আড়িপাতা নয়
আড়ি পাতা স্বভাব নয়
তবু শুনে ফেলি ফিসফিসে কিছু কথা
পাখি গাছকে বললো
সংটাকুল বিশ্বে অসংখ্য উদ্বাস্তুর কালে
সবুজ টোপরপরা বর তুমিই
আমার নিখরচার ঘর
চেয়ার টেবিলকে বললো
দিন নেই রাত নেই আমরা সকল সময়
মুখোমুখি অদৃশ্য স্পন্দিত হৃদয়ে
চুড়ান্ত চুম্বনের জন্য অপেক্ষমাণ
তোশক খাটকে বললো
তোমার আমার যুগ্মতা সমাজে
ন্যায্যত শয্যা ব’লে খ্যাত
অথচ আমাদের মিলন চিরন্তন ফুলশয্যা
বই শেলফকে বললো
তাক-লাগানো তোমার ঔদার্য
কর্কশ বিবাপুর্ণ খন্ড প্রলয়ময় দুনিয়ায়
বৈপরীত্যের চমৎকার সহাবস্থান তোমার তাকগুলো
কলম খাতাকে বললো
রোদপোড়া বৃষ্টিভেজা পরিশ্রমী চাষীর মতো
তোমাকে চাষ করি নিয়ত
আমাদের তন্নিষ্ঠ সঙ্গমে ফসলের কী বাহার
প্রজাপতি সর্ষে ক্ষেতকে বললো
ঢেউ বললো নৌকাকে
ফুটপাত দোকানকে বললো চুপিসাড়ে
নক্ষত্র বললো আকাশকে
আড়বাঁশি ঠোঁটকে ঠোঁট বয়ে-যাওয়া সুরকে
গ্রীষ্মের গেলাস টলমলে আবেহায়াতকে
মৌমাছি শূন্য পাতাকে বললো
শূন্যতা বললো শব্দহীনতায় চিরন্তন শূন্যতাকে
২২।৪।৯০
এ কাকে দেখতে গিয়ে
লি্ফট বড় দেরি করে, কতক্ষণ এখানে এভাবে
এক ঠায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা যায়? বার বার ঘড়ি পড়ি,
ছটফট করি, পাঁচতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবো? সহজ তো নয় আর,
এদিকে সময় বড় কম। দীর্ঘ করিডোর
স্তব্ধতায় কেমন ঝিমিয়ে-পড়া, প্রায়
দৌড়ে যাই কেবিনের দিকে, দরজায় মৃদু টোকা।
এ কাকে দেখতে গিয়ে দেখে ফেলি কাকে? ঠান্ডা রোদে
ছিলেন চেয়ারে ব’সে বারান্দায়, খাড়া শিরদাঁড়া
গায়ে ডোরাকাটা
শোবার পোশাক; মনে হলো,
নাৎসী বন্দী শিবিরের অতিশয় বিশীর্ণ বাসিন্দা, অত্যাচারী
পাহারাদারের পশুকেও লজ্জা-দেওয়া নির্যাতনে
ক্লিষ্ট, জব্দ, অথচ নালিশ
নেই কোনো, স’য়ে যাওয়া, শুধু স’য়ে যাওয়া
মুখ বুঁজে প্রতিক্ষণ, এমনকি কাতরানি নেই
এতটুক; বুক তার ধুক-পুক করছে কি? কোথায় উধাও ছন্দোজ্ঞান।
ইনিই কি একদা ফাইল থেকে চোখ তুলে দেখতেন কিছু
নৃত্যপরায়ণ পাখি, ঝুঁকে-পড়া কোনো রক্তজবা,
মাঝে-মধ্যে জিপসি মেঘের শোভা, কৌতুকমিশ্রিত
ভঙ্গিময় জনস্রোত, যান প্রবাহ কখনো? হেঁটে
যেতে যেতে ছায়াচ্ছন্ন পথে ভাবতেন কতকিছু। কোনো কোনো
মুখ, টুকরো কথা কিংবা কারো
হাসির ফোয়ারা, টেলিফোনে বলা গীতবিতানের
কোনো পংক্তি; ওষুধের গন্ধে ইদানীং
কোথায় মিলিয়ে গেছে মৃগনাভি শব্দের সৌরভ।
অসহায়, অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ্য কুপিয়ে
কুপিয়ে মারছে তাকে ক্রামগত। ঝুঁকে, ধুঁকে ধুঁকে
জীবনের করুণা কুড়ানো
একমাত্র কাজ তার আজ। বরাবর সৌন্দর্য আরাধ্য তার,
অথচ এখন নির্বাসিত সুন্দরের
মায়াকাননের কুঞ্জ থেকে। অনেক অষ্ফুট কথা
শুনে যাই-বাল্যকাল, যৌবন, বার্ধক্য ভাসমান।
যার সঙ্গে এতকাল অন্তরঙ্গ পরিচয়, তাঁকে
একটি অদ্ভুত ছায়া ভেবে ব’সে থাকি ব্যথিত, স্তম্ভিত। দুপুরেই
সন্ধ্যা নামছে কি? বাড়ি ফেরার সময়
হয়ে এলো বুঝি, যাই? যেতে যেতে শুধু
মনে পড়ে, ছায়াময় ঘরে
শুষ্ক মাঠে ঈষৎ গজিয়ে-ওঠা শাদা
শিশু ধান চারার মতন চুল মাথা জোড়া, মাথার তিনটি
ফুটো দ্রুত ভরাট হবার পথে, কম্পমান ঠোঁট।
১৬।১।৯০
ওরা চায়
কত কিছু চায়, ওদের চাওয়ার অন্ত নেই।
ওরা চায় তুমি ধুলায় গড়াও রাত্রিদিন,
নিজেকে পোড়াও, থুতু চেটে খাও, এখুনি মরো;
ওরা চায় তুমি চেকের বদলে আত্মা বেচো।
ওরা চায় তুমি হাত কচলাও, ভিক্ষা করো;
ওরা চায় তুমি নিমেষে হারাও সকল খেই,
দু’হাতে কেবল ভায়ের বোনের রক্ত সেচো,
দুঃখের জমি বাড়তেই থাক সীমানাহীন।
ওরা চায় তুমি নতজানু হও সর্বদাই,
ওরা চায় আজ তোমার কলমে ধরুক ঘুণ,
তোমার এমন প্রেমিক- হৃদয় ছিন্ন হোক,
শকুন-শোভিত ভাগাড় তোমার হোক ঠিকানা।
ওরা চায় তুমি এক লহমায় হারাও চোখ,
তোমার ডেরায় দিন দুপুরেই চলুক হানা,
কারো ইঙ্গিতে ঘাতক তোমাকে করুক খুন,
তোমার করোটি শেয়াল পাড়ায় পাক গে ঠাই।
এত দূর এসে সত্যি বলোতো কী চাও তুমি?
যায় যাক সব, তবুও কখনো হবো না নত।
কোদালকে আজো বলবো কোদাল, অকম্পিত;
দেখাবোই শাদা আলখাল্লার নোংরাগুলো।
আমার কবিতা প্রজাপতি হয়ে উড়বে প্রীত
কারো গাল ছুঁয়ে, জখমি মনের সারাবে ক্ষত;
আমার কবিতা এইতো দেখছি নীলিমা ছুঁলো,
হোক সে সকল দুঃখীর প্রিয় মাতৃভূমি।
১৯।১।৯০
কবি এবং ঘোড়া
অজানা তোড়ে, কিসের ঘোরে মেঝেতে টগবগানো ঘোড়া, কেশর
কালো মেঘ, ফাঁপানো, শ্যাম্পু- করা চুল, খুরের ধাক্কায়
কফিন স’রে যায় এক কোণে, বুনো নিঃশ্বাস।
হকচকানো কবি চেয়ার-ছাড়া, পাণ্ডুলিপির বিকিরণ।
কী ক’রে ঘোড়টা ঘরে? কে পাঠালো? কবির চোখে
তখনও স্বপ্নের আঠালো রেশ। অন্যমনস্কতায়
ওষুধের শিশি কাটা মুণ্ডুর মতো
গড়ায়; হস্তধৃত পাণ্ডুলিপি থেকে সদ্য কবিতার উকিঝুঁকি।
কবিতা কৌতূহলী শিশু, এরকম তাকায় ঘোড়ার
দিকে; কফিনের উদ্দেশে
অশ্ব-দৃষ্টি, ঝুঁকে থাকা। কবির বুকে তোলপাড়। এ কেমন
কাণ্ড কারখানা? কফিন কে এনেছে এখানে? কেন?
খেলনা তো নয়, জীবনের উষ্ণতা টান টান চকচকে
চামড়ায়। কী খাদ্য দেবো তাকে, দণ্ডায়মান
কবিকে নিজেরই প্রশ্ন। ভাঁড়ারে
অনেক কিছুর মতোই ছোলা নেই, খড় বিচালি অবান্তর।
‘তোকে খাবো’ ঘোড়া বলে। কবি ভড়কানো,
পেছনে হটে, দেয়ালে পিঠ। চির্হি হাসি, জ্যোৎস্নার
জোয়ার ঘরে অকস্মাৎ; চক্রাকার নাচ, ভীত
কবির পায়ের নিচে এখন মাটি; ঘোড়ার কফিন ভক্ষণ।
কোথাকার ঘোড়া তুই? এ কেমন রুচি তোর, কফিন চিবিয়ে
খাচ্ছিস? চিৎপটাং চাঁদটাকে করবি কি
সাবাড় শেষ অব্দি? স্তম্ভিত, প্রশ্নাতুর কবিকে
কিছু না ব’লে পাণ্ডুলিপির ভেতর ঘোড়ার প্রবেশ।
১৭।২।৯০