খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুমি নিজেকেই করছো আহত
অবিরত; বারণ করেছি তবু শোনো নি নিষেধ,
হিমাঙ্কের বহু ডিগ্রী নিচে জমে থাকে নানা খেদ।
নিজে দায়ী; অথচ আমাকে দিচ্ছো ঠেলে ক্রমাগত
দ্রুত ফ্যাসিবাদী ফুটোহীন গ্যাস চেম্বারের মতো
কুঠরিতে; পারছি না নিতে আর সহজে নিঃশ্বাস।
ফর্সেপ উপড়ে নিচ্ছে একে একে সকল বিশ্বাস,
অথচ হৃদয় জুড়ে জেগে আছে প্রণয়ের ক্ষত।
আমি কি বুলেটপ্রুফ দেয়াল ভেবেছো? ঝাঁক ঝাঁক
গুলি এসে ঝরে যাবে, লাগবে না গায়ে কিছুতেই
একটি আঁচরও? হয়তো ভাবো লাস্যময়ী অবসরে
লোকটার হতচ্ছাড়া বুকে এক ফোঁটা রক্ত নেই;
ধুরন্ধর সাপ ভেবে কেবলি পিছিয়ে যাও। থাক
অবান্তর কথা, শেষে যাবোইতো অখ্যাত কবরে।
২৬।২।৯০
গুঢ় সহবতে
বেলী আর কনকচাঁপার গুঢ় সহবতে থাকি,
বেশ আছি সর্ষে ক্ষেত, প্রজাপতি, শালুক, শামুক,
দোয়েল ঘুঘুর সঙ্গে। কোকিলের সঙ্গে কুহু ডাকি
নির্জন নেপথ্যেঃ কত বলাবলি-লোকটা কী সুখ
পায় এতে? চুল খায় রূপালি আদর, রাতে ভালো
ঘুম নেই, থাকি না কখনো হুজরায়। খোলা মাঠ,
জোনাকির দাওয়াত কবুল করি, চাঁদের আলোয়
ওজু সারি বারংবার। মধ্যরাতে পুকুরের ঘাট
ডেকে নেয় চুপিসাড়ে, দেখবো পরীর নাচ আর
ঝিঁঝি পোকাদের সঙ্গে মাতবো জিকিরে সারা রাত।
হরফের তসবি হাতে ঘুরি, প্রায় অলৌকিক বাজনার
তালে নেচে উঠে দেখি অকস্মাৎ কী সুন্দর হাত
আমার কপালে দেয় আলগোছে চন্দনের ফোঁটা;
ফলত দিগন্তপানে একা ছোটা, নিরন্তর ছোটা।
২৭।৪।৯০
ঘুরে দাঁড়াও
আর নয়, অন্য কিছু নয়, এবার দাঁড়াও ঘুরে,
জুতে নাও ধনুকে অব্যর্থতীর। দেখছো না ধেয়ে
আসছে চৌদিক থেকে হন্তারক দল? রক্তপায়ী
বাদুড়ের ঝাঁক ঝুলে আছে ভরসন্ধেবেলা, চোখ
পুড়ে যায়, মিত্র ভেবে শক্রকেই ধরেছো জড়িয়ে
বার বার, মৈত্রীর সহজপাঠী ভুলে বসে আছো।
পদতল থেকে দ্রুত মাটি স’রে যাবার আগেই
পূর্ণ বেগে ছোটাও দূরন্ত অশ্ব, হানো শত বাণ।
যুদ্ধে ক্লান্তি আছে, ব্যেপে-আসা বিষাদ, শূন্যতা,
বুকফাটা ক্রন্দনের রোল শুনে হাত থেকে খ’সে
পড়বে ধনুক হয়তো, এবং ফেরাতে পারো মুখ
রক্তঝরা গোধূলি-আকাশ থেকে। যারা মৃত বহু
আগে, তারা যদি আজ তোমার হাতেই মৃত্যু পায়,
তাহ’লে কোরো না খেদ, শুধু ঘুরে দাঁড়াও এবার।
১৭।৩।৯০
জনপথ লেখে
ঝেড়ে ফেলে দিতে দেশজোড়া
অনড় পাথর
শুধু রাজধানী নয়, আমাদের প্রতিটি শহর
এবং শহরতলী গ্রাম
ক্রুদ্ধ মানুষের কপালের
শিরার ধরনে করে দপ দপ। কখনো দেখিনি,
তবু তোমাদের কথা ভেবে
আমাদের হৃদয়ের চোখে অশ্রধারা বয়,
স্ফীত হয় বুক। তোমাদের বুক থেকে
রক্তের ঝলক এই মানচিত্রটিকে
আরো বেশি রক্তজবাময় করে তোলে।
এবং শহরতলী, গ্রাম
অধিক পবিত্র হয় তোমাদের অন্তিম নিঃশ্বাসে।
দুপুর কী এক সুর দিয়েছিলো বুনে
তোমাদের বুকে, সে সুরের সম্মোহনে
বুক দিলে পেতে দ্বিধাহীন শয়তানের হাতের
মতো বন্দুকের মুখে। ব্যারিকেডে, তেতে-ওঠা পিচে,
দেয়ালে, দিগন্তে যেন পুনরায় লাগে
মুক্তিযোদ্ধাদের তাজা শোণিতের ছাপ।
তোমরা যখন শীতদুপুরে রাস্তায়
মৃত্যুর গহ্বরে, হায়, হচ্ছিলে বিলীন,
তখনই তোমরা আরো বেশি উঠলে বেঁচে
স্বদেশের স্পন্দিত হৃদয়ে। তোমাদের জীবনের
শেষ সুর্যাস্তের আভা, দ্যাখো,
আনে আজকের সূর্যোদয়।
কবির কলম নয়, রঙধনু দিয়ে
জনপথ লেখে তোমাদের এপিটাফ;
সূর্যরশ্মি দিয়ে
জনপথ লেখে তোমাদের স্মৃতিময় জয়গাথা।
২।১২।৯০
জমিনের বুক চিরে
জমিনের বুক চিরে লাঙলের পৌরুষে কৃষক
শস্য তোলে কায়ক্লেশে; রকমারি রঙিন আনাজে
ঋদ্ধ করে গৃহকোণ। মাঠ ছেড়ে চ’লে আসে সাঁঝে;
কোনো কোনো জ্যোৎস্নারাতে কী ব্যাকুল করে সে পরখ,
শোঁকে ফসলের ডগা। কিছুতেই ভাবে না নরক
নিজের কুটিরটিকে, বিবির পাশেই শোয়, মাঝে
উদোম বাচ্চার ঘুম, সারাদিন হাড়ভাঙা কাজে
কাটে, রাতে স্বপ্ন দ্যাখে পঙ্গপাল নামে বেধড়ক।
কবিও কর্মিষ্ঠ চাষী, রোজ চষে হরফের ক্ষেত
নুয়ে-নুয়ে, কখনো কখনো খুব আতশি খরায়
জলসেচে মগ্ন হয়, বোনে কিছু বীজ অলৌকিক।
মাটি ফুঁড়ে চারা জাগে, তখলিফে আগাছা নিড়ায়
কতদিন, ঘ্রাণ নেয় স্তবকের উপমাসমেত;
কখনো কখনো পোকা শায়েরকে সাজা দেয় ঠিক।
২৭।৪।৯০
জানা নেই
জানি না এরকম কিছু আছে কি নেই
মৌতের আগেই প্রত্যহ সয়ে চলেছি গোরের আজাব
প্রায়শ চোখে অমাবস্যা
মগজে বৃশ্চিক হাঁটে আঁচড়ে কাটে পাগলা কুকুর
কিছু থাক না থাক এপারে ওপারে
ধুক ধুক আছে হামেশা কলিজায়
এদিকেও বাড়ায় হাত বিদ্রোহী রোবট
কম্পিউটার-নির্ভর জীবনে এ কেমন কহর
কে তুলে দেয় জহরভরা পেয়ালা আমার হাতে
দন্ত-নখর বের করা সন্ধেবেলা
আমাকে ঘানিতে পিষছে সর্ষের মতো
সকালে সূর্যোদয়ের ইনাম রাতে খওফের সাজা
বন্দনা-লিপ্সা কাউকেই সাজে না কস্মিনকালে
তবে কেন মেষপালে এমন তোলপাড়
বিগ ব্যাঙের পরে অযুত অযুত বছর কেটেছে
গ্যালাক্সিতে ঘুরছে গ্রহ-উপগ্রহ
একদিন সূর্য অপরাহ্নের উনুন হবে
ফৌত হবে তামাম প্রাণিকুল
শীতার্ত শূন্যতাকে ওম দিতে ব্যর্থ শূন্যতা
ভাবলেই শিরদাঁড়ায় হিমপ্রবাহ
বলবো না মাফ করে দিও শত নাফরমানী আমার
হে রহস্যাবৃত ওগো অনির্বচনীয়
এতকাল করেছি তাজিম ফুল নারী এবং মনীষাকে
নানা রাগ-রাগিনীর প্রলম্বিত জিকিরে
সবই কি নাকাম আখেরে
পাই না নিশ্চিত জবাব দানেশমন্দ কোনো কেতাবে
২৭।৪।৯০