কী ক’রে আমরা
কী ক’রে আমরা হয়েছি দুপুর বেলা
পরস্পরের এরকম মুখোমুখি?
নষ্ট তারার ভস্ম কণার কাছে
ঋণী হ’য়ে আজ তোমার দিকেই ঝুঁকি।
কখনো হয়তো ব্যাপ্তির দূর টানে
সূর্যের মুখ, লাল দৈত্যের মুখ,
কাছের সকল গ্রহকেই গিলে খাবে;
হবে সে বামন ভীষণ শৈত্যভুক।
সুপার নোভার হঠাৎ বিষ্ফোরণ
প্রাচীন স্মৃতিতে কখনো বাঁধেনি বাসা;
ভাবি না কী হবে পৃথিবীর পরিণতি;
মনের কোটরে বাঁচবার প্রত্যাশা।
আমরা দু’জন যেন দু’ট উপগ্রহ,
দিনরাত্তির ঘুরি শুধু ছায়াপথে।
তীব্র আবেগে চেয়ে থাকি অসহায়,
কিছুতেই, হায়, পারি না লগ্ন হ’তে।
দু’চার ঘন্টা কেটে গেলে অবশেষে
ড্রইং রুমের কথোপকথনে ছেদ,
সোফার কাছেই শজারু, শূকর-ছানা;
শিরায় শিরায়া জমে বিদায়ের খেদ।
এভাবে দাঁড়াও যদি দরজার কাছে,
তাহ’লে কী ক’রে বলবো, ‘বিদায় দাও?’
তোমার দু’চোখ, সোনালি শরীর বলে-
‘হে কবি আমাকে মাত্রাবৃত্তে নাও’।
বইছে সময়, বয়েস উর্ধ্বগামী,
তোমার শরীরে জ্যোৎস্না-জোয়ার আজো
রয়েছে অটুট; মনে মনে আওড়াই,
সময়ের মাঝে সময়হীনতা বাজো।
উন্মাদনায় মেতে আছি কিছুকাল;
নিশ্চিত জানি, অচিরে আমার লয়।
পরের পর্বে কোন্ ঘাটে ব’সে তুমি
হবে উজ্জ্বল, গ্রাস করে সেই ভয়।
নভোমণ্ডলে কালো গর্তের ভিড়ে
অস্তিত্বের এতটুকু নেই ঠাঁই।
মহাশূন্যের আলো-তরঙ্গে প্রেম
এক লহমায় জ্বলে পুড়ে হবে ছাই।
জ্যোতিশ্চক্র থামবে ভবিষ্যতে,-
এই জ্ঞানে আছে বিষবৃক্ষের বীজ।
নশ্বরতার আতঙ্কছুট ক্ষণে
হৃদয়ে আসন পেতেছেন মনসিজ।
২।৪।৯০
কী-যে হয়
অনেকগুলো ছোট ছেলেমেয়ে জুল জুল তাকিয়ে আছে
ফলহীন ফলের গাছের দিকে
ইচ্ছে হয় এক লহমায় প্রতিটি ডালে
বসিয়ে দিই রাঙা টস টসে ফল
প্রতিবেশীনী তরুণীর বয়েস উদাস প্রান্তরে
ছুটছে শাহাজাদার ঘোড়ার মতো
জ্যোৎস্না ওর তৃষ্ণাতুর ঠোঁটে নিরপেক্ষ চুমু খায়
চাঁদ ওকে স্বপু দেখায়
দুধরঙ সরোবরকে কাটছে ছুরি
যে ওর যৌবনে অবগাহন ক’রে হবে
মোরগ ফুলের মৃর্তি
তাকেই খুঁজছি অষ্টপ্রহর
অলৌকিক সূর্যমুখীর স্বপ্নে বিভোর এক যুবা
হাতে চিবুক ঠেকিয়ে
বসে আছে ডালিম গাছের তলায়
বার বার তার হৃদয়ের সূর্য হয়ে যাচ্ছে কালো
আর পূথিপত্র থেকে আহরিত চিন্তার ভারে
সে ভীষণ কৃশকায় প্রায় মুমুর্ষু
এক্ষুণি ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অনেকগুলো
সূর্যমুখী ফুটিয়ে দিলে হতাম ঝর্ণাধারা
কী-যে হয় আমার বিকলাঙ্গ হিরোশিরা
আমাকে কেবলই দিচ্ছে ঠেলে
দেয়ালের দিকে আমার উপরে ধাবমান ট্রেন
ঠাসঠাসি শবের মধ্যে নির্কণ্ঠ হাহাকার
জীবন্মৃত আমি সুন্দরতম উদ্যানের কাছে
পৌঁছতে গিয়ে ঢুকে পড়ি শ্বাসরোধকারী অস্ত্রাগারে
যদি বিশ্বের যাবতীয় অস্ত্রাগার
আমার ইচ্ছে দোলায়
হতো ঝকঝকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর
অথবা শস্যভান্ডার
তাহলে আমাকে ঘিরে তারাবাতির ফোয়ারা
প্রেমের কবিতার ষ্ফুরণ শ্যামা পাখির গান
১৯।৪।৯০
কৃষ্ণপক্ষে
ওরা কাকে
শূলে চড়াবে কৃষ্ণপক্ষে? রক্ষে নেই,
রক্ষে নেই তোর, ধেই ধেই নাচছে
মাটি কাঁপিয়ে মুখোশ মুখে রাক্ষসের দল। ছল চাতুরী
ওদের তুই বুঝবি নে। মাথায় হাতুড়ি মারলো
কারা? ওরা, যারা গাছের পাতায়
ফড়িং আর প্রজাপতির ঝাঁকে, নদীর বাঁকে বাঁকে
ধরালো জাহাঁবাজ আগুন আজ।
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর। বক্ষে দ্যাখ তুলেছে ফণা
চক্র-আঁকা সাপ। নড়বি নে, নড়লে তোর
অন্তরসুদ্ধ হয়ে যাবে নীল, খাবে তোকে জলবিছুটি,
অন্তর্ভেদী কাঁকড়া। ওরে, ঝাঁকড়াচুলো ডাকাতগুলো
আসছে ধেয়ে সড়কি হাতে। থামা ওদের
থামা, থাকিস নে মুখ চেয়ে থর থর উঠবে কেঁপে
ঘরদোর, কাঁদবে ছেলেমেয়ে নারীর সন্ত্রম
ভাসবে মান্দাসে।
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর। চক্ষে
অগ্নিদগ্ধ বিভ্রম; নাড়া, হাত-পা নাড়া,
বাজা কাড়া নাকাড়া, দে বল্লমে তুই ধার। আঘাত
আসছে ধেয়ে, খুঁজিস নে গর্ত
এই শর্তহীন যুদ্ধে, লুকোস নে মুখ কারো
বক্ষে, সারা জনম দুধ খেয়েছিস যার, তাকে একটু সুখ দে।
ভাবিস নে গেলো সব চুকে বুকে,
রক্ষে নেই, রক্ষে নেই তোর,
যদি না রুখে দাঁড়াস। দ্যাখ চেয়ে স্বচক্ষে
তোর দোরগোড়ায় তিনটি দাঁড়াশ।
১৯।২।৯০
কোকিল
এমন নিঃশব্দে কে দাঁড়ায় দরজায়
ভোরবেলা স্মিত দশটায়
গজলের মদির আঙ্গিকে? বলপেন
খাতার পাতায় সমর্পিত; বলি, ‘এখুনি এলেন?’
নিরুত্তর; বুঝতে হয় না কষ্ট, খাতা থেকে উঠে
এখানে ব্যাকের পাশে রয়েছে সে স্বতঃষ্ফুর্ত ফুটে।
এই জ্ঞান হৃদয়ে ঝরায় অশ্রুকণা, এরকম
পুনর্জন্ম ক্ষণিকের, তুব কল্পনার সেবাশ্রম
আঁকড়ে থাকতে চাই। তার এই আসা-যাওয়া থাকবে অটুট,
যতদিন মুঠোয় আমার লগ্ন চাদরের খুঁটি
হায়াতের; ধু ধু ফাঁকা পথ,
গাছের নোয়ানো ডালে দোয়েল, নৈরাশ্য যযুগপৎ।
মনোনীতা অস্তরালে, ডেকেই চলেছি এতকাল,
ডেকে-ডেকে আমার দু’চোখে আজ শিমুলের লাল।
১১।৪।৯০
খণ্ডিত গৌরব
মেঘের কাঁথায় মুখ লুকায় দুঃখী চাঁদ,
মধ্যরাতের নির্বাক রাস্তায়
অভাজনের কাতর প্রার্থনা;
ভাঙা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে
রুটির টুকরোর মতো সৃষ্টিকণা
ভিক্ষা চাইছি নিয়ত।
সঙ্গীতচিহ্নিত জ্বলজ্বলে আকাশ থেকে
হঠাৎ কে আমাকে ছুঁড়ে দিলো
স্তব্ধ ধূসরতায়?
ঝর্ণা আমার আঙুলে,
এই বিশ্বাসের শেকড় ছিলো মজবুত,
অথচ সম্প্রতি তুষারিত সেই প্রস্রবণ।
আমার হাতে একলব্যের রিক্ততার হাহাকার;
কে আমাকে বলে দেবে
কোন দ্রোণাচার্যের পায়ের তলায়
লুটোচ্ছে আমার খণ্ডিত গৌরব?
১৮।৯।৯০