কবিতাকে কেউ
কবিতাকে কেউ ভাবে জুঁই বেলী গোলাপ
কিংবা সেরকম কোনো ফুল
ডালে সাজানো
কবিতা কারো চিন্তায় আপেল আলুবোখারা
নাশপাতি কামরাঙা সুগন্ধি আম
কিংবা এ ধরনের কোনো ফল
সাফ সাফ বলেই ফেলি
এমন ভাবনা আমাকে পারে না বানাতে বশম্বদ
কবিতাকে কেউ দোয়েল বুলবুল কোকিল
ইত্যাদি ভেবে সুখী হয়
কেউ কেউ ধরে নেয় কবিতা
রূপালি মাছ ছাড়া কিছু নয়
আহা শোনোই না
এমন কোনো ধারণার মোসাহেব আমাকে ভেবো না
কেউ কবিতাকে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে-থাকা রূপসীর আদলে
ভাবতে পারলেই খুশীতে ডগমগ
জ্বি হ্যাঁ একথা সত্যি
এমন ভাবনা আমার মাথায় উপর ছড়ি ঘোরাতে অক্ষম
কবিতাকে কেউ রসকদম কাঁচাগোল্লা
কেউ জিলিপি অথবা বাতাসা মনে করে
কেউ কেউ মুর্গীর রোষ্ট নুডলস শুটকির ভর্তা ভাবে
কেউ কেউ ঠাউরে নেয় কৌটোর সার্ডিন
কবুল করি এরকম কোনো কিছু
বিলকুল না- পছন্দ আমার
কবিতায় গল্প বলার ধরন অথবা
উপমা চিত্রকল্পের চর্বিতচর্বণ নারকেলের ছিবড়ের মতো
বিষয় স্যাঁতসেঁতে আধ্যাত্মিকতা ন্যাকা ছলাকলা
ভড়কে-দেওয়া আঙ্গিকের বুজরুকি কঙ্কে পায় না আমার কাছে
কবিতা আমার হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে চাঁদি ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসা লাভাপ্রতিম কিছু
বলা যেতে পারে উত্তরবঙ্গের গোরুর গাড়ির চাকা
যার গায়ে বহু দূরত্ব ধুলো কাদা গাড়িয়াল ভাইয়ের ঘামের দাগ
বলেতো ফেললাম পষ্টাপষ্টি
কিন্তু মাছের কাঁটায় মতো কী একটা বিঁধছে মনে
আসলে কবিতা লোহার খাঁচায় আটকানো এক জলকন্যা
সমুদ্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য লেজ আছড়াচ্ছে লাগাতার
২৫।৪।৯০
করোনি কসুর
করোনি কসুর দিতে রক্তাক্ত গঞ্জনা খামোকাই
নিত্যদিন; এ শহরে বসবাস হয়েছে কঠিন
আজকাল, গায়ে এসে পড়ে কত বেহুদা কমিন
ক্রমাগত; যেদিকেই যাই ইট পাটকেল খাই
অহর্নিশ, তুমিও বলোনি ছেড়ে কথা বেরহম।
তোমার রসনা থেকে বয়ে যায় শহদের ধারা,
এরকম ধারণার রঙধনু ছিলো চমৎকারা;
ভাবতে অবাক লাগে, এতটুকু পাওনি শরম।
সম্প্রতি কী এক আলো সিনায় বেড়ায় নেচে, ফলে
লানতের ভাষা আর অঙ্গারের মতো ধ্বক ধ্বক
করে না আমার ঠোঁটে। খ্যাপা, পোড়া আত্মা ধুয়ে জলে
ধারণ করেছি মুদ্রা ক্ষমার; কুঠার আহাম্মক,
এরকম আচরণে তূণ শূন্য ক’রে দুলদুল
বানালে আমাকে, তবু শ্রীচরণে রেখে যাই ফুল।
২৭।৪।৯০
কাঁটার মুকুট
অসুস্থ, অসুখী একজন বহুকাল
বিষাদের বুকে বুক চেপে স্তব্ধতার কানে কানে
ফিস্ফিসে স্বরে কথা বলে। বাচাল সে
নয় কোনোকালে; আঁধারকে জব্দ করবার সাধ
অন্তরীণ আর দুর্ভাবনার মক্ষিকা
তাড়াতে নারাজ। মাঝে-মাঝে মুঠো থেকে
ছেড়ে দ্যায় একটি কি দু’টি পাখি আর
রঙধনু মেখে নেয় বয়েসী শরীরে।
মাথার ভেতর তার ধোঁয়াটে আকাশ,
পাগলাটে চাঁদ, বুকে সপ্তর্ষিমণ্ডল চেতনায়
পূর্বপুরুষের স্বপ্ন, কলরব, অপরাধ,
আহ্লাদ, বিমর্ষ নৈঃশব্দ্যের গাঢ় শৈলী।
সে জানে গোখরো তাকে ছোবল দেবেই,
তবু ওরা বিষধর সর্পকেই গলায় জড়িয়ে
নিতে বলে; মাথা তার শোণিতের ছোপে
রঙিন স্থাপত্য যেন, তবু কাঁটার মুকুট পরানোর খেলা।
১৩।১২।৯০
কাঁহাতক
দু’টুকরো, তিন টুকরো, চার টুকরো পাঁচ টুকরো
বহু টুকরো দিনভর রাতভর। এভাবেই কৈ মাছের নাচ
নেচে, নিজের রক্ত নিজে ছেঁচে বেশ কিছু গড়বড়
ক’রে বেঁচে আছে। ওর কাছে
কীসের যে কী দাম;
বিষের নাকি লোকশ্রুত অমৃতের, বোঝা দায়। কাম ওকে প্রায়শই
গনগনে লোহা বানায়; অথচ
তেমন সরোবর কই, যেখানে মনোমুগ্ধকর শীতলতা?
আসলে ওসব বাজে কথা, আকাট মূর্খের
বুজরুকি। জানে না, কোন্ কাজে কোন্ ঝুঁকি, শরীর
টরীর সব নয়। অন্য কিছু অবশ্যই আছে। গাছে
বাকল থাকে, ফল মূলও লভ্য। ডালই একমাত্র, বাকি
সব ফক্কিকার, এমন ভাবার সুযোগ নেই সভ্য
মানুষের। শীঘ্র চ’লে যাবে ভেবে দীর্ঘ জীবনের আকাংক্ষা
দোলায় মাথা, ভোলায় নশ্বরতা। ‘যা’ কিছু
পেলাম সীমিত এ জীবনে তাকেই সেলাম’
বলে সে প্রীত, মাটির ঢেলা ছুঁড়ে দেয় দূরে সূর্য ডুবুডুবু
বেলায়। বয়স ফুরোচ্ছে, কালের বায়স কর্কশ সুরে
দেয় জানান। তাতে কী? দুধে-ভাতে নাই বা গেলো
থাকা। একেবারে ভূখা নয়, রুখা সুখা খাচ্ছে দু’বেলা।
এরও বেশি কিছু চাই ওর। কীসের জন্যে হাহাকার সত্তা জুড়ে?
আগুন রঙের অশ্বক্ষুরে উঠুক বেজে
জমিন; খাল শুকোলে কী করে থাকবে মীন? নতুন কাল
ডেকে আনার ইন্দ্রজাল কোথায়? কোনো মন্ত্র কেউ কি
জানে না? যন্ত্রণা, সাপ-কামড়ানো যন্ত্রণা আপাদমস্তক।
চামড়া ফুঁড়ে গল গল বেরোয় বিষ। কাঁহাতক আর সইবে সে?
২০।২।৯০
কিছু না কিছু নিয়ে
কিছু না কিছু নিয়ে ভাবনা থেকেই যায় শেষ তক
করুরি কাজে যখন নিমজ্জিত
মনে হয় কিছু ভাবার নেই অথচ
তখনও মগজে চিন্তা-ভ্রমরের গুঞ্জরণ
কখন ভোকাট্রা চাকরির প্রবঞ্চক ঘুড়ি
ভিসা অফিসে লাইনে দাঁড়ানোর ঝুট ঝামেলা
প্রবাসে কন্যার সুবিধা-অসুবিধার জটাজাল
কনিষ্ঠার বিয়ের ফুল ফুটেও ফুটছে না
বাইয়োস্ফিয়ারে আমরা পরস্পর জড়ানো
পরিবেশের উপর লাগাতার বলাৎকার কি সমীচীন
সূর্যের আয়ু ফুরিয়ে যাবে কোন সুদূরে
কবে শিঙ-ভাস্কর্যকে দোলাবে গণতন্ত্রের সোনার হরিণ
পথ চলতে রেস্তোরাঁয় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বন্ধুর সৌহার্দ্যের ঘ্রাণ নেওয়ার সময়
বই পড়ার ফাঁকে ঘামেভেজা ব্রা শোঁকাকালীন
কিছু না কিছু ভেবেই চলি
আকাঙক্ষার ছায়ায় তার মুখোমুখি ব’সে থাকার লগ্নে
ঘুমাতে যাবার আগে জেগে ওঠার পরে
জনৈক বিদেশী যুবক আত্মহত্যার প্রাক্ মুহুর্তে কী-যেন লিখেছিলো
খাতার শেষ পাতায় দীর্ঘশ্বাসের হরফে
ভাঙাচোরা পূর্ব ইউরোপকে কি সারানো যাবে রাংঝালে
কবিতার স্বায়ত্তশাসন কি প্রতিষ্ঠিত মুল্যবোধের পোড়াবাড়িতে
পরাবাস্তবতার মৃত্যুঘন্টা কি বাজলো
বনকপোতের ডাক কবে শুনবো আবার
স্বৈরতন্ত্রের কটমটে পাহারা আর কতকাল
ক’জন পুতুল মন্ত্রী নিলেন শপথ দবিজ কার্পের দাঁড়িয়ে
যে ডোরাকাটা শার্দুলের সওয়ার গর্বাচভ
সেই কি খাবে তাঁকে আখেরে
বুদ্বুদের উপর দাঁড়িয়ে সটান
পায়রা ওড়ানো কতটা সম্ভবপর
নিঃসঙ্গতার বুদোয়ারে ছায়াবৃতা গ্রেটা গার্বোর প্রয়াণ
রবীন্দ্রনাথ মূঢ় ময়রাদের হস্তাবলেপে নিদারুণ চটচটে
সুরম্য দালান থেকে বেরিয়ে আসে ভেড়ার পাল
কালো চুলের জালে আটকে-পড়া মাথা
কয়েকটি ভুতুড়ে তারা হাসে নিপস্টিক-হাসি
চুমু খেতে না পারার বাস্তুহারা ডুকরানো
ভাবছি গরহাজির-তুমি কেন ঘুমোতে দাও না আমাকে
শেকড়হীন চাঁদের পায়ে মিলিটারি বুট
হিস্পানি ঘাগরায় দ্রাক্ষাবনের স্বপ্ন
জ্যোৎস্নার নাগরদোলায় তুমি
যেদিন মৃত্যু হবে আমার তুমি কি আসবে ছুটে
প্রসাধন উপেক্ষা ক’রে
মাঝিবিহীন ফাঁকা নৌকা চলেছে ঢেউ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
এরপরও থাকে কিছু না কিছু ভাবার
২২।৪।৯০