শাশ্বতীর আঁচল
শাশ্বতীর আঁচল মুঠোয় আনার ব্যাকুলতা নিজিনস্কি-নাচ
আকাশ কালপুরুষ আর মাটি
গাছপালা নদীনালা পালতোলা নৌকা
আলোজ্বলা ফ্ল্যাট ক্ষয় রোগীর পাঁজরবৎ
পুরানো বাড়ি শ্যামা পাখি বিখ্যাত গ্রন্থমালা কবিতা
এবং কয়েকটি প্রিয় মুখ আমার নিজস্ব জগৎ
আমার হাত আর শাশ্বতীর আঁচলের মাঝে
আছে-কি নেই সেতু কম্পমান ঝালর
আকাশ বলে এমন একদিন আসবে
আমি তোমার থাকবো না
তলোয়ার-উঁচানো কালপুরুষ বলে মুছে যাবো
তোমার দৃষ্টি থেকে
গাছ-গাছালি নদীর ঢেউ নৌকার দোলা
পুরানো বাড়ির খিলান শ্যামা পাখির গান
গ্রন্থরাজি আর কবিতার কোরাস
রঙিন বুদ্বুদের উপর দাঁড়িয়ে
আমার কানে ঢালে প্রত্যাখ্যানের
উচ্ছের রসের মতো সুর
এমন দিন আসবে যেসব মুখ
এক মুহুর্ত না দেখলে
আমার বুক ভ্রুকম্পন
এমন দিন আসবে সেদিন আমার চিরন্তন অন্ধতা
এবং তাদের উপস্থিতির মধ্যে
অস্তহীন বিচ্ছেদ
মাটির মাতৃত্বময় মেঘমেদুর উচ্চারণ
আমার গভীর তোমার নাড়ি
তোমার জন্য আমার বুক প্রতীক্ষার ঘর
অথচ শাশ্বতীর ছলনার শাড়ির দিকে
পৌষ সংক্রান্তির দিনে কাটা ঘুড়ি ধরতে যাওয়া বালকের হাতের
মতো বাড়ানো আমার ব্যাকুলতা
২১।৪।৯০
শ্বাস-প্রশ্বাস
কোথাও একটা কিছু গলদ রয়েছে সুনিশ্চিত,
নইলে কেন এত ছটফটানি এবং কাতরানি আশেপাশে?
না, না, কারারুদ্ধ নই; এ শহরে যখন যেখানে খুশি
হেঁটে যেতে পারি, ইচ্ছে হ’লে
প্রত্যহ সকালবেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যায়
যথারীতি, সন্ধ্যেবেলা স্ন্যাকবারে, রাত্তিরে কোথাও
রেস্তোরায়ঁ ব’সে থাকা অসম্ভব নয়। মাঝে-মাঝে
ফুলের সুঘ্রাণ পেলে ভালো লাগে আর
টেলিফোনে মানোমুগ্ধকর
কথোপকথনে বেলা ব’য়ে গেলে খুশি।
অথচ কেন যে প্রায়শই অস্বস্তির কাঁটাগুলি
বেড়ালের নখরের মতো
ক্রমাগত ভীষণ আঁচড় কাটে অস্তিত্বে আমার। সন্ত্রাসের
কী ব্যাপক বিদঘুটে থাবার তলায়
দিন যায়, রাত কাটে। হায়েনারা মানচিত্র নিয়ে
স্বেচ্ছাচারী, নেকড়ের পালের কামড়ে
ফালা ফালা স্বপ্নের পতাকা। কখন যে
নিজেই নিজের বমি হাভাতের মতো গিলি খেয়াল থাকে না।
কয়েদখানায় নয়, বাইরেই আছি। তবু কেন স্বাভাবিক
প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন টেনে নিতে পারি না সম্প্রতি
প্রহরে প্রহরে আর? দম বন্ধ হ’য়ে আসে, শুধু
হাঁসফাঁস; কারা যেন মুখের উপর
খুব জোরে চেপে ধরে নিরেট বালিশ,
যেমন সুদক্ষ খুনী কাজ সারে অবলীলাক্রমে। প্রাণপণ
চিৎকার করতে গিয়ে দেখি
সকল আওয়াজ স্তব্ধ, বুক ফেটে যায়।
১৮।২।৯০
সত্যি-বলতে
সত্যি-বলতে আজকাল যে যার মর্জিমাফিক
আমার কবিতার গালে ঠিক গুনে গুনে
ঠাস ঠাস চড় চাপড় লাগিয়ে দ্যায়। কেউ পানের
পিক ছোঁড়ে মুখে, গলা ধাক্কা, গুঁতো,
পাক্কারদ্দা আছে লেগে। কেউ
মোড়লী চালে কান মুচড়ে নিজের তপ্ত মেজাজে
ঢালে ঠাণ্ডা পানি। কেউবা ফেউ লেলিয়ে
পরখ করে, কান্না জুড়ে দ্যায় কিনা অভিমানী
আমার পংক্তিমালা। মাতব্বর
সেই লোক, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যে রাষ্ট্বপতিকে নিজের বাপের চেয়েও
কদর করে বেশি, ঘাসের সাপের ধরনের
সেই লোক, আমার কবিতার
একটি হাত খসিয়ে র্যা কেট বানিয়ে টেনিস
খেলতে শুরুকরে।
অন্যজন পাঁজরের হাড় খুলে নিয়ে
পগার পার, পাঁড়মাতাল
এক মুরগীচোর আমার নগ্ন কবিতার ঠ্যাঙ ধ’রে
করে টানাটানি, মারে ল্যাঙ। এক লেজযুক্ত
সজ্জন সাফ সাফ ব’লে দিলো আমার সদ্য-লেখা
পংক্তিমালাকে, ‘এই যে শুনছিস, যার
হাত থেকে উৎসারিত তোরা, সেই উজবুক
খাসির গোশ্তের মতো মৃত
এক দশক আগে। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? দাঁড়া
বেকুবের দল, কে আছিস তাড়াতাড়ি
আলমারি থেকে বের ক’রে আন ওর ম্রিয়মাণ কংকাল।
এরই ফাঁকে বেশ্যালয়-ফেরত এক মাস্তান
বেলফুল জড়ানো হাতে
আমার কবিতার মুণ্ডু লোফালুফি
ক’রে চিবুতে থাকে, যেন কচকচ খাচ্ছে টোমাটো।
পাড়ার পাঁচজনের এই কাণ্ড কারখানা দেখে
কবিতা আমার বেদম হাসে, হেসেই খুন, যেন সার্কাসে
কয়েকটি বেবুন জবর লাফাচ্ছে, দিচ্ছে সুড়সুড়ি,
কাতুকুতু, থুতু ছিটোচ্ছে যেখানে সেখানে,
ভেংচি কাটছে, ইত্যাদি।
ব্যপারটা এরকম, দেখে-শুনে কিন্তু মনেই
হয় না পিলে চমকে-দেওয়া এক জন্তু আমাদের গিলে
খেতে এগিয়ে আসছে হেলে দুলে,
লেজ আছড়ে কাঁপাচ্ছে মাটি।
২১।২।৯০
সৌন্দর্যের স্পর্ধা নিয়ে
অগ্রসরমান, অগ্রসরমান, অগ্রসরমান, অতি দ্রুত
চতুর্দিক থেকে
নিরেট দেয়াল, সত্তা-চেপে-ধরা, দম-বন্ধ করা;
দেয়ালের গায়ে সংখ্যাহীন
সনাতনী উদ্যত তর্জনী, নিত্যদিন তার হাসি মুছে-ফেলা।
কেউ কেউ ঢেলা ছুঁড়ে মজা লোটে, কেউবা শাসায়
সর্বক্ষণ নানা ছলছুতোয়, সে নারী মাথা কোটে
বিরূপ বাসায়, ছেঁড়া সুতোয় সেলাই করে পীড়িত যৌবন।
কপালে, কোমরে, বুকে, হাতের চেটোয়, দু’টি পায়ে
জন্মান্ধ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে বর্বরেরা; অট্রহাসি,
উপহাস অবিরত, থুতু এবং দেয়ালঘেরা
জীবন হাঁপায় জীর্ণ হাপরের মতো,
তৃতীয় প্রহরে
তার ফোঁপানিতে
উনিশ শো নব্বই সালের ধুকপুক, বুকফাটা
আওয়াজ, দূরন্ত বাজপাখি
চক্রাকারে উড়ে
ঠুকরে ঠুকরে খায় তার আর্ত হৃৎপিণ্ড অবেলায়।
অলৌকিক কিছু ঘটবে না। ‘ধিক তোকে, এই ধ্বনি
অন্ধকার থেকে
উথিত, সে ত্রস্ত ভীত, ক্লান্ত, মূক মুখ
হাতে ঢাকতেও পারছে না। গলগল
রক্তবৃষ্টি, বিফল গোধূলি, বিচ্ছিন্নতা মহাগ্রাস;
এক্ষুনি থামাও নারকীয় ক্রিয়াকর্ম, আলগোছে
নামাও তোমরা ওকে পীড়নের মঞ্চ থেকে, ঢেকে
দাও ওর কান্নায় উথলে-ওঠা ক্ষত
জ্যোৎস্না-চন্দ্রনের মসলিনে কতকাল
যন্ত্রণা পাঁজর খুলে নিয়ে
সাজাবে কংকালকীর্ণ উদগ্র উদ্যান? ধ্যান তার
প্রখর অঙ্কুশে বিদ্ধ, কবিতার ভ্রূণাবস্থা কাটে
কালেভদ্রে এ দারুণ জন্মের খরায়। আছড়ায়
অস্তিত্বকে শুধু ড্রাগ ত্র্যাডিক্টের মতো।
কোথাও প্রহরী নেই, তবু
সতর্ক পাহারাদার সবদিকে। সন্ধিগ্ধ, খণ্ডিত আসমান,
অবিরত লাঠি ঠোকা, চোখা, একরোখা বল্লমের অন্ধ ক্রোধ;
উনুনের পোড়া দাগ কাঁটার্ত চোখের
নিচে, আপাতত শায়িতা সে,
আহত সৌন্দর্য নিয়ে বিপন্ন, বিব্রত; স্নায়ুগুলো
ছটফটে, যেন বাইপাস সার্জারির
সুঁচোলো অপেক্ষা, ঝুঁকে-থাকা কিছু পাহাড়ি শকুন,
পক্ষীতত্ত্ববিদের বিষয়ে উদাসীন,
ছড়ায় আগ্রাসী ছায়া চঞ্চু নেড়ে নেড়ে। মুহূর্তেরা
চূর্ণ কাচ, ছেঁড়া-খোঁড়া স্বপ্ন, ভূলুণ্ঠিত
সৌন্দর্যের স্পর্ধা নিয়ে সে কি টান টান উঠে
দাঁড়াবে আবার?
১৫।৩।৯০