স্বপ্নচারিতায়
খুব ফিকে গাঁদা রঙের বিকেল। চোখ চোলা,
মন ডুবুরীর আঁটো পোশাক পরেছে
নিরিবিলি; আমাকে কি মানায় এখন জেগে
স্বপ্ন দেখা? দেখি অকস্মাৎ ঘরে এসে, হে নবীনা,
তুমি একগুচ্ছ ফুল তুলে দিতে হাতে
ঋজু স্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ ছিলে বসে
দূরে টুকরো টাকরা কথা, আমার গতায়ু
যৌবনের শুশ্রুষায় নিজেকে নিয়োগ
করেছিলে বুঝি, নয়তো কী ক’রে আবার
আমার ভেতর যুবা বয়সের দিনগুলি
আড়মোড়া ভাঙে? কখন যে বাড়াই তোমার দিকে হাত,
শুধু রিক্ত পাঁচটি আঙুল স্পর্শ করে শূন্যতাকে।
তুমি চ’লে যাবার পরেও বসে থাকো
সম্মুখ চেয়ারে
আমার মুখস্থ-করা সেই ভঙ্গিমায়। হেঁটে যাই
তোমার ভেতর দিয়ে স্বপ্নচারিতায়
কোনো এক বেনামি নগরে। কেউ দেখে না, শোনে না
কিছু, শুধু নিজে জানি, তুমিহীনতায়
তুমি থাকো পবিত্র সৌরভ হয়ে এবং তোমার করতলে
লোর্কার কমলালেবু, ঠোঁটে নেরুদার প্রজাপতি।
আমার পাঁজর ফুঁড়ে রক্তের ফোয়ারা টেবিলের
গোলাপকে আরো বেশি লাল ক’রে তোলে আর দেয়ালের সাদা
থেকে পেরেকের ক্ষতচিহ্নসহ
নিঃশব্দে ওঠেন জেগে যীশু,
তর্জনী উচিয়ে
আমাকে দেখিয়ে দেন ক্রূশকাঠ, উচ্চারিত হয়
‘বও, বয়ে যাও তুমি বিরামবিহীন। গলগোথা
গন্ধে ভরে যায় ঘর, লাল জোব্বা, হায়,
প’ড়ে আছে পুরোনো মেঝেতে, বুড়ো সুড়ো
কারো খুব কুষ্ণিত ললাটরেখা, কে এক নারীর
দু’গালে গড়িয়ে পড়ে কী করুণ পানি; কারা যেন
জুয়ো খেলে চ’লে গেছে, দিব্যকান্তি গাঁথা ক্রূশকাঠে।
কখনো তোমাকে শুনি, শোনাই তোমাকে
কখনো-বা, তোমার মধুর কণ্ঠস্বরে মুছে যায়
আমার অতীত আর তোমার নীরব ফুলগুলি
কী বাঙ্ময় ঝুঁকে থাকে আমার উদ্দেশে। তোমারও কি
এমন ধরন? কিছুকাল
পরে কথাচ্ছলে প্রশ্ন করি, ‘সেদিন বিকেলবেলা
এসেছিলে নাকি? স্মিত ঠোঁটে
বললে তুমি, ‘কই, না তো। কে খবর দিলো মিছেমিছি?’
বেজে ওঠে যেন স্যাল্ডেলিয়ার কোথাও
এবং তোমাকে ঘিরে থাকে গীতবিতানের বিভিন্ন মুর্চ্ছনা।
১৪।২।৯০
স্বপ্নজীবী
নিদ্রার জরায় ছিঁড়ে বেরোয় স্বপ্ন
কানকো উন্টিয়ে মাছ পরখ করার মতো
স্বপ্নের বিশ্লেষণে মনোযোগী হই
অস্পষ্টস্মৃত ভগ্মংগুলো পিছলে যায় মাছেরই ধরনে
তারা- ঝোপের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে বেড়াল
রাত্রি আর বেড়ালের এমন ফষ্টিনষ্টি কখনো দেখিনি
অবশ্য স্বপ্নজীবী
জাগরণের পরেও মাথা ফাঁকা দেখলে
সিঁধেল চোর স্বপ্ন আবার ঢুকে পড়ে হঠাৎ
চোখের পশ্চাদ্দেশে হাত বুলোয় নাক ঘষে
তখন বিশ্ব এবং আমার পরিচয়ের উপর
যবনিকা পতন
বালিশ চুমো খায় মাথাকে
মাথা হাওয়াকে আর হাওয়া আমার চুল
চোখ কান নাক পাঁজর নখ
বুকের রোমরাজি আর নিদ্রাতুর শিশ্নকে
শিশ্ন স্বপ্নের ছ্যাঁদায় সুড়সুড়ি দেয়
এবং স্বপ্ন এখন রজস্বলা
২১।৪।৯০
স্বাতন্ত্র্য
আমি কি স্বতন্ত্র্য কেউ? নাকি আগাগোড়া একই ছাঁচে
গড়াপেটা? আ দশজনের প্রতিভু? নিয়ন্ত্রিত
নড়া চড়া, দমদেওয়া বিবর্ণ পুতুল? বুলবুল
ভুলক্রমে জানালার গ্রিলে এস বুকের রেশম
মেলে দিলে আমার নিজের বুক বেশি ধুক ধুক
করবে না? অগোচরে থেকে যাবে সংবাদপত্রের
অন্তরালে জলকন্যা? কবিতা আমাকে অবহেলা
ছুঁড়ে দিয়ে নিছক কর্পূর, তুব উঠবো না কেঁপে?
অকাম্য এমন পরিণাম; ঠিক ঠাক দাগ মেপে
ওষুধ খাওয়ার মতো জীবন যাপন খাক হোক
চুল্লীতে, আমার চাই খাদের কিনারে ঝুলে-থাকা
অত্যন্ত বিপজ্জানকভাবে কিংবা দ্রোহী সমুদ্রের
মধ্যখানে,বড় একা, ক্ষুধার করাতে ফালা ফালা,
মৃত্যুর চোয়ালে ব’সে ঝটকায় পাখি টেনে আনা।
১৩।৪।৯০
হতাশার ঘরে
ধুর্তামি, ভণ্ডামি আজ প্রবল বিগ্রহ। অবেলায়
কাদায় ডুবেছে চাকা। একে একে অনেকে স্খলিত,
দিশেহারা; অবশেষে তুমিও কি হবে নিমজ্জিত,
হায়, চোরাবালিতেই? খুঁজবে আশ্রয় সাহারায়?
এখন অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসের বিপুল কিনারায়
ছুটছে লেমিং গুলো; সুচতুর শিকারী হারপুন
দিচ্ছে গেঁথে মুক্তিকামী ভেসে-ওঠা পিঠে কী নিপুণ;
ডোবে দেশ ক্রমশ কৃত্রিম আধ্যাত্মিক ধোঁয়াশায়।
কফিন কবর ডাকে প্রতিদিন কোকিলের স্বরে,
অথচ এগুতে হবে ঝেড়ে ফেলে সব পিছুটান।
খ্যাতির বাইজী খুব লাস্যময়ী ঢঙে টানে আর
মূর্খের বন্দনা ফিঙে হ’য়ে নাচে, মস্তির দোকান
হৈহুল্লোড়ে ভরপুর। দুর্বিষহ হতাশার ঘরে
ঠাঁই পাই; গোলক ধাধাঁয় চোখে দেখি অন্ধকার।
২২।৩।৯০
হরিণী-কবিতা
সুন্দরবনের রোদ-চকচকে হিরণ পয়েন্টে যে হরিণী
জলপানে মগ্ন সেই কবে, পুনরায়
যেন সে বিদ্যচ্চমক কবিতার রাজধানীতে সকালবেলা;
এ-ও এক খেলা তার শহরকে জড়িয়ে শরীরে।
অনির্বচনীয় রূপ নিয়ে একগা হরিণী যায়
কবি সম্মেলনে হেঁটে যায় সাবলীল, মহিমার
ছটা তার সত্তা থেকে বিচ্ছুরিত; হঠাৎ উধাও।
এদিক ওদিক খুঁজি, বুক চিরে ট্রেন দূরগামী, চতুর্দিকে
সুচতুর শিকারীর ফাঁদ পাতে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল
রেখে ঘোরে ইতস্ততঃ। হরিণীর কোথায় তেমন বর্ম যাতে
সহজে পিছলে যাবে ঝাঁক গুলী?
ওদের সকল তাক যাক ফস্কে যাক।
অকস্মাৎ হরিণীকে দেখি উত্তাপ উপেক্ষা ক’রে
চলেছে ব্যানার ছুঁয়ে কবির মিছিলে, গায়ে তার
বাংলার মখমলী গাঢ় সবুজিমা, এমন সুন্দর টিপ
কোথায় সে পেলো? কাঁচপোকা
ব’সে আছে মসৃণ কপালে?
গলায় নিবিড় লগ্ন নক্ষত্রের মালা,
দু’চোখে বিলীয়মান স্বপ্নের অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস,
যেন সে লাফিয়ে ওঠা শিখা, প্রতিবাদে
স্পন্দিত সৌন্দর্য ক্ষণে ক্ষণে,
চম্কে তাকায় রৌদ্রে স্নাতা। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখি
তাকে, দেখে সে-ও, পরস্পর চোখাচোখি, বুঝি এক
মধুর মালিন্যহীন গোপন দাঁতাত।
জানি আজ প্রকৃতির অভিষেক হবে তার হাতে
আবার নতুন ক’রে। চলায় ছিলো না দ্বিধা, পথে
পুলিশের ভ্যান,
তবু দৃক্পাতহীন চলেছি সম্মুখে, তার গায়ে
আঁচড় লাগলে কোনো আমার হৃদয়
বিষম আহত হবে, অশ্রু হ’য়ে ঝরবে শোণিত
সারাক্ষণ, চাই না কখনো তার সৌন্দর্য ভুলেও
অন্ধকার মর্গে যাক। সে থাকুক বেঁচে রোদবৃষ্টি বুকে নিয়ে
দীর্ঘজীবী কবিতার মতো সজীব, নিটোল। নিত্যদিন
আমার জীবদ্দশায় হোক সে অধিক বন্দনীয়।
হরিণী অক্ষরবৃত্তে এগোয় মঞ্চের দিকে, মাইক্রোফোনের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ে। শব্দাবলী থেকে
যন্ত্রনা গিয়েছে ঝ’রে, পথকষ্ট মুছে গেছে, লুপ্ত স্বেদমুক্তো;
কবিতা পাঠের কালে নিজেই কবিতা হ’য়ে জ্বলে
সুবিশাল সমাবেশে পিন-পড়া স্তব্ধতায়। হ্রদের পানির
মতো স্বচ্ছ বাক্য রাত্তিরে লতিয়ে ওঠে, আখেরে চকিতে
কখন যে নেমে আসে, চ’লে যায়, ‘হরিণী-কবিতা’
ব’লে আর্তনাদ করি, তাকায় না ফিরে। আমি কুকুরের মতো
কী ব্যাকুল চুমো খাই চিহ্নহীন পদাচিহ্নে তার। একা-একা
যতি, ছেদ, পর্বসহ তাকেই মুখস্থ করা নিয়তি আমার।
কে ডাকে আমাকে মধ্যরাতে? কে এক অকালমৃত কবি
লেখার টেবিল থেকে ওঠে এস যেন
শয্যা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে ডেকে নেন কাছে।
মুখ তাঁর, মনে পড়ে, ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্থটির
অন্তর্গত; ব্যথিত ফ্যাকাশে। স্থির হও, বসো তুমি
এখানে চেয়ারে, লেখো একটি সনেট
নিষাদে, নির্বেদে ভরপুর। যাকে চাও
সে হরিণী নাকি অমল কবিতা, সে তোমার
কোনোদিন হবে কিনা ভেবে কষ্টে বিবর্ণ হয়ো না।
আমার মতোই, হাতে তুলে নাও এখুনি কলম;
থাকবো না বেশিক্ষণ, ঢুকবো কফিনে পুনরায়,
‘বিদায়, বিদায়’ ব’লে তিনি ঘন কুয়াশায় ট’লে ট’লে
মিশে যান। নির্ঘুম, স্তম্ভিত ব’সে থাকি
কিছুক্ষণ বড় একা। কবিতা-হরিণী ধরা দিয়ে চ’লে যায়।
১৭।২।৯০