রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে
রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে হঠাৎ ঝিনুকের আবরণ থেকে
বেরিয়ে এলো যমজ মুক্তো-দু’টি আশ্চর্য দিন
আমার ধূসরতাকে
ঝকঝকে শ্যামলিমায় রূপান্তরিত করে
এখন স্মৃতিতে সঞ্চরণশীল। প্রাত্যহিকতার
দাসত্বের শেকল গেল খসে,
যখন অনেকদিন পর তোমাকে
আবার দেখলাম
সম্মেলন প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের কবিতা
আর গানের ভিতর দিয়ে।
অনেক মুখের আড়ালে তোমার মুখ
মঙ্গল প্রদীপ যেন, আমি তার আলোয়
অবগাহন প্রার্থী। একটু কেবল কাছে বসতে চাওয়া
মুকুলিত হয়ে ঝরে যায় অলক্ষ্যে। আমাদের
দু’জনের মধ্যে সুদূরতা আক্রোশে
ফুঁসতে থাকে; বাসনার ঢেউয়ের আঘাতে
অবসন্ন আমি, মাঝে মাঝে ক্ষুধিত গাংচিল
সন্ধ্যার ঢেউয়ে ডানা ঈষৎ ভিজিয়ে উড়তে থাকে চৌদিকে।
আমি আমার সকল স্বপ্ন, সকল ব্যাকুলতা,
আমার অবরুদ্ধ অভিমান,
আমার কবিতার কাতরতা
তোমার চোখে, অধরে, বুকে, হাতে
অর্পণ করতে চাইলাম নতুন করে। এমন
ভিড়ে, কোলাহলে আমার নির্জন নৈবেদ্য
তোমাকে ছুঁতে পারলো কি না,
কি করে বুঝবো?আমার যন্ত্রণা
আড়াল করে বসে রইলাম এক কোণে। ভেবেছিলাম,
এই সুরেলা সম্মেলনে আমাদের দু’জনকে
নিয়ে যাবে অনুপম সুরতীর্থে, অথচ
কেমন বেসুরো, কর্কশ হয়ে যায় সন্ধ্যার মেঘমালা।
শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, খোলা আকাশ,
বকুলতলা আমাদের কিছুক্ষণের জন্য
কাছে এনে দূরে ঠেলে দেয় আবার। খুচরো, কৃপণ
আলাপের আড়ালে মাথা কোটে হৃদয়ের গভীর ধ্বনি।
যাবার বেলায় কিছু অপ্রয়োজনীয়, নিষ্ঠুর
অক্ষর উপহার দিয়ে হঠাৎ ছুটে এলে তুমি
মোটরকারের কাছে, যেখানে বসেছিলাম নিস্তব্ধতায়
নিঝুম আসন্ন বিচ্ছেদে কাতর। তুমি মোটরকারের
জানালার কাচে হাত রাখলে, আমিও
আমার হাত স্থাপন করি একই জায়গায় ওপার থেকে।
বৈরী কাচ দু’টি মিলন-তৃষিত হাতের
স্পর্শের শক্রতা সেধে অনড়। তোমার দু’চোখ
শ্রাবণের আকাশ, কুয়াশাচ্ছন্ন; আমাদের অসহায় নিঃসঙ্গতা
বুঝিবা তারাবিহীন নিশীথকে বলতে চাইলো, ‘তবু মনে রেখো’।
শতাব্দী এবং একটি পাখি
শতাব্দী শারদ ভোরে বারান্দায় নিজের মনের সঙ্গে
খেলছিল কী মধুর খেলা। বাস্তবিক
সে নিজেই জানে না কিছুই
তার মনো-ক্রীড়ার ব্যাকরণ।
সোফাটায় এলিয়ে শরীর বসে থাকে
চুপচাপ, সোনালি পায়ের কাছে লুটোপুটি খায়
বিশ্বের খবর, দ্যাখে বারান্দায় কাছের গাছের
ডালে এক হলুদ রঙের পাখি দোল
খেয়ে ভোরটিকে সুরময় করে তোলে
অজানা আনন্দে। শতাব্দীর হৃদয়ের তন্ত্রীমালা
বেজে ওঠে; চকিতে সে পাখিটিকে দিকে
চোখ রেখে প্রেশ্ন করে, ‘কবি কি আসবে আজ ভোরে?’
পাখি বুঝি শতাব্দীর ব্যাকুলতা বুঝে নেয় নিজের রীতিতে,
বলে সুর তোলে-
‘এই তো এসেছি আমি তোমার কবির দূর হয়ে। হায় মেয়ে,
তুমি তো জানো না, কাল সারারাত কবি
বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিয়েছে নিদ্রাহীন। কাঁটাবনে
ঘুরে ঘুরে আহত হয়েছে তার শরীর, হৃদয়। নিশীথের
তৃতীয় প্রহরে, শোনো শতাব্দী, তোমার সুরক্ষিত
নিবাসের চারপাশে দীর্ঘশ্বাস বিছিয়ে দিয়েছে
কবি, তুমি ঘুমের নরম মেঘদলে ভাসমান
সে সময়। এ সকালে একবার কাছে ডেকে নাও, আসবে সে
ছুটে নগ্ন পায়ে, রুক্ষ বেশে, উস্কো-খুস্কো চুলে,
তুমি ওকে কোলে মাথা খানিক রাখতে দিও, হে সুন্দরীতমা।
‘তুমি তো জানোই পাখি,’ শতাব্দীর কণ্ঠস্বর ছোঁয়
হলুদ পাখিকে, আমি আমার প্রতিটি
মুহূর্ত সাজিয়ে রাখি কবির উদ্দেশে, আমি তার
পথ চেয়ে থাকি, তার জন্যে এ হৃদয়ে
সময় কি অসময় নেই, কিন্তু বড়ই নির্দয়
জগৎ-সংসার; করাতের মতো কেটে ফেলে
প্রকৃত মিলন বেলা। ইচ্ছে মতো ডেকে নেব কাছে,
কী করে সঞ্চয় করি সে সাহস, হে পক্ষী, তুমিই বলে দাও!
মাঝে-মধ্যে কী-যে হয়, কেউটের মতো
এক প্রশ্ন ফণা তোলে-কবি কি আমাকে প্রকৃতই
ভালোবাসে? না কি
এ এক মোহন খেলা ওর? হে পাখি জবাব দাও’।
হল্দে পাখি শতাব্দীর কানে কানে বলে-
‘ভালোবাসা বলে কাকে, তা আমার অজানা, অথচ
ঠিক জানি, কবির রক্তের প্রতি ফোঁটা
কেবলি তোমারই নাম করে উচ্চারণ। আরো বলি,
এই যে তোমাকে সাত সকালে দেখছি আমি, তা-ও
কবিকে করবে ঈর্ষাতুর। আমি এই মাত্র দেখে
এসেছি, সে তোমাকে ভেবেই অন্তর্গত
যন্ত্রণাকে কবিতায় করছে তর্জমা।
২১.৯.৯৪
শতাব্দীর জন্যে
শতাব্দী হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে-
আচ্ছা ধরো, যদি তোমার হাত থেকে এখন
কবিতার বই ছিনিয়ে নিই,
কী করবে তুমি? তোমার মেজাজ
চৈত্রের দুপুর হয়ে যাবে নিশ্চয়। এই দ্যাখো,
কেড়ে নিলাম তোমার সাধের আধুনিক বাংলা কবিতা।
মাথা পেছনে হেলিয়ে বলি, যখন
খোদ কবিতাই আলিঙ্গনে বেঁধেছে আমাকে,
তখন কয়েকটি মুদ্রিত অক্ষর নিয়ে
কী করব আমি? অক্ষর সমুদয় উড়ে যাক মেঘমালায়।
আচ্ছা ধরো, শতাব্দী এবার আমার মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে বলে, সমাজতন্ত্র পুরাণের পাখির মতো
ভস্মরাশি থেমে পুনরায় জ্বলজ্বলে রূপে
জেগে উঠবে কি না, এমন ভাবনায় মগ্ন তুমি আর
ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার হাতে আমি
একটি আপেল দিয়ে বললাম, এসো আমরা দু’জন
দু’দণ্ড গল্প করি, তখন কী করবে তুমি? খুব রেগে যাবে,
তাই না? ম্লান করে দেবে আমার মুখ?
না, তেমন কিছুই হবে না, শতাব্দী। তোমার আপেলের
স্বাদ নিতে-নিতে কথা বলব ওই গহন দু’টি
চোখের দিকে তাকিয়ে, বলব লতাগুল্ম, পাখি,
নদী, নৌকোর গলুই, শস্যক্ষেত, লালনের আরশিনগর,
আর গেরুয়া বসনধারী বাউলের কথা, বলব
আমাদের ভালোবাসার কথা।
শতাব্দীর কণ্ঠ ঝরায় অপরূপ ধ্বনি-
আচ্ছা কবি, ধরা যাক, তুমি প্রস্তুত হচ্ছো
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী মিছিলে
যোগ দেওয়ার জন্যে, আর সেই মুহূর্তে
আমি বললাম, কিছুতেই তোমাকে
যেতে দেবো ন। বলতে হবে, তখন কী করবে তুমি?
শোনো শতাব্দী, যদি তেমন কিছু ঘটে, তাহলে আমি
শুনব না তোমার বারণ। বরং তোমার হিরন্ময় হাত ধরে
যুগলবন্দি দীপক রাগ হয়ে পা বাড়াব
খোলা পথে, নিশ্চিত মিশে যাব ভাস্বর জনস্রোতে।