Site icon BnBoi.Com

এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা – শামসুর রাহমান

এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা - শামসুর রাহমান

অন্ধ বালিকাদের র‍্যালীতে

বেশ ক’জন অন্ধ বালিকা জড়ো হয়েছে
টিএসসির সড়ক দ্বীপে। ঘাসের উপর কী যেন চিক চিক
করছে, দেখি কিয়দ্দূর থেকে। শিশির ভেবে
এগিয়ে যাই, আমার দৃষ্টি
প্রতারিত হয়। একরত্তি কিছু বেনামি ফুল বিনীত
মেলা বসিয়েছে। এক্ষুণি শুরু হবে ব্যাপ্টিস্ট
অন্ধ বালিকা বিদ্যালয়ের
ছাত্রীদের র্যাদলি। সারিবন্দি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দেখি।

দু’জন অন্ধ বালিকার হাৎড়ে-বেড়ানো
হাত ধরে পথ চলতে থাকি। মনে হয়, অন্ধকারের
রাজ্যে আলোর তালাশে বেরিয়েছি। দৃষ্টিহীনারা
নরম রোদ, আকাশের নীলিমা, গাছপালার সবুজ, সড়ক দ্বীপের
ভাস্কর্য, ফুলের শোভা, আশপাশের
কিংবা দূরের লোকজন, নিজের চেহারা দেখতে পায় না,
তবু ওরা ভাঙাচোরা কিছু স্বপ্ন লালন করে মনের ভেতর।
ওদের প্রত্যেকের জীবন গড়ে ওঠে নিজস্বতায়।

আমি ওদের চলার পথে বিছিয়ে দিই
আমার মমতার ছায়া, যেন ওরা সহজে পেরিয়ে যেতে পারে
রোদ-তাতানো দীর্ঘ পথ। ওদের রাস্তা থেকে তাড়াতাড়ি
সরিয়ে দিই জংধরা তারকাঁটা আর
ভাঙা কাচের টুকরো।
দু’জন দৃষ্টিহীনার হাত
শক্ত মুঠোয় ধরে রাখি, যাতে ওরা
দিনদুপুরেই অধিকতর অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।
২০.১০.৯৪

অবিশ্বাস্য এক রাত

না সুপ্রিয়া, ভেবো না, এখন এত রাতে
যে তোমার সাথে টেলিফোনে
কথায় মেতেছে, তার সুরা পানের মাত্রাটা খুব
বেশি হয়ে গ্যাছে। এই আমি যাকে তুমি একজন
কবি বলে জানো, তার আচরণ বিষয়ে তোমার
ধারণা ভালোই, বলা যায়। মদ্য পান
করি বটে মাঝে-মাঝে, তবে
বেহেড মাতাল নই। আজ কি আমার
কথাগুলো খানিক জড়িয়ে যাচ্ছে? কিছু এলোমেলো?

হ্যালো, হ্যালো, সুপ্রিয়া বিশ্বাস করো, আমি
আজকের চেয়ে এত সুস্থ, স্বাভাবিক
ছিলাম না কোনোদিন আর। পেটে একটু আধটু
হুইস্কি পড়লে বলা হয়, আস্তে আস্তে
সুরাপায়ীদের আঁটো মুখোশ সহজে খসে পড়ে,
প্রকৃত সত্তার রূপ প্রকাশিত হয়। আমার সুপ্রিয়া, শোনো,
কবুল করছি, এর আগে অনেকের
প্রেমে পড়েছিলাম, যদিও ক্যাসানোভা নই কোনো; কিন্তু আজ
কেবল তোমারই ধ্যানে কাটে সারাবেলা। ভাসমান
মেঘে, লতাগুল্ম-হ্রদে, রক্তগোলাপের
পেলব আভায়, পূর্ণিমায় শুধু তোমাকেই দেখি,
দেখি নক্ষত্রের সিঁড়ি বেয়ে নীলিমায় পৌঁছে যাও।

তোমাকে দেখার পরই প্রথম জেনেছি কী একম
শিশিরের শব্দের মতন প্রেম আসে,
কেমন বদলে যায় আমাদের চেনা এই গ্রহ। ভালোবাসা
কতটা গভীর হয়, এর আগে জানি নি কখনো
দিন যাপনের কোনো বাঁকে। হ্যালো, হ্যালো, শোনা যাচ্ছে?
সুপ্রিয়া, তোমার প্রেমে এখনো প্রগাঢ়তম বিশ্বাস আমার।

হ্যালো, হ্যালো, এমন না হয় যেন কোনোদিন, তোমার বিহনে
নিশীথের বুক থেকে জাগর পূর্ণিমা মুছে যায়,
বাগানের সীমা থেকে পুষ্পল বসন্ত
নিমেষে বিদায় নেয়, প্রত্যহ তোমার জন্যে আমার অপেক্ষা
যেন ব্যর্থতার ধুলো চেটে চেটে অবসন্ন হয়,
আমার চোখের পাতা থেকে চিরতরে প্রিয় ঘুম চলে যায়।

সুপ্রিয়া আমার, এমন কি হবে কোনোদিন তুমি
আমাকে নিবিড় ভালোবেসে ভালোবেসে
খুব ক্লান্ত হয়ে মুখ হঠাৎ ফিরিয়ে নেবে সূর্যাস্তের দিকে?
হে আমার শেষতমা, হে আমার বিরান বাগের
একমাত্র ফুল, তুমি থাকো সর্বক্ষণ
আমার র উড়োপুড়ো হৃদয়ের কাছে। এ মুহূর্তে
কত শত কথা মনে পড়ছে আমার। মনে পড়ে,
আমার উজাড় গ্লাসে কোনো এক রাতে অসংকোচে
ঢেলে দিয়েছিলে অসামান্য সুরা আর
সে-রাতেই বুঝেছিলে তুমি-
লোকে যাকে মাতলামো বলে
তা’ আর আমার মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই। কী? ঠিক বলিনি?

হ্যালো, হ্যালো, আজ এই রাতে বড় বেশি কষ্ট পাচ্ছি, এ রকম
রাত বুঝি বড়ই নিঃসঙ্গ করে দেয়;
সুপ্রিয়া, আমার হৃদয়ের তন্তুজাল ছিঁড়ে যাচ্ছে। হ্যালো, হ্যালো,
কে ঢুকে পড়েছে অন্তরঙ্গ কথার ভেতর? প্লিজ,
দয়া করে আপনি একটু রেখে দিন। হ্যালো, হ্যালো,
সুপ্রিয়া শুনছ? হ্যালো, হ্যালো, দূর ছাই,
টেলিফোনটাই বুঝি বিগড়ে গেল, তবে
কী হবে? কী হবে? বোতলেও এক ফোঁটা বাকি নেই,
ফাঁকি, এই জগত সংসারে সবই ফাঁকি, বাতুলের বক বক;
যন্ত্রণাই জীবন, জেনেছি; হ্যালো…হ্যালো…
১১.১২.৯৪

আবৃত্তির আসর

একটু আগে ঘাসজমির শিশিরকে
জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলাম
এবং কথা বলছিলাম পেয়ারা গাছের
পাতাগুলোর সঙ্গে। সবুজ পত্রালি বলল,
‘তোমার কবিতা শুনতে চাই আমরা’। বিব্রত আমি
পাতাগুলোকে কোনোমতে
নিরস্ত করে কোকিলকে ডেকে আনলাম অনুপম
আবৃত্তির আসর বসানোর জন্যে।

কোকিলের কুহুধ্বনি দীঘির মাছগুলোকে প্রবল
আলোড়িত করল, কয়েকটি পাব্‌দা
দীঘির ধারে উঠে আসতে চাইল। এমন সময়
ঘাসজমির শিশির দু’পায়ে মুক্তোর মতো ছড়িয়ে সে এলো
আমার কাছে। তাকে দেখেই
লতাগুল্ম, মৌমাছি, যুবতী পদ্ম, একটি কি দু’টি
ঘাসফড়িং কোরাস গাওয়ার উদ্দেশ্যে
চঞ্চল হয়ে ওঠে। অভিভূত আমি চেয়ে থাকি হঠাৎ
অতিথির সৌন্দর্যের দিকে। এমন কাউকেই
এর আগে দেখিনি। তার সৌন্দর্যে নিজেকে বিছিয়ে দিলাম।

জিগ্যেস করি ওকে, ‘তুমি কি দেবী, না কি অপ্সরা কোনো?
কী তোমার ধর্ম? গোত্রই বা কী?’ ফুল গাছে
হাত রেখে সে বলে, ‘ধর্ম কিংবা গোত্র আমার বিবেচনা নয়।
আমি দেবী অথবা অপ্সরা কিছুই নই’। তবু আমার প্রশ্ন-
‘তবে কি কুহকিনী তুমি, যে ভীষণ নির্জন পথে মানুষকে
মতিচ্ছন্নতায় ডোবায়’।
‘না, মানবী আমি, সে বলে তার অনিন্দ্য কণ্ঠস্বর
চরাচরে কোমল ছড়িয়ে, মধ্যরাতের
স্তব্ধতায় উচ্চারণ করি, ‘মানবী বলেই তোমাকে
এমন উথাল পাথাল ভালোবাসি’।

এই বাক্য উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
একটি উল্লুক মাথা তুলল
গাছপালার আড়াল থেকে। ডেকে আনলো
ওর গোত্রের কাউকে কাউকে উদ্ভট এক প্রেস কনফারেন্সে!
আমার নতুন পাণ্ডুলিপি
ওদের বিষ্ঠায় ফেলে খিস্তি খেউড়ের গুদাম
অনর্গল করল। আমি সেই জ্যোতির্ময়ী মানবীকে
ওদের দাঁত-নখরের হিংস্রতা থেকে
আড়ালে সরিয়ে তার মুখচুম্বন করলাম। আমার
উৎপীড়িত পাণ্ডুলিপি উঠে এলো তার হাতে ভালোবাসা হয়ে।

শিশির, রাধাচূড়া গাছের পাতা, কোকিল,
দীঘির কেলিপরায়ণ মাছ, সপ্তর্ষিমণ্ডল রাতের তৃতীয় প্রহরে
জীবন এবং প্রেমের আবৃত্তির আসরের
আয়োজন করল সিএ সুন্দরীতমা এবং আমার উদ্দেশে।
আমি ওদের মনোভঙ্গিতে মুগ্ধতার
ডালপালা দেখে প্রত্যেকের জন্যে সাজালাম নৈবেদ্য।
১১.১০.৯৪

আমরা এসে দাঁড়িয়েছি

আমরা এসে দাঁড়িয়েছি খোলা আকাশের নিচে;
নত আমাদের মাথা, চোখের পাতা
কাঁপছে অবিরত, বুকের ভেতর গড়িয়ে পড়ছে
নুড়ি পাথর, মড়ার খুলি। স্মৃতিতে কম্পমান কয়েকটি মুখ।

যদিও তোমাদের অনেকেই কবরই নেই, তবু
ভাবতে ভালো লাগে আমার,
তোমাদের কবরের উপর ঝুঁকে আছে
অনেকগুলো রক্তগোলাপ।
ভাবতে ভালো লাগে, প্রহরে প্রহরে গায়ক পাখিরা
তোমাদের কবরের উপর সুর ঝরিয়ে
উড়ে যায় যে যার গন্তব্যে। ভাবতে ভালো লাগে,
যে-হাওয়া বয়ে যায় তোমাদের কবরের উপর,
তার কণ্ঠে বেহাগের বেদনাপ্লুত স্বর এবং কবরের উন্নতশির
তরুণ ঘাসদল উচ্চারণ করছে আত্মোৎসর্গের মাতৃভাষা।
আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে
স্মরণ করছি তোমাদের, এই সেই ভৌতিক ইটখোলা,
করোটির ভেতরকার শূন্যতার মতো
অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সেই বধ্যভূমি; যেখানে
তোমরা রক্তখেকো ঘাতকদের অস্ত্রের বেলেল্লা
চিৎকার শুনেছ, ওদের পাশব চোখে দেখেছ
হিংসার আগুনের আষ্ফালন, তোমরা স্তব্ধতার স্থাপত্য হয়ে
সহ্য করেছ পৈশাচিক নির্যাতন, তোমাদের জীবন
জন্মান্ধ আক্রোশে খুবলে নিয়েছে নরপশুরা। সেই কালবেলায়
একঝাঁক শকুনের চঞ্চু আর নখরাঘাতে
আর্তনাদ করেছিল হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতা। মৃত্যুকে
তোমরা আলিঙ্গন করেছ কালজয়ী মহিমায়।

যাদের হাতের আস্তিনের আড়াল থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো
টুপটাপ পড়ছে তোমাদের রক্ত, আমরা দেখছি,
ওরা আজ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, হা দেশ! হা মানুষ!
তোমাদের চোখ যারা উপড়ে নিয়ে, ছিন্ন ভিন্ন করেছে তোমাদের হৃৎপিণ্ড
তারাই আজ মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছ যেখানে সেখানে,
রক্তলিপ্সু নেকড়ের পাল জনসাধারণকে দিচ্ছে নৈতিকতার সবক।
আর্তনাদ করছে শহীদদের আত্মা, অট্রহাসিতে ফেটে পড়ছে ইটখোলা;
হা আমাদের বেঠিক পথের রাজনীতি! হা এ দেশের শাসকদল!

হে মহান শহীদেরা, তোমরা এই বাংলায় নেই, এই নির্দয় সত্য
মেনে নিতে পারি না কিছুতেই
আমরা যখন শীত সকালের মধুর রোদে হাঁটি কিংবা কোনো
জ্যোৎস্নারাতে শুনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, তখন
উপলব্ধি করি তোমাদের উপস্থিতি। যখন আমরা
সুন্দর এবং কল্যাণের অভিষেকের প্রস্তুতির জন্যে
মিছিল করি, যখন পশু-তাড়ানোর সংগ্রামে আমরা
মিলিত হই জনসভায়, তখন স্পষ্ট দেখতে পাই
তোমরা আছো আমাদের পাশে। তোমাদের চোখে মানবতার
অবিনশ্বর দীপ্তি, হাতে উজ্জ্বলতম ভবিষ্যতের ঠিকানা।
আমাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রার পথে
অজস্র ফুলের বিকাশ, পাখিদের নীলিমা-ছোঁয়া গীতিধারা।

[এই কবিতাটি বিজয় দিবস উপলক্ষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
আয়োজিত অনুষ্ঠানে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পঠিত। শা-রা]

আমরা যে যা’ বলেছিলাম

আমরা ক’জন সারা দুপুর আর বিকেল
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত শরীরে
শান্ত দিঘির ধারে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই
তিনি উপস্থিত হলেন সেখানে।

তাঁর পরনে খসখসে জোব্বা, মাথায় সাদা পাগড়ি,
গালে লালন ফকিরের মতো দাড়ি,
চোখে সুফীর অনাসক্তি। তাজিম-জাগানো
সেই মানুষটিকে দেখামাত্র আমরা উঠে দাঁড়ালাম।

আমাদের উদ্দেশে তাঁর প্রগাঢ় কণ্ঠস্বর
ধ্বনিত হয় স্তোত্রের মতো, “তোমরা কে কী চাও
স্পষ্ট ভাষায় বলো আমাকে। কথা দিচ্ছি,
তোমাদের প্রত্যেকের ইচ্ছাই পূরণ হবে”।

তাঁর উচ্চারণ ফাঁকা কলসের আওয়াজ নয়,
এ-কথা বুঝতে আমাদের দেরি হয়নি।
একে-একে সবাই
নিবেদন করল নিজেদের আকাঙ্ক্ষা।

বেকার যে সে চাইল আমলাতন্ত্রের
সর্বোচ্চ চূড়ায় বসে হাওয়া খেতে পরম সুখে,
আরেকজনের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো সুরম্য
প্রাসাদপ্রতিম বাড়ি, মার্সিডিজ গাড়ি আর বিস্তর টাকার প্রার্থনা।

আমাদের মধ্যে যে ছিল রাজনৈতিক কর্মী,
সে চটজলদি মন্ত্রী হওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করল,
যে ছিল উস্‌কো-খুস্‌কো কবি, সে জানালো, এখন থেকে
তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ যেন লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়।

আমার পাশেই ছিলে তুমি, প্রিয়তমা। আমার ঈর্ষা জাগিয়ে
তোমাকে ব্যাকুল চুমো খাচ্ছিল গোধূলি। তোমাকে দেখিয়ে সেই
বুজর্গকে বললাম ‘একে ছাড়া
অন্য কিছুই কামনা করি না আমি। তুমি
দু’হাতে ঢেকে ফেললে গোধূলিরঙিন মুখ;
কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন তোমাকে দখল করেনি।
২১.৬.৯৪

আমার লেখার টেবিল

আমার লেখার টেবিল আজন্ম নিজের
বস্তুত বিষয়ে সচেতন আর বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতায়
ক্রমশ নিবেদিত। সে জানে, আমার
শতাব্দীর সৌজন্যে নির্মিত ওর উপরিকাঠামো।
বস্তুত, এই লেখার টেবিল আমার প্রিয়তমার প্রকৃত নাম
ঈষৎ ভ্রমবশত শতাব্দীর আড়ালে রেখেছে।
আমার লেখার টেবিল ভাববাদী ধোঁয়াশায়
নিজেকে হারিয়ে ফেলে অন্ধের মতো দিনরাত্তির
পথ হাতড়ে বেড়াতে নারাজ। অথচ সে জানে, ওর হৃদয়ে
কী এক বকুলতলা ছায়ার মমতা বিছায়, নিঝুম জ্যোৎস্না
শতাব্দীর প্রেম হয়ে জ্বলে, বাউলের দেহতত্ত্ব আলোকে
কী ফুল ফোটায়; ওর বুকে মীন হয়ে খেলছে নীরে
প্রহরে প্রহরে চেতনগুরুর সঙ্গ নিয়ে
শতাব্দীর প্রতি আমার ভালোবাসা।

এই লেখার টেবিল জানে, শতাব্দীহীন
আমার জীবন কেবল ভস্মরাশির অক্ষর।
আমার লেখার টেবিল সর্বক্ষণ কান পেতে রাখে প্রতিদিন,
যদি শতাব্দীর পদধ্বনি শোনা যায়, শতাব্দীর হাতের স্পর্শ
কামনা করে অসীম ব্যাকুলতায়।
শতাব্দীর আঙুলগুলো যখন আদর বুলায়
ওর শরীরে, তখন সে নিরঞ্জন দেয়ালি,
সৃজনশীল রূপটানে নতুন দিগ্বলয়ের কবিতা।
যখন সে বঞ্চিত শতাব্দীর সঙ্গসুখ থেকে তখন
সারাদিন দুঃখ বোধ করে, মধ্যরাতে করে অশ্রুপাত।

আমার লেখার টেবিলের অরুচি টীকাভাষ্যে,
তবু সে নোট নেয় দুঃসময়ের। বড় বিচলিত হয়
গুলিবিদ্ধ দিন আর দুঃস্বপ্নঘেরা রাতের আর্ত চিৎকারে।
আমার লেখার টেবিল যখন শোনে
ফতোয়াবাজদের পাথরের আঘাতে মৃত্যুর কর্কশ হাতে
ধরা পড়ে গ্রাম্য তরুণী, তখন সে ভীষণ
ক্রোধে ফেটে পড়ে; যখন দ্যাখে ধর্মের কপট সওদাগর
চৌদিকে পরকালের পসরা সাজিয়ে
সরলমতি ক্রেতাদের ভিড় বাড়ায় অহর্নিশ,
তখন সে ইহজাগতিক দীপ জ্বালে নিভৃতে প্রবীণ আন্ধারে।
১১.৯.৯৪

আরো কিছুক্ষণ

আরো কিছুক্ষণ থাকো এখানে আমার খুব কাছে;
এখুনি যেও না।
শারীরিক শোভা নিয়ে দূরে। যদি যাও, শীতের সুতীক্ষ্ণ দাঁত
আরো বেশি হিংস্র হয়ে কামড়াতে থাকবে আমাকে সারাক্ষণ।

কতকাল পরে আমি তোমাকে দেখছি পুনরায়!
এই দুটি কালো চোখে গাঢ় মায়া আছে আগেকার
মতোই, আশ্চর্য স্তনচূড়া নত নয় এতটুকু,
শরীরের বিভা এখনো তো খুব মনোমুগ্ধকর।
কেবল এ-আমি দ্রুত ভীষণ বদলে যাচ্ছি, দ্যাখো,
তোমার সমুখে এক বিবিক্ত বৃদ্ধের প্রতিকৃতি!
আরো কিছু কথা বলো, কতদিন তোমার কথার
মাধুর্যে করেনি স্নান মন, কতদিন, হে সুপ্রিয়া,
তোমার হাসির আভা দেয়নি রাঙিয়ে
আমার প্রহর, দাও, আমাকে যযাতি করে দাও।

আরো কিছুক্ষণ থাকো এখানে আমার খুব কাছে।
না, দূরে থেকো না আর, আমার বাঁ পাশে এসে বসো,
রাখো হাত আমার তৃষিত হাতে, মুখ চুম্বনের
জন্যে দাও বাড়িয়ে তোমার মুখ, নিষেধের বেড়া ভেঙে যাক।

আরো কিছুক্ষণ থাকো যদি এখানে আমার কাছে,
যদি তুমি আমার নিষ্প্রভ চোখে চোখ রেখে বলো,
‘চল যাই আজ জ্যোৎস্নারাতে বনে কিংবা নৌকো ভ্রমণে’ তা হলে,
সুপ্রিয়া, বিশ্বাস করো, নিমেষে যুবক হয়ে যাব পুনরায়।
১৪.১২.৯৪

উত্তর

তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো,
‘এই আকাশ আমার।
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবে না।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতে পারো,
‘ফুল তুই আমার’,
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোৎস্ন আমার’,
কিন্তু চাঁদনী থাকবে নিরুত্তর।

মানুষ আমি আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকব নির্বাক?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।
২৩.৫.৯৪

ঋণ স্বীকার

গোলাপ সুঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে আমার বইয়ের
পাতা জুড়ে বসে বলে, “তুমি যাকে ভালোবাসো সে
আমার সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে সোফায়;
আমি তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে এসেছি”।

একটি বুলবুল আমার টেবিলে-রাখা
চায়ের পেয়ালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে
বলে সুর ঝরিয়ে, “যে তোমার সর্বেশ্বরী
সে আমার গান নিজের কণ্ঠে করেছে ধারণ;
আমি তোমাকে এ-কথা বলতে
দূরের বাগান ছেড়ে তোমার ঘরে এসেছি”।

শ্রাবণের মেঘদল আমাকে জড়িয়ে ধরে মেঘলা
স্বরে করে উচ্চারণ, “যে তোমার স্বপ্নের
অভ্রময় পথে হাঁটে একলা, তার চুলের ঝরনা
ধার নিয়েছে আমাদের শোভা; ঋণ স্বীকারের নাম নেই-
এ-কথা জানাতে আকাশ থেকে
তোমার ছোট ঘরে নেমে এসেছি”।

সুন্দরবনের হরিণ ঝিলের জল থেকে
মুখ তুলে হাওয়া চিরে, খুরে ধুলো উড়িয়ে
ছুটতে-ছুটতে আমার ঘরে পৌঁছে গ্রীবা
দুলিয়ে বলে “যে তোমার প্রিয়তমা, সে আমার চোখের
গড়ন করেছে হরণ আমি সেই অপরাধের
বিচারের দাবি নিয়ে এসেছি”।

আমি আমার সদ্যলেখা প্রেমের কবিতা
ওদের প্রত্যেককে দেখিয়ে বলি,-
দ্যাখো, এই পংক্তিমালায় তার হয়ে তোমাদের সবার
ঋণ স্বীকারের তুমুল ঝংকার তুলেছি।
২৬.৭.৯৪

এই মুহূর্তে তুমি

এই মুহূর্তে তুমি আসতে পারো এখনে। তোমার
পদস্পর্শে ঘাসগুলো হেসে উঠবে, লোকটার
স্বপ্ন সমুদয় আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে, তোমাকে
সংবর্ধনা জানাবে দোয়েল আর অজস্র
প্রজাপতি। কোনো দ্বিধা কোরো না তুমি,
তোমাকে আলিঙ্গন করবে
লোকটার আকাঙ্ক্ষার সকল গোলাপ, তোমার
পায়ে চুমু খাবে শারদ রাতের ঝর্নাধারা।

তুমি এসেই দ্যাখো একবার, তোমার কাঁধে
এসে বসবে পৃথিবীর সুন্দরতম পাখি,
প্রাণমাতানো সুর ঝরাবে তোমার সারা শরীরে।
একটি হরিণ ওর কোমল পদ্ধতিতে
তোমার আঁচল ধরে টেনে এনে তোমাকে
আসন পেতে দেবে পদ্মদীঘির কিনারে। তোমার
পায়ের রাঙা পাতা ধুইয়ে দেবে রূপোলি তন্বী মাছ।
তোমার সত্তায় জাগবে অপূর্ব শিহরণ এবং
তুমি কবিতার অপরূপ উন্মীলন দেখে চকিতে
বুঝতে পারবে, তোমাকে ঘিরেই সকল আয়োজন।

এই যে লোকটা দাঁড়ানো এখানে
সেই কবে থেকে, তাকে স্বর্ণচাঁপা, বন পায়রা, ক্যামেলিয়া,
শেষ রাতের তারা, জ্যোৎস্না-ঝলসিত নদীর ধারা অনেক আগেই
শনাক্ত করেছে কবি বলে। এই লোকটাই
তোমার প্রকৃত প্রেমিক, যে জানে আমাকে
তার সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয় কিছুতেই।

লোকটা, যে কবি, তার মুহূর্তগুলো নক্ষত্রের মতো
ছিটিয়ে দেবে তোমার চারপাশে,
তুমি সেই রূপোলি টুকরোগুলো ধারণ করো
তোমার চোখের পাতায়, অধরে, স্তনচূড়ায়, নাভিমূলে।

আকাশের তারার মিছিল যখন অপসৃত দৃষ্টি থেকে,
যখন জোনাকিরা সব আলো বিলিয়ে ফতুর হয়ে
মৃত পড়ে থাকবে ভেজা ঘাসে, তখন তুমি ইচ্ছে হলে চলে যেও।
সেই লাজনম্র প্রস্থানে কবিতা, উর্মি, শতাব্দী তোমাকে
অনুসরণ করবে ছায়া হয়ে এবং তখন
লোকটাকে ঘিরে স্বপ্নের ঝাঁক ঝাঁক গোলাপি মৌমাছির গুঞ্জরণ।
২৩.৯.৯৪

 এমন কেন হয় না?

শুদ্ধতার সরোবরে ডুবসাঁতার কেটে
এইমাত্র উঠে এলে তুমি, তোমার
সত্তার অপরূপ তীক্ষ্ণ নগ্নতা থেকে ঝরছে জলের
স্বচ্ছ রূপোলি ফোঁটা উৎসুক ঘাসমাটিতে।

যেসব কদাকার বৃশ্চিক আমার হৃদয়ের
তন্তুগুলো আহার করে
বেঁচে থাকে কর্কশ নধরতায়, তুমি তাদের কাল রাত্তিরে
তোমার শৈল্পিক আঙুলে
তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছ কবরস্তানে। আমার
অন্তর্গত ক্ষত সযত্নে ধুইয়ে দিয়েছ শুদ্ধতার শিশিরে।

কাল রাত্তিরে তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি
ভালোবেসেছ; কাল তুমি এমন কিছু উচ্চারণে
আমাকে আলোকাবৃত করেছ যা,
শোনার আকাঙ্ক্ষায় আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
প্রতীক্ষায় ছিলাম। কাল নিশীতে বালিশে
মুখ চেপে তোমাকে আবৃত্তি করতে করতে ভালোবাসার মাতৃভাষায়
যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখন দূর থেকে
কয়েকটি নক্ষত্র দেখছিল আমাদের দু’জনের ঘুমের স্তব্ধতা।

এমন কেন হয় না, সব সময় দেখতে পাচ্ছি
তোমাকে? তুমি আমার সামনে লঘু পায়ে
ঘোরা ফেরা করছ স্যুইচ টিপছ আলো-হাওয়ায়,
চুল আঁচড়াচ্ছ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে,
শাড়ি পরছ, খুলছ ব্লাউজের হুক, আমার পাশে বসছ নিবিড়,
আমার আঙুল নিয়ে খেলা করছ, কখনো করছ
মুখ চুম্বন, কখনো আমার মাথা টেনে নিচ্ছ কোলে, কখনো-বা
তোমার চুলের ঝর্নাধারায় ঢেকে দিচ্ছ আমার মুখ-কেন এমন হয় না?
কেন এমন হয় না, ইচ্ছে করলেই তোমাকে ছুঁতে পারি
যে-কোনো সময়? ইচ্ছে হলেই তোমাকে নিয়ে
বেরিয়ে পড়তে পারি, নির্জনতাকে সাজাতে পারি নান্দনিক
যুগ্মতায়? এই মুহূর্তে তোমার যুগল স্তন উৎকর্ণ হয়ে
শুনছে আমার হৃদস্পন্দন, সেই ধ্বনিপুঞ্জে
তোমার নাম ঢেউ হয়ে নেচে উঠছে কি না, তা’
যাচাই করে নিতে আর আমি তোমার সুবর্ণ উরুর শোভা
দেখা আর চুমোর সুঘ্রাণের স্মৃতি আউড়ে চলেছি।
২৫.৯.৯৪

এসো কোকিল, এসো স্বর্ণচাঁপা

হে কোকিল, শহরের নিভৃত কোকিল, অনির্দিষ্ট ঝোপ ছেড়ে
চলে এসো কবিতার খাতায় আমার;
প্রাণের আনন্দে গাও গান,
নিষাদের ভয় নেই, নোটেশন নেবো লোকচক্ষুর আড়ালে।

কোকিল আমাকে বলে, “কী করে গাইব গান, বলো,
তোমার খাতায়? তুমি যাকে ডাকো নিভৃতে সুপ্রিয়া,
যে আমার ডাক শুনে প্রহরে প্রহরে
কী ব্যাকুল রাঙা হয় তোমার জন্যেই,
এখন সে নেই এ শহরে, তাই আমি
বিরান কাগজে আজ ডেকে আনতে অপারগ অকাল বসন্ত”।
স্বর্ণচাঁপা, এসো তুমি অব্যাহত দারুণ খরায়
কবিতার খাতায় আমার,
শূন্য পাতা ভরে যাক তোমার সুঘ্রাণে। হরফেরা
স্নিগ্ধ আর সুরভিত হবে, চলে যাবে কালান্তরে।

ম্রিয়মাণ স্বর্ণচাঁপা বলে চাপা স্বরে,
“তুমি যার নাম করো উচ্চারণ নিশীথের কানে,
নিবিড় সৌজন্যে যার একদিন দুপুরে তোমার করতলে
পেতে দিয়েছিলো বুক আমার দু’জন
সহোদরা, তার দেখা নেই এ শহরে ইদানীং,
পারি না অতিথি হতে এখন তোমার এই কবিতার ঘরে”।

হে কোকিল, ওগো স্বর্ণচাঁপা,
হয়ো না বিমুখ আজ। সে নেই বলেই এখনই তো
এ নিঃসঙ্গ কবির সবচে’ বেশি প্রয়োজন তোমাদের সঙ্গ,
তোমাদের দাক্ষিণ্য, সম্প্রীতি।
এসো হে কোকিল, এসো স্বর্ণচাঁপা, দ্যাখো এ বিচ্ছেদে
সকাতর চেয়ে আছে কবিতার খাতা!
৯.১২.৯৪

কবিতা তোমার সঙ্গে

কবিতা, তোমার সঙ্গে সারাটি জীবন উন্মতাল
কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখি
আজো; এই গোধূলিতে পা ডুবিয়ে ভাবি-
আমার বিরান ঘাটে কেন
বড় বেশি দেরি করে ভেড়ালে তোমার
অনুপম কারুকাজময় তরী? কেন আরো আগে
দেখিনি তোমার রূপ, কোন্‌ অপরাধে? লহমায়,
হে কবিতা, আমার দীনতা তুমি দিয়েছে ঘুচিয়ে।

আমাকে পাঠাও তুমি ফুল, পাঠাও দোরেল,
পাতার আড়ালে-থাকা কোকিল, চাতক, মুঠো মুঠো
জোনাকি, সুমিষ্ট ফল, প্রজাপতি আর রঙধনু। কোনোদিন
ফির্নি রেঁধে আনো দ্বিপ্রহরে, কখনো শ্যামল সাঁঝে
চলে আসে কেক নিরিবিলি
তোমার সৌজন্যে। দেখি, মোহন ব্যঞ্জন
সাজাও আমার জন্যে গাঢ় অনুরাগে। ‘অন্নপূর্ণা’
বলে আমি দোল খাই তোমার নিবাসে।

কখনো আমার খর খর যৌবনের উজ্জ্বলতা
পেয়ে যায় তোমার সোনালি পদস্পর্শে,
খোলা চুল ঘরে আনে শ্রাবণের রাত। কালো দু’টি
চোখ অনন্তের ফোঁটা যেন,
নিজের রেশমি চুল নিয়ে খেলা করো
আপন সত্তায় মগ্ন, সরোবর হয়ে ডেকে বলো
‘এসো কবি নিঝুম সাঁতার কাটো উদ্বেলিত জলে’।
ফেরাতে পারি না দৃষ্টি, সরোদের মতো বাজে আমার শরীর।

কবিতা, তোমার সঙ্গে সারাটি জীবন অন্তরঙ্গ
কাটাবার সুখ
পেতে চাই, বড় আশা নিয়ে বসে থাকি
তোমাকে দেখার জন্যে পুনরায় একবার, মুখচুম্বনের
সাধ তীব্র হয় আর নিদ্রাহীন রাতে
তোমার স্তনের তিল কালো নক্ষত্রের মতো জ্বলে
আমার স্মৃতিতে। ভয়ে থাকি সর্বক্ষণ, পাছে তোমার আমার
মাঝখানে বিচ্ছেদের অলঙ্ঘ্য দেয়াল গড়ে ওঠে!

কবিতা, তোমার সঙ্গে সারাটি জীবন বাধাবন্ধহীন আমি
তুমুল কাটিয়ে দিতে চাই।
কখনো নেব না ছুটি, থাকব প্রস্তুত
প্রতিটি প্রহরে, যদি তুমি হাত ধরে নিয়ে যাও হৃদয়ের অন্তঃপুরে।
২৬.৭.৯৪

 ক’দিন পর

কতদিন দেখি না তোমার মুখ; মনে হয়,
কয়েক খৃষ্টাব্দ অতিবাহিত হয়েছে তোমার সঙ্গে
শেষ দেখা হওয়ার পর, অথচ
সাত দিনও হয়নি।

তোমার নিকট থেকে অনেক দূরে একাকী
আমি থাকি, দিন কাটে, বিষাদে। জানি, যে রাস্তায় তোমার বাড়ি,
তার মোড়ের সাইনবোর্ডে আজো রৌদ্র ছায়া
খেলা করে, রেস্তোরাঁয় প্রত্যহ সন্ধ্যেবেলা
ভিড় বাড়ে আগেকার মতোই; মোটরকার,
মোটরসাইকেল হুস্‌ করে চলে যায় বাড়ির পদতল ঘেঁষে।
ক’দিন পর আবার তোমাকে দেখলাম,
যেমন কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক কর্মী
বহুকাল পর তার অন্ধকারাচ্ছন্ন অজ্ঞাতবাস থেকে খোলা পথে
বেরিয়ে দ্যাখে কী সুন্দর প্রস্ফুটিত চিরকালীন রোদ।
২৫.১১.৯৪

জানালার কাছে

জানালার কাছে দাঁড়াইতেই আমার
ভেতরে একটি সুরের জন্ম হলো, যার আদি উচ্চারণ-
আহ্‌, কি অপরূপ সকাল। গলিপথ
সৌভাগ্যের বাহুর মতো প্রসারিত, হাস্যেজ্জ্বল।
নরম রোদ জড়িয়ে ধরেছে পথ,
গাছপালা, লম্বা দেয়াল আর বাড়িগুলোকে।

হালকা হাওয়ায় নেচে উঠছে গাছের পাতা,
নারকেল গাছের ডালগুলো মাথা নুইয়ে রেখেছে,
যেন কোনো মাননীয় অতিথি আসবেন। এই মুহূর্তে
রাস্তায় কোনো যান নেই, জন নেই,
একেবারে ফাঁকা। হঠাৎ দেখি, তুমি হেঁটে আসছো একা;
তোমার ফিরোজা শাড়ি মুর্হূর্তগুলোকে
চঞ্চল করে তুলেছে, তোমার গৌর, স্বপ্নিল মুখে
চুমো খাওয়ার জন্যে রোদ আর হাওয়ার সে কি হুটোপুটি।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কেন জানি কৃতজ্ঞতায়
ভরে উঠল মন। এ কি, আমার কাঁধ ফুঁড়ে জেগে উঠেছে
দুটি স্বর্ণচাঁপা আর তিনটি রক্তজবা। ওরা এখন
উন্মুখ তোমার নৈবেদ্য হাওয়ার অভিলাষে।

তুমি কি এই মুক্তোপ্রতিম ভোরবেলায়
হেঁটে এলে আমার দুঃখগুলোকে মুছে ফেলার জন্যে?
তুমি কি এলে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার উদ্দেশ্যে,
যে-প্রতিশ্রুতি তোমার গহন মমতাময় দু’টি চোখ
মুদ্রিত করেছিল আমার মর্মমূলে? তুমি কি নিজেকে আমার কাছে
পরিপূর্ণ উন্মোচিত করবে ছায়ার আড়ালে স্নানরতা গ্রিক দেবীর মতো?
সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি এই ছোট ঘরে,
আমার অন্তরে বাউলের গোপীযন্ত্র
বাজিয়ে চলেছে মনের মানুষের আগমনী সুর এবং
আমি আবৃত্তি করছি তোমার নাম। অথচ
তোমার অনুপস্থিতির স্তব্ধতা
আমাকে উপহাস করছে খল নায়কের ধরনে।
২৪.৯.৯৪

তুমি কি বিরূপ?

তুমি কি আমার সদ্য প্রকাশিত পদ্য সমুদয়
এক বর্ণ না পড়েই রেখেছ টেবিলে ফেলে উদাসীনতায়?
তুমি কি আমার প্রতি অত্যন্ত বিরূপ? নইলে কেন
সমস্ত শহরে আজ একটিও গোলাপ ফোটেনি?
কেন কোনো পাখি
আসেনি কথাও? কেন বিষাদ আমাকে
কবর খনক হয়ে খুঁড়ছে সর্বদা? মনে হয়,
দারুণ উষ্মায় তুমি ফিরিয়ে রেখেছে মুখ, নইলে
কেন আজ বিরোধী দলের কোনো ঘোষণা ছাড়াই
হরতাল সমস্ত শহরে? কেন আমি
নিজেকে ডুবিয়ে গাঢ় ছায়ায় কেবলি
কবিতার সঙ্গে একা-একা কথা বলি?
২৭.৫.৯৪

তুমি চুল আঁচড়াচ্ছিলে

এই তো সে রাতের কথা। দেয়াল ঘড়িতে তখন
রাত দশটা থর থর করছে
কবুতরের মতো। লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
তুমি চুল আঁচড়াচ্ছিলে। হলকা মেরুন রঙের
চিরুনির সঙ্গে কেলিপরায়ণ একরাশ কালো দিব্যুৎ
এবং আমি সোফায় বসে দেখছিলাম তোমাকে।

তোমার কাছে গিয়ে কালো বিদ্যুৎগুলো হাতে নিয়ে,
তোমার বুকের দুটো রাঙা টিলায়
মুখ রেখে সময়কে শাসন করার এক প্রবল ইচ্ছা
আমার ভেতর মাতলামি শুরু করছিল।

চুল আঁচড়াচ্ছিলে তুমি; তোমার চুলের প্রপাতের
দু’দিকে গড়িয়ে পড়ছিল সাইকেডেলিক স্বপ্নের মোহন নুড়ি
বয়ে যাচ্ছিল আমার বাসনার দীপাবলি।
তোমার সোনালি বাহুতে, গ্রীবায়
গোলাপি ঠোঁটে, উজ্জ্বল গালে আর গহন দুটি চোখে
জ্বল জ্বল করছিল আমার জন্ম-জনান্তর।

তুমি ঘরময় আলোর জাল কেটে কেটে
সোনার তরীর ধরনে এসে
ভিড়লে আমার সোফার ঘাটে, পিছনে গিয়ে
দাঁড়ালে; কয়েকটি কালো বিদ্যুৎ ছুঁলো আমাকে
আর পরিচিত এক সুঘ্রাণ
আমার চেতনাকে আরো প্রখর
করে তুলছিল। আমার ভেতরকারি প্রণয়ী
তখন জটিল লতাপাতায় জড়িয়ে যাওয়া
সিংঅলা এক ছটফটে হরিণ। এবার তুমি আমার
সামনের সোফায়।

কী গভীর তোমার দৃষ্টিপাত। সেই মুহূর্তে
আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারতো; তোমার
দৃষ্টিতে বয়ে যাচ্ছিল যে তারা স্রোত,
তাতে থই পাচ্ছিলাম না কিছুতেই, অমন
রহস্য তুমি কী করে ধারণ করো তোমার দুই চোখে,
কীভাবে আড়াল করো মৃত্যুবাণ? তোমার চোখের
নির্জন অতলে শতবার মরি এবং
সহস্রবার বেঁচে উঠি।

তুমি আবার গিয়ে দাঁড়ালে লম্বা আয়নার সামনে। আবার
শুরু হয় চিরুনি আর দীঘল চুলের মধ্যে
যুগপৎ বিরোধ আর মিতালি। একরাশ কালো বিদ্যুতের
ঝলসানিতে উদ্‌ভাসিত আমি
বুঁদ হয়ে থাকি গজল অধিকৃত গালিবের মতো
তাৎক্ষণিক চুম্বনের সুঘ্রাণে ভরপুর। তখন
রাত সাড়ে দশটা আমাদের শাসাচ্ছে, অথচ তুমি
অপরূপ আলোকলতার মতো দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলে।
২৮.৮.৯৪

তোমাকে লেখা আমার প্রথম চিঠি

প্রিয়তমা প্রতিমা আমার,
আমাদের পরিচয়ের যাপিত অনেক
রৌদ্রছায়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তোমাকে
আজো কোনো চিঠি লিখিনি।
প্রয়োজন কি অনুভব করিনি কখনো লেখার টেবিলে
প্যাড মেলে রেখে অথবা
বিছানায় শুয়ে তারার স্রোতে চোখ পেতে?
পথ চলতে গিয়ে মনে কি হয়নি
এক্ষুণি বাড়ি ফিরে তোমার উদ্দেশে
হৃদয়ের আভা ছড়িয়ে অক্ষরের শরীরে সাজাই
অনেক কথার শোভাযাত্রা?

টেলিফোন আমার চিঠির পথ আগলে
দাঁড়িয়েছে বার বার। তুমি টেলিফোনে কত না
বসন্ত দিনের সৌরভ, শারদ আকাশের
স্বচ্ছ নীলিমা, শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর দুপুর আর
জ্যোৎস্নারাতের স্বর্ণচাঁপাময় স্তব্ধতা
রচনা করেছ আমার কানে। আমি মুগ্ধতার মেঘে
ভেসে বেড়িয়েছি প্রহরে প্রহরে। তোমার কণ্ঠস্বর
চুম্বন করেছে আমাকে, বানিয়েছে আমার জন্যে শূন্যের মাঝার
এক প্রশান্ত বিশ্রামের ঘর। তোমার পরিশীলিত উচ্চারণ
আমাকে পৌঁছে দিয়েছে ভালোবাসার তীর্থে।

তোমার স্বপ্নিল টেলিফোন বলেছে এসো,
আমার দীঘল চুলের প্রশান্ত থেকে শান্তির ছায়া চেয়ে নাও;
এসো, আমার ঠোঁট থেকে স্বর্গীয় সুধা নাও ওষ্ঠ পেতে,
এসো, আমার দু’চোখ থেকে সন্ধ্যার পাখির নীড়ে ফেরার
তারা ঝলসিত আনন্দ চেয়ে নাও। তোমার টেলিফোন
আমার হৃদয়ের দিগন্ত জুড়ে সৃষ্টি করেছে হরিৎ শোভা।

হে সুন্দরীতমা, বাক্‌শিল্পী তুমি, কণ্ঠস্বরের
মাধুর্য মিশিয়ে নিত্য পাঠাও কথার সওগাত। ইথারে
ইথারে তরঙ্গিত আমাদের হৃদয়ের ধ্বনি। তোমাকে
আবারো আলিঙ্গন করি, আবারো তোমার
চোখে, বুকে মুখে স্তনে চুম্বনের তারা ফোটাই স্মৃতিতে।
তোমার চুল নিয়ে আঙুলে জড়ানো, তোমার পায়ের
আঙুলের সলজ্জ মৃদু হাসি, লজ্জার কোমল ছায়ায় মদির দুপুরে
তোমার নীরব শুয়ে থাকা আমাকে
স্মরণ করিয়ে দেয় টেলিফোনের অলৌকিক কণ্ঠস্বর।
ভুলে যাই তোমাকে চিঠি লেখার কথা।

তোমার কাছেও অবান্তর হয়ে যায় পত্ররচনা;
কিন্তু আমি চাই, আমাদের দু’জনের অন্তর্গত কথারা
অক্ষরের স্পর্শ পাক, যেমন আমার সত্তার প্রতিটি মুকুল
ফুল হয়ে উঠতে চায় তোমাকে স্পর্শ করার ব্যাকুলতায়।
এজন্যেই তোমাকে লেখা আমার এই প্রথম চিঠি উদাসীন
হাটে বিলিয়ে দিলাম তোমার বিনা অনুমতিতে।
আমার এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে,
মিনতি আমার, তিরস্কারের ওপারে রেখো, প্রিয়তমা প্রতিমা আমার।
আমার একটি কথা রাখবে তুমি? ভাদ্রের বিকেলের
ডাকেই তোমার হস্তাক্ষরের অপরূপ গান শুনতে চাই।
ভালোবাসা। একান্ত তোমারই
কবি।
২২.৮.৯৪

 নতুন নৈশ টেস্টামেন্ট

কোজাগরী পূর্ণিমা আজ। রাতের
কাঁধের ওপর দিয়ে একটি বাদামি পাখির ধরনে
উড়ে যাচ্ছি। শ্যামলীর পথের ধারে
একজন বুড়ো সুড়ো লোক ল্যাম্পপোস্ট ঘেঁষে বসে
কী যেন খাচ্ছে মলিন ঠোঙার ভেতর
নোংরা আঙুল ঢুকিয়ে। তার পাশে ঘুর ঘুর
করছে রেওয়ারিশ, বিমর্ষ কুকুর। একটি ধবধবে
মোটরকার যাত্রীহীন দ্রুত চলে যাচ্ছে কোথায়।

এই মুহূর্তে আমি তোমার জ্যোৎস্নাধোয়া ভবনের
খুব কাছে। কী করে কোন্‌ ইন্দ্রজালের
সৌজন্যে আমি রাতজাগা প্রহরী আর
যমদূতমার্কা কুকুরের সতর্ক নজর এড়িয়ে
সিংদরজা পেরিয়ে সোজাসুজি দোতলায়
তোমার বন্ধ বেডরুমে
প্রবেশ করলাম, বলতে পারব না। রাতদুপুরে
তুমি ভাসমান টল টলে ঘুমের সরোবরে।

তোমার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালাম নিশ্চুপ। বালিশে
ছড়ানো তোমার চুলের ঝর্না। বধির রাত্রি তোমার গ্রীবা, বাহু,
ঠোঁট, স্তন, নাভিমূল আর আশ্চর্য বদ্বীপ
কামুকের মতো ক্রমাগত লেহন করছে। আমি
ঈষৎ ঝুঁকলাম তোমার ওপর। তোমার
কবোষ্ণ, সুগন্ধি নিশ্বাস নিরিবিলি ছুঁয়ে যার আমাকে।
তোমার চারদিকে স্বপ্নেরা প্রজাপতির মতো
উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার বাসনার পাপড়িগুলো
ঝরছে তোমার ওপর, তুমি পাশ ফিরে
ডুবে গেলে গভীরতর নিদ্রায়। তোমার
মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে হাসির ঈষৎ আভা। স্বপ্নের
ভেতর আমার কোনো বোকা-বোকা কথা হঠাৎ
মনে পড়েছিল কি তোমার? বেডরুমের
দেয়াল, ড্রেসিং টেবিল, টেলিফোন সেট, টিভি,
ত্র্যালার্ম-দেওয়া ঘড়ি-সবকিছুই মুছে গেল
নিমেষে; শুধু তুমি শুয়ে আছো
মনোরম এক ঝর্নার ধারে। বনদেবীর
সুন্দরী সহচরীরা চামর দুলিয়ে বাতাস করছে তোমাকে।

সেই মুহূর্তে চুমোয় চুমোয় বিহ্বল করে দিতে পারতাম
তোমাকে, জাগিয়ে দিতে পারতাম
প্রবল আকর্ষণে। এসব কিছুই করিনি। আমি
চেয়ে থাকি নিদ্রাতুর তোমার দিকে, বুঝি
চেয়ে থাকব অনন্তকাল। মৌমাছিদের সোনালি
গুঞ্জরণ আমাদের ঘিরে বয়ন করবে স্মৃতির অলৌকিক পাড়।

অকস্মাৎ লুপ্ত ইন্দ্রজাল, আমি মুখ থুবড়ে পড়ি
আবার ঘরের মেঝেতে, গলা ছিঁড়ে বেরোয়
ঝলক ঝলক রক্ত এবং
চোখে লেগে থাকে কতিপয় অবিনশ্বর চিত্রকলা, যা
কখনো অনুবাদ করতে পারব না
কোনো কবিতায়। এই মহিমা-রহিত প্রহরে
কেবলি মৃদু উচ্চারণে
কথা বলব তোমার ঘুমন্ত সত্তার কানে কানে।
২০.১০.৯৪

 না

ব্লাড প্রেসারের গোধূলিবরণ ওষুধ খাওয়া হয়েছে আগেই;
আন্তোনিও গ্রামসি বিষয়ক একটি বই কিছু পড়ে
রেখে দিই টেবিলে। বেলা প্রায় দুপুর-ছোঁয়া,
অর্থাৎ কাঁটায় কাঁটায় সোয়া এগারোটা।
‘হ্যালো’ বলে তোমার কণ্ঠস্বর শোনার আশায় রিসিভার ধরে থাকি,
তখনই কানে এলো ঘুমে-পাওয়া, বিষণ্ন ‘হ্যালো’।

‘তুমি অসুস্থ না কি? কী হয়েছে বলো তো’।
‘কোনো অসুখ ধরেনি আমাকে, কিছুই হয়নি আমার’।
‘মন খারাপ বুঝি?’
‘আমার মন বলে কিছু নেই’।

সে মুহূর্তে তোমার সত্তা অনূদিত হচ্ছিল
কান্নার মাতৃভাষায়। কী কথা বলব তোমাকে,
কী বলতে কী বলে ফেলব, আমার এই দোটানাকে নাড়িয়ে দিয়ে
বেজে ওঠে তোমার অনিন্দ্য কণ্ঠস্বর, ‘কিছু বলছ না যে!’

‘বুঝতে পারছি, তোমার মন খুব খারাপ, এখন রাখি’।
আমার কথা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপার থেকে ভেসে-আসা
‘না’ ধ্বনি আমার মর্মমূল স্পর্শ করে। এমন মাধুর্যময়, এমন
অন্তরঙ্গ ‘না’ কখনো শুনিনি। এই ‘না’ বিশ্বের সংক্ষিপ্ততম
প্রেমের কবিতা হয়ে আমাকে উদ্বেলিত করে, অতিক্রম করে
ছড়িয়ে পড়ে নীলাভতম দিগন্তে, চরাচরে।
১২.৬.৯৪

প্রেমের কবিতা নিয়ে সংলাপ

তখন ভোরবেলা, দুপুর না কি রাত
আমার মনে নেই,
শুধু মনে পড়ে তোমাকে আর মনে পড়ে
এক-আকাশ বৃষ্টি
স্নান করাচ্ছিল ধূলিম্লান শহরকে। রাজধানীর
ত্বকে সেই মুহূর্তে ভেজা শ্যামলিমা,
যেন কোনো রূপসী
পরেছে সবুজ আর কালো রঙ মেশানো শাড়ি।

আমার দিকে স্থাপিত তোমার দুটি
গভীর, সুন্দর চোখ, গুণীর বাদ্যের মতো
জেবে-ওঠা তোমার কণ্ঠস্বর
পরিবেশকে ধনী করে আমার মর্মমূলে
গুঞ্জরিত। কী যেন বলতে চেয়েছিলাম;
বলা হয়নি। তুমি বললে, “তোমার পুরনো
প্রেমের কবিতাগুলো কি যে অপরূপ মনে হয় আমার,
বোঝাতে পারব না। ঈর্ষা করি তোমার
প্রাক্তন প্রেমিকাদের, যাদের নিয়ে লিখেছ প্রেমের পদাবলি। এখন
আমি তোমার প্রেমের কবিতার উৎস, জানি;
তবু তুমি যা-ই বলো, তোমার আগেকার
কবিতাগুলোই বেশি ভালো”।

তোমার হাত হাতে নিয়ে বললাম, আমার
সকল প্রেমের কবিতা-অতীতের এবং বর্তমানের-
তোমার উদ্দেশেই রচিত।আমার কথা বিশ্বাস করলে
কি না বুঝতে পারিনি। খটকা থেকেই গেল।
২২.১১.৯৪

 বলা যায় না, তবুও

কোনো কোনো কষ্ট আছে যা, কাউকেই
বলা যায় না, এমনকী নিজেকেও না।

এই তো সেদিন কয়েকটি ঘণ্টা স্বপ্নিল স্বরে
আমাকে কথা দিয়েছিল, বলেছিল
আমার কানে কানে, ‘আমরা তোমাকে দেবো
তোমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় অনুভূতি,
তোমার হাত ধরে নিয়ে যাব সে এক
সোনালি চূড়ায়, যেখানে তোমার পথে সুন্দরীতমা কোমল
বিছিয়ে রাখবে অনুরাগের পরাগ সমুদয়। কথা দিচ্ছি,
আমরা এই সামান্য ক’টি ঘণ্টা তোমাকে
উপহার দেবো সেই অপরূপ দৃশ্যাবলি,
যা রচনার সাধ্য নেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকরের’।

সেদিন একটি ছোট ঘর আমাকে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মেঘমেদুর স্বরে-
‘আমি তোমার জন্যে মেলে ধরব আমার বুক,
সবচেয়ে শীতল সুরভি-মদির
ছায়া দেবো। আমি তোমার নিভৃত আশ্রয় হবো,
যেখানে তুমি দয়িতার উজাড় অন্তরঙ্গতাকে
আকণ্ঠ করবে পান। তোমাদের যুগ্মতা
আমার সামান্য অবয়বকে দেবে অপার মহিমা।
তোমাদের চুম্বন শূন্যে দুলিয়ে দেবে গোলাপচারা,
তোমাদের আলিঙ্গনে চারদেয়ালের ভেতর
ডেকে উঠবে অকাল বসন্তের কোকিল আর
খাট নিমেষে হয়ে যাবে কাশ্মীর-হ্রদের শিকারা’।

কয়েকটি ঘণ্টা আর একটি ছোট ঘর হঠাৎ
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আমার
একটি অপরূপ স্বপ্নকে মুছে ফেলল এবং আমি
নিজস্ব কষ্টকে বুকের ভেতর পাখির মতো পুষতে লাগলাম।
আমি আমার কবিতার খাতাকে
মিনতি জানালাম, ‘আমার এই কষ্টকে তুমি
একটু ঠাঁই দাও, নইলে আমার শ্বাস
রুদ্ধ হয়ে যাবে এক্ষুণি। তুমি কি সইতে পারবে তা?’

কবিতার খাতা বলে, ‘তোমার মনোজ রৌদ্র-জ্যোৎস্না, জুঁই
চামেলি, দোয়েল, বুলবুল, সোঁদা মাটি, গোস্পদ, ব্যাঙ,
দীর্ঘ সাঁকো, নদীতীরের যমজ গাছ, মেঘনার ঢেউ, পালতোলা নৌকা,
বস্তির ঝুপড়ি, কৃষকের কুটির, মধ্যরাতের স্তব্ধতা, তোমার স্বপ্ন,
দুঃস্বপ্ন, জনপথের কোলাহল, তোমার দীর্ঘশ্বাস, একাকীত্ব
নির্দ্বিধায় ধারণ করেছি আমার বুকে। মার্জনা করো,
তোমার এই কষ্টের জন্যে
জায়গা করে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।
৯.১০.৯৪

বিনিময়

সবেমাত্র একটি কবিতা লিখে উঠল সে। তখন
এক বালক তার কাছে এসে বললো,
‘কবি, তোমার জন্যে এই গোলাপ এনেছি, নেবে তুমি?’
সে মৃদু হেসে বললো, ‘কী সুন্দর, দাও’।

এক ফ্রকপরা বালিকা চুলের ফিতে
তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘বড় শখের
আমার এই ফিতে, কবি, তুমি নেবে?’ সে বলল,
‘দাও, এটা দিয়ে আমি স্বপ্ন বানাব’।

একজন সুন্দরী তার সমুখে এসে বলে
কণ্ঠে সুরের তরঙ্গ খেলিয়ে, ‘এইমাত্র একটি আশ্চর্য
কবিতা লিখছ তুমি, তোমার জন্যে আমি আমার
হৃদয় এনেছি, কবি তুমি গ্রহণ করবে একে?’

সে অপলক তাকিয়ে থাকে সৌন্দর্যের চোখে। একটু পরে,
যখন তার ঘোর কাটে, সে উচ্চারণ করে-
‘এসো এসো, তোমার জন্যেই এতকাল প্রতীক্ষায় কাটিয়েছি,
দিবসরাত্রি, এতকাল নিজেকে নিংড়ে লিখেছি কবিতা’।
২২.১১.৯৪

ভাঙা ঘাটে

এখানে আসার কথা ছিল না তোমার। এরকম
ভাঙা ঘাটে আসে না কখনো
ভাসাতে কলস কেউ। জলের তেমন সজীবতা
নেই, ঝরা পাতাদের ফোঁপানি নিথর জলে ভাসে।
এখানে চৌদিকে কাঁটাবন, আগাছার ভিড়, ফুল
ফোটে না মোটেই, হু হু হাওয়া বয়ে যায় মরা ঘাসে,
মৃত পাখিদের শুক্‌নো পালক ছড়ানো ইতস্তত, বাউলের
ভাঙাচোরা দোতারা রয়েছে পড়ে দূরে এক কোণে।

এখানে আসার কথা ছিল না তোমার এই রুক্ষ
বিরানায়; অথচ স্বেচ্ছায় তুমি এখানেই এলে। আঘাটায়
তোমার পা পড়তেই জলাশয় কেমন সজীব;
কাকচক্ষু জল করে ছলছল, নিষ্পত্র গাছেরা সুসজ্জিত।

চোখের পলকে কী পুষ্পল কাঁটাবন, মৃত পাখি
হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে সুরে সুরে দাগ কাটে স্তব্ধতায়
স্থাপত্যে, গৈরিক বাউলের কণ্ঠে, সে যারে বোঝায়, সেই বোঝে
মৃর্ত হয়। তোমার গ্রীবায় বিষাদের জাল-ছেঁড়া প্রজাপতি।

সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তুমি
স্বচ্ছ জলে ধুয়ে দিলে ধূলিম্লান জীবন আমার
কী ব্যাকুল স্পর্শে, দেখি তোমার দু’চোখে ভালোবাসা
দিনান্তে অমর্ত্য কণ্ঠে শব্দহীন অপরূপ কলরব করে।
১৪.১২.৯৪

ভালোবাসার নিশ্বাস

এখন সকাল ক’টা বাজে? আলস্য-হেতু
ঘড়ি দেখতে অনাগ্রহী। এতক্ষণে নিশ্চয় তুমি বিছানার আরাম আর
রাতপোশাক ছেড়ে উঠে পড়েছ, মন দিয়েছ
সংসারের খুচরো কাজে, খবরের কাগজে
চোখ বুলিয়ে দেখে নিচ্ছ আমার কোনো নতুন কবিতা
ছাপা হলো কিনা। হয়তো
কাজ করা কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার ফাঁকে
মনে পড়ছে আমার মুখ অথবা ভাবছ
বোনের কথা, যে সংসার পেতেছে প্রবাসে। আর আমি
একটি কবিতার খসড়াকে
কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যত্নবান। লিখে-ফেলা
পংক্তি এবং না-লেখা পংক্তির মাঝখানে তুমি, শুধু তুমি।

দিনটি কেমন কাটবে, জানি না। তোমার সঙ্গে কি
দেখা হবে আজ? কোনো মৃত্যু-সংবাদ কি এসে পড়বে
হঠাৎ। আমার পরিচিত কোনো রাজনৈতিক কর্মীর
জেলে যাওয়ার খবর কি বিচলিত করবে আমাকে? জানি না।
সবরকম আশঙ্কার জাল ছিঁড়ে
তোমার চুম্বনের মাধুর্য, তোমার সঙ্গে মিলনের সৌরভ
আমার কবিতায় লগ্ন হবে
এবং আমি জেগে থাকব শীতদুপুরে, যখন তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।
তোমার গ্রীবায়, স্তনচূড়ায়
বইবে আমার ভালোবাসার নিশ্বাস।
১৫.১২.৯৪

 ভ্রমণ

ইচ্ছে ছিল, কোনো একদিন তোমার সঙ্গে
ভ্রমণ করব দূর বিদেশে কিংবা স্বদেশেরই কোনো
সুন্দর, এলাকায়, যেখানে কেউ চিনবে না আমাদের।
আমরা দু’জন বেপরোয়া ঘুরে বেড়াব
পথে পথে, দেখব নানা দৃশ্য, কোথাও বসে
দু’দণ্ড বিশ্রাম নেব, তুমি আমার দিকে তাকাবে
তোমার দু’টি সুন্দর কালো চোখ মেলে,
সেই দৃষ্টি হরণ করবে আমার সকল ক্লান্তি আর আমাদের
অবাধ, অগাধ ভালোবাসায়
রঙিন হবে ক’দিনের সফর।

দূরের আকাশ আমাকে জানালো, শিগ্‌গিরই তুমি
বেরুবে বিদেশ ভ্রমণে। তোমার সঙ্গে
কেউ কেউ যাবে, যারা তোমার আপনজন। বিচ্ছেদের
দাঁত এখন থেকেই ছিঁড়তে শুরু করেছে আমার হৃৎপিণ্ড।
তুমি যখন বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উঠবে, তখন
তোমার সঙ্গে যাবে আমার দীর্ঘশ্বাস,
আমার অজস্র নিষ্ফল চুম্বন, ব্যর্থ আলিঙ্গন,
আমার ব্যাকুল-করুণ চেয়ে থাকা,
আমার নির্ঘুম ছটফটে রাত্রি আর
আমার কবিতার কতিপয় নাছোড় পংক্তি।

শুধু আমি যাব না, পড়ে থাকব
এই শহরে ধু ধু মরুভূমির মতো তুমিহীনতায়
এবং কয়েকটি না-লেখা কবিতার অস্পষ্ট ছায়ায়
শিয়রে আহত স্বপ্ন নিয়ে শুয়ে থাকব। আমার চোখে জমবে শিশির।
২০.১১.৯৪

ভয়ে-ভয়ে থাকি

আজকাল বড় বেশি ভয়ে-ভয়ে থাকি দিনরাত।
বয়স বেড়েছে বলে এই ভয় আমাকে কেবলি
তাড়িয়ে বেড়ায় না কি কুকুরের মতো? যে আমাকে
ভালোবাসে তার অভয়ের মুদ্রা ঈষৎ সান্ত্বনা।

ভয়ে-ভয়ে থাকি, যদি সহসা বধির হয়ে যাই,
তবে আমি শুনব না কুহুধ্বনি, মোৎসার্ট এবং বিটোভেন,
রবীন্দ্রনাথের গান, লালনের গীত, শিশুদের কলরব,
সবচেয়ে বেশি ভয়, শুনতে পাবো না তার সুমধুর কথা।

আমার দু’হাত যদি অকস্মাৎ ভীষণ অসাড়
হয়ে যায়, তবে আমি ছুঁতে পারব না গোলাপ কি
স্বর্ণচাঁপা, পারব না লিখতে কবিতা, ভয় পাই;
সবচেয়ে বেশি ভয়, পারব না করতে তাকে দৃঢ় আলিঙ্গন।

ভয়ে-ভয়ে থাকি, অসুস্থতাহেতু হঠাৎ আমার
পদদ্বয় যদি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, তবে সকালের রোদে,
গোধূলিবেলায় আকাশের নিচে হেঁটে যেতে ব্যর্থ হবো;
পারব না যেতে গুলবাগে, সবচেয়ে বেশি ভয়,
কখনো হবে না গাওয়া গুনগুনিয়ে, কবিতার পংক্তি
সৃষ্টির মাদকতায় আর তার উজ্জ্বল নিবাসে।

ভয়ে-ভয়ে থাকি, যদি জিহ্বা, ওষ্ঠ আমার নিঃসাড়
হয়ে পড়ে কোনোদিন, তাহলে খাদ্যের, পানীয়ের
কোনো স্বাদ আমি নিতে পারব না; সবচেয়ে বেশি
ভয়, তার মুখ চুম্বনের ক্ষণগুলো লুপ্ত হবে চিরতরে।
ভয়ে-ভয়ে থাকি নিত্য, আমার দু’চোখে যদি জ্যোতি
কখনো হারিয়ে ফেলে, তবে বই কিংবা চিঠিপত্র
পারব না পড়তে কিছুই। দৃশ্যাবলি মুছে যাবে
দৃষ্টি থেকে; সবচেয়ে বেশি ভয়, তাকে আর দেখতে পাবো না।
১৫.১২.৯৪

মেঘমানবী

মেঘের জমিনে একটি বাড়ি বানাবার কথা
ভাবছিল সে। চাঁদের পাথর আর
রৌদ্রের গাঁথুনি দিয়ে বাংলো ধরনের বসতবাড়ি
গড়ার খেয়াল তাকে অনেক দূর নিয়ে যায়।
সকাল সন্ধ্যা শাদা মেঘ আর কালো মেঘের
আহ্বান তার রক্তে আনে দোলা, তন্ময়তায় সে
রচনা করে মেঘসঙ্গীত এবং
সেই মেঘসঙ্গীতের মূর্ছনা জন্ম দেয়
এক অপরূপ মেঘ মানবীকে, যার চোখের
মেঘাঞ্জনে অনন্তের রূপটান। সে ভাবে,
মেঘ-জমিনে তৈরি বাংলায় সেই প্রতিমাপ্রতিম
নারীকে বসবাসের আমন্ত্রণ জানাবে।
তার মনোভাবনা টের পেয়ে মেঘমানবী
একবার মেঘের আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়,
তারপর বলে মেঘলীন স্বরে-‘এখানে
আমি তো অতিথি নই কোনো, নিশ্চিত এ আমার জন্মভূমি।
এই মেঘমগ্ন গাছপালাময় বাংলোয় আমরা
ভালোবাসব পরস্পর
এবং সেই ভালোবাসার মোহনতাপে
তোমার হৃদয় থেকে উৎসারিত হবে মেঘমানুষের কবিতা’।

কিছুই না বলে সে, শব্দের রূপকার, তাকিয়ে থাকে
মেঘমানবীর দিকে, তার চোখে হঠাৎ
আগুন আর গলতে থাকে মেঘজমিনের বাড়ি,
মেঘমানবী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে।
২২.১১.৯৪

মোমবাতি

সকাল না কি সন্ধ্যা, দুপুর না রাতদুপুর,
বলতে পারব না। কখনো কখনো এ রকম হয়, সময়ের
বাইরে আমাদের অবস্থান। মন
আমাদের পার্থিবতার অন্তরালে নিয়ে যায়।
কখনো স্বপ্ন আমরা রচনা করি, কখনো-বা
স্বপ্ন আমাদের নির্মাণ করে-স্বপ্নময়তায় বাস্তবতাকে
অগ্রাহ্য করে পরিযায়ী পাখি আমরা
কাল থেকে কালান্তরে। তখন
ভীষণ তোলপাড় আমার ভেতর, হৃদয়
ঝড়-লাঞ্ছিত পাখির নীড়ের মতো। বিপর্যস্ত খড়কুটোগুলোকে
বিন্যস্ত করতে চেষ্টাশীল আমি, ঠিক সেই মুহূর্তেই
ভেসে এলো তোমার কণ্ঠস্বর।

আমার প্রতিক্ষণের নির্ভর তোমার জ্যোৎস্নামদির কণ্ঠস্বর;
আমি সেই অগোছালো পাখির নীড়ের কথা বলার
পর তুমি বললে, ‘এখন থেকে শুধু জ্বলবে তুমি,
যেমন আমি জ্বলছি’। তোমার কণ্ঠস্বরে
বেদনার গাঢ় আদিবাসী উচ্চারণ ছিল, ছিল
অপার সহিষ্ণুতার পরাগ-কেশর।

কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহূর্তের পর
তুমি বললে, ‘অনেক আগে থেকেই
মোমবাতির আলো দেখতে আমার ভালো লাগে।
কখনো-কখনো ঘরের ইলেকট্রিক আলো
নিভিয়ে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে থেকেছি
নিষ্কম্প একাগ্রতায়। দু’চোখ ভরে দেখেছি নিঃসঙ্গ
মোমবাতির একটু একটু করে জ্বলে যাওয়া, গলে যাওয়া;
সে এক নান্দনিক অভিজ্ঞতা আমার।
এখন আমি কালের শামাদানে নিজেই সেই একাকিনী মোমবাতি-
প্রতি পলে জ্বলছি, গলে গলে পড়ছি তপ্ত অশ্রুকণার মতো’।

তোমার এই বেদনার্ত কথাগুচ্ছের পিঠে কোনো কথা
না চাপিয়ে তাকিয়ে থাকি
শূন্যতায় বসবাসকারী অলীক জোনাকিদের দিকে
আর তোমার শব্দাবলিকে স্বার্থপরের মতো
কবিতার বীজ হিসেবে সঞ্চয় করি আমার
নিজস্ব গোলায় গভীর তন্ময়তায়।
৭.১০.৯৪

যদি তোমার পাশে থাকতাম

কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আর মুয়াজ্জিনের সুরেলা আজান
ছুঁয়ে যাচ্ছে সুবে সাদিকের ঘুমন্ত শহরকে
নিদ্রাতুর শহরের ঠোঁট ঈষৎ খুলে যায়
দু’টি ফুল ফোটার মতো। এখন তুমি ঘুমিয়ে আছো।

কখন তোমার শরীর থেকে ঘুমের পাপড়িগুলো
খসে পড়বে, জানি না। ভোরবেলার
ঘুমভাঙা মুহূর্তেই কি তোমার মনে পড়বে
এই আমাকে, যে এখন বসে আছে লেখার টেবিলে,
যে তোমার নিদ্রাকে অনুভব করতে চাইছে
শিরায় শিরায়, যে তোমার শরীরের প্রতিটি ভঙ্গি
আবৃত্তি করছে এই মুহূর্তে, যার মগজে
গুনগুনিয়ে উঠছে না-লেখা কবিতার সোনালি ভ্রমর।

যদি এখন আমি তোমার পাশে থাকতে পারতাম, আমার
উৎসুক আঙুলেরা ঘুমের হ্রদ থেকে তোমাকে
টেনে তুলতো নিপুণ জেলের মতো; আমার ওষ্ঠ তোমার ঠোঁটের
স্বপ্নমদির তীরে ফেলতো নোঙর। আমার দৃষ্টি
বিস্ময়ের রেখা এঁকে দিতো তোমার সারা শরীরে,
যেমন কোনো শ্রমনষ্ঠ কৃষক
তার জমিতে দাগ কাটে ফসল ফলানোর
স্বপ্নে বিভোর। তোমার ঘুমে টোল পড়তেই
আমাকে নিবিড় জড়িয়ে ধরতে তুমি। তখন তোমার সত্তা
হাসিতে উদ্ভাসিত, তোমার গোলাপি উপকূলে জেগে-ওঠার
উচ্ছ্বসিত ফেনা, সেই ফেনায় মুখ ধুয়ে
আমি সম্মানিত, সুখী এবং ঋণী হবো নতুন করে।

যদি তোমার পাশে থাকতে পারতাম
এখন এই সোনালি ঘণ্টার ধ্বনিময় প্রহরে,
তুমি আমার বুকে মাথা গুঁজে বলতে, ‘কী? কী? কী?’
নিরুত্তর আমি শুধু তাকিয়ে থাকতাম,
তোমার চিবুক তুলে ধরে নতুন কিছু
আবিষ্কারের আনন্দে অভিভূত হতাম, যেমন
স্বর্গোদ্যানের কোনো বৃক্ষছায়ায় শুয়ে আদম
হাওয়ার দিকে দৃষ্টি মেলে বিস্ময়-বিহ্বল, প্রশ্নাকুল।
১৫.১২.৯৪

 যদি ফিরে আসি

মা, তোমার আর আমার মধ্যে পনের বছরের
ব্যবধান। তোমার মুখের রঙিন সূর্যাস্ত আমাকে
বলছে আমাদের দূরত্ব আর
নৈকট্যের দীর্ঘ কাহিনী-বলেছে,
কী করে তুমি আমাকে স্নেহের সরোবরে
নাইয়েছ প্রতিদিন। তোমার দোয়ার
পাপড়িগুলো নীরবে
ঝরেছে আমার ওপর।
তোমার শুভকামনা দিয়ে আমাকে
আগলে রেখেছ প্রতি মুহূর্তে।

তোমার কাছেই শিখেছি ঔদার্য, মানবপ্রীতি,
তুমি আমাকে দাঁড়াতে
শিখিয়েছ সত্যের সূর্যোদয়ের সামনে।
তোমার কাছে চিরঋণী আমি,
এই উচ্চারণ এমন তুচ্ছ যে,
তোমাকে বলিও নি কোনোদিন।

মা, সেদিন খর দুপুরে, তুমি আমাকে
ব্যাকুল কণ্ঠে বললে, ‘তুমি যাবে না
আর কোনো জনসভায়
অথবা মিছিল। চাই না
তুমি রক্ত-জবার মতো কথা বলো কোথাও।
তোমার কণ্ঠনালি ওরা চেপে ধরতে চায়,
তা-কি অজানা তোমার?
না, তুমি কোথাও যাবে না আর।
আমার নির্দেশ সবার ওপর জেনো।

মা, তোমার নির্দেশ হিতকথার মতো
অবশ্য মান্য। তোমার বারণকে
সম্মান জানাতে গিয়ে
ভুল করেছিলাম একদা।

এবার আমি তোমার বারণ শুনব না, মা,
কারণ এখন তোমার আমার,
আমাদের পূর্বপুরুষ আর উত্তরপুরুষদের
সবার মা, জননী জন্মুভূমি আমাকে
ডাক দিয়েছে এই সকালে।
দ্যাখো নিরস্ত্র আমি সকল পিছুটান ছেড়ে
খোলা পথে পা বাড়ালাম।

দানব দলনে সফল হয়ে
কপালে জয়টিকা নিয়ে
যদি ফিরে আসি, তখন
আমাকে ক্ষমার আলোয় ধুইয়ে দিয়ে
বুকে টেনে নিও, মা।
২৭.৭.৯৪

 যাচ্ছিলাম ডলফিন কোচে

যাচ্ছিলাম ডলফিন চ্যালেঞ্জার কোচে
ভোরবেলা চট্রগ্রামে। আবীরের পোচে
উদ্‌ভাসিত চতুর্দিক। ‘বেশ তো মজার লোক তুমি,
আমাকে ফেলেই যাচ্ছ চলে চুপিসারে? মনোভূমি
ঈষৎ চমকে ওঠে চেনা কণ্ঠস্বর শুনে। পার্শ্ববর্তী সিটে
বসে আছ, গায়ে ফিরোজা রঙের শাড়ি, মিটমিটে
নক্ষত্রপ্রতিম হাসি পাতলা ঠোঁটে। কী করে বিশ্বাস করি, বলো,
প্রকৃত তুমিই ঝলোমলো
সত্তা নিয়ে অসহায় এ কবির যাত্রাসঙ্গী? তোমার সোনালি
হাতে হাত রখি, এক ফালি
আপেল বাড়িয়ে দিলে আমার উদ্দেশে।
হঠাৎ একটি পাখি এসে
তোমাকেই ছুঁতে চায় চঞ্চু কিংবা পাখা
দিয়ে, বুঝি অজ্ঞাত আক্রোশে ছিন্ন করবে আমাদের বসে থাকা।

চলেছি আমরা কোচে পাশাপাশি বসে কী নিবিড়;
যেন নেই ভিড়,
নেই অন্য কোনো প্রাণী সমুখে, পিছনে,
প্রখর আবেগে করি চুম্বন তোমার মুখ অবিশ্বাস্য, কোমল নির্জনে।
সীতাকুণ্ডে প্রবশ করেই দেখি, হায়,
তুমি নেই, হাওয়ায় মিলিয়ে গ্যাছো, তুমিহীনতায়
বসে থাকি; শুধু চেনা পারফিউমের ঘ্রাণ ভাসে;
ভাবি, এই পর্যটন নজিরবিহীন ভ্রমণের ইতিহাসে।
১৫.৬.৯৪

যে-পথে ঝলসে উঠবে

এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি মাটির উপর,
এই মাটি কি আমার?
যে শ্যামল ভূখণ্ডকে মাতৃভূমি বলে জেনেছি,
একি আমারই দেশ?
তাহলে কেন এমন বেগানা মনে হচ্ছে একে?
কেন এরকম বিকৃত এর মুখ কেন? কেন?
কারা যেন ত্র্যাসিড ছুঁড়ে দিয়েছে রূপসী বাংলার মুখে,
আমার নিকট থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে স্বদেশ।

অনেকগুলো নোংরা, লোমশ হাত চেপে ধরেছে
গায়ক পাখির কণ্ঠ, যাতে সে চরাচরে
ছড়াতে না পারে প্রাণজাগানো, কাল মাতানো সুর।
অনেকগুলো সাড়াশির মতো হাত
ফুল না ফুটতেই চটকে দিচ্ছে মুকুল সমুদয়।
যাকে আমি জননী জন্মভূমি বলে ডাকি
আমার মর্মমূল থেকে,
সে নিশ্চুপ দেখছে সুন্দরের খুন-হওয়া,
যেন এতে সায় আছে তার।

না, বিলাপের ধ্বনিতে আমি ভারি করব না
তোমার বাতাস, বিষাদের কুয়াশা
ছড়িয়ে দেব না তোমার নিশ্বাসে। আজ এই তাণ্ডবে
তোমাকে প্রশ্ন করতে চাই, হে স্বদেশ আমার,
রক্ত-সমুদ্র থেকে তোমাকে পদ্মের মতো তুলে এনেছিল
যারা গভীর ভালোবাসায়,
কেন তাদের তুমি ঠেলে দিচ্ছ কারাকুঠুরিতে?
কেন তাদের মুখ ঘষটে দিচ্ছ পথের ধুলায়, কাঁকরে?
কেন কণ্ঠ রোধ করতে মরীয়া হয়ে উঠেছ তাদের,
যারা নান্দীপাঠ করেছিল তোমার মুক্তির?

হে স্বদেশ, তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে
জেরা করব, তেমন স্পর্ধা আমার নেই, আমার মনের ভেতর
শুধু কিছু সওয়াল ঝিকিয়ে উঠছে বিষাক্ত
চাবুকের মতো। যারা তোমাকে ভ্রূণাবস্থায়
হত্যা করতে চেয়েছিল, তোমার শ্যামল শরীরকে
অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছিল, সেই দানবদের কোন্‌ মোহে
এগিয়ে দিচ্ছ সিংহাসনের দিকে?
কেন ক্লান্ত বাঈজির মতো ক্ষতবিক্ষত পায়ে অবিরত
ঘুঙুর বাজিয়ে নেচে চলেছ
মানবতা-বিরোধী বকধার্মিকদের উদ্ভট ইঙ্গিতে?

পাখির গান, ফুলের উন্মীলন আর
প্রেমের পদাবলি যাদের আতঙ্ক,
যাদের কপালে মুদ্রিত হিংস্রতার, পৈশাচিকতার উক্তি,
তাদের তুমি সত্যি কি চাও
তোমার ত্রিসীমানায়? যারা তোমার স্বপ্ন দেখেছে দীর্ঘকাল,
তোমার উদ্দেশে অর্পণ করেছে রক্তাঞ্জলি,
তোমার গলায় দুলিয়ে দিয়েছে জয়মাল্য শিশিরভেজা চোখে,
তারা কি পাবে তোমার উপেক্ষা আর আক্রোশ?
এই প্রশ্নের সুদত্তর তোমাকে আজ দিতেই হবে স্বদেশ।
তুমি দোদুল্যমান চিত্তে মুখ বুজে
আড়চোখে তাকাবে শুধু, তোমার এই ভঙ্গি
আমরা কস্মিনকালেও মেনে নেব না।

স্বদেশ আমার, তোমার শারদ আকাশে যখন
কাশফুলের মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়,
তোমার আষাঢ়ে যখন ফোটে প্রথম কদম ফুল,
তোমার ফাল্গুনে যখন পলাশ ছড়ায় আবীর,
তোমার হেমন্ত গোধূলিতে যখন বাজে, গরুর গলার ঘন্টি,
যখন গাছের সবুজ পাতা থেকে ঝরে শিশির,
তখন আনন্দে আমার দু’চোখ হয় বাষ্পাকুল,
হৃদয়ে বাজতে থাকে বাউলের দোতারা।

প্রাণের স্বদেশ, আমার এই আনন্দকে তুমি
কী করে সোপর্দ করবে কসাইখানায়? পারবে কি?
আমরা যারা বিরূপ ঋতুতেও তোমার স্তব করি,
আমরা প্রতীক্ষা করছি সেই ভবিষ্যতের জন্যে,
যে বর্বরতা-বিরোধী, করুণাপ্লুত ফেরেশতার মতো অপেক্ষমান।
সঙ্কটের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অষ্টপ্রহর
আমরা দৃষ্টি বিছিয়ে রেখেছি সে-পথে,
যেখানে দানবদের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠবে তোমার সংহার-মূর্তি।
১৪.৬.৯৪

 রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে

রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে হঠাৎ ঝিনুকের আবরণ থেকে
বেরিয়ে এলো যমজ মুক্তো-দু’টি আশ্চর্য দিন
আমার ধূসরতাকে
ঝকঝকে শ্যামলিমায় রূপান্তরিত করে
এখন স্মৃতিতে সঞ্চরণশীল। প্রাত্যহিকতার
দাসত্বের শেকল গেল খসে,
যখন অনেকদিন পর তোমাকে
আবার দেখলাম
সম্মেলন প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের কবিতা
আর গানের ভিতর দিয়ে।

অনেক মুখের আড়ালে তোমার মুখ
মঙ্গল প্রদীপ যেন, আমি তার আলোয়
অবগাহন প্রার্থী। একটু কেবল কাছে বসতে চাওয়া
মুকুলিত হয়ে ঝরে যায় অলক্ষ্যে। আমাদের
দু’জনের মধ্যে সুদূরতা আক্রোশে
ফুঁসতে থাকে; বাসনার ঢেউয়ের আঘাতে
অবসন্ন আমি, মাঝে মাঝে ক্ষুধিত গাংচিল
সন্ধ্যার ঢেউয়ে ডানা ঈষৎ ভিজিয়ে উড়তে থাকে চৌদিকে।
আমি আমার সকল স্বপ্ন, সকল ব্যাকুলতা,
আমার অবরুদ্ধ অভিমান,
আমার কবিতার কাতরতা
তোমার চোখে, অধরে, বুকে, হাতে
অর্পণ করতে চাইলাম নতুন করে। এমন
ভিড়ে, কোলাহলে আমার নির্জন নৈবেদ্য
তোমাকে ছুঁতে পারলো কি না,
কি করে বুঝবো?আমার যন্ত্রণা
আড়াল করে বসে রইলাম এক কোণে। ভেবেছিলাম,
এই সুরেলা সম্মেলনে আমাদের দু’জনকে
নিয়ে যাবে অনুপম সুরতীর্থে, অথচ
কেমন বেসুরো, কর্কশ হয়ে যায় সন্ধ্যার মেঘমালা।
শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, খোলা আকাশ,
বকুলতলা আমাদের কিছুক্ষণের জন্য
কাছে এনে দূরে ঠেলে দেয় আবার। খুচরো, কৃপণ
আলাপের আড়ালে মাথা কোটে হৃদয়ের গভীর ধ্বনি।

যাবার বেলায় কিছু অপ্রয়োজনীয়, নিষ্ঠুর
অক্ষর উপহার দিয়ে হঠাৎ ছুটে এলে তুমি
মোটরকারের কাছে, যেখানে বসেছিলাম নিস্তব্ধতায়
নিঝুম আসন্ন বিচ্ছেদে কাতর। তুমি মোটরকারের
জানালার কাচে হাত রাখলে, আমিও
আমার হাত স্থাপন করি একই জায়গায় ওপার থেকে।
বৈরী কাচ দু’টি মিলন-তৃষিত হাতের
স্পর্শের শক্রতা সেধে অনড়। তোমার দু’চোখ
শ্রাবণের আকাশ, কুয়াশাচ্ছন্ন; আমাদের অসহায় নিঃসঙ্গতা
বুঝিবা তারাবিহীন নিশীথকে বলতে চাইলো, ‘তবু মনে রেখো’।

শতাব্দী এবং একটি পাখি

শতাব্দী শারদ ভোরে বারান্দায় নিজের মনের সঙ্গে
খেলছিল কী মধুর খেলা। বাস্তবিক
সে নিজেই জানে না কিছুই
তার মনো-ক্রীড়ার ব্যাকরণ।

সোফাটায় এলিয়ে শরীর বসে থাকে
চুপচাপ, সোনালি পায়ের কাছে লুটোপুটি খায়
বিশ্বের খবর, দ্যাখে বারান্দায় কাছের গাছের
ডালে এক হলুদ রঙের পাখি দোল
খেয়ে ভোরটিকে সুরময় করে তোলে
অজানা আনন্দে। শতাব্দীর হৃদয়ের তন্ত্রীমালা
বেজে ওঠে; চকিতে সে পাখিটিকে দিকে
চোখ রেখে প্রেশ্ন করে, ‘কবি কি আসবে আজ ভোরে?’

পাখি বুঝি শতাব্দীর ব্যাকুলতা বুঝে নেয় নিজের রীতিতে,
বলে সুর তোলে-
‘এই তো এসেছি আমি তোমার কবির দূর হয়ে। হায় মেয়ে,
তুমি তো জানো না, কাল সারারাত কবি
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিয়েছে নিদ্রাহীন। কাঁটাবনে
ঘুরে ঘুরে আহত হয়েছে তার শরীর, হৃদয়। নিশীথের
তৃতীয় প্রহরে, শোনো শতাব্দী, তোমার সুরক্ষিত
নিবাসের চারপাশে দীর্ঘশ্বাস বিছিয়ে দিয়েছে
কবি, তুমি ঘুমের নরম মেঘদলে ভাসমান
সে সময়। এ সকালে একবার কাছে ডেকে নাও, আসবে সে
ছুটে নগ্ন পায়ে, রুক্ষ বেশে, উস্‌কো-খুস্‌কো চুলে,
তুমি ওকে কোলে মাথা খানিক রাখতে দিও, হে সুন্দরীতমা।

‘তুমি তো জানোই পাখি,’ শতাব্দীর কণ্ঠস্বর ছোঁয়
হলুদ পাখিকে, আমি আমার প্রতিটি
মুহূর্ত সাজিয়ে রাখি কবির উদ্দেশে, আমি তার
পথ চেয়ে থাকি, তার জন্যে এ হৃদয়ে
সময় কি অসময় নেই, কিন্তু বড়ই নির্দয়

জগৎ-সংসার; করাতের মতো কেটে ফেলে
প্রকৃত মিলন বেলা। ইচ্ছে মতো ডেকে নেব কাছে,
কী করে সঞ্চয় করি সে সাহস, হে পক্ষী, তুমিই বলে দাও!
মাঝে-মধ্যে কী-যে হয়, কেউটের মতো
এক প্রশ্ন ফণা তোলে-কবি কি আমাকে প্রকৃতই
ভালোবাসে? না কি
এ এক মোহন খেলা ওর? হে পাখি জবাব দাও’।

হল্‌দে পাখি শতাব্দীর কানে কানে বলে-
‘ভালোবাসা বলে কাকে, তা আমার অজানা, অথচ
ঠিক জানি, কবির রক্তের প্রতি ফোঁটা
কেবলি তোমারই নাম করে উচ্চারণ। আরো বলি,
এই যে তোমাকে সাত সকালে দেখছি আমি, তা-ও
কবিকে করবে ঈর্ষাতুর। আমি এই মাত্র দেখে
এসেছি, সে তোমাকে ভেবেই অন্তর্গত
যন্ত্রণাকে কবিতায় করছে তর্জমা।
২১.৯.৯৪

শতাব্দীর জন্যে

শতাব্দী হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে-
আচ্ছা ধরো, যদি তোমার হাত থেকে এখন
কবিতার বই ছিনিয়ে নিই,
কী করবে তুমি? তোমার মেজাজ
চৈত্রের দুপুর হয়ে যাবে নিশ্চয়। এই দ্যাখো,
কেড়ে নিলাম তোমার সাধের আধুনিক বাংলা কবিতা।

মাথা পেছনে হেলিয়ে বলি, যখন
খোদ কবিতাই আলিঙ্গনে বেঁধেছে আমাকে,
তখন কয়েকটি মুদ্রিত অক্ষর নিয়ে
কী করব আমি? অক্ষর সমুদয় উড়ে যাক মেঘমালায়।

আচ্ছা ধরো, শতাব্দী এবার আমার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে বলে, সমাজতন্ত্র পুরাণের পাখির মতো
ভস্মরাশি থেমে পুনরায় জ্বলজ্বলে রূপে
জেগে উঠবে কি না, এমন ভাবনায় মগ্ন তুমি আর
ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার হাতে আমি
একটি আপেল দিয়ে বললাম, এসো আমরা দু’জন
দু’দণ্ড গল্প করি, তখন কী করবে তুমি? খুব রেগে যাবে,
তাই না? ম্লান করে দেবে আমার মুখ?

না, তেমন কিছুই হবে না, শতাব্দী। তোমার আপেলের
স্বাদ নিতে-নিতে কথা বলব ওই গহন দু’টি
চোখের দিকে তাকিয়ে, বলব লতাগুল্ম, পাখি,
নদী, নৌকোর গলুই, শস্যক্ষেত, লালনের আরশিনগর,
আর গেরুয়া বসনধারী বাউলের কথা, বলব
আমাদের ভালোবাসার কথা।

শতাব্দীর কণ্ঠ ঝরায় অপরূপ ধ্বনি-
আচ্ছা কবি, ধরা যাক, তুমি প্রস্তুত হচ্ছো
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী মিছিলে
যোগ দেওয়ার জন্যে, আর সেই মুহূর্তে
আমি বললাম, কিছুতেই তোমাকে
যেতে দেবো ন। বলতে হবে, তখন কী করবে তুমি?

শোনো শতাব্দী, যদি তেমন কিছু ঘটে, তাহলে আমি
শুনব না তোমার বারণ। বরং তোমার হিরন্ময় হাত ধরে
যুগলবন্দি দীপক রাগ হয়ে পা বাড়াব
খোলা পথে, নিশ্চিত মিশে যাব ভাস্বর জনস্রোতে।

শহীদ জননীকে নিবেদিত পংক্তিমালা

বৃষ্টিভেজা গোধূলিতে তোমার শোকমিছিলে
এসে মনে হলো, কেন আমরা
এমন বিহ্বল শোকে? কেন আমাদের চোখের পাতা
ভিজে উঠছে বার বার?

তুমি দুঃসহ যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েও
মৃত্যুর নিষ্ঠুরতার কথা ভাবোনি,
নিস্তব্ধ কণ্ঠে জীবনের স্তব
রচনা করেছ তন্দ্রাচ্ছন্নতায়।
জীবন এবং মৃত্যুর বিবাদে তুমি বিপন্ন এই বদ্বীপে
ফুল ফোটানো আর
সুর জাগানোর উদ্যোগ নিয়েছ,
প্রাণের স্বদেশ
তোমার চৈতন্যের কুয়াশাময় প্রবাহে
দীপের মতো ভেসেছে সারাক্ষণ।

এদেশের প্রতিটি গোলাপ উচ্চারণ করে
তোমার নাম,
প্রতিটি গাছের সবুজ পাতা, লতাগুল্ম
আবৃত্তি করে তোমার জীবন;
প্রত্যে সুকণ্ঠ পাখি তোমার নামের গান ছড়িয়ে দেয়
খোলা রাস্তায়,
মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে, নিঃস্ব বস্তিতে।
খরগোশের লাল বোতামের মতো চোখে
কাঁপে তোমার নাম।
তোমার দিগন্ত-কাঁপানো আন্দোলনের গাথা
বাঙ্ময় হয় প্রতিটি নদীর উৎসমুখে,
পাহাড়ি কুটিরের বিষণ্নতায়,
বিপন্ন মানুষের আর্তিতে।
তোমার নাম আমাদের হৃৎস্পন্দন,
আমাদের আক্রান্ত অতীতের
ইতিহাস, আমাদের আহত গৌরবের
সোনালি দুপুর,
আমাদের মৈত্রীর পূর্ণিমা-রাত।

যে মর্কটেরা তোমার নাম
কাদায় ফেলে কলুষিত করে,
ওরা এই বাংলার কেউ নয়।
বাংলার নিসর্গ ধিক্কারের ঝংকারে
ওদের অশ্লীলতাকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে,
ওদের কুৎসিত মুখে
চুনকালি মেখে দিচ্ছে প্রগতির নতুন ইতিহাস,
যার বুনিয়াদ নির্মিত তোমারই হাতে,
আমরাও হাত লাগিয়েছি সেই কাজে।

এই তিমিরাবৃত প্রহরে দেখতে পেলাম
তোমার উত্তোলিত হাতে
নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে ফেরারি বসন্ত
আর আমাদের ভবিষ্যৎ।

 সুপ্রভাত আর শুভ্ররাত্রি

প্রত্যহ তোমার কণ্ঠে বাজে সুপ্রভাত
আর শুভরাত্রি।
যখন নিবিড় বলো তুমি সুপ্রভাত,
আমার চৌদিকে এক ঝাঁক পাখি জুড়ে দেয় নাচ,
বয়ে যায় সুরের রূপালি ঝর্না, ফুল ফোটে। যখন তোমার
কণ্ঠে সুপ্রভাত শুনি, আমার হৃদয়
উন্মীলিত পদ্ম হয় শূন্যতায়; দেখি, স্নানার্থিণী বনদেবী
ভোরের আবীর মেখে সমস্ত শরীরে
আবরণ ছেড়ে ঘন ঝোপে নেমেছেন জলে, ভবিষ্যৎ হাসে
নির্জন রাস্তার মোড়ে একাকী দাঁড়িয়ে
এবং দিঘির ঘাটে অষ্টাদশী ভাসায় কলস
ঢেউ তুলে, আকাশে পায়রাগুলো শান্তির শিবির গড়ে তোলে।

যখন তোমার কণ্ঠে বাজে শুভরাত্রি, মনে হয়-
হঠাৎ গুণীর তানে ছায়া নেমে আসে, বেদনার
জন্ম হয়, যেন তুমি চলে যাচ্ছ দূরে,
আমার ব্যাকুল হাত তোমার সোনালি হাত থেকে,
ওষ্ঠ ঠোঁট থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে; তুমি
শুভরাত্রি বললেই আমার কবিতা খাতা থেকে অবিরল
ঝরে অশ্রুজন নিশীথের করতলে, দুব্বো ঘাসে। চোখে পড়ে,
শূন্য নৌকো এক কম্পমান ঢেউয়ে ঢেউয়ে।

প্রত্যহ তোমার কণ্ঠে বাজে সুপ্রভাত, শুভরাত্রি আর এই
শব্দ যুগলের মাঝে দুলছে দোয়েল হয়ে আমার জীবন।
৫.৬.৯৪

সেই ছায়াবৃতা

যেদিন তোমাকে দেখি চারতারা হোটেলের
লবির সোফায় এক গোধূলি বেলা,
নিমেষে আমার বুকের মধ্যে ক্যামেলিয়ার জাগরণ,
আমার করোটির ভেতর কোকিলের কুহু ডাক, আমাকে ঘিরে
নক্ষত্রের নাচ, সরোবরের রূপোলি জল
আমার হৃদয়ের তুন্তুজালে শিহরণ। সৌন্দর্যের সজীব স্থাপত্য তুমি।

কী করে যে কাঁটাতারের বেড়া আমি
টপ্‌কে প্রবেশ করলাম তোমার মোহন উদ্যানে,
নিজেই জানি না। তোমার চোখের অতলতায়
স্নান করে আমার চেতনা এবং
দেখি, আমার সামনে তারার কাঁকরে গড়া পথ,
তোমার হৃদয় হাত বাড়াল আমার হৃদয়ের দিকে।
সেই পথ বেয়ে চলছি আমরা দু’জন। আমাদের
স্বাগত জানায় দু’ধারের সারি সারি প্রহরীপ্রতিম গাছ,
আমাদের ক্লান্তি ধুইয়ে রঙ বেরঙের পাখির গীতধারা,
দেবদূতদের পুষ্পবৃষ্টিতে স্নাত হই আমরা। তোমার
মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারি না
মুহূর্তের জন্যেও। কী এক জ্যোতি লতানো তোমার সত্তায়

বহু বছর আগে থেকেই ভাবনায় দেখে আসছিলাম
এক প্রতীক্ষারতা নারীকে,
যার পিঠে এক ঢাল দীঘল কালো রেশমি চুল। ছায়ায়
ডোবা ওর মুখ। দূর থেকে দেখা স্বপ্নের সেই নারীর

আবছা রূপ আমি ভেবেছি, খুঁজছি বহু বছর ধরে
খোলা রাস্তায়, পাকদণ্ডিতে, ঝর্নার ধারে, কুয়োতলায়,
শহরে ফ্ল্যাটে; তোমাকে প্রথম দেখেই মনে হলো-
এই নিঃসঙ্গ মুখ আমি খুঁজে বেড়িয়েছি জন্ম-জন্মান্তর।

তুমি এভাবে তাকালে আমার দিকে,
যেন তোমার দু’টি চোখ সেই বালিকা বয়স থেকে
অনলস আরাধান করে আসছে
আমার উপস্থিতির এবং আমি
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আসছি তোমারই ব্যাকুলতায়
বলয়ে, তোমারই সত্তার অমিয় ধারা পান করার জন্যে।

আমার স্বীকারোক্তি শোনো,
তোমাকে দেখার পর থেকেই সেই বহুকাল ধরে ভাবনার
ছায়ায় ডোবা স্মৃতিবিস্মৃতি ছড়ানো
দীঘল চুলের নারী বিদায় নিয়েছে আমার ভাবলোক থেকে
তাকে হারিয়ে আম বিষাদের চত্বরে ঘুমাই না;
কেননা সেই ছায়াবৃতা তোমার মধ্যেই পেয়েছে সম্পূর্ণতা।
১০.১০.৯৪

স্বর্ণচাপা

আবছা অন্ধকারে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম নির্জন
ব্যালকনিতে। ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান কি
এর চেয়ে সুন্দর ছিল? আকাশে চাঁদ ছিল না
তোমার আংটির হীরের মতো
জ্বলজ্বল করছিল একটি কি দু’টি তারা। তুমি দূরের
একটি গাছ দেখিয়ে কণ্ঠস্বরে
ঈষৎ আনন্দ খেলিয়ে বললে-
‘ঐ যে দেখছ সেটাই স্বর্ণচাঁপা গাছ’।

দ্বিজেন শর্মার মতো গাছগাছালি বিষয়ে
আমার জ্ঞান নেই। তাই, আবছা পুষ্পবিহীন
গাছের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট বললাম, ‘তাই নাকি?’
তুমি কিছুই না বলে দাঁড়িয়ে রইলে ব্যালকনিতে।
আমি সেই মুহূর্তে দেখছিলাম, আমার পাশেই
কী স্নিগ্ধ ফুটে আছে একরাশ স্বর্ণচাঁপা এবং
একটা চাপা সুঘ্রাণ বিলোচ্ছে,
যা তোমার একান্ত সত্তার সৌরভ।
৪.৬.৯৪

হংসমিথুন

যখন আমরা দু’জন মুখোমুখি বসে
ঘনিষ্ঠ কথোপকথনে মাতি,
ওদের খুব চোখ টাটায়
আর ওরা আমাদের হিংসুটে
কায়দায় বিচ্ছিন্ন করতে চায়,
যেমন দাঙ্গা পুলিশ
রাজনৈতিক কর্মীদের
অবস্থান-স্থল থেকে।

যখন তোমার মুখ চুম্বনের জন্যে
মুখ বাড়াই,
আমাদের মাঝখানে দাপটে
ওরা ঝুলিয়ে দেয় নিষেধাজ্ঞা,
যেমন স্বৈরাচারী শাসকচক্র
নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মানুষের মিলনমেলা।

যখন আমি বুকের ভেতর
একরাশ স্বর্ণচাঁপা নিয়ে তোমার দিকে
যাত্রা করি, তখন ওরা
শহরময় সান্ধ্য আইন জারি করে।

তবু আমাদের নিবিড় ভালোবাসা কখনো
রাজহাঁসের মতো
গ্রীবা উচিয়ে হাঁটে বাগানে, কখনো বা
নিষাদের নিষ্ঠুর দৃষ্টি উপেক্ষা করে
স্পন্দিত পাখার নির্মল সুর ঝরিয়ে
দূরের নীলিমায় উল্লসিত হংসমিথুন।
১১.৯.৯৪

হঠাৎ বৃষ্টি এলো

হঠাৎ আজ বিকেলে চারদিকে অন্ধকারে ডুবিয়ে
বৃষ্টি এলো। শত শত আরবি ঘোড়ার পদশব্দে মনে পড়ল তোমাকে
আর মনে এলো অনেক বছর আগেকার কথা।
তখন আমি কৈশোরের বেড়া-ডিঙানো যুবা এবং
আমার বাবা ছিলেন জীবিত। আমি কোনো কোনো বিকেলবেলা
বিছানায় গা এলিয়ে, হাতের তালুতে থুৎনি রেখে
বাঈজির ঘুঙুরের মদির আওয়াজের মতো
বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তাকিয়ে থাকতাম বাইরে। এই দৃশ্য
অসহ্য ছিল বাবার কাছে। বিরক্তির হুলে কাতর তিনি ভাবতেন-
তাঁর ছেলেটার মাথায় শ্রাবণের আকাশ আর
বৃষ্টির অজস্র বিপজ্জনক জুঁই ঢুকে পড়েছে। আজো আমি
বাবার বর্ষাকালীন চোখের আগুন ভুলতে পারিনি।
আজ অন্ধকারময়, সপসপে বিকেলে বৃষ্টিপাত দেখে যুগপৎ
আমার বাবার চোখের ফুলকি এবং
তোমার দৃষ্টির বিদ্যুৎ মনে পড়ল। আমার
প্রয়াত পিতা আজকের দৃশ্য থেকে তাড়াতাড়ি দূরে
সরে দাঁড়ালেন তোমাকে প্রধান ভূমিকা দান করে। এই উতল হাওয়ায়
এখন তুমি আমার একার, একাকিত্বের অধীশ্বরী।

বৃষ্টির অন্তরঙ্গ সুর শুনতে শুনতে দেখি এইমাত্র গোসল সেরে
তুমি এসে দাঁড়িয়েছ আমার
শয্যার পাশে, চুলের ভেজা সুগন্ধে আমি মাতাল,
তোমার চুলের ঝর্নাধারা আমার সারা মুখে আর তুমি
আমার মুখ চুম্বন করছ আমাকে মহিমার চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে। বৃষ্টি
গেছে থেমে; এখন ঘরে নীরবতা
আমজাদী সরোদের সুর। কোথাও তুমি নেই।
শীতল জলে গা ধুয়ে
তুমি আদৌ আসোনি আমার কাছে। এভাবে
আসবেও না কোনোদিন। আমাকে এই মুহূর্তে বৃষ্টিহীনতায়
শাসন করছে আমার বাবার বর্ষাকালীন চোখের আগুন;
জলজ অন্ধকারে একলা ঘরে আমি ভীষণ পুড়ে যাচ্ছি।
২৫.৫.৯৪

২৩ অক্টোবর, ১৯৯৪

আমার ধূসরতাকে বালুকণার মতো উড়িয়ে
তুমি বললে, ‘কাল তোমার জন্মদিন,
এই উপলক্ষে তোমাকে
কয়েকটি কথা লিখে পাঠাতে চাই। ভাবছি,
রবীন্দ্রনাথ থেকে চয়ন করব
পংক্তি, কী বলো? তোমার কণ্ঠস্বরে
আমার জন্মদিনের
সকাল ছিল, ছিল হৃৎস্পন্দনের প্রতিভাস।

“মিছেমিছি ‘সঞ্চয়িতা’-র কাছে” আমি জানাই,
“হাত পাতবে কেন? বরং নিজেই তুমি
লিখে ফেলো কিছু”। “কী সাধ্য আমার
তোমার উদ্দেশে রচনা করি পংক্তিমালা”-তুমি
এই বাক্য সাজাও এবং আমার জন্মদিন
নবীন যুবার মতো উৎসুক চোখ মেলে তাকায় তোমার দিকে।

তোমাকে বলি, “যদি তুমি একটি সাদা পাতার ঠোঁটে
কলমের ওষ্ঠ স্থাপন করো, তাহলে
একটি দোয়েল, কতিপয় প্রজাপতি
শূন্য পাতাটিকে ঘিরে উড়ে বেড়াবে,
কিছু কনকচাঁপা
বাড়িয়ে দেবে হাত। ওদের সমবায়ী সহযোগিতায়
তোমার প্রয়াসে প্রস্ফূটিত হবে ভালোবাসার
হৃৎকমল, শুভেচ্ছার অপরূপ পরিভাষা।

আমি তোমার মৃদু হাসি অনুভব করি
আমার সত্তার তন্তুজালে। আমার উপলব্ধিতে
তরঙ্গ তুলে তোমার জন্মদিন
আমার জন্মদিনকে সোনালি বনহংসীর মতো
অনুসরণ করে মানস সরোবরে,
যেখানে আমাদের অবিনশ্বর মিলনোৎসব।
২২.১০.৯৪

Exit mobile version