- বইয়ের নামঃ কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষরবৃত্তের টানে
এতই কি জাঁহাবাজ হ’তে পারে পায়ের তলার
মাটি, এত হিংস্র, যে রকম আসমান
যখন তখন চোখ রাঙায় এবং মনে হয়
এ রকম গাছপালা যারা শান্ত থাকে প্রায়শই
তারাও কেমন যেন মূল ছিঁড়ে ছুটে এসে আমাদের ঘাড়
মুচড়ে দেয়ার সাধ অন্তরে লালন করে, নদ
নদীও বিরূপ অতিশয়। এ রকম ভয়াবহ অন্ধকার
নামেনি কখনও চারদিক লুপ্ত ক’রে অর্থহীনতায় আর।
মানবের, বানবীর মুখচ্ছদ এই মতো পাথরস্বরূপ,
দেখিনি কখনও আগে। হাটে, মাঠে, ঘাটে
হেঁটে যায় যারা, যেন চলমান কিছু পুতুলের
নিষ্প্রাণ মিছিল!
অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি
আমাদের প্রিয় বাংলাভাষার প্রদীপ্ত কতিপয়
স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ বিছানার কিনারে দাঁড়িয়ে
আমাকে কী যেন বলবার অপেক্ষায়
রয়েছে অনেকক্ষণ থেকে। তাদের নির্দিষ্ট প্রতিনিধি
বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘আর কতকাল কবি তুমি
আমাদের কেবলই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ব্যবহার
করবে বলো তো? আমরা তো ব্যবহৃত হতে হতে ক্লান্ত
ক্লান্ত হ’য়ে ঝিমিয়ে পড়েছি, তা’কি বুঝতে পারো না
তুমি আজও? অক্ষরবৃত্তের মায়াজাল থেকে মুক্তি দাও কবি’।
নিরুত্তর আমি ভোরবেলা আপন টেবিলে ঝুঁকে
রাতের ঘটনা ভুলে অক্ষরবৃত্তেরই টানে ফের লিখে চলি।
১৬-১২-২০০২
অন্ধকার কাঁটা হয়ে বিঁধে
ভাবতেই পারিনি আমার মুখোমুখি বসবেন একজন
প্রবীণ সাধক আর বলবেন গাঢ়
কণ্ঠস্বরে কিছু গূঢ় অনুপম কথা। বিষণ্নতা
ছিল তাঁর বিদায়ী বক্তব্যে যার অর্থ বস্তুত পাইনি খুঁজে
বুঝি না আমাকে কেন অসংখ্য বাদুড় বার বার
চারদিকে থেকে
হামলা করতে আসে। ওদের ডানার
ঝাপ্টায় দু’চোখ থেকে রক্ত ঝরে যখন তখন।
কিছুতেই পারি না তাড়াতে হিংস্র এই প্রাণীদের; বহু দূরে
ছুটে যেতে চাই,
অথচ এমন ভারী হয়ে যায় পদযুগ,
পারি না নড়তে এক চুলও কিছুতেই। অন্ধকার কাঁটা হয়ে
ভীষণ বিঁধতে থাকে শরীরে আমার। অসহায়,
দিশহারা এই আমি নিজেকেই কামড়াতে থাকি।
যে মোহন বাগানের স্বপ্ন দেখে ঘর ছেড়ে পথে
বেরিয়ে পড়েছিলাম, তার
কোনও চিহ্ন নেই কোনও দিকে, শুধু ধুধু
শূন্যতা বিলাপ করে অবিরত শব্দহীনতায়।
এমন বিরান স্থান ছেড়ে অন্য কোনখানে যেতে
চাইলেও শুধু ঘুরে ফিরে
একই স্থানে থেকে যেতে হবে শাস্তিপ্রাপ্ত,
অসহায় বন্দীর মতোই, জানবো না কী আমার অপরাধ!
৬-১২-২০০৩
অপরাধ জানা নেই
কী আমার অপরাধ জানা নেই, অথচ কেন যে
খামোকাই ধ’রে বেঁধে আমাকে হাজির
করেছে এখানে কাঠগড়ায় হঠাৎ! পথে যেতে
মারিনি পকেট কারও, লাঠির আঘাতে কিংবা ঠাণ্ডা
মাথায় চালিয়ে ছোরা কাউকে করিনি খুন ঘরে
অথবা রাস্তার মোড়ে। কোনও ব্যাংক লুট করিনি কস্মিনকালে।
তবু মনে হয়, যেন কেউ কেউ খুব খাঁখাঁ দুপুরে অথবা
সন্ধ্যায় গলিতে অনুসরণ করছে
আমাকে নিশ্চুপ গোয়েন্দার মতো, যেন আমি কোনও
ধুরন্ধর, দাগী
আসামি, সবার চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি
ঘুরছি, ফিরছি সবখানে, বিলক্ষণ দিচ্ছি আড্ডা, সিগারেট
অথবা চুরুট ফুঁকে চলেছি বেদম কখনও-বা
একাকী নিজেরই সঙ্গে কথা বলি মুখ রেখে দেয়ালের দিকে।
কখনও কখনও মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি বুক-ভরা
কান্না নিয়ে, আচমকা কে যেন আমাকে
চুল ধ’রে দ্রুত টেনে হিঁচড়ে কোন্ সে অজানায়
নিয়ে যেতে চায়, কেঁদে উঠলে শাসায়
বেয়াড়া ভাষায়, আমি কোনওমতে দম বন্ধ রেখে
নরক যন্ত্রণা ভোগ করি; মনে হয়,
এলো বুঝি অন্তিম বিদায়ক্ষণ এই
জগতের শোরগোল থেকে অতিশয় অন্ধ চাপে!
কার ক্রীড়নক এই লোক?- আয়নার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে সওয়াল করি। উত্তর পাবো না খুঁজে কারও
কাছে, শুধু এক ব্যাকুলতা সত্তা জুড়ে
করবে বিরাজ। আমি শুধু ডানে বামে বারবার
তাকিয়ে খুঁজবো কেউ রহস্যের তটে ভেলা নিয়ে
অপেক্ষা করছে কি না পৌঁছে দিতে আমাকে কোথাও।
ইচ্ছে হয় চাঁদটিকে ছিঁড়ে আনি
যে যায় তোমাকে ছেড়ে দূরে, বহুদূরে, প্রকৃতই
সে কি চলে যায়। না, সে যায় না তোমাকে
ছেড়ে অন্য কোনও খানে। সে-তো
কখনো হঠাৎ ভোরবেলা সহস্র মাইল থেকে
তোমার শয্যার পাশে এসে
দাঁড়ায় প্রসন্ন মুখে এক লহমায়, স্মৃতিময় কথা বলে।
যদি বলো কাউকে এ-কথা, নিশ্চিত সে
গাঁজাখুরি গপ্প ভেবে হেসেই উড়িয়ে দেবে, জানি। এ-ঘটনা
বান্ধব মহলে রটে যাবে। কেউ কেউ
বলবে নিশ্চিত, “শোনও, শোনও, আমাদের
বন্ধুটির ভীষণ উর্বর মাথা, ওহে
বেজায় বিগড়ে গেছে। এক্ষুণি পাঠাও ওকে পাগলা গারদে।
কখনো, কখনো দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে, কখনো-বা মধ্যরাতে
তোমাকে জাগিয়ে তোলে ঘুম থেকে আর
শোনায় স্বপ্নিল সুরে কৈশোরের খেলার মাঠের
কাহিনী, তুমি কি ওকে ভর্ৎসান ক’রে
তক্ষুণি তাড়িয়ে দেবে বিরানায়? তোমার কি সেই
স্মৃতিকথা উপভোগ্য মনে হবে? অবশ্যই নয়।
ধরা যাক, যে যুবতী একদা আমাকে ভালবেসে
আমার যৌবনে দূর দেশে চলে গেছে, যদি সে নিমেষে এসে
দাঁড়িয়ে আমারই পাশে অপরূপ হাসি দেয় উপহার, তখন এ বান্দা
মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াবে কি তার পাশে? সে-তো
এসে পড়ে নিমেষেই মাঝে মধ্যে, করে না পরোয়া কারও, এই
এমন কি বয়সের ভারে জব্দ আমারও কখনো।
নিদ্রোহীন মাঝরাতে বস্তুত ছিলাম মগ্ন একটি ধূসর
কাব্যগ্রস্থ পাঠে; অকস্মাৎ কানে এলো
কার যেন গাঢ় কণ্ঠস্বর, “কেন তুমি নিজেকেই
দিচ্ছ ফাঁকি লুকোচুরি খেলায় এমন
মেতে উঠে? এই খেলা কারো কারো দিবাস্বপ্ন দিব্যি
সুখকর করে তোলে। না, হবে না যার স্বপ্নে তুমি মশগুল”।
ঈষৎ চমকে উঠি উটে, তবে ভীতি ব্যর্থ হয়
আমাকে ঘায়েল ক’রে জন্মন্ধ গুহায়
ঠেলে দিতে। হাতের ধূসর কাব্যগ্রন্থ বিছানার
এক পাশে রেখে উঠে পড়ি। মনে হলো, এখন আকাশ থেকে
চাঁদটিকে ছিঁড়ি এনে শহরকে শতগুণ আলোকিত ক’রে
অশুভ আন্ধার চিরতরে ঝেঁটিয়ে বিদায় ক’রে দিতে পারি।
১৭-১২-২০০৩
ইতিহাসের পাতা থেকে
এই যে তুমি, এই যে আমি
ঘুটঘুটি এই অন্ধকারে যাচ্ছি হেঁটে,
জানি না তো কোন্ বিপদে।
আমাদের এই কাফেলাটি কোথায় গেলে
স্বস্তি পাবে? শান্তি পাবে কোন্ ছায়াতে?
পৌঁছলে কোথায় ফুটবে হাসি সবার মুখে?
এখানো তো মাথায়, বুকে, সবার চোখে
ভয়-জাগানো দৃশ্যাবলি কামড়ে ধরে
ঐ তো ছুরি বসছে গলায়, নারীর শাড়ি
নরপশু হ্যাঁচকা টানে ফেলছে খুলে।
আর্তনাদে যাচ্ছে ফেটে সাঁঝের ছায়া,
গাছের সবুজ চোখে ঝরে লালচে পানি।
আমরা ক’জন কোন্ সে কালে ঘুটঘুটে এক
অন্ধকারে পেরুচ্ছিলাম বুনো রাস্তা?
আমাদের সেই কাফেলাটি কোন্ পশুদের
দংশনে, হায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো?
আখের এই আমরা সবাই অস্ত্র দিয়ে
বদলা নিয়ে তাড়িয়ে দিলাম পশুর পাল্কে।
১৭-০৯-২০০৩
এই রীতি রয়ে যাবে
প্রত্যুষের আলোছায়াময় কালে চোখ খুলে
তাকালেই কখনো কখনো
চেনা পরিবেশ কেমন যে বেয়াড়া বেগানা খুব
মনে হয়, বোঝানো যাবে না কিছুতেই।
চতুর্দিকে সাজানো, গোছানো আসবাব,
পড়ার টেবিল আর শেল্ফে রক্ষিত
সারি সারি বইপত্র, দেয়ালে ঝোলানো ছবি-এই
সব কিছু কেমন বেগানা মনে হয়।
যে-নারী আমার পাশে ঘুমে অচেতন, কে সে? তাকে
বেজায় অচেনা মনে হয়। এই আমি
বয়সের ভারে বড় অপদস্থ, সে-ও নয় চেনা সুনিশ্চিত
তার কাছে, অথচ দু’জন ক্রমাগত করে যাচ্ছি বসবাস।
এই যে রঙিন পাখি বহুদিন পর এসে বারান্দায় ব’সে
তাকাচ্ছে আমার দিকে, সে-কি এই
লোকটিকে প্রকৃত নিরীহ ভেবে নিরাপদ বোধ
করে বাস্তবিক? করে সম্ভবত, নইলে সে নিশ্চিত উধাও
হয়ে যেতো পাখা
ঝাপ্টিয়ে কে জানে কতদূর কোন্ শান্ত ঠিকানায়।
পাখিটির সুকোমল উপস্থিতি, আমার বিনীত
ঘরঘেঁষা ফুলের গাছের মৃদু নাচ আংশিক ভুলিয়ে দেয়
বিষাদের অন্ধকার। ঈষৎ আলোর মৃদু চুমো
আমাকে ফিরিয়ে আনে অন্ধকূপ থেকে সুগভীর নদীতীরে।
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে মহিমায় ভরপুর
রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে এসে
আলিঙ্গন করলো আমাকে, আমি সেই
কথা আর সুরে রূপান্তরে অন্য কেউ হয়ে যেন
নিমেষে আনন্দলোকে চলে যাই, ভেসে
বেড়াই মেঘের সঙ্গীরূপে।
আমার শয্যায় এখনো যে-নারী ঘুমে অচেতন,
এখনো কি সে অচেনা আমার, এখনো
যখন আঁধার থেকে আলোয় নন্দিত খুব আমি?
জীবন সঙ্গিনী সে আমার। তবু কেন একটি সোনালি হাত
এখনো আমার দিকে প্রায়শ এগিয়ে আসে আর
কখনো কখনো করে আলিঙ্গন দিব্যি অগোচরে?
অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষণ্নতা, আনন্দের আলোচ্ছেটা-
দু’টি হেঁটে যায় পাশাপাশি যমজ বোনের মতো
সকল ঋতুতে দু’টিকেই চুম্বন না
ক’রে বুকে না জড়িয়ে পৃথিবীর খোলা পথে সত্যি এগোবার
জো নেই-এ কথা বলে গেছেন অভিজ্ঞ গুণীজন যুগে যুগে,-
এই রীতি রয়ে যাবে যতদিন আসমানে চন্দ্র, সূর্য আছে।
১৯-১১-২০০৩
একজন ঈগলের কথা
বয়সের ভারে জব্দ একজন প্রবীণ ঈগল
গাছের চূড়ায় ব’সে ঝিমোতে ঝিমোতে মাঝে মাঝে
বড় কষ্টে আকাশের নীলে আলগোছে
তাকাচ্ছিলো। কয়েকটি শঙ্খচিল পাখায় ছড়িয়ে
আনন্দ সেখানে উড়ছিলো কাছে ধারে;
মনে হলো, কোথাও অজানা দূরে পৌঁছুনোর সাধ
জন্মেনি ওদের মনে কস্মিনকালেও। এভাবেই
প্রথামতো কাটছিলো দিনরাত পাখির সমাজে।
বয়সী, অসুস্থ ঈগলের মনে অকস্মাৎ কী-যে
ঢেউ খেলে গেলো,
সে তার দুর্বল দু’টি পাখাকে ঝাঁকুনি দিয়ে নীল
আকাশের দিকে মেলে ধরে
এবং মেঘের স্তরে স্তরে ভেসে যেতে থাকে, যেন
গুণীর কণ্ঠের সুললিত তান কোনো মশগুল দরবারে।
ক্রমাগত বেলা বাড়ে, রোদ্দুরের তাপে
ঈগলের ডানা
কেমন ঝলসে যেতে থাকে যেন, তবু পাখিটির
নিজ আস্তানায় ফিরে যাওয়ার তাগিদ
কাঁটা হয়ে বিঁধছে না ওকে। ওড়ার নেশায় তার
ডানা দু’টি বেজায় চঞ্চল, বড় বেশি উড্ডয়নপ্রিয় আজ।
আচানক কী-যে হলো, বুড়ো সেই উড়ন্ত ঈগল ঘুরে ঘুরে
প্রবীণ গাছের নীচে পড়ে যায়। বেশ কিছু পরে
নিষ্প্রাণ ঈগলটিকে পশু, পাখি পিঁপড়ে
ঠুকড়ে ঠুকড়ে, খুঁটে খুঁটে কী দ্রুত সাবাড় করে ফেলে।
সন্ধ্যায় প্রাচীন গাছে শোকের কুয়াশা জমে ওঠে
ব’লে মনে হয়, পক্ষীসমাজ নিস্তব্ধ অতিশয়,
এমনকি বুড়োসুড়ো গাছটি নুয়ে
পড়েছে নিষাদে যেন। বাতাসে কান্নার ছায়া দোলে।
কেন যেন মনে হলো কোত্থেকে প্রবীণ একজন
ঈগল উৎসুক ডানা দু’টি ঝাপটাতে ঝাপটাতে
জ্যোৎস্নাময় মেঘদলে অনুপম ছন্দে ঘুরে ঘুরে
একলা উড়তে থাকে। ওকে যেন খুব চেনা মনে হয়।
৯-৯-২০০৩
একটি উপকথার খসড়া
শকুনটা ছিলো দশাসই আর ওর সাঙ্গাত
ছিল অন্য এক তাঁবেদার শকুন।
দু’টিতে এক জোট হয়ে হামলে পড়লো
দ্বীপবাসী তেজী, স্বাধীনচেতা এক ঈগলের ওপর।
অকারণ নয় এই উড়ে এসে জুড়ে বসে বিকট
হামলায় মেতে ওঠা। জেদি, অথচ
শান্তিপ্রিয় ঈগলের দখলে
বেশ ক’টি দুর্লভ মুক্তো আছে ব’লেই
শকুনদের উড়ে এসে জুড়ে বসার
বাসনা ছিল প্রবল। শকুনদ্বয় ঝাপ্টে, চঞ্চু চালিয়ে
ঈগলকে ক্ষতবিত ক’রে বনেদী,
দুর্লভ মুক্তোগুলোর দিকে লোভার্ত থাবা বাড়ায়।
দুই শেয়ানা শকুন এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের হামলা,
ক্রমাগত ঝাপ্টায় ঈগল এবং তার সহচরেরা চরম
পর্যুদস্ত হওয়ার আগে ওরা হঠাৎ
উধাও হলো ব’লে ধন্দে পড়ে অনেকে।
আক্রান্ত জেদি ঈগল জীবিত কি মৃত-সে এক গূঢ় রহস্য
হয়ে থাকে দ্বীপের বাসিন্দাদের নিকট।
১১-৪-২০০৩
একটি এপিটাফের খসড়া
ভোরবেলা পথে হেঁটে যেতে যেতে আচানক ঘন কুয়াশায়
ঢাকা পড়ি না জানি কোন্ সে জাদুবলে! এমন তো
হওয়ার ছিল না কথা গ্রীষ্মকালে। প্রায়
অন্ধের মতোই অসহায় আমি পথ
হাতড়াতে থাকি ক্রমাগত, কী করবো
ভেবেই পাচ্ছি না আর মাথার ভেতর আজগুবি ছবি কাঁপে!
আমি কি উন্মাদ হয়ে যাবো? নাকি অজ্ঞান হয়েই
থাকবো এখানে এই বিরানায়! হতাশায় কব্জায় আটকে
পড়ার আগেই হেঁটে যেতে হবে পেরিয়ে সকল
বাধার কুটিল ফাঁদ। থামবো না যতক্ষণ প্রাণে
স্পন্দন বজায় থাকে। ভেঙে
পড় ক মাথায় আসমান, ঝাঁপিয়ে পড় ক বন্য পশু, তবু
আমাকে যেতেই হবে, নইলে কী করে
নিজেকে দেখাবো মুখ আরশিতে কোনও দিন আর?
দূর থেকে, মনে হয়, কে যেন ইঙ্গিতে ডাকে আমাকেই; যাবো
কি যাবো না মনস্থির করার আগেই
ছায়া-মূর্তি উবে যায়। পুনরায় হতাশায় ডুবে
কুয়াশায় মিশে ব’সে পড়ি অনুমানে হিজল গাছের নিচে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি কিংবা পড়িনি, সে-কথা না ভেবেই
গাছতলা ছেড়ে ফের যাত্রা শুরু করি
অজানার পথে, হায়, বস্তুত কখনও প্রথামতো
সিদ্ধান্ত করিনি স্থির। যখন যা ইচ্ছেমতো ক’রে গেছি তা-ই
এলোমেলো, পরিণামহীন কঠোর জুয়ায়, ফলে
এ জীবনে জমেছে কত-না কালো মেঘ, বয়ে গেছে চোরা ঝড়!
আমার দরজা থেকে কিয়দ্দূরে এখনও নেকড়ে ক্রূর চোখে
আর লকলকে জিভে তাকায় কবির
বিনীত আস্তানাটির দিকে। দীর্ঘকাল পদ্য লিখে
পারেনি সে গোছাতে সংসার কোনও শিল্পীর ধরনে! করুণার
পাত্র হয়ে ভাসবে কি মেঘলোকে আর
কখনও কখনও কেউ হয়তো লিখবে ব্যঙ্গ ছড়া।
৩০-১১-২০০২
একটি পুরানো ঘরে
একটি পুরানো ঘরে আমি বাস করি। ঘরটির
চার দেয়ালের রঙ ফিকে
হয়ে গেছে। রাত শুরু হতেই কেমন
বেয়াড়া শব্দের ধাক্কা তন্দ্রা ছিঁড়ে ফেলে। চোখ মেলে
দেখি দু’টি ইঁদুর দেয়াল ঘেঁষে বুক-শেল্ফের
ভেতরে প্রবেশ ক’রে নিমেষে উধাও।
কী করি, কী করি, ভেবে নিষ্ক্রিয় কাটিয়ে দিই কিছু
সময় এবং পুনরায় তিনটি ইঁদুর ছুটে
চলে যায় অন্য দিকে না জানি কীসের খোঁজে আর
হতবাক আমি শূন্যতার স্তব করি চোখ মুদে।
অকস্মাৎ মনে পড়ে গেলো সেই নারী
সৌন্দর্যের আভা নিয়ে এসেছিলো দেহমনে, অথচ চকিতে
চলে গেলো কী নিষ্ঠুর কর্কট ব্যাধির
নিপীড়নে ক্লান্ত হয়ে চির-নিশীথেরঅন্ধকারে। বর্তমানে
তার প্রিয়জন যারা রয়ে গেলো অনেকেই, হায়, তারা নিত্য
মাথা কুটে মরলেও সে আর কখনো
আসবে না শুধু কিছু স্মৃতি-
কথা তার কালেভদ্রে হবে জাগরিত।
যতদূর মনে পড়ে, যৌবনের ঊষালগ্নে সে নিত্য চেয়েছে
প্রবল নাড়িয়ে দিতে স্তবির, নিষ্ফল
বুনিয়াদ নতুন সৃষ্টির প্রেরণায়। এই তো সে
এখনো রয়েছে আমাদের মহফিলে সুচেতনা
কথায় ছড়িয়ে দিতে। বিমুগ্ধ সবাই
তাকিয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের আভাময় তার দিকে।
ইতিমধ্যে ঢের ধুলো পড়েছে ছিটিয়ে-থাকাকিছু
স্মৃতিতে এবং নিদ্রাহীন এই কালো রাতে ক্ষণে
ক্ষণে ঢের ঢ্যাঙা, হিংস্র ইঁদুর লাফিয়ে
পড়ছে আমার চোখ, মুখ, বুক ছিঁড়ে খাবে ব’লো! চতুর্দিক
প্রবল কাঁপিয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠতে চাই, অথচ বোবার
মতো অসহায় পড়ে থাকি; অতি দ্রুত খসে পড়ছে শরীর!
২-১১-০৩
একবার নিশীথের প্রথম প্রহরে
একবার নিশীথের প্রথম প্রহরে প্রিয় ঢাকা
শহর ভ্রমণে বের হ’য়ে
অপরূপ যে সৌন্দর্য তার দেখলাম,
বলা যেতে পারে,
তাক লেগে গেলো, চোখ দুটো কিছুতেই ঝলমলে
আলো মালা, মোটর কারের মিছিলের
ঝাঁঝালো বহর থেকে সরাবার সাধ জাগার উপায়
ছিল না বস্তুত কারও। এ শহর সত্যি কি আমারই জন্মস্থান?
সুসজ্জিত প্রতিটি দোকানে নরনারীদের ভিড়, লকলকে
ক্রয়স্পৃহা চরিতার্থ করার রসদ
থরে থরে সাজানো শো-কেসে। কেনাকাটা
চলছে বেদম, দূর থেকে চেয়ে থাকি বিস্ময়ের
ডালা খুলে, তারপর যথারীতি চোখের খোরাক নিতে-নিতে
ধীরে সুস্থে এগোই আরেক দিকে। ভাবনার মেঘ
ক্রমশ জমতে থাকে মনের আকাশে। কিয়দ্দূরে বুড়োসুড়ো
একটি অসুস্থ লোক দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে পথে
পড়ে আছে বড় একা। থামছে না কেউ তাকে দেখে,
বাজে দৃশ্য দেখবার মতো ফুরসৎ এ শহরে নেই কারও!
এ শহরে আলোর আড়ালে নানা দিকে ভয়ঙ্কর অন্ধকার
জাঁকিয়ে বসেছে জাঁহাবাজ মোড়লের মতো আর
বহুরূপী মারণাস্ত্র প্রায়শ ঝলসে ওঠে অলিতে গলিতে,
এমনকি ঝলমলে দ্বিপ্রহরে রাজপথে। সে কার সঙ্কেতে?
হায়, সেই রহস্যের হয় না সহজে উন্মোচন। কেউ কেউ
জানলেও কখনও খোলে না মুখ স্ত্রী-র আশু বৈধব্যের ভয়ে!
আমরা তো দিব্যি আছি আমাদের এই প্রিয় সোনার বাংলায়
তুমুল বাজিয়ে ব্যান্ড, নেচে গেয়ে, বোমার ঝলক দেখে আর
কাগজের প্রত্যহ খুনখারাবির লোমহর্ষক খবর পড়ে-
আমাদের জাতীয় কর্তব্য বটে বাৎসরিক
মরণোৎসবের দিন স্থির ক’রে নিয়ে বাজনা বাজিয়ে আর
পরস্পর গলাগলি ক’রে খুনিদের বেহেস্ত কামনা করা!
১৩-১২-২০০২
এখানেই রয়ে গেছে
এখনও আমার জীবনের গোধূলিতে, সময়কে ধন্যবাদ,
আকাশ-পাতাল, বন মরুভূমি এবং পর্বত
পাড়ি দিয়ে এই অধমের কাছে চলে আসে
অশেষ রহস্যময়ী অপরূপ রমণী, কবিতা তার নাম।
আচমকা কেন আমাকে ঝাঁকুনি দিয়েছে? এই ভাবে
ছিলাম নিমগ্ন ধ্যানে। না আমার মন
বেহেস্তের গুলবাগে হেঁটে বেড়াবার স্বপ্নসাধে
বস্তুত ছিল না মশগুল। পলাতক
একটি কবিতা পায়রার
খোঁজে মেঘমালা ছুঁয়ে ছেনে
দেখে নিচ্ছিলাম,
যাচ্ছিলাম মিলেমিশে নীলে।
হাতে মেঘ গলে যায়, নীলময় ভাসমান আমি
ধীরেসুস্থে নামতে নামতে
ছুঁয়ে ফেলি কাঙ্ক্ষিত জমিন পেয়ে যাই
সবুজের ঘ্রাণ, আর গোধূলি রঙিন ঋদ্ধ চিত্র।
এবং জলেরও মোলায়েম
সুরভি আমার প্রতি স্নেহপরায়ণ হয়ে ওঠে
মনে হয়, পলাতক কবিতা প্রকৃত এখানেই রয়ে গেছে।
এরা চেনা কেউ নয়?
সন্ধ্যারাতে বিছানায় শুয়ে আকাশ কুসুম ভেবে
ভেবে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। যে-শহরে
আমার নিবাস তার অস্তিত্বে প্রকৃতি
বড়ই কৃপণ ভেবে আক্ষেপ হচ্ছিলো খুব। ডান দিকে ফিরে
তাকালাম আকাশের দিকে,
যেমন প্রেমিক তার দৃষ্টি প্রেমিকার
বুকে করে স্থাপন প্রগাঢ় আবেগের সুষমায়।
অকস্মাৎ প্রেমের কবিতা রচনার
ভাবনা আমাকে দিব্যি করলো দখল। বিছানার
কোমল আশ্রয় ছেড়ে গৃহকোণে স্থাপিত টেবিলে
রাখা প্যাড এবং কলম টেনে নিয়ে
প্রেমিকার চোখ, মুখ স্মৃতিপটে রেখে কাগজের
বুকে শব্দাবলি সাজাবার উদ্যোগ নিতেই কী-যে
হলো, প্রিয় মুখ স্মৃতি থেকে গেলো মুছে
নিমেষেই আর কী প্রবল ভেসে ওঠে কতিপয় শীর্ণ মুখ।
কারা এরা? চেনা কেউ নয়, তবু বড় পরিচিত
মনে হয়, আমার আত্মীয় খুব নিকটের
সুনিশ্চিত। তবে কেন এ রকম বিষণ্ন, ক্ষুধার্ত
মুখ, যেন মৃতপ্রায়? তাহ’লে আমি কি
নির্দয় ভীষণ? অমানুষ একজন। হায় মঙ্গা
ওদের কামড়ে খেতে-খেতে প্রায় লাশ দ্রুত বানিয়ে ফেলেছে!
১০-১১-২০০৩
কখনো কখনো
কোনো কোনো ভোরবেলা একটি কি দুটি পাখি এসে
বারান্দায় বসে আর তাকায় আমার দিকে, যেন
অতিশয় পরিচিত আমি
ওদের, তাই তো খুব কাছে এসে বসে,
আমার ছিটানো বিস্কুটের গুঁড়ো খেয়ে
পাখা মেলে চলে যায় কত দূরে জানি না কোথায়।
কখনো কোকিল খাঁখাঁ দুপুরের কানে
ব্যাকুল, নিভৃত সুর ঢেলে দেয় বারবার, ভারি
ইচ্ছে হয় ছুটে যাই ঝোপঝাড়ে, টেনে নিই বুকে
পাখিটিকে। সে কি ধরা দেবে? এ কবিকে
পছন্দ হ’লেও ওরে দেবে না তো ধরা। ব্যর্থ আমি
মাঝে মাঝে কল্পনায় শুনি তার গান।
যখন ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা, কাছের গাছের
একটি উৎসুক ডাল বাড়ায় সবুজ গলা তার
আমার নিভৃত ঘরে, যেন
আদর কুড়াতে চায় নিরালায় নিঃসঙ্গ কবির।
ওকে ছুঁতে গেলে আচমকা হাওয়া এসে
এক ঝটকায় ওকে দূরে নিলে শুনি হাহাকার।
নিশীথের প্রথম প্রহরে আকাশের ক’টি তারা
নেমে এসে বসে হেসে প্রসারিত দু’হাতে আমার;
অপরূপ কণ্ঠস্বরে কী যেন বলতে
চেয়ে থেমে যায়, নাচে হাতের তালুতে
প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ পরিচয় স্মৃতিপটে ঝলসিত ব’লে বুঝি।
হঠাৎ হাতের পাতা গাঢ় অমাবস্যা হয়ে যায়!
কোন কোনো গহন রাত্রিরে মনে হয়
কখনো না-দেখা এক জলাশয় ডাকছে আমাকে
মায়াবী জলজ সুরে। জ্যোৎস্না
ওকে বড় বেশি বিচলিত
করছে বুঝি-বা তাই ওর তট ছিঁড়ে
চাইছে আসতে ছুটে এ শহরে আমার নিকট।
২৪-০৪-২০০৩
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
সূর্য জাগবার আগে, দুপুরে, গোধূলিবেলা কিংবা
সন্ধ্যা, এমনকি মধ্যরাতে
কণিকা, তোমার গান প্রাণের উপত্যকায় কখনও ঝরায়
কত অপরূপ ফুল, কখনওবা স্বর্গীয় শিশির।
আনন্দের প্রহরে অথবা বেদনার মেঘময়
মুহূর্তে তোমার সুর আমাকে অনন্য এক ভ্রমণে করেছে
সঙ্গী বারবার সেই দেশে
যেখানে মানব তার কল্পনার উজ্জ্বল উড়াল
পেয়ে যায় অনন্তের সীমাহীনতায়। তুমি নেই
প্রকৃতি-শোভিত প্রিয় শান্তিনিকেতনে,-
এ নির্দয় সত্য মেনে নিতে আমার চৈতন্য আজও
হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তুমি আছো, থাকবে নিয়ত
তানে, লয়ে প্রস্ফুটিত রবীন্দ্রনাথের চিরঞ্জীব গীতিমাল্যে
এবং তোমার কণ্ঠসুধা সুখী, দুঃখী
কালে জানি জাগাবে পূর্ণিমা।
১৫-০৮-২০০২
কণ্ঠস্বর অন্ধকারে বটায় প্রেম
জ্বলজ্বলে, ঝলমলে এই শহরের অনেক
আলিশান দালানে
কত না আনন্দধ্বনি সাহেব, বিবিকে তন্ময়
করে রাখে, শৌখিন প্লেটের উচ্ছিষ্ট
খাবার ভেসে যায় নর্দমায়, কে তার
হিশেব রাখে ক্ষুধার্ত বনি আদম ছাড়া এখন?
‘জয়তু বিলাসিতা, জয়তু ধনসম্পদ’
স্লোগান দিতে-দিতে ঢের আয়েশি মোটরকার ছোটে মসৃণ।
কখনো ভাঙাচোরা পথে হেঁটে যেতে-যেতে দৃষ্টিতে
দুর্দশাগ্রস্ত মহল্লায় আমার
চোখে চোখ রেখে ওরা দারিদ্র্যের কথা বেজায়
তিক্ত স্বরে ঘোষণা করে। কোনো দ্বিধা অথবা
লজ্জা নেই ওদের। সেইসব কণ্ঠস্বরে কখনো
কৌতুক, কখনো-বা ঝগড়া-প্রসূত
অগ্নিকণা ঝলসে ওঠে কোনো-কোনো কুটিরে,
কখনো-বা উলঙ্গ, বেয়াড়া উঠোনে।
বস্তির চেহারা কেবল নয়তো এমন। এখানে,
হ্যাঁ, এখানেও সূর্যোদয়ের আভা ছড়ায়
আনন্দধারা। সুনসান রাত্তিরে
যুবতীর স্তনের মতো চাঁদ জেগে থাকে আকাশে,
কখনো, কখনো দারিদ্র্যঘেরা কুটিরে
মধ্যরাতে মোটা মিহি কণ্ঠস্বর আন্ধারে প্রেম বটায়।
১০-১২-২০০৩
কতিপয় কঙ্কালের মুখোমুখি
জ্বলজ্বলে মধ্য-দুপুরে নদীর বুকে ইলিশের আচমকা
লাফিয়ে ওঠার মতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি
হয়ে যায় কোনো কোনো স্মৃতি। সেই কাঙ্ক্ষিত আলো
আদর বুলোয় অস্তিত্বে, সুর হয়ে ঝরে, ভুলিয়ে দেয় হঠাৎ
নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে-পড়া মৃত্যুচিন্তা। বস্তুত
সুন্দরের বন্দনা-গীত রচনায় কাটে নানা প্রহর।
এই যে কখনো কখনো কোনো দুপুর, গোধূলিবেলা,
নিস্তব্ধ মধ্যরাতে খাতার পাতায় ঝুঁকে-থাকা নিষ্ক্রিয়
কলম হাতে, অথচ একটি পঙ্ক্তিও প্রস্ফুটিত নয়, তখন
তুমি কি দেখতে পাও কয়েকটি কঙ্কাল এসে দাঁড়িয়েছে
তোমার নির্ঘুম ঘরে? তোমার অনুরোধের তোয়াক্কা না করেই
ওরা গরহাজির, অদৃশ্য চেয়ারে বসে পড়ে। ওদের বিকট,
নিঃশব্দ হাসি আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করে যেন ঘেন্না-ছড়ানো
অবহেলায়। আমাকে বিপন্ন দেখে অধিকতর কৌতুকপ্রবণ,
নিষ্ঠুর, করাত সরবরাহ করে অদৃশ্য অপশক্তি!
আতঙ্কিত নিরুপায় আমি প্রাণপণ চিৎকার করতে গিয়ে
মূক হয়ে থাকি, এদিক ওদিক তাকাই। উদ্ধারের বাণী নয়, কতিপয়
কঙ্কালের অট্রহাসি আমার ছোট ঘরটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার
অভিলাষে আরো বেশি কট্রর, তুমুল হয়ে ওঠে। বেপরোয়া আমি
কঙ্কালদের তাণ্ডব থেকে মুক্তির আশা মহান কবিদের নানা
কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে ওদের ক্ষান্ত করতে গিয়ে আরো বেশি উপহাস্য,
বিড়ম্বিত হই। কঙ্কালেরা সেই সব কালজয়ী সৃষ্টিকে দূরে ছুড়ে
ফেলে মেদমাংসচর্মহীন পদতলে চটকাতে চটকাতে মাটিতে
মিশিয়ে দেয়। দু হাতে মুখ ঢেকে গোরস্তানের নৈশ স্তব্ধতায়
স্তম্ভিত, ভীত, সন্ত্রস্ত আমি নির্জ্ঞান হয়ে যাই।
১০-১০-২০০২
কবরের পাশে
গোধূলি বেলায়
একটি অচেনা কবরের পাশ দিয়ে
হেঁটে যেতে-যেতে কেন জানি
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশে পাশে
কোনও ঘরবাড়ি নেই, শূন্যতা বিলাপ করে শুধু
আর কিছু গাছপালা শোনাতে চাইছে কোনও কথা।
বিরান স্থানের
এই প্রায় নিশ্চিহ্ন, অচেনা কবরের
প্রয়াত বাসিন্দা কে ছিলেন?
তিনি কি পুরুষ না কি নারী? হাওয়ায় স্পন্দিত এই
গাছের সবুজ পাতাগুলি পারবে কি সত্যি জানাতে এখন?
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি আরো কিছুক্ষণ।
কবরের পাশে
না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হেঁটে
যেতে শুরু করি আর কখনো সুনীল আকাশের
দিকে, কখনো-বা চারদিকে দৃষ্টি মেলে দিই কিছুই না ভেবে।
কিছুতেই ফুরায় না যেন পথ; ভাবি, আমার কি
কেবলি সম্মুখে হেঁটে চলাই নিয়তি?
বেলা পড়ে আসে,
ক্লান্তি ভর করে দু’পায়ে আমার এবং আচমকা
আমার প্রয়াত জননীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে মেঘমালা থেকে-
‘বাচ্চু, বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো তুমি দাঁড়াওনি
আমার নিঝুম এই কবরের পাশে। আমাকে কি ভুলে গেলে?
হায়, অপরাধী আমি মাথা নীচু ক’রে থাকি বেশ কিছুক্ষণ।
১৩-১২-২০০৩
কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার পথ
(তুষার কর প্রীতিভাজনেষু)
আমাদের জীবনে কি কৃষ্ণপক্ষ শাসন করেই
যাবে বহুকাল? পূর্ণিমার
মুখে দেখে যেতে বুঝি পারবো না আর। চতুর্দিকে
নৈয়াশা-পীড়িত, নুয়ে-পড়া মানুষের আসা-যাওয়া।
এই আমি একদা ছিলাম জ্বল জ্বলে আশাবাদী;
হতাশার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জয়ী হয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি বহুকাল। দুর্দশার মুখে থুতু
ছিটিয়ে এনেছি উৎসবের দিনগুলি, রাতগুলি।
কোন সে অশুভ ঝড় চকিতে গুঁড়িয়ে দিলো এই
ঈর্ষণীয় শান্তির মোহন নীড়? কার
অসুস্থ চেতনা সত্য, সুন্দরের বিলয় সাধনে
নিয়ত সৃষ্টির নয় ধ্বংসের সপক্ষে ক্রিয়াশালী সর্বক্ষণ।
ষড়যন্ত্র যতই তুখোড় হোক, অন্ধকারে অস্ত্র
যতই শানাক কিংবা অশুভের সঙ্গে সন্ধি করে
বুনুক ধ্বংসের বীজ যত্রতত্র, আখেরে নিশ্চিত শুভ জয়ী
হয়ে চতুর্দিকে কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার পথ খুলে দেবে ঠিক।
২
দিন, মাস, বছর, শতাব্দী,
শতাব্দীর পর শতাব্দীও
কেটে যাবে; অসংখ্য শতাব্দী
লুপ্ত হলে প্রিয় বাংলাদেশ,
দুনিয়াদারি কি রয়ে যাবে?
যাবে না কি সব লুপ্ত হয়ে?
শূন্যতাই পরিণতি নিশ্চিত আখেরে।
১১-১২-২০০৩
কোনওমতে টিকে আছি
কী করি? কী করি, বলো কিছুই তো লাগছে না ভালো,-
সভা সমিতিতে গিয়ে কয়েক মিনিট
কক্তৃতায় গা ভাসিয়ে দেয়া, তর্কে মাতা আর আড্ডায় নরক
গুলজার করা কিংবা কী ক’রে চলবে
সংসার মসৃণ রূপে, আমার মৃত্যুর পর গোটা পরিবার
কোন্ সে বিপাকে প’ড়ে কাটাবে কঠিন দিনগুলি,
রাতগুলি, আমার কবিতা কেউ ছুঁয়ে দেখবে কি দেখবে না,-
এ সব কিছুই আর এখন পাচ্ছে না আশকারা দুশ্চিন্তার।
অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এক ঝাঁক ঝিঁঝিঁ পোকা
মাথার ভেতর একটানা একঘেয়ে আওয়াজ করতে থাকে আর
চোখে ঘুম নামার পরেই থামে ওদের কোরাস। জাগলেই
নিশ্চিত বাজাবে ব্যান্ড আমি জেগে থাকা অব্দি; এমনকি কোনও
কবিতা লেখার দীপ্র মুহূর্তেও করে না রেয়াত; এ যন্ত্রণা
কোনও দিন শেষ হবে কি না, কে আমাকে ব’লে দেবে?
যন্ত্রণা হয় না শেষ এক লহমায় কোনও দিন;
মানুষ অথবা পশু, বস্তুত জীবের
কিছুতে রেহাই নেই যন্ত্রণার নির্দয়তা থেকে
এই দুনিয়ায়, অন্য কোনও পৃথিবীর অস্তিত্বের কথা আজও
অজানা আমার। বড় বেশি ঝামেলায়
সত্তায় অনিশ্চয়তা ব’য়ে কোনওমতে টিকে আছি।
০৭-১১-২০০২
ক্যালেন্ডার পালটে গেলে
ক্যালেন্ডার পাল্টে গেলে নতুন বছর প্রকৃতই
পরিবর্তনের রঙ এনে দেয়, যদি
স্বস্তি আর শান্তি গলাগলি করে পরস্পর খুব
সুখে বসবাস করবার স্বাদ পায় সুনিশ্চিত।
অন্ধকার আকাশের বুকে প্রত্যাশার পূর্ণচাঁদ
জেগে উঠলেই জানি ভোগান্তি-বিদীর্ণ জনগণ
হাত ধরাধরি করে যাবে
মিলনমেলায় আর স্বাগত জানাবে শুভ আর কল্যাণকে।
আমরা সকল হতভাগ্য, প্রতারিত জনসাধারণ সত্যি
পাবো তো আবার ফিরে আনন্দের রঙধুন আর
প্রগতির পদধ্বনি হবে তো সুস্পষ্ট আরও নিকট তারিখে?
হয়তো দুলবে সাফল্যের মালা অচিরেই, মন বলে।
অথচ মনের কত প্রত্যাশার আলো মালা হতাশার ঝড়ে
নিভে গিয়ে লুটোপুটি খেয়েছে ভাগাড়ে,
এ-ও তো দেখেছি কত আহত দৃষ্টিকে
ধূম্রজালে বিদ্ধ হয়ে হত্যাযজ্ঞে সত্তাহীন হতে!
কী-যে হলো, এখন নতুন ক্যালেন্ডারে
চোখ পড়লেও বনবাদাড়ের ভীষণ দৃশ্যের
ছবি ফুটে ওঠে, কল্যাণের পলায়নে
হতাশায় ডুবে যেতে-যেতে রজ্জু ভেবে সর্পকেই তুলি হাতে।
আবার খুঁড়িয়ে হাঁটবো কি দীর্ঘ ভাঙাচোরা পথে,
যেখানে অনেক মোড়ে আচমকা অতি
ভয়ানক গহ্বর নিষ্ঠুর হাসি ছড়িয়ে তিমিরে
তুমুল লাফিয়ে ওঠে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুদের হিংস্রতায়।
২৬-১২-২০০২
ক্রিসমাস ট্রি যার স্মৃতির প্রতীক
কেন যে অনেকদিন থেকে মাঝে-মধ্যে আচমকা
গোধূলি বেলায় চোখে ভেসে ওঠে অতিদূরে
কালের বিচারদৃশ্য আর
আলখাল্লা-পরা এক বিবাগী পুরুষ।
কী এমন অপরাধ ছিল তার? বস্তুত কিছুই
নয়, শুধু তিনি তার বিশ্বাসের কথামালা পথের কিনারে
দাঁড়িয়ে আগ্রহী কিছু শ্রোতাকে কখনো
কখনো প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে শোনাতেন। উপস্থিত
শ্রোতারা শুনতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। আলখাল্লা-পরা
সেই বক্তা ধীর, স্থির অনন্য যেশাস।
ঈর্ষান্বিত, ভীষণ চক্রান্তকারী পুরোহিতদের
দু’চোখের বালি তিনি। ওরা তাকে পৃথিবীর রৌদ্র-ছায়া থেকে
চিরতরে সরিয়ে দেয়ার ক্রূর বাসনায় পাইলেট নামে
খ্যাত এক রোমান কর্তার দোরে ধর্না দেয়। ওদের নালিশে
প্রথমে দেয় না কান পাইলেট । পরে বন্দী যেশাসকে
হঠাৎ জিগ্যেস করে, “বলো দেখি সত্য বলে কাকে?”
হই হল্লা তীব্র হ’লে যেশাস জবাব না দিতেই তাকে ক্রুশবিদ্ধ
করার হুকুম দিয়ে পাইলেট মৃদু হেসে সাত তাড়াতাড়ি
চলে গেলো অন্যত্র কোথাও। যেশাসকে
ক্রুশে ওরা বিদ্ধ করে জালিম পেরেকে। পৈশাচিক হৈ-হল্লায়
মত্ত, হীন পুরোহিতদের সাধ মেটে। যন্ত্রণায়, যন্ত্রণায়
ভুগে শেষে প্রাণ ত্যাগ করলেন যীশুখৃষ্ট। এখনতো তার স্মৃতি ঘিরে
ক্রিসমাস ট্রির জ্বলজ্বলে দীপ জ্বলে সারা রাত
নিবেদিত ভক্তদের ঘর। মহান সে পুরুষের মৃত্যু নেই!
১৯-১২-২০০৩
খেদমতগারের নির্দেশনামা
শোনও প্রিয় দেশবাসীগণ, তোমরা সবাই
তোমাদের ফুয়েরারের নির্দেশগুলো কান পেতে,
মন দিয়ে শোনও। একটি শব্দও যেন
তোমাদের কান ফস্কে হাওয়ায় মিলিয়ে না যায়।
আমি যা যা বলবো কানে তো বটেই মনেও
নিশ্বাসী, ষোল-আনা নির্ভরযোগ্য সংবাদদাতার ধরনে
স্পষ্টাক্ষরে তুলে নেবে, যাতে একরত্তি
ভুলও না থাকে তোমাদের স্মৃতির পাতায়
প্রত্যহ আমার নির্দেশ মাফিক ভোরবেলা এই সময়ে
তোমরা সবাই ঘুম থেকে উঠবে, সবাই
একই মুহূর্তে প্রাতঃকৃত্য সারবে, ব্রেকফাস্টা করবে,
দ্বিপ্রাহরিক আহার, বৈকালিক নাশ্তা আর
নৈশ ভোজন সমাধা করবে। এতে ব্যত্যয় ঘটলে
নারী-পুরুষ নির্বিচারে প্রত্যেকের পিঠে পড়বে
একশো ক’রে বেত্রাঘাত। আমি
সবার কথা শুনবো, কিন্তু সবাইকে মানতে হবে আমারই হিতকথা।
শোনও প্রিয় দেশবাসী, যদি আমি বলি,
বাম দিকে নয়, পুরো ডান দিকে চলতে হবে, তা’হলে
মানতে হবে সেই নির্দেশ। যদি বলি, মাটিতে মাথা রেখে দু’পা
আকাশের দিকে তুলে হাঁটতে হবে বারো ঘণ্টা সেই হুকুম
চটজলদি পালন না করলে নাক ফুটো ক’রে
স্থুল সুতো দিয়ে ছয় ঘণ্টা বেঁধে রাখা হবে খুঁটিতে।
শোনও ভাইসব, বোনগণ, তোমরা তো
ভালো ক’রেই জানো, আমি আমার জিন্দেগি
উৎসর্গ করেছি তোমাদেরই উন্নয়ন এবং কল্যাণের জন্যে,
আমি দিনরাত এক ফোঁটা না ঘুমিয়ে, সামান্য বিশ্রাম
না নিয়েও খেদমত ক’রে যাচ্ছি নির্বিশেষে
তোমাদের সবার। দেখছো তো আমার এই মহান
জনকল্যাণে কেউ বাধা দেয়ার বাসনা মনেমনে
ঠাঁই দিলেও তার কল্লা জল্লাদের খাঁড়ার এক কোপে
ধুলোয় লুটিয়ে দেয়া হয়। কেউ ষড়যন্ত্রের কথা মনে
পুশিদা কোণে ঠাঁই দিলেও, অথবা তিনমাথা
এক জোট হয়ে জমিনের সাত হাত নীচের
কোনও কুঠুরিতে ফিস্ফিসিয়ে আমার পথে বিষকাঁটা
বিছানোর প্রস্তাব করলেও রেহাই নেই জালিমদের।
শোনও ভায়েরা, বোনেরা আমার, দেশের
উন্নয়নের এই জ্বলজ্বলে দশকের উদ্দেশে আমরা
আমাদের সবার টুপি খুলে নিই, নামিয়ে ফেলি
ঘোমটা, এসো আমার উন্নয়নের দশকের গুণ গাই,
প্রগতি ও কল্যাণ শোভিত জীবনের গান গাই,
এসো আমার জগৎ-কাঁপানো শাসনের প্রচারে
মুক্তবিহঙ্গ হয়ে নক্ষত্রলোকে অভাবিত মিছিল নিয়ে যাই,
এসো বিশ্বের সর্বোত্তম রাষ্ট্রের বাসিন্দা হিসেবে নৃত্য করি!
১৩-১১-২০০২
চলে তো যেতেই হয়
(সহোদরা মেহেরুন্নেসার প্রয়াণে)
চলে যাচ্ছি, চলে তো যেতেই হয় শেষ অব্দি, তবে হা-পিত্যেশ
করে নয়; সম্ভ্রম বাঁচিয়ে, বাধা-বিপত্তির হাত
ভীষণ মুচড়ে দিয়ে মাথা উঁচু রেখে
যেন চলে যেতে পারি, এ রকমই খায়েশ আমার।
আমার চলার পথে, এতদিনে জেনে গেছি, কাঁটা বিছানোর
লোকের অভাব নেই, কেউ কেউ এ রকমও আছে
এখুনি আমাকে জিন্দা কবরে শোয়াতে
পারলেই কী তোফা আহ্লাদে আটখানা
হয়ে নেচে নেচে ঢের বাতাসা বিলাবে
মসজিদে, ইয়ারবক্শির মজলিশে।
চলে যাচ্ছি, চলে তো যেতেই হয় ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়
বাস্তবিক; তবে প্রশ্ন হলো এই, এই যে আমার
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রকৃতির হরেক রকম
উপচার, ঋতুর বাহার, জ্ঞান আহরণে উপযোগী
গ্রন্থমালা, দিগ্ধিদিক থেকে বিচ্ছুরিত
আলোরশ্মি, যা সত্তাকে ঋদ্ধ করে প্রহরে প্রহরে, সবই চাই।
সহোদরা, যে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট,
বস্তুত ক’মাস থেকে শয্যাগত অসুখের হিংসুটে ঝাপ্টায়,
তিনদিন চেতনার সুদৃপ্ত এলাকা থেকে নির্বাসিতা শেষে
প্রত্যুষে পড়লো ঢলে; ‘গেলো’ গেলো’ ব’লে
রাতজাগা পাখি প্রভাতকে নিমেষেই
কৃষ্ণপক্ষময় প্রহরের অংশ করে ফেলে ফের!
মেহের, আমার বোন, দেখি মেঘে ভেলা
ভাসিয়ে চলেছে একা, বড় একা, কোন্ সে অজ্ঞাত লোকে নাকি
মহাশূন্যতায়? নিজেও কি
শূন্য হয়ে দুনিয়ার এক হাহাকারপুজ্ঞের নিখাদ
অংশের শামিল হবে? এমন কেউ তো নেই যে আমাকে বলে দেবে আজ?
কোনও জ্ঞানী, কোনও গ্রন্থ আমাকে জানাতে আসবে না।
তা’হলে কি আজ এই সন্ধ্যেবেলা নিজের গলায়
চালাবো অব্যর্থ ছুরি? কস্মিনকালেও নয়। যতদিন পারি
জীবনকে আলিঙ্গন ক’রে রয়ে যাবো
পূর্ণ আশা-জাগানিয়া আলোক ধারায়।।
২০-১১-২০০২
চেনা অচেনার কুয়াশায়
আছি তো এখনও, আছি ঠিকঠাক, তবে
এ কথাও সত্য, মেনে নেয়া যেতে পারে, সময়ের
অর্থাৎ দুঃসময়ের বেশ কিছু চড়-চাপড় খেয়েও
গোঁয়ার গোবিন্দ হয়ে টিকে আছি ক্ষয়িষ্ণু সংসারে।
এ এক কিম্ভূতকিমাকার কালে বসবাস
করছি আমরা অনেকেই। আমার কথাই বলি,-
এখানে আমরা এ শহরে তিন ভাই
করি বসবাস, সহোদর বটে, তবে
কারও সঙ্গে কারও না মুখের
আদল অথবা চরিত্রের মিল বিদ্যমান। পেশার মিল তো
শূন্যের কোঠায় হা-হা করে। এ যুগের
হাওয়াই এমন, লোকজন বলাবলি করে বটে অগোচরে।
ভাইদের একজন আদালতে বিচারপতির
একলাশে যুক্তি পেশ করে বিলক্ষণ,
অন্যজন করে তেজারতি ভিন দেশে আর আমি
অভাজন কখনও টেবিলে ঝুঁকে কবিতার পঙ্ক্তি
সাজাই, হঠাৎ কোনও কোনও
রাতে দূরে নক্ষত্র মেলায় উড়ে যাই পাখাহীন
আর পত্রিকায় লিখে টিখে
সংসারের ঘানি টানি, বেঁচে আছি কোনও মতে আজও।
বস্তুত আমরা তিন ভাই একই দুনিয়ার বাসিন্দা হয়েও
আলাদা জগতে করি বাস, বহুকাল
পর অকস্মাৎ দেখা হলে পরস্পর তাকাই কেমন এক
খাপছাড়া, নির্বোধ ভঙ্গিতে, তারপর ফের চেনা-অচেনার
কুয়াশায় যে যার গন্তব্য চলে যাই, কস্মিনকালেও, হায়,
পারবো না জেনে যেতে সারা পথ পেরুনোর কালে
কী কথা ভাবছিলাম আমরা আপন তিনজন। ফের কবে
দেখা হবে কোন্খানে, তাও তো জানি না।
১৩-১১-২০০২
জন্মন্ধ গুহায়
একদা অনেক বছর আগে যার চেহারা, চলা, বলা
মুখস্থ ছিল আমার, যার সঙ্গে প্রায়
প্রতিদিন হতো দেখা সাক্ষাৎ, তাকে
আজ এমনি ধূসর মনে হয়, এমনই আবছা, তখন
বড়ই অস্বস্তি বোধ করি যে ইচ্ছে হয় নিজের চুল ছিঁড়ি,
তক্ষুনি টেলিফোন করি কোনও বন্ধুকে সেই নামের সন্ধানে।
মনে পড়ে, আমার সেই সঙ্গী সেকালে একজন
কবি হিশেবে প্রচুর সুনাম
অর্জন করেছিলেন। কোনও কোনও তরুণ তার কবিতার
পঙ্ক্তি ব্যবহার করতো প্রেমিকার কাছে লেখা চিঠিতে।
তার কবিতা তুমুল আলোচিত হতো
বিশ্ববিদ্যায়ের চায়ের ক্যান্টিনে। হায়, যার
নাম গুজ্ঞরিত হতো বিভিন্ন পত্রিকার অফিসে,
আজ সে বিস্মৃতির বালিতে সমাহিত।
তার কি কোনও কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিলো? যদ্দূর
মনে পড়ে, তার বই প্রকাশের কিছু গুজ্ঞন শুনেছিলাম,
কিন্তু সম্ভাব্য সেই কাব্যগ্রন্থ তিমিরেই
নিমজ্জিত হয়েছে। অথচ তার পদাবলী
কতই না জ্বলজ্বলে মনে হয়েছিলো সেকালে। আজ
তার নাম কিছুতে
মনে করতে পারছি না। এই লজ্জা আমি কোথায় লুকাই?
একদা তার কবিতা শোনার জন্যে কত না
খোশামোদ করেছি, অবশ্য সে আমাকে
নিরাশ করেনি; স্মৃতি থেকে কী চমৎকার আবৃত্তি ক’রে
শুনিয়েছে নিজের সাধের পঙ্ক্তিমালা।
অথচ আজ তার নাম মুছে গেছে আমার
স্মৃতির তরঙ্গমালা থেকে। নিজেকে ধিক্কার দিই,
তাকিয়ে থাকি দূর দিগন্তের দিকে অসহায়, পরিত্যক্ত
পথিকের মতো। এই মুহূর্তে সেই বিস্মৃত
আবছা, ধোঁয়াটে কবিকে উচ্চস্বরে নাম ধ’রে ডাকতে ইচ্ছে করছে,
অথচ করুণ গোঙানি ছাড়া অন্য কোনও অর্থবহ ডাক
নিঃসৃত হচ্ছে না কণ্ঠ থেকে। আমাকে
নিষ্ঠুর অন্ধকার গ্রাস ক’রে নিয়ে চলেছে জন্মন্ধ গুহায়!
১৮-৩-২০০৩
ঠিকানা
লোকটা সেই কবে থেকে ছুটছেই। গন্তব্য
জানাই নেই তার, তবু ছুটছে দিশেহারা। কাক-ডাকা ভোর,
ঝিমঝিমে দুপুর, মোলায়েম বিকেল গড়িয়ে পড়ছে আয়েশে
গোধূলিবেলায়। লোকটার দৌড়ের বিরাম নেই, অতিশয়
শুকিয়ে-যাওয়া গলা থেকে ধোঁয়া উড়ছে যেন, কোটর থেকে
ছিটকে পড়তে চাইছে দুটি চোখ। তবু পড়ি মরি করে ছুটছে
ঢ্যাঙা লোকটা। কোন্ স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে,
শুধু সেই শীর্ণকায়, ড্যাঙা লোকটাই জানে।
সন্ধ্যা পরিবেশকে ধীর, শান্ত চুমো খেতেই লোকটা কালো
মাটিতে ঢলে পড়ে, যেন একটা দিঘল কুঁজো গড়াগড়ি
যায় মুহূর্তে জন্যে। কাছের গাছের অনেকগুলো গাঢ়, সবুজ
পাতা ঢেকে দেয় আলগোছে লোকটার মুখ। একজন
পথচারী লোকটাকে অমন অসহায় পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে
যায়, স্পর্শ করে ওকে কোমল মুদ্রায়। শুয়ে-থাকা ব্যক্তিটির
স্পন্দন অনুভব ক’রে মুখের পত্রালি সরিয়ে দেয়। পথচারী প্রায়-
মুমূর্ষু লোকটিকে কী যেন জিগ্যেস করে। লোকটি ফিস্ফিসিয়ে
কিছু একটা ব’লে পথচারী হাতে গুঁজে দেয় কী যেন একটা
ঠিকানায় পৌছে দেয়ার বিনয়-কাতর অনুরোধের সংকেতে।
পথচারী খামটি হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকে বনবাদাড়ে;
জানে না সে কোন্ ঠিকানায় পৌঁছে দেবে এই বার্তাময় খাম।
আকাশের নক্ষত্রমালা তাকিয়ে থাকে পথচারীর দিকে সকৌতুক।
হস্তধৃত খামটির দিকে চোখ রেখে ভাবে-কোন্ ঠিকানায় যাব?
২৪-৯-২০০২
দুর্ভাবনার রাত
অকস্মাৎ কোনও কোনও দিন, বলা কওয়া নেই, মন
এ রকম বেয়াড়া, বিষিয়ে ওঠে, ইচ্ছে হয় ছেড়ে
ছুড়ে দূরে, বহুদূরে চলে যাই, যেখানে কখনও চেনা মুখ
চোখে পড়বে না, তাকে দেখে কেঠো হাসি
অধরে ঝুলিয়ে রেখে ঝরাতে হবে না কিছু ফালতু কথার
চুন, বালি! অকাম্য অতিথি এলে বিরক্তির কিছু মশা, মাছি
বসবে না মনে আর কোনও কোনও আত্মবিজ্ঞাপিত
কুটুম্বের অযাচিত নসিহত্ হবে না শুনতে।
অথচ কোথাও যাওয়া হয় না আখেরে। এই বড় চেনা গলি,
বিনীত, মাঝারি বাড়ি, ছোট ঘর, সবচেয়ে বেশি
প্রত্যহ গোচরে-আসা ছোট পরিবার
ফেলে রেখে মরুরূপ ভবিষ্যতে। পা উঠেও
ওঠে না কিছুতে; যে-মুহূর্তে চোখে পড়ে
তাদের ঘনিষ্ঠ প্রিয় মুখ, হৃদয়ে ধ্বনিত হয় বেহাগের সুর।
কখনও কখনও দিন-দুপুরে অথবা মধ্যরাতে আচমকা
ঘুমের ঘুড়িটি কেটে গেলে তাদের পতিণতির কুহেলিকা
ভেবে ভেবে কেঁপে ওঠে; আমার ভেতর থেকে একজন বোবা
কী যেন বলতে গিয়ে বড় বেশি ব্যর্থতায় ডোবে
এবং তখন আমি বালিশে উত্তপ্ত মাথা রেখে, হায়, স্রেফ
বিফল প্রয়াসে মজি। ঝাঁঝাঁ, ভারী মাথা নিয়ে শয্যা ত্যাগ করি।
এমন তো প্রয়শই ঘটে, কখনও পায় না কিছু টের কেউ,
কখনও সখনও শয্যাসঙ্গিনী হঠাৎ, জেগে উঠে
তিনি প্রশ্নাকুল হ’লে ‘হয়নি কিছুই’ ব’লে ব্যাকুল উৎকণ্ঠা
সহজে তাড়াই আর ঘোর অমাবস্যা বিদ্রূপের হাসি হাসে।
০৫-১১-২০০২
ধীরেসুস্থে হেঁটে যেতে যেতে
ভীষণ তিমিরাচ্ছন্ন আজকের এ পৃথিবী
আমাদের। ভাই, বন্ধুদের দেখলেও
ইদানীং যায় না কস্মিনকালে চেনা। ধাক্কা খেয়ে তাড়াতাড়ি
দূরে সরে যাই, জানা নেই কার কামিজের নিচে
ছোরা কিংবা অন্য কোনও মারণাস্ত্র খুব সন্তর্পণে
লুকানো রয়েছে কি না ভেবে ভয়ে কুঁকড়ে থাকি সকল সময়।
কোনও কোনও মধ্যরাতে ভীষণ চমকে উঠে এক
লাফে শয্যা ত্যাগ করি, পাছে কোনও প্রেত
কিংবা আততায়ী গলা চেপে ধরে আচমকা। ঘামে ভিজে ওঠে
শরীর আমার, কোনও মতে টেবিলের এক কোণ
চেপে ধ’রে দাঁড়াই যেন-বা বজ্রাঘাতে
বড় স্থির, কোনও পাখি বেদম ঠোকরালেও উঠবে না নড়ে।
কখনও কখনও নিজ বাসগৃহে অথবা রাস্তায়
ধীরেসুস্থে হেঁটে যেতে-যেতে
নিজের ছায়াটি চোখে পড়লে ভীষণ কেঁপে উঠি,
তারপর অতি দ্রুত হেঁটে চলি, যেন সেই ছায়াটি আমাকে
করবে হামলা আচমকা! গলা ভীষণ শুকিয়ে
আসে, যেন সে মুহূর্তে মুখে ঠেসে দেয়া হলো ঢের শুষ্ক বালি।
বস্তুত কোথাও আজকাল স্বস্তি নেই, শান্তি নেই
এতটুকু; আমার নিজের সত্তা যেন
প্রায়শ আমারই দিকে মারণাস্ত্র উঁচিয়ে এগিয়ে
আসে, চোখ বন্ধ ক’রে বড় বেশি কম্পিত শরীরে
নিজেকে জড়িয়ে ধরি। ভয়ংকর দাঁতাল একটি জন্তু যেন
আমাকে ছিঁড়তে থাকে, তাকে হটাবার মস্ত্র আজও জানা নেই।
১১-১২-২০০২
ধূসর দিন, অমাবস্যা-রাত
লক্ষ করি, প পাড়ার একজন তরুণের সাধনায় এক
ফুলের বাগান সৃষ্টি হয়েছে, শোভায় যার প্রতিবেশী আমি
মুগ্ধ হই, যুবকের উদ্যম, সৌন্দর্যেবোধ আমার মানসে
অন্য এক পরা বাস্তবের
অপরূপ উদ্যানের জন্ম দেয়। নিজের অজ্ঞাতে
অন্য এক জগতের বাসিন্দার জন্য প্রবেশপত্র পাই।
মাঝে মাধ্যে এই তরুণকে কে এক রূপসী তরুণীর হাত
ধ’রে হেঁটে যেতে দেখি। উভয়ের মুখে অপরূপ আভা,
ভালবাসা সে-আভার জন্মভূমি সুনিশ্চিত। যুবার সত্তায়,
যতদূর জেনেছি, প্রগতিশীল চেতনায় ধারা বয়,
মার্কসবাদে আস্থা তার এখনও উজ্জ্বল,
অটল। ফলত বস্তাপচা রাজনীতি শত হস্ত দূরে থাকে।
জনগণমনে নানা অভিযোগ জমতে জমতে অকস্মাৎ
একদিন সারা দেশ তুমুল গর্জনে
কেঁপে ওঠে-সভায়, মিছিলে
প্রতিক্রিয়াপ্রিয় প্রতিষ্ঠান বড় বেশি বিদ্ধ হয়
বক্তাদের স্ফুলিঙ্গ-ছিটানো বক্তৃতায়, মিছিলের
শ্লোগানে শ্লোগানে প্রতিষ্ঠান পতনের সম্ভাবনা প্রজ্বলিত!
এদিকে অসুস্থ, প্রায় গৃহবন্দি আমি, জেনে যাই-
আমার পাড়ার সেই প্রগতির সাধক তরুণ,-
এলো সে বাড়িতে মধ্যরাতে
ত্র্যাম্বুলেন্সে বেজায় কাতর হয়ে জখমি শরীরে-
হারালো সে এক পা গুলির
স্বৈরাচারে। কাটে তার সঙ্গীহীন পঙ্গুত্বের কঠোর জীবন!
বন্ধুদের অনেকেই আজকাল ভুলেও দেয় না দেখা, আর
সেই সুন্দরীর পদচ্ছাপ
পড়ে না বাগানে তার, পঙ্গুত্বকে মেনে নিয়ে যুবা
কখনও দূরের আকাশের নীল আর
কখনও নিজের হাতে-গড়া বাগানের দ্রুতগামী মৃত্যু দেখে
কাটায় ধূসর দিন, কাঁটাময় অমাবস্যা-রাত।
১-৪-২০০৩
প্রকৃত কতটা পথ
প্রকৃত কতটা পথ শেষ তক পারবো পেরুতে,
জানা নেই। সময় যে ফুরিয়ে আসছে
ক্রমান্বয়ে অতি দ্রুত-এইটুকু বুঝি
সুনিশ্চিত। হঠাৎ কখন
কোথায় থামতে হবে কোন্ জনপদে
অথবা কেমন বিরানায়, সে-তো সুপ্ত অজানায়।
বস্তুত কাটছে কাল সরাইখানায়; অকস্মাৎ সবকিছু
নির্ঘাৎ পেছনে ফেলে কৃষ্ণ কুয়াশায়
মিশে যেতে হবে সুনিশ্চিত। নিজেকে পাবো না
খুঁজে কিছুতেই কোনওখানে। এমনই তো নিয়তির ক্রূর খেলা।
এই ভয়ঙ্কর সত্য জেনেও এখানে এই রৌদ্র ছায়াময়
পৃথিবীতে নিশ্বাস নেয়ার
প্রবল বাসনা নানা বিচ্ছেদ, হতাশা, আক্রমণ
সত্ত্বেও অটুট আজও। জীবনের আলিঙ্গন কাঙ্ক্ষণীয় খুব।
বর্তমানে এই আমি আয়নায় তাকাতে গেলেই
খানিক ভড়কে যাই নিজের চেহারা দেখে, এই যে লোকটা
সম্মুখে প্রতিফলিত, একে
আমি কতটুকু চিনি? কে সে বাস্তবিক? শামসুর
রাহমান নাম তার বটে, মাথাভরা একরাশ
সাদা চুল, ভাঙা চোরা মুখে
পশ্চিমাকাশের স্বর্ণথালার মতোই
আভা প্রতিফলিত এখন। আচমকা
এই দৃশ্য মুছে যাবে, জন্ম হবে আরেক দৃশ্যের,-
এমনই তো পট পরিবর্তনের পালা।
হঠাৎ যেদিন পৃথিবীর পট থেকে মুছে যাবো,
হয়তো আপনজন করবে স্মরণ কিছুদিন, তারপর
মুখের আদল এই মানবের ম্লান থেকে ম্লানতর
হয়ে যাবে, অন্ধকার বড়ই নিষ্ঠুর।
৯-৪-০৩
বন্ধু, চলেছো কোথায়?
তুমি যাচ্ছো দিব্যি পা চালিয়ে বন্ধু, তবে বলবে কি
এত দ্রুত চলেছ কোথায়? কোন্ মোড়ে, খোলা পথে
অথবা কোন্ গুপ্ত আস্তানায়? ভয় নেই,
আমি নই ছদ্মবেশী গুপ্তচর কোনও।
ডাকছি কখন থেকে উঁচু স্বরে, তুমি কি বধির? নইলে ভায়া
কেন হন-হনিয়ে হাঁটছো একবারও
না তাকিয়ে পেছনে তোমার? এমন কী
ঘটেছে যে, হায়, পালাবার পথ খুঁজছো কেবল?
জানি, আমাদের প্রিয় শহর দাঁতাল এক আঁধারের
মুখের গহ্বরে প’ড়ে বড় হাঁসফাঁস
করছে, বিষাক্ত বায়ু নেচে বেড়াচ্ছে চৌদিকে,
নানা ঠিকানায় জমিয়েছে আসর কী মৌজে আর
অপমৃত্যু প্লেগের ধরনে অতি দ্রুত
ছড়িয়ে পড়েছে শত শত বাড়ি ঘরে।
ইদানীং বিষণ্ণ চাঁদের গলাতেও ঝোলে মড়া,
গলা ইঁদুরের মালা! এসো নাগরিক বন্ধু সব
আজ ফের মিলেমিশে নিমেষে তাড়াই জাহাঁবাজ
আঁধারের ইয়ারবক্শিকে আর রটাই শান্তির জয়গাথা।
১০-১১-২০০২
বসরার গোলাপেরা হাসুক আবার
হিংস্র উড়োজাহাজের ঘন ঘন পীড়নে মৃত্তিকা
বড় বেশি আর্তনাদ করে,
কখনো কখনো জ্বলে ওঠে অভিমানে,
হয়তো-বা একদিন রুখেই দাঁড়াবে।
এই যে এখন বসরার গোলাপেরা আচানক
মুষড়ে পড়েছে খুব, বাগদাদে চলছে তাণ্ডব,
একদা নন্দিত মূর্তি লুণ্ঠিত ধুলায় ইদানীং
এই প্রবণতা অশুভের পূর্বাভাস সুনিশ্চিত।
তবে কি আখেরে বসরাও
বাগদাদে ঘোর অমাবস্যা
নেমে এলো? আমার দু’চোখে
ভয়ঙ্কর দৃশ্যাবলি কাঁপে।
রাত্তিরে শোবার আগে রবীন্দ্রনাথের
কিছু গান শোনার আশায় এক সি.ডি.
রেকড চাপাতে গিয়ে দেখি, কিয়দ্দূরে
একজন ইরাকী জননী বুকে তার
গুলিবিদ্ধ শিশুটিকে নিয়ে বড় একা
দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরো দেখি বারান্দায়
চিৎ হয়ে শুয়ে খুব কাতরাচ্ছে, হায়,
ইরাকেরই একজন যুদ্ধাহত সেনা।
আখেরে আক্রান্ত ইরাকের ভবিশ্যৎ কোন্ রূপে দেখা দেবে,
জানা নেই। সাদ্দামের অবসান হোক আর না-ই
হোক, শুভবাদী বিশ্ববাসী
তুলবেন দৃঢ় হাত ইরাকের সব দেশপ্রেমী
নর-নারী বিজয়ের পতাকার পক্ষে। বসরার
গোলাপেরা হাসুক আবার, শক্রমুক্ত হোক প্রিয় বাগদাদ।
১০-৪-২০০৩
বাগানটি আখেরে
আখেরে ভীষণ
অগোছালো হয়ে পড়েছিল সে-বাগান।
শুরুতে সৌন্দর্য ছিল সত্তাময়, পথচারী হেঁটে
যাওয়ার সময় আচমকা থেমে যেত,
পারতে না দৃষ্টি তার সহজে ফেরাতে। বিশেষত
একটি গোলাপ গাছ ছিল বটে অতুল সুন্দর।
সেই গোলাপের
পেলব সৌন্দর্য আমাকেই টেনে নেয়
খুব কাছে। উন্মাতাল আমি ওকে ঘিরে
কল্পনায় নানা ছবি আঁকি, সাজাই বাসরঘর।
আমাকে উন্মাদ ভেবে গোলাপ কাঁটার সহবতে
চলে যায়। খুঁজে তাকে কিছুতেই পাই না কোথাও।
বড়ই বেগানা
সেই বাগানের কথা মনে পড়ে জাগরণে আর
স্বপ্নে ভেসে ওঠে অপরূপ লাল একটি গোলাপ।
আচমকা স্বপ্ন ভেঙে গেলে
একটি কঙ্কাল এসে দাঁড়ায় শয্যার পাশে, হা!হা!
হেসে ওঠে। কঙ্কালে আগের চেনা গোলাপ স্ফুটিত।
৯-১২-২০০৩
বিরানায় হঠাৎ
কখনো কখনো অকস্মাৎ মনে হয়,
এখন কোথাও কেউ নেই। চার পাশে ভয়ঙ্কর
শূন্যতা আহলাদে আটখানা হয়ে ধেই
ধেই নেচে বেড়াচ্ছে সর্বত্র বিলুপ্তিতে!
আমিওতো প্রাণী এক, মানবই নিশ্চিত,
তবে এই আমি কেন দিব্যি রয়ে গেছি
এমন নিষ্প্রাণ শূন্যতায়? এ কি পুরস্কার? না কি
ভয়ঙ্কর শাস্তি কোনও? নারকীয় শাস্তি সুনিশ্চিত।
আমিতো আমার চার পাশে জীবনের কলরব
শোনার ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থাকি, এই
পাথরপ্রতিম নীরবতা বুকে চেপে থাকে, দূর
দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে কিসের অপেক্ষা করি?
গায়ে কাঁটা দেয়া নীরবতা আমাকে উন্মাদ করে
দেবে ভেবে পাথরের বুকে মাথা ঠুকে ঠুকে ব্যর্থ
জীবন বিলিয়ে দেবো হন্তারক বিরানায়। হঠাৎ দিগন্তে
মিছিলের মতো কিছু পরিস্ফুট, জীবনের মেলা আসছে এগিয়ে।
১৫-১২-২০০৩
বিষাদের ছায়া
এ ভাবে কি নিষ্প্রাণ, নিস্পৃহ থাকা যায়
বেশি দিন নিজের ছায়ার মতো? থাকা কি উচিত
আপনজনের মাঝে? তাহলে তো নানা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হবে
আমার দিকেই বারবার। বস্তুত হলোও ঠিক তাই। অনেকেই
আমাকে প্রশ্নের জালে আটকে মেটাতে চাইলেন
কৌতূহল। কী বলবো? পাইনি উত্তর খুঁজে কোনও।
তারপর থেকে নিজ বাসগৃহের বাসিন্দা কাছে এলে হাসি
এঁকে মুখে নানা কথা বলি,
কিন্তু, হায়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছন্দ পতনের ফলে
হাসি উবে যায় আর নিজেকেই খুব বোকা-বোকা মনে হয়।
কখনও কখনও ভাবি, অপূর্ব আনন্দনিকেতনে
আছি হেসে খেলে, সত্যি-সত্যি
কোথাও নিকট থেকে দুঃখ ভোলানো গানের সুর
কী মধুর ভেসে এসে আমাকে দখল করে নিচ্ছে ক্রমাগত।
আমি তো নিজেই জানি নকল আনন্দ বেশিক্ষণ
যায় না টিকিয়ে রাখা, যেমন অপটু অভিনেতা
খানিক পরেই ঠিক নিজের ব্যর্থতা তুলে ধরে
দর্শকের কাছে। তবু আমি মাঝে মাঝে
নিজ বাসগৃহের বাসিন্দাদের সন্দেহ ঘোচাতে চটপট
হাস্যরস জড়ানো গল্পের অবতারণা ক’রেই
হাসির ফোয়ারা খুলে দিই সাড়ম্বরে কখনও বা
ভূতুড়ে গল্পের শিহরন সৃষ্টিতে উদ্যোগী হই রাতিবেলা।
অথচ আমার বিষণ্নতা ভেসে ওঠে বারবার চেহারায়,
মধ্যরাতে গাঢ়তর হয়ে পড়ে বিষাদের ছায়া।
১৮-১২-২০০২
বিড়াল-শূন্য বারান্দা
আমি কি এভাবে নিজেকেই কুরে কুরে খেয়ে ফেলে
বাহবা কুড়িয়ে যাবো দশদিকে? দ্যাখো,
এই ক্ষয়া আমাকে খুঁটিয়ে দ্যাখো। না, না,
অমন কষ্টের ভার স’য়ে যাওয়া আমার নিয়তি সুনিশ্চিত।
আসবে কি তোমরা আমার আস্তানায়? না, তেমন
বিড়ম্বনা হবে না পোয়াতে। দেখে যাও,
এখানে তেমন ভিড় নেই আসবাবপত্রের, কেবই কিছু
পছন্দের বইপত্র আছে। মাঝে মাঝে
চাইলে অথবা না চাইলে
কিয়দ্দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির মধুর সুর।
আমার বিনীত বারান্দার প্রায়ঃশই একটি বিড়াল এসে
বসে থাকে খাদ্যের আশায়। আমি ওকে
হামেশা আমার পাত্র থেকে মাছ, মাংস
কিংবা অন্য কোনও খাদ্য দিই ভালবেসে।
বেশ কিছুদিন পর লক্ষ্য করি, সেই
অতিথি আমার মানে বিড়ালটি আসে না আর; প্রশ্ন জাগে-
কোথায় হারিয়ে গেলো কোন্ ঝোপঝাড়ে? সে কি তবে
হয়েছে শিকার দ্রুত ধাবমান কোনও মোটর কারের?
জানতে পারিনি আজও কে বাজায় বাঁশি। সে কি সুখী?
নাকি কোনও গুপ্ত বেদনার ছায়া তাকে
রয়েছে দখল করে বহুদিন থেকে। ব্যক্তিগত
দুঃখের আঁচড়ে আমি যতদূর পারি
আড়ালেই রাখি। তবু বারান্দার সেই বিড়ালের
খাঁ খাঁ অনুপস্থিতির ছায়া শূন্যতাকে আরও গাঢ় ক’রে তোলে।
বেশ কিছুকাল পর ভুলে যাই চেনা বিড়ালের উপস্থিতি-
চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ি, কখনও টেবিলে
ঝুঁকে কোনও অসমাপ্ত কবিতার শেষ পঙ্ক্তিমালা
রচনায় ফের দরবেশ তুল্য ধ্যানী হয়ে যাই।
১১-১২-২০০৩
মরণ-বিরোধী পঙ্ক্তিমালা
আমি গোলাকার চাঁদ এবং জ্যোস্নাধারার কথা
চিন্তা করি, অথচ ঘোর অমাবস্যা
ধেয়ে আসে আমার দিকে। মনে হয়, একটা
কুচকুকে কালো কাফন আমাকে ঢেকে ফেলেছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাহলে
আমার দিন কি ফুরিয়ে এলো? চিরকালের জন্যে
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই শরীর আমার,
যাকে কত যত্নেই না ধুলোবালি, নোংরা
আবর্জনা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি? শরীর একটু
বিগড়ে গেলেই তো ধর্না দিই চিকিৎসকের দুয়ারে।
এই যে আমি বন্ধুদের মজলিশে দিলখোশ গল্পে
মেতে থাকি কখনও সখনও, এই যে চার বছরের
পৌত্রী দীপিতার কষ্ট ভোলানো
হাসির ঝলক আমাকে কোনও পবিত্র এলাকায়
নিয়ে যায় অথবা কোনও বিগত কবির পঙ্ক্তিমালা
আমার চেতনায় অপরূপ পাখি হয়ে
ভাসতে থাকে, তখন আমার নামের আড়ালে
যে সত্তার বসবাস, তার জন্যে মন কেমন উদাস হয়ে যায়।
যদি বলি, মৃত্যুকে আমি ঘৃণা করি, মৃত্যুর মুখ দেখার
কোনও সাধ নেই আমার,
তবে কি এ কথা শুনে সবাই হেসে উঠবে
ঘরদোর কাঁপিয়ে? মরণের ভয়ানক চোখমুখবিহীন
মুখ দেখার, জীবনের শপথ, সত্যি বলছি
এক কণা সাধ নেই এই বান্দার।
৩-৪-২০০৩
মরমী কবি এবং পথচারী
জনৈক মরমী কবি বড় একা যাচ্ছিলেন হেঁটে
ফুটপাতে হলুদ বিকেলে। পথচারীদের তিনি
লক্ষ করেছিলেন অথবা না করেই অন্য মনে
ভাসমান মেঘ কিংবা উড়ন্ত পাখি
রূপ দেখে নাকি কবিতার পঙ্ক্তিমালা
ভাবতে ভাবতে, কেউ বলতে পারে না।
কিছু পথ তিনি অতিক্রম করতেই তিন চারজন লোক,
পরম উৎসাহী, ঘিরে ধরে আলাভোলা
কবিকে এবং বোকা-সোকা কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে
ভীষণ বিব্রত করে তাকে। নিরুত্তর তিনি মৃদু
হেসে শুধু তাকান ওদের দিকে সপ্রেম প্রশয়ে। আকাশের
সূর্য বুঝি লজ্জায় লুকোয় মুখ মেঘের বোরকায়।
কিয়দ্দূরে জনৈক যুবক, কবিতার গভীর পাঠক, স্মিত
হেসে যাত্রা থামিয়ে কবির
বিবতির, তার মতে, হেনস্থার দৃশ্য তাকে প্রায়
রুষ্ট করে তোলে এক লহমায়, কিন্তু কোনও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া
প্রদর্শনে ব্যর্থতার অন্ধকার বয়ে নিয়ে বুকে
ফুটপাতে দ্রুত, অতি দ্রুত হেঁটে যেতে শুরু করে।
১৯-১১-২০০২
মিশে যাচ্ছে গাধার বিষ্ঠায়
সম্প্রতি হঠাৎ ক্ষণে কী-যে হয়, ভোরবেলা
দশটি বছর ব্যবহৃত আমার আপনকার
ঘরের চেহারা যেন কোনও ম্যাজেশিয়ানের অঙ্গুলি হেলনে
বড় বেশি পাল্টে যায়। বিছানা গায়েব, কিছু দূরে
রাখা ছোট বইপত্র-বোঝাই টেবিল
পোকামাকড়ের রাজধানী, চার দেয়ালের গায়ে
ঝুলে আছে অসংখ্য করোটি ফাঁকা মুখে বাঁকা হাসি
নিয়ে আর মেঝে জুড়ে তীক্ষ্ণ মাথা-উঁচানো কাঁটার ভিড়ভাট্রা!
দুপুর হতেই ঘরে কে জানে কোত্থেকে এসে ধু-ধু তেপান্তর
ঢুকে পড়ে, রুক্ষ এই এলাকায় ক’জন পথিক
পিপাসায় হা-পিত্যেশ করে আর এদিকে ওদিকে
তাকায় কাতর চোখে। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরে বিশুষ্ক ধুলোয়।
অপরাহ্নে এই ঘর আচানক রূপান্তরে বড়ই নিঝুম
গোরস্তান হয়ে যায়, তিনজন দরবেশ কবরের পাশে
হাঁটু গেড়ে ব’সে মারফতি সুরে দুলে দুলে সেই
জনহীন এলাকাকে সচকিত ক’রে
মৌনব্রতে ডুবে যান। সূর্য অস্তমিত হ’লে গোরস্তান এক
লহমায় জমকালো সার্কাস দলের
আস্তানায় পাল্টে যায়। আসমান থেকে এক দল উল্লসিত
তারা নেমে যুবতী নর্তকীদের সঙ্গে তোফা নৃত্য জুড়ে দেয়।
মধ্যরাতে স্বপ্ন দ্যাখে অমাবস্যা গাঢ় থেকে গাঢ়তর আর
গাঢ়তম হয় শেষে। পূর্ণিমার আকাঙ্ক্ষায় হাঁসফাঁস করে
উৎপীড়নে বড় নাজেহাল, দুঃখী গ্রাম ও নগর-
যে-স্বপ্ন সবার চোখে স্বর্গীয় পুষ্পের মতো ফোটে তার নম্র
পাপড়ি সকল আজ ঘোড়া আর গরু-ছাগলের
পদতলে বেজায় দলিত হচ্ছে, মিশে যাচ্ছে গাধার বিষ্ঠায়!
০৯-১১-২০০২
রাতের তৃতীয় প্রহরে
স্বপ্ন দেখি, রাতে তৃতীয় প্রহরে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে
অমাবস্যার দিকে তাকিয়ে রয়েছি
সেই কবে থেকে। আমি কি
ঘুটঘুটে অন্ধকারের বুকে উজ্জ্বল
কিছু দেখার প্রত্যাশায় এতক্ষণ প্রতীক্ষাকে অনড়
রাখার চেষ্টা কায়েম রেখেছি? কেন আমি খামোকা
বারবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি জানলার বাইরে,
বুঝতে পারছি না কিছুতে।
ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে যাচ্ছি, আবার
গড়ে উঠছি কোন্ ভাস্করের অসামান্য শৈল্পিক
প্রয়াসে? আজকের এই একাকিত্ব আমাকে
খুবলে খাচ্ছে শকুনের ভঙ্গিতে।
জানলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শরীর
অদূরে রাখা চেয়ারে
স্থাপন করে মন এলিয়ে দিই খানিক
ভাবনায় স্রোতে। স্রোতবাহী এক হাঙর
আমাকে বেধড়ক কামড়াতে থাকে। হঠাৎ
বন্ধ দরজায় ধাক্কা অবিরাম, বেয়াড়া।
দোর খুলতেই দেখি, ক’জন ডাকাবুকো লোক আমার
দিকে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে
দাঁড়ানো। কেন যে ওরা কারো সাতে পাঁচে নেই এমন
একজনের প্রায় নিঃস্ব, বিনম্র, বিনীত বাসায় হানা দিয়েছে-
ভেবে পাওয়া ভার। ‘চল শালা আমাদের সাথে’ ওদের
কর্কশ কণ্ঠস্বর গর্জে ওঠে, নিরুপায় আমি মেনে নিই সেই হুকুম।
বিরান এক এলাকায় হুট করে নিয়ে গিয়ে সেসব
জাঁহাবাজ, অস্ত্রবাজ গুলির
বৃষ্টিতে আমাকে আপাদমস্তক ভাসায় ভীষণ এবং
নিমেষে আমি মৃত্যুর কবলে পড়ে যাই। রক্তাক্ত
আমার লাশ কাঁটা-ঝোপে আন্ধারে
পড়ে থাকে; পরে পশুর খাদ্য হয়ে রূপান্তরিত কঙ্কালে।
শেয়াল, কুকুর আমার ভ্যাবাচ্যাকা করোটিকে শুঁকে অথবা
চেটে-চুটে ফেলে যায় ঝোপঝাড়ে। হঠাৎ
জেগে উঠি নিজের কৃপণ কামরায় এক গা’
ঘেমে-চেতনাকে দুঃস্বপ্ন ক্রমাগত করতে থাকে আঘাত।
৯-৪-২০০৩
রৌদ্র ছায়াময় পৃথিবীতে
জানা আছে, নতুনের আকর্ষণে বিচিত্র গাছের
পুরনো সবুজ পাতা হলুদের রঙ
পেয়ে ঝরে যেতে থাকে, যেমন পুরনো
বছরের মৃত্যু হলে নতুন বছর জন্ম নেয় সবুজের
দীপ্ত নিয়ে। এভাবেই কাটে দিন, কাটে
রাত ক্রমাগত বার বার অন্ধকার আর আলো-ছায়া নিয়ে।
কে তুমি আমাকো ডাকো কখনো সকালে, কখনো-বা
মধ্যরাতে? সেই ডাক আমাকে ঘরের
বাইরে নেয়ার সুরে ঝরে পড়ে চতুর্দিকে। জ্বল জ্বল সব
তারা মানবিক কণ্ঠস্বরে ডেকে ডেকে
আমাকে স্থাপন করে জনহীন খোলা পথে। আমি
মন্ত্রমুগ্ধ পথিকের মতো হেঁটে যেতে থাকি জানি না কোথায়।
এমন যাত্রায় কেন জানি যমজ ভাইয়ের মতো ঘন ঘন
আনন্দ, বেদনা উভয়কে আলিঙ্গন
করে যেতে হয়, যতদিন রৌদ্র ছায়াময় পৃথিবীতে
হেঁটে যাবো কখনো ঝরিয়ে ঘাম, কখনো হাওয়ার
আদর প্রফুল্লচিত্তে সম্মুখে এগিয়ে যাবো, আশার ছলনা
যতই ভ্রষ্টার মতো ভীষণ ছলনাময় চুমো খেতে খেতে!
২৯-১২-২০০৩
লালনের টানে
(আবুল আহসান চৌধুরী প্রিয়বরেষু)
কোনো এক উদাস বিকেলে, মনে হয়, তোমার পড়ার ঘর
থেকে সাংকেতিক এক প্রগাঢ় ভাষায়
তোমাকে দূরের
সবুজ মাঠের দিকে যেন কেউ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। তুমি
নিজের ভেতরে স্বপ্ন-জাগানিয়া এক আলোড়ন
টের পেয়ে তাকালে চৌদিকে বিস্ময়ের ঝলসানি-লাগা চোখে।
মনে শূন্যতার সাদা প্রভাবে নিজেই যেন হেঁটে
হেঁটে সামনের কিছু প্রাপ্তির আশায় বুঝি পা দুটি সচল
রাখলে অনেকক্ষণ আরও। দূর থেকে
ভেসে আসে দোতারার সুর।
সমুখে ক্রমশ ফুটে ওঠে একজন পক্ককেশ বাউলের
মুখ আর গীত, ক্ষণকাল পরে তার
গীতসুধা যায় থেমে তোমার উদ্দীপ্ত পদধ্বনি বেজে উঠতেই আর খুব কাছে
গিয়ে বলো তুমি ‘দৃষ্টিহারা
আপনি, অথচ বোঝা গেল বিলক্ষণ কী প্রখর
উজ্জ্বল নজর আপনার’।
বাইরের দৃষ্টি নয়, অন্তরের চোখে দেখে নিই
দেখান যা সাঁই,’ বলে তিনি গাইতে গাইতে
গেলেন মিলিয়ে পথে গোধূলিতে। চমকিত তুমি
অতি দ্রুত পা চালিয়ে পৌঁছে গেলে ভিন্নরূপে আপন ভুবনে।
৩-১২-২০০২
শীতের পাতার মতো
আমি যে যুবক নই আর, পদে পদে বিলক্ষণ
টের পেয়ে যাই, তাই আয়নার মুখোমুখি হ’লে
নিজের চেহারা দেখে ভীষণ চমকে
উঠি, প্রশ্ন করি-
কে এই লোকটা? আজ এই ভোরবেলা
আমার শোবার ঘরে কী ভাবে প্রবেশ করেছে সে
কারো অনুমতি ছাড়া? যতদূর জানি, এ বাড়ির
কেউ তাকে এই ঘরে ঢোকার দেয়নি অনুমতি।
বুড়োসুড়ো এই লোক শীতের প্রতাপে
বড়ই কাতর, মনে হয়। মুখের চামড়া তার
ভীষণ কুঁকড়ে গেছে, মাথার ক্ষয়িষ্ণু চুল যেন এক রাশ
কাশফুল, চোখ দু’টি ঈষৎ নিষ্প্রভ। এই মাঘে
লোকটাকে, বাড়ির বাইরে তাড়ানো কি
মানবিক আচরণ? এই ঘর থেকে
বাড়ির আলাদা কোনও ঘরে বসানো উচিত হবে,
গরম চা আর এক বাটি মুড়ি দেয়া যেতে পারে।
এসব কী বলছি দাঁড়িয়ে আয়নার
সম্মুখে এমন হাড়-কাঁপানো শীতের ভোরবেলা? হায়, আমি
নিজেকেই অন্য কোনও লোক ভেবে নিয়ে এতক্ষণ
আবোল তাবোল বকে গেছি বাঘ-তাড়ানো মাঘের
হিমায়িত প্রভাতী প্রহরে। কম্পমান আমি শীতের দংশনে
এবং চকিতে চিন্তা ধাবমান দুঃখিনী বাংলার
দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকায় যেখানে মানব, মানবীর প্রাণ
শীতের পাতার মতো ঝরে যায় বনি আদমের অগোচরে!
সহস্র ক্ষুধার্ত চোখ-মুখ
এমন একটা সময় ছিল, যখন
প্রায়শই সকালে অথবা বিকেলে
নদীতীরে হেঁটে বেড়াতাম কিংবা আয়েশে
বসতাম একা। বহুদিন থেকে হঠাৎ
সেই প্রিয় অভ্যাস কেন যে আমাকে
ত্যাগ করেছে, বুঝতেই পারিনি।
এখন আমি ছোট ঘরের এক কোণে একলা
বসে থাকি। আলসেমির এভাবে
কত যে বেলা আমাকে ছুঁয়ে কোথায়
মিলিয়ে যায়, বুঝতে পারি না কিছুতে।
বিকেলে দেখি, আমার ঘরের কিনারে
এক নিঝুম জলাশয়ে কতিপয় হরিণ
মুখ ডুবিয়ে জলপানে মগ্ন এবং খানিক
পরে এদিক সেদিক গোয়েন্দার মতো তাকায়।
আচমকা সেই দৃশ্য মুছে গিয়ে দৃষ্টিতে
ফুটে ওঠে কজন বাউলের আসর
এবং লালনের গান চৌদিকে, উৎসুক আকাশে
ছেয়ে যায় এবং একতারা সুর ঝরায়-
সেই সুরে বাউল নর্তক হয়, জ্যোৎস্না নর্তকী। দিগন্তে হঠাৎ
মঙ্গা সহস্র চোখ-মুখ হয়ে বানবতাকে শাসায়!
১০-১২-২০০৩
সানন্দে সাঁতার কাটে কয়েকটি হাঁস
আমাকে পেছনে টেনে নিতে
চায় কারো? রাতে না ঘুমিয়ে ভোরবেলা
সামনে এগিয়ে যেতে না যেতেই, এ কি!
হঠাৎ পেছন থেকে কারা যেন টেনে
ধরে খুব জোড়ে মুখ থুবড়ে পড়ার
নির্ঘাৎ আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়া ভার।
পেছনের দিকে দৃষ্টি না দিয়েই দ্রুত
হেঁটে যেতে থাকি সামনের দিকে। বিদঘুটে কিছু
শব্দ কানে আসে ক্রমাগত, যেন সেই
আওয়াজ ভীষণ হিংস্র কুকুরের মতো
কামড়াতে বেজায় মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি চোখে
রোদমাখা শূন্যে শত তারা দেখে ফেলি!
হাঁপাতে হাঁপাতে এক জলাশয়ের নিকটে এসে
যেন স্বস্তি পাই আর এসে পড়ি ঢের পাতাময়
একটি গাছের নিচে। প্রায়
ঘুমের নিঝুম আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করে
অতিদূর মেঘে ভেসে যেতে থাকি আর
অপরূপ ক’টি পাখি কী মধুর গান গেয়ে যায়।
কিন্তু এ কী? আমিতো দাঁড়িয়ে আছি ঠিক
আগের জায়গাতেই। নড়িনি, চড়িনি
এক চুলও, ছুটে আমি যাইনি কোথাও।
ভোরবেলাকার সেই একই দৃশ্যাবলি
প্রস্ফুটিত, ছলছলমান হ্রদের রুপালি জলে
সানন্দে সাঁতার কাটে কয়েকটি হাঁস উপদ্রবহীনতায়।
সেই কাঙ্ক্ষিত সংবাদ
দিন, মাস, বছরের পর বছর লোকটা
মন দিয়ে পড়ছে খবরের কাগজ। প্রতিটি খবর
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে এক বিশেষ
সংবাদের জন্যে। তন্নতন্ন ক’রে খুঁজেও
তার আশা পূর্ণ হচ্ছে না
কিছুতেই। খুঁজছে, তবু খুঁজছে।
আকাঙ্ক্ষিত খবরটি খুঁজতে খুঁজতে সন্ধানী
লোকটির সব কালো চুল শাদা হয়ে গেছে এবং
চশমার কাচ পুরু থেকে পুরুতর হচ্ছে, অথচ
কিছুতে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না
যা দেখার, পড়ার জন্যে তন্নতন্ন ক’রে খুঁজছে
প্রতিটি পাতা, ঘোর অমাবস্যায় সে খুঁজছে পূর্ণিমা।
খবরের কাগজের স্তূপে লোকটা
প্রায় ডুবে যাচ্ছে, তবু নিভে-আসা চোখের
মৃদু আলোয় ভেসে উঠছে না কাঙ্ক্ষিত সংবাদ,
তবু সে খুঁজছে, খুঁজতে থাকবে সর্বদা।
কয়েক অমাবস্যার পর এক পূর্ণিমায় প্রতিটি
শহর ও গ্রাম ঝলসে উঠলো অপরূপ মুক্তির
আলোয়। প্রতিটি সংবাদপত্রে ইয়া বড় হরফে মুদ্রিত
হলো সেই সংবাদ সেই অনুসন্ধানী লোকটি অনুপস্থিত এখন।
১২-১১-২০০৩
হেঁটে যেতে যেতে
বাঁকাচোরা পথে হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো যেন
আকস্মাৎ আকাশ চৌচির
হয়ে গেলে নক্ষত্রেরা মাটিতে লুটোয়,-
সেগুলো কুড়িয়ে নিতে শিশু,
বুড়ো, যুবা যুবতী সবারই
বড় সাধ হয়। এমনকি
ভিখিরীরা নিজ নিজ কোচর ভরার
প্রতিযোগিতায় খুব দড় হয়ে ওঠে-
এই চিত্র ভাসমান দৃষ্টিতে আমার। পথ যেন
হঠাৎ সরিয়ে নিলো কেউ।
সেই দৃশ্য মুছে গেলে বাড়ির দিকেই যেতে চাই
এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে ক্লান্ত হই;
বাড়ির পথ কি তবে স্মরণের আলো থেকে দূরে,
বহুদূরে অজানায় নিশ্চিহ্ন এখন?
তাহলে কী হবে এই বড় ছন্নছাড়া,
বিপন্ন আমার? পথ, করুণায় প্রস্ফুটিত হও।
ক্রমাগত হেঁটে চলি, খুঁজে ফিরি নিজের অভীষ্ট
নিকেতন, ব্যর্থতা ভীষণ পীড়া দেয়। পথে পাই
কেবল বধির, মূক পথচারী। তারা
নয় কোনও সহায় আমার। হাঁটি, হাটি,
শুধু হাঁটি, ক্লান্তির কুয়াশা গিলে খায়, চক্ষুদ্বয়
বন্ধ হয়ে আসে, তবু ঝুঁকে, কেঁপে কেঁপে পথ চলি।
১৮-৪-২০০৩