুপুরে তার সত্তায় ছুঁড়ে দিয়েছে বৈধব্যের ধুধু শাদা,
তারা কি ক্ষমার ছায়ায় কাটাবে প্রহর?
যারা তার যৌবনের স্বপ্নমালাকে কুটি কুটি ছিঁড়ে
ফেলে দিয়েছে ধুলায়
তারা কি সুখস্বপ্নে থাকবে বিভোর?
যারা তার সংসারকে করেছে ক্রূশবিদ্ধ,
তারা কি হেঁটে যাবে নিষ্কন্টক পথে?
এইতো সেদিনও শোকাচ্ছন্ন নারীর শরীর
ভিজে উঠতো সুখী বৃষ্টিতে,
আজ শামিয়ানার নিচে বসে তিনি বারবার আঁচলে ঢাকছেন মুখ
দুপুর বারোটায়,
যেন দুঃখিনী বাংলাদেশ চোখ থেকে
অবিরত মুছে ফেলছে অশ্রুধারা।
১০।১২।৯০