ভালোবাসার নিশ্বাস
এখন সকাল ক’টা বাজে? আলস্য-হেতু
ঘড়ি দেখতে অনাগ্রহী। এতক্ষণে নিশ্চয় তুমি বিছানার আরাম আর
রাতপোশাক ছেড়ে উঠে পড়েছ, মন দিয়েছ
সংসারের খুচরো কাজে, খবরের কাগজে
চোখ বুলিয়ে দেখে নিচ্ছ আমার কোনো নতুন কবিতা
ছাপা হলো কিনা। হয়তো
কাজ করা কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার ফাঁকে
মনে পড়ছে আমার মুখ অথবা ভাবছ
বোনের কথা, যে সংসার পেতেছে প্রবাসে। আর আমি
একটি কবিতার খসড়াকে
কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যত্নবান। লিখে-ফেলা
পংক্তি এবং না-লেখা পংক্তির মাঝখানে তুমি, শুধু তুমি।
দিনটি কেমন কাটবে, জানি না। তোমার সঙ্গে কি
দেখা হবে আজ? কোনো মৃত্যু-সংবাদ কি এসে পড়বে
হঠাৎ। আমার পরিচিত কোনো রাজনৈতিক কর্মীর
জেলে যাওয়ার খবর কি বিচলিত করবে আমাকে? জানি না।
সবরকম আশঙ্কার জাল ছিঁড়ে
তোমার চুম্বনের মাধুর্য, তোমার সঙ্গে মিলনের সৌরভ
আমার কবিতায় লগ্ন হবে
এবং আমি জেগে থাকব শীতদুপুরে, যখন তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।
তোমার গ্রীবায়, স্তনচূড়ায়
বইবে আমার ভালোবাসার নিশ্বাস।
১৫.১২.৯৪
ভ্রমণ
ইচ্ছে ছিল, কোনো একদিন তোমার সঙ্গে
ভ্রমণ করব দূর বিদেশে কিংবা স্বদেশেরই কোনো
সুন্দর, এলাকায়, যেখানে কেউ চিনবে না আমাদের।
আমরা দু’জন বেপরোয়া ঘুরে বেড়াব
পথে পথে, দেখব নানা দৃশ্য, কোথাও বসে
দু’দণ্ড বিশ্রাম নেব, তুমি আমার দিকে তাকাবে
তোমার দু’টি সুন্দর কালো চোখ মেলে,
সেই দৃষ্টি হরণ করবে আমার সকল ক্লান্তি আর আমাদের
অবাধ, অগাধ ভালোবাসায়
রঙিন হবে ক’দিনের সফর।
দূরের আকাশ আমাকে জানালো, শিগ্গিরই তুমি
বেরুবে বিদেশ ভ্রমণে। তোমার সঙ্গে
কেউ কেউ যাবে, যারা তোমার আপনজন। বিচ্ছেদের
দাঁত এখন থেকেই ছিঁড়তে শুরু করেছে আমার হৃৎপিণ্ড।
তুমি যখন বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উঠবে, তখন
তোমার সঙ্গে যাবে আমার দীর্ঘশ্বাস,
আমার অজস্র নিষ্ফল চুম্বন, ব্যর্থ আলিঙ্গন,
আমার ব্যাকুল-করুণ চেয়ে থাকা,
আমার নির্ঘুম ছটফটে রাত্রি আর
আমার কবিতার কতিপয় নাছোড় পংক্তি।
শুধু আমি যাব না, পড়ে থাকব
এই শহরে ধু ধু মরুভূমির মতো তুমিহীনতায়
এবং কয়েকটি না-লেখা কবিতার অস্পষ্ট ছায়ায়
শিয়রে আহত স্বপ্ন নিয়ে শুয়ে থাকব। আমার চোখে জমবে শিশির।
২০.১১.৯৪
ভয়ে-ভয়ে থাকি
আজকাল বড় বেশি ভয়ে-ভয়ে থাকি দিনরাত।
বয়স বেড়েছে বলে এই ভয় আমাকে কেবলি
তাড়িয়ে বেড়ায় না কি কুকুরের মতো? যে আমাকে
ভালোবাসে তার অভয়ের মুদ্রা ঈষৎ সান্ত্বনা।
ভয়ে-ভয়ে থাকি, যদি সহসা বধির হয়ে যাই,
তবে আমি শুনব না কুহুধ্বনি, মোৎসার্ট এবং বিটোভেন,
রবীন্দ্রনাথের গান, লালনের গীত, শিশুদের কলরব,
সবচেয়ে বেশি ভয়, শুনতে পাবো না তার সুমধুর কথা।
আমার দু’হাত যদি অকস্মাৎ ভীষণ অসাড়
হয়ে যায়, তবে আমি ছুঁতে পারব না গোলাপ কি
স্বর্ণচাঁপা, পারব না লিখতে কবিতা, ভয় পাই;
সবচেয়ে বেশি ভয়, পারব না করতে তাকে দৃঢ় আলিঙ্গন।
ভয়ে-ভয়ে থাকি, অসুস্থতাহেতু হঠাৎ আমার
পদদ্বয় যদি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, তবে সকালের রোদে,
গোধূলিবেলায় আকাশের নিচে হেঁটে যেতে ব্যর্থ হবো;
পারব না যেতে গুলবাগে, সবচেয়ে বেশি ভয়,
কখনো হবে না গাওয়া গুনগুনিয়ে, কবিতার পংক্তি
সৃষ্টির মাদকতায় আর তার উজ্জ্বল নিবাসে।
ভয়ে-ভয়ে থাকি, যদি জিহ্বা, ওষ্ঠ আমার নিঃসাড়
হয়ে পড়ে কোনোদিন, তাহলে খাদ্যের, পানীয়ের
কোনো স্বাদ আমি নিতে পারব না; সবচেয়ে বেশি
ভয়, তার মুখ চুম্বনের ক্ষণগুলো লুপ্ত হবে চিরতরে।
ভয়ে-ভয়ে থাকি নিত্য, আমার দু’চোখে যদি জ্যোতি
কখনো হারিয়ে ফেলে, তবে বই কিংবা চিঠিপত্র
পারব না পড়তে কিছুই। দৃশ্যাবলি মুছে যাবে
দৃষ্টি থেকে; সবচেয়ে বেশি ভয়, তাকে আর দেখতে পাবো না।
১৫.১২.৯৪
মেঘমানবী
মেঘের জমিনে একটি বাড়ি বানাবার কথা
ভাবছিল সে। চাঁদের পাথর আর
রৌদ্রের গাঁথুনি দিয়ে বাংলো ধরনের বসতবাড়ি
গড়ার খেয়াল তাকে অনেক দূর নিয়ে যায়।
সকাল সন্ধ্যা শাদা মেঘ আর কালো মেঘের
আহ্বান তার রক্তে আনে দোলা, তন্ময়তায় সে
রচনা করে মেঘসঙ্গীত এবং
সেই মেঘসঙ্গীতের মূর্ছনা জন্ম দেয়
এক অপরূপ মেঘ মানবীকে, যার চোখের
মেঘাঞ্জনে অনন্তের রূপটান। সে ভাবে,
মেঘ-জমিনে তৈরি বাংলায় সেই প্রতিমাপ্রতিম
নারীকে বসবাসের আমন্ত্রণ জানাবে।
তার মনোভাবনা টের পেয়ে মেঘমানবী
একবার মেঘের আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়,
তারপর বলে মেঘলীন স্বরে-‘এখানে
আমি তো অতিথি নই কোনো, নিশ্চিত এ আমার জন্মভূমি।
এই মেঘমগ্ন গাছপালাময় বাংলোয় আমরা
ভালোবাসব পরস্পর
এবং সেই ভালোবাসার মোহনতাপে
তোমার হৃদয় থেকে উৎসারিত হবে মেঘমানুষের কবিতা’।
কিছুই না বলে সে, শব্দের রূপকার, তাকিয়ে থাকে
মেঘমানবীর দিকে, তার চোখে হঠাৎ
আগুন আর গলতে থাকে মেঘজমিনের বাড়ি,
মেঘমানবী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে।
২২.১১.৯৪
মোমবাতি
সকাল না কি সন্ধ্যা, দুপুর না রাতদুপুর,
বলতে পারব না। কখনো কখনো এ রকম হয়, সময়ের
বাইরে আমাদের অবস্থান। মন
আমাদের পার্থিবতার অন্তরালে নিয়ে যায়।
কখনো স্বপ্ন আমরা রচনা করি, কখনো-বা
স্বপ্ন আমাদের নির্মাণ করে-স্বপ্নময়তায় বাস্তবতাকে
অগ্রাহ্য করে পরিযায়ী পাখি আমরা
কাল থেকে কালান্তরে। তখন
ভীষণ তোলপাড় আমার ভেতর, হৃদয়
ঝড়-লাঞ্ছিত পাখির নীড়ের মতো। বিপর্যস্ত খড়কুটোগুলোকে
বিন্যস্ত করতে চেষ্টাশীল আমি, ঠিক সেই মুহূর্তেই
ভেসে এলো তোমার কণ্ঠস্বর।
আমার প্রতিক্ষণের নির্ভর তোমার জ্যোৎস্নামদির কণ্ঠস্বর;
আমি সেই অগোছালো পাখির নীড়ের কথা বলার
পর তুমি বললে, ‘এখন থেকে শুধু জ্বলবে তুমি,
যেমন আমি জ্বলছি’। তোমার কণ্ঠস্বরে
বেদনার গাঢ় আদিবাসী উচ্চারণ ছিল, ছিল
অপার সহিষ্ণুতার পরাগ-কেশর।
কয়েকটি নিস্তব্ধ মুহূর্তের পর
তুমি বললে, ‘অনেক আগে থেকেই
মোমবাতির আলো দেখতে আমার ভালো লাগে।
কখনো-কখনো ঘরের ইলেকট্রিক আলো
নিভিয়ে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে থেকেছি
নিষ্কম্প একাগ্রতায়। দু’চোখ ভরে দেখেছি নিঃসঙ্গ
মোমবাতির একটু একটু করে জ্বলে যাওয়া, গলে যাওয়া;
সে এক নান্দনিক অভিজ্ঞতা আমার।
এখন আমি কালের শামাদানে নিজেই সেই একাকিনী মোমবাতি-
প্রতি পলে জ্বলছি, গলে গলে পড়ছি তপ্ত অশ্রুকণার মতো’।
তোমার এই বেদনার্ত কথাগুচ্ছের পিঠে কোনো কথা
না চাপিয়ে তাকিয়ে থাকি
শূন্যতায় বসবাসকারী অলীক জোনাকিদের দিকে
আর তোমার শব্দাবলিকে স্বার্থপরের মতো
কবিতার বীজ হিসেবে সঞ্চয় করি আমার
নিজস্ব গোলায় গভীর তন্ময়তায়।
৭.১০.৯৪