- বইয়ের নামঃ এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্ধ বালিকাদের র্যালীতে
বেশ ক’জন অন্ধ বালিকা জড়ো হয়েছে
টিএসসির সড়ক দ্বীপে। ঘাসের উপর কী যেন চিক চিক
করছে, দেখি কিয়দ্দূর থেকে। শিশির ভেবে
এগিয়ে যাই, আমার দৃষ্টি
প্রতারিত হয়। একরত্তি কিছু বেনামি ফুল বিনীত
মেলা বসিয়েছে। এক্ষুণি শুরু হবে ব্যাপ্টিস্ট
অন্ধ বালিকা বিদ্যালয়ের
ছাত্রীদের র্যাদলি। সারিবন্দি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দেখি।
দু’জন অন্ধ বালিকার হাৎড়ে-বেড়ানো
হাত ধরে পথ চলতে থাকি। মনে হয়, অন্ধকারের
রাজ্যে আলোর তালাশে বেরিয়েছি। দৃষ্টিহীনারা
নরম রোদ, আকাশের নীলিমা, গাছপালার সবুজ, সড়ক দ্বীপের
ভাস্কর্য, ফুলের শোভা, আশপাশের
কিংবা দূরের লোকজন, নিজের চেহারা দেখতে পায় না,
তবু ওরা ভাঙাচোরা কিছু স্বপ্ন লালন করে মনের ভেতর।
ওদের প্রত্যেকের জীবন গড়ে ওঠে নিজস্বতায়।
আমি ওদের চলার পথে বিছিয়ে দিই
আমার মমতার ছায়া, যেন ওরা সহজে পেরিয়ে যেতে পারে
রোদ-তাতানো দীর্ঘ পথ। ওদের রাস্তা থেকে তাড়াতাড়ি
সরিয়ে দিই জংধরা তারকাঁটা আর
ভাঙা কাচের টুকরো।
দু’জন দৃষ্টিহীনার হাত
শক্ত মুঠোয় ধরে রাখি, যাতে ওরা
দিনদুপুরেই অধিকতর অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।
২০.১০.৯৪
অবিশ্বাস্য এক রাত
না সুপ্রিয়া, ভেবো না, এখন এত রাতে
যে তোমার সাথে টেলিফোনে
কথায় মেতেছে, তার সুরা পানের মাত্রাটা খুব
বেশি হয়ে গ্যাছে। এই আমি যাকে তুমি একজন
কবি বলে জানো, তার আচরণ বিষয়ে তোমার
ধারণা ভালোই, বলা যায়। মদ্য পান
করি বটে মাঝে-মাঝে, তবে
বেহেড মাতাল নই। আজ কি আমার
কথাগুলো খানিক জড়িয়ে যাচ্ছে? কিছু এলোমেলো?
হ্যালো, হ্যালো, সুপ্রিয়া বিশ্বাস করো, আমি
আজকের চেয়ে এত সুস্থ, স্বাভাবিক
ছিলাম না কোনোদিন আর। পেটে একটু আধটু
হুইস্কি পড়লে বলা হয়, আস্তে আস্তে
সুরাপায়ীদের আঁটো মুখোশ সহজে খসে পড়ে,
প্রকৃত সত্তার রূপ প্রকাশিত হয়। আমার সুপ্রিয়া, শোনো,
কবুল করছি, এর আগে অনেকের
প্রেমে পড়েছিলাম, যদিও ক্যাসানোভা নই কোনো; কিন্তু আজ
কেবল তোমারই ধ্যানে কাটে সারাবেলা। ভাসমান
মেঘে, লতাগুল্ম-হ্রদে, রক্তগোলাপের
পেলব আভায়, পূর্ণিমায় শুধু তোমাকেই দেখি,
দেখি নক্ষত্রের সিঁড়ি বেয়ে নীলিমায় পৌঁছে যাও।
তোমাকে দেখার পরই প্রথম জেনেছি কী একম
শিশিরের শব্দের মতন প্রেম আসে,
কেমন বদলে যায় আমাদের চেনা এই গ্রহ। ভালোবাসা
কতটা গভীর হয়, এর আগে জানি নি কখনো
দিন যাপনের কোনো বাঁকে। হ্যালো, হ্যালো, শোনা যাচ্ছে?
সুপ্রিয়া, তোমার প্রেমে এখনো প্রগাঢ়তম বিশ্বাস আমার।
হ্যালো, হ্যালো, এমন না হয় যেন কোনোদিন, তোমার বিহনে
নিশীথের বুক থেকে জাগর পূর্ণিমা মুছে যায়,
বাগানের সীমা থেকে পুষ্পল বসন্ত
নিমেষে বিদায় নেয়, প্রত্যহ তোমার জন্যে আমার অপেক্ষা
যেন ব্যর্থতার ধুলো চেটে চেটে অবসন্ন হয়,
আমার চোখের পাতা থেকে চিরতরে প্রিয় ঘুম চলে যায়।
সুপ্রিয়া আমার, এমন কি হবে কোনোদিন তুমি
আমাকে নিবিড় ভালোবেসে ভালোবেসে
খুব ক্লান্ত হয়ে মুখ হঠাৎ ফিরিয়ে নেবে সূর্যাস্তের দিকে?
হে আমার শেষতমা, হে আমার বিরান বাগের
একমাত্র ফুল, তুমি থাকো সর্বক্ষণ
আমার র উড়োপুড়ো হৃদয়ের কাছে। এ মুহূর্তে
কত শত কথা মনে পড়ছে আমার। মনে পড়ে,
আমার উজাড় গ্লাসে কোনো এক রাতে অসংকোচে
ঢেলে দিয়েছিলে অসামান্য সুরা আর
সে-রাতেই বুঝেছিলে তুমি-
লোকে যাকে মাতলামো বলে
তা’ আর আমার মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই। কী? ঠিক বলিনি?
হ্যালো, হ্যালো, আজ এই রাতে বড় বেশি কষ্ট পাচ্ছি, এ রকম
রাত বুঝি বড়ই নিঃসঙ্গ করে দেয়;
সুপ্রিয়া, আমার হৃদয়ের তন্তুজাল ছিঁড়ে যাচ্ছে। হ্যালো, হ্যালো,
কে ঢুকে পড়েছে অন্তরঙ্গ কথার ভেতর? প্লিজ,
দয়া করে আপনি একটু রেখে দিন। হ্যালো, হ্যালো,
সুপ্রিয়া শুনছ? হ্যালো, হ্যালো, দূর ছাই,
টেলিফোনটাই বুঝি বিগড়ে গেল, তবে
কী হবে? কী হবে? বোতলেও এক ফোঁটা বাকি নেই,
ফাঁকি, এই জগত সংসারে সবই ফাঁকি, বাতুলের বক বক;
যন্ত্রণাই জীবন, জেনেছি; হ্যালো…হ্যালো…
১১.১২.৯৪
আবৃত্তির আসর
একটু আগে ঘাসজমির শিশিরকে
জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলাম
এবং কথা বলছিলাম পেয়ারা গাছের
পাতাগুলোর সঙ্গে। সবুজ পত্রালি বলল,
‘তোমার কবিতা শুনতে চাই আমরা’। বিব্রত আমি
পাতাগুলোকে কোনোমতে
নিরস্ত করে কোকিলকে ডেকে আনলাম অনুপম
আবৃত্তির আসর বসানোর জন্যে।
কোকিলের কুহুধ্বনি দীঘির মাছগুলোকে প্রবল
আলোড়িত করল, কয়েকটি পাব্দা
দীঘির ধারে উঠে আসতে চাইল। এমন সময়
ঘাসজমির শিশির দু’পায়ে মুক্তোর মতো ছড়িয়ে সে এলো
আমার কাছে। তাকে দেখেই
লতাগুল্ম, মৌমাছি, যুবতী পদ্ম, একটি কি দু’টি
ঘাসফড়িং কোরাস গাওয়ার উদ্দেশ্যে
চঞ্চল হয়ে ওঠে। অভিভূত আমি চেয়ে থাকি হঠাৎ
অতিথির সৌন্দর্যের দিকে। এমন কাউকেই
এর আগে দেখিনি। তার সৌন্দর্যে নিজেকে বিছিয়ে দিলাম।
জিগ্যেস করি ওকে, ‘তুমি কি দেবী, না কি অপ্সরা কোনো?
কী তোমার ধর্ম? গোত্রই বা কী?’ ফুল গাছে
হাত রেখে সে বলে, ‘ধর্ম কিংবা গোত্র আমার বিবেচনা নয়।
আমি দেবী অথবা অপ্সরা কিছুই নই’। তবু আমার প্রশ্ন-
‘তবে কি কুহকিনী তুমি, যে ভীষণ নির্জন পথে মানুষকে
মতিচ্ছন্নতায় ডোবায়’।
‘না, মানবী আমি, সে বলে তার অনিন্দ্য কণ্ঠস্বর
চরাচরে কোমল ছড়িয়ে, মধ্যরাতের
স্তব্ধতায় উচ্চারণ করি, ‘মানবী বলেই তোমাকে
এমন উথাল পাথাল ভালোবাসি’।
এই বাক্য উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
একটি উল্লুক মাথা তুলল
গাছপালার আড়াল থেকে। ডেকে আনলো
ওর গোত্রের কাউকে কাউকে উদ্ভট এক প্রেস কনফারেন্সে!
আমার নতুন পাণ্ডুলিপি
ওদের বিষ্ঠায় ফেলে খিস্তি খেউড়ের গুদাম
অনর্গল করল। আমি সেই জ্যোতির্ময়ী মানবীকে
ওদের দাঁত-নখরের হিংস্রতা থেকে
আড়ালে সরিয়ে তার মুখচুম্বন করলাম। আমার
উৎপীড়িত পাণ্ডুলিপি উঠে এলো তার হাতে ভালোবাসা হয়ে।
শিশির, রাধাচূড়া গাছের পাতা, কোকিল,
দীঘির কেলিপরায়ণ মাছ, সপ্তর্ষিমণ্ডল রাতের তৃতীয় প্রহরে
জীবন এবং প্রেমের আবৃত্তির আসরের
আয়োজন করল সিএ সুন্দরীতমা এবং আমার উদ্দেশে।
আমি ওদের মনোভঙ্গিতে মুগ্ধতার
ডালপালা দেখে প্রত্যেকের জন্যে সাজালাম নৈবেদ্য।
১১.১০.৯৪