যদি তোমার পাশে থাকতাম
কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আর মুয়াজ্জিনের সুরেলা আজান
ছুঁয়ে যাচ্ছে সুবে সাদিকের ঘুমন্ত শহরকে
নিদ্রাতুর শহরের ঠোঁট ঈষৎ খুলে যায়
দু’টি ফুল ফোটার মতো। এখন তুমি ঘুমিয়ে আছো।
কখন তোমার শরীর থেকে ঘুমের পাপড়িগুলো
খসে পড়বে, জানি না। ভোরবেলার
ঘুমভাঙা মুহূর্তেই কি তোমার মনে পড়বে
এই আমাকে, যে এখন বসে আছে লেখার টেবিলে,
যে তোমার নিদ্রাকে অনুভব করতে চাইছে
শিরায় শিরায়, যে তোমার শরীরের প্রতিটি ভঙ্গি
আবৃত্তি করছে এই মুহূর্তে, যার মগজে
গুনগুনিয়ে উঠছে না-লেখা কবিতার সোনালি ভ্রমর।
যদি এখন আমি তোমার পাশে থাকতে পারতাম, আমার
উৎসুক আঙুলেরা ঘুমের হ্রদ থেকে তোমাকে
টেনে তুলতো নিপুণ জেলের মতো; আমার ওষ্ঠ তোমার ঠোঁটের
স্বপ্নমদির তীরে ফেলতো নোঙর। আমার দৃষ্টি
বিস্ময়ের রেখা এঁকে দিতো তোমার সারা শরীরে,
যেমন কোনো শ্রমনষ্ঠ কৃষক
তার জমিতে দাগ কাটে ফসল ফলানোর
স্বপ্নে বিভোর। তোমার ঘুমে টোল পড়তেই
আমাকে নিবিড় জড়িয়ে ধরতে তুমি। তখন তোমার সত্তা
হাসিতে উদ্ভাসিত, তোমার গোলাপি উপকূলে জেগে-ওঠার
উচ্ছ্বসিত ফেনা, সেই ফেনায় মুখ ধুয়ে
আমি সম্মানিত, সুখী এবং ঋণী হবো নতুন করে।
যদি তোমার পাশে থাকতে পারতাম
এখন এই সোনালি ঘণ্টার ধ্বনিময় প্রহরে,
তুমি আমার বুকে মাথা গুঁজে বলতে, ‘কী? কী? কী?’
নিরুত্তর আমি শুধু তাকিয়ে থাকতাম,
তোমার চিবুক তুলে ধরে নতুন কিছু
আবিষ্কারের আনন্দে অভিভূত হতাম, যেমন
স্বর্গোদ্যানের কোনো বৃক্ষছায়ায় শুয়ে আদম
হাওয়ার দিকে দৃষ্টি মেলে বিস্ময়-বিহ্বল, প্রশ্নাকুল।
১৫.১২.৯৪
যদি ফিরে আসি
মা, তোমার আর আমার মধ্যে পনের বছরের
ব্যবধান। তোমার মুখের রঙিন সূর্যাস্ত আমাকে
বলছে আমাদের দূরত্ব আর
নৈকট্যের দীর্ঘ কাহিনী-বলেছে,
কী করে তুমি আমাকে স্নেহের সরোবরে
নাইয়েছ প্রতিদিন। তোমার দোয়ার
পাপড়িগুলো নীরবে
ঝরেছে আমার ওপর।
তোমার শুভকামনা দিয়ে আমাকে
আগলে রেখেছ প্রতি মুহূর্তে।
তোমার কাছেই শিখেছি ঔদার্য, মানবপ্রীতি,
তুমি আমাকে দাঁড়াতে
শিখিয়েছ সত্যের সূর্যোদয়ের সামনে।
তোমার কাছে চিরঋণী আমি,
এই উচ্চারণ এমন তুচ্ছ যে,
তোমাকে বলিও নি কোনোদিন।
মা, সেদিন খর দুপুরে, তুমি আমাকে
ব্যাকুল কণ্ঠে বললে, ‘তুমি যাবে না
আর কোনো জনসভায়
অথবা মিছিল। চাই না
তুমি রক্ত-জবার মতো কথা বলো কোথাও।
তোমার কণ্ঠনালি ওরা চেপে ধরতে চায়,
তা-কি অজানা তোমার?
না, তুমি কোথাও যাবে না আর।
আমার নির্দেশ সবার ওপর জেনো।
মা, তোমার নির্দেশ হিতকথার মতো
অবশ্য মান্য। তোমার বারণকে
সম্মান জানাতে গিয়ে
ভুল করেছিলাম একদা।
এবার আমি তোমার বারণ শুনব না, মা,
কারণ এখন তোমার আমার,
আমাদের পূর্বপুরুষ আর উত্তরপুরুষদের
সবার মা, জননী জন্মুভূমি আমাকে
ডাক দিয়েছে এই সকালে।
দ্যাখো নিরস্ত্র আমি সকল পিছুটান ছেড়ে
খোলা পথে পা বাড়ালাম।
দানব দলনে সফল হয়ে
কপালে জয়টিকা নিয়ে
যদি ফিরে আসি, তখন
আমাকে ক্ষমার আলোয় ধুইয়ে দিয়ে
বুকে টেনে নিও, মা।
২৭.৭.৯৪
যাচ্ছিলাম ডলফিন কোচে
যাচ্ছিলাম ডলফিন চ্যালেঞ্জার কোচে
ভোরবেলা চট্রগ্রামে। আবীরের পোচে
উদ্ভাসিত চতুর্দিক। ‘বেশ তো মজার লোক তুমি,
আমাকে ফেলেই যাচ্ছ চলে চুপিসারে? মনোভূমি
ঈষৎ চমকে ওঠে চেনা কণ্ঠস্বর শুনে। পার্শ্ববর্তী সিটে
বসে আছ, গায়ে ফিরোজা রঙের শাড়ি, মিটমিটে
নক্ষত্রপ্রতিম হাসি পাতলা ঠোঁটে। কী করে বিশ্বাস করি, বলো,
প্রকৃত তুমিই ঝলোমলো
সত্তা নিয়ে অসহায় এ কবির যাত্রাসঙ্গী? তোমার সোনালি
হাতে হাত রখি, এক ফালি
আপেল বাড়িয়ে দিলে আমার উদ্দেশে।
হঠাৎ একটি পাখি এসে
তোমাকেই ছুঁতে চায় চঞ্চু কিংবা পাখা
দিয়ে, বুঝি অজ্ঞাত আক্রোশে ছিন্ন করবে আমাদের বসে থাকা।
চলেছি আমরা কোচে পাশাপাশি বসে কী নিবিড়;
যেন নেই ভিড়,
নেই অন্য কোনো প্রাণী সমুখে, পিছনে,
প্রখর আবেগে করি চুম্বন তোমার মুখ অবিশ্বাস্য, কোমল নির্জনে।
সীতাকুণ্ডে প্রবশ করেই দেখি, হায়,
তুমি নেই, হাওয়ায় মিলিয়ে গ্যাছো, তুমিহীনতায়
বসে থাকি; শুধু চেনা পারফিউমের ঘ্রাণ ভাসে;
ভাবি, এই পর্যটন নজিরবিহীন ভ্রমণের ইতিহাসে।
১৫.৬.৯৪
যে-পথে ঝলসে উঠবে
এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি মাটির উপর,
এই মাটি কি আমার?
যে শ্যামল ভূখণ্ডকে মাতৃভূমি বলে জেনেছি,
একি আমারই দেশ?
তাহলে কেন এমন বেগানা মনে হচ্ছে একে?
কেন এরকম বিকৃত এর মুখ কেন? কেন?
কারা যেন ত্র্যাসিড ছুঁড়ে দিয়েছে রূপসী বাংলার মুখে,
আমার নিকট থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে স্বদেশ।
অনেকগুলো নোংরা, লোমশ হাত চেপে ধরেছে
গায়ক পাখির কণ্ঠ, যাতে সে চরাচরে
ছড়াতে না পারে প্রাণজাগানো, কাল মাতানো সুর।
অনেকগুলো সাড়াশির মতো হাত
ফুল না ফুটতেই চটকে দিচ্ছে মুকুল সমুদয়।
যাকে আমি জননী জন্মভূমি বলে ডাকি
আমার মর্মমূল থেকে,
সে নিশ্চুপ দেখছে সুন্দরের খুন-হওয়া,
যেন এতে সায় আছে তার।
না, বিলাপের ধ্বনিতে আমি ভারি করব না
তোমার বাতাস, বিষাদের কুয়াশা
ছড়িয়ে দেব না তোমার নিশ্বাসে। আজ এই তাণ্ডবে
তোমাকে প্রশ্ন করতে চাই, হে স্বদেশ আমার,
রক্ত-সমুদ্র থেকে তোমাকে পদ্মের মতো তুলে এনেছিল
যারা গভীর ভালোবাসায়,
কেন তাদের তুমি ঠেলে দিচ্ছ কারাকুঠুরিতে?
কেন তাদের মুখ ঘষটে দিচ্ছ পথের ধুলায়, কাঁকরে?
কেন কণ্ঠ রোধ করতে মরীয়া হয়ে উঠেছ তাদের,
যারা নান্দীপাঠ করেছিল তোমার মুক্তির?
হে স্বদেশ, তোমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে
জেরা করব, তেমন স্পর্ধা আমার নেই, আমার মনের ভেতর
শুধু কিছু সওয়াল ঝিকিয়ে উঠছে বিষাক্ত
চাবুকের মতো। যারা তোমাকে ভ্রূণাবস্থায়
হত্যা করতে চেয়েছিল, তোমার শ্যামল শরীরকে
অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছিল, সেই দানবদের কোন্ মোহে
এগিয়ে দিচ্ছ সিংহাসনের দিকে?
কেন ক্লান্ত বাঈজির মতো ক্ষতবিক্ষত পায়ে অবিরত
ঘুঙুর বাজিয়ে নেচে চলেছ
মানবতা-বিরোধী বকধার্মিকদের উদ্ভট ইঙ্গিতে?
পাখির গান, ফুলের উন্মীলন আর
প্রেমের পদাবলি যাদের আতঙ্ক,
যাদের কপালে মুদ্রিত হিংস্রতার, পৈশাচিকতার উক্তি,
তাদের তুমি সত্যি কি চাও
তোমার ত্রিসীমানায়? যারা তোমার স্বপ্ন দেখেছে দীর্ঘকাল,
তোমার উদ্দেশে অর্পণ করেছে রক্তাঞ্জলি,
তোমার গলায় দুলিয়ে দিয়েছে জয়মাল্য শিশিরভেজা চোখে,
তারা কি পাবে তোমার উপেক্ষা আর আক্রোশ?
এই প্রশ্নের সুদত্তর তোমাকে আজ দিতেই হবে স্বদেশ।
তুমি দোদুল্যমান চিত্তে মুখ বুজে
আড়চোখে তাকাবে শুধু, তোমার এই ভঙ্গি
আমরা কস্মিনকালেও মেনে নেব না।
স্বদেশ আমার, তোমার শারদ আকাশে যখন
কাশফুলের মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়,
তোমার আষাঢ়ে যখন ফোটে প্রথম কদম ফুল,
তোমার ফাল্গুনে যখন পলাশ ছড়ায় আবীর,
তোমার হেমন্ত গোধূলিতে যখন বাজে, গরুর গলার ঘন্টি,
যখন গাছের সবুজ পাতা থেকে ঝরে শিশির,
তখন আনন্দে আমার দু’চোখ হয় বাষ্পাকুল,
হৃদয়ে বাজতে থাকে বাউলের দোতারা।
প্রাণের স্বদেশ, আমার এই আনন্দকে তুমি
কী করে সোপর্দ করবে কসাইখানায়? পারবে কি?
আমরা যারা বিরূপ ঋতুতেও তোমার স্তব করি,
আমরা প্রতীক্ষা করছি সেই ভবিষ্যতের জন্যে,
যে বর্বরতা-বিরোধী, করুণাপ্লুত ফেরেশতার মতো অপেক্ষমান।
সঙ্কটের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অষ্টপ্রহর
আমরা দৃষ্টি বিছিয়ে রেখেছি সে-পথে,
যেখানে দানবদের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠবে তোমার সংহার-মূর্তি।
১৪.৬.৯৪