না
ব্লাড প্রেসারের গোধূলিবরণ ওষুধ খাওয়া হয়েছে আগেই;
আন্তোনিও গ্রামসি বিষয়ক একটি বই কিছু পড়ে
রেখে দিই টেবিলে। বেলা প্রায় দুপুর-ছোঁয়া,
অর্থাৎ কাঁটায় কাঁটায় সোয়া এগারোটা।
‘হ্যালো’ বলে তোমার কণ্ঠস্বর শোনার আশায় রিসিভার ধরে থাকি,
তখনই কানে এলো ঘুমে-পাওয়া, বিষণ্ন ‘হ্যালো’।
‘তুমি অসুস্থ না কি? কী হয়েছে বলো তো’।
‘কোনো অসুখ ধরেনি আমাকে, কিছুই হয়নি আমার’।
‘মন খারাপ বুঝি?’
‘আমার মন বলে কিছু নেই’।
সে মুহূর্তে তোমার সত্তা অনূদিত হচ্ছিল
কান্নার মাতৃভাষায়। কী কথা বলব তোমাকে,
কী বলতে কী বলে ফেলব, আমার এই দোটানাকে নাড়িয়ে দিয়ে
বেজে ওঠে তোমার অনিন্দ্য কণ্ঠস্বর, ‘কিছু বলছ না যে!’
‘বুঝতে পারছি, তোমার মন খুব খারাপ, এখন রাখি’।
আমার কথা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপার থেকে ভেসে-আসা
‘না’ ধ্বনি আমার মর্মমূল স্পর্শ করে। এমন মাধুর্যময়, এমন
অন্তরঙ্গ ‘না’ কখনো শুনিনি। এই ‘না’ বিশ্বের সংক্ষিপ্ততম
প্রেমের কবিতা হয়ে আমাকে উদ্বেলিত করে, অতিক্রম করে
ছড়িয়ে পড়ে নীলাভতম দিগন্তে, চরাচরে।
১২.৬.৯৪
প্রেমের কবিতা নিয়ে সংলাপ
তখন ভোরবেলা, দুপুর না কি রাত
আমার মনে নেই,
শুধু মনে পড়ে তোমাকে আর মনে পড়ে
এক-আকাশ বৃষ্টি
স্নান করাচ্ছিল ধূলিম্লান শহরকে। রাজধানীর
ত্বকে সেই মুহূর্তে ভেজা শ্যামলিমা,
যেন কোনো রূপসী
পরেছে সবুজ আর কালো রঙ মেশানো শাড়ি।
আমার দিকে স্থাপিত তোমার দুটি
গভীর, সুন্দর চোখ, গুণীর বাদ্যের মতো
জেবে-ওঠা তোমার কণ্ঠস্বর
পরিবেশকে ধনী করে আমার মর্মমূলে
গুঞ্জরিত। কী যেন বলতে চেয়েছিলাম;
বলা হয়নি। তুমি বললে, “তোমার পুরনো
প্রেমের কবিতাগুলো কি যে অপরূপ মনে হয় আমার,
বোঝাতে পারব না। ঈর্ষা করি তোমার
প্রাক্তন প্রেমিকাদের, যাদের নিয়ে লিখেছ প্রেমের পদাবলি। এখন
আমি তোমার প্রেমের কবিতার উৎস, জানি;
তবু তুমি যা-ই বলো, তোমার আগেকার
কবিতাগুলোই বেশি ভালো”।
তোমার হাত হাতে নিয়ে বললাম, আমার
সকল প্রেমের কবিতা-অতীতের এবং বর্তমানের-
তোমার উদ্দেশেই রচিত।আমার কথা বিশ্বাস করলে
কি না বুঝতে পারিনি। খটকা থেকেই গেল।
২২.১১.৯৪
বলা যায় না, তবুও
কোনো কোনো কষ্ট আছে যা, কাউকেই
বলা যায় না, এমনকী নিজেকেও না।
এই তো সেদিন কয়েকটি ঘণ্টা স্বপ্নিল স্বরে
আমাকে কথা দিয়েছিল, বলেছিল
আমার কানে কানে, ‘আমরা তোমাকে দেবো
তোমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় অনুভূতি,
তোমার হাত ধরে নিয়ে যাব সে এক
সোনালি চূড়ায়, যেখানে তোমার পথে সুন্দরীতমা কোমল
বিছিয়ে রাখবে অনুরাগের পরাগ সমুদয়। কথা দিচ্ছি,
আমরা এই সামান্য ক’টি ঘণ্টা তোমাকে
উপহার দেবো সেই অপরূপ দৃশ্যাবলি,
যা রচনার সাধ্য নেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকরের’।
সেদিন একটি ছোট ঘর আমাকে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মেঘমেদুর স্বরে-
‘আমি তোমার জন্যে মেলে ধরব আমার বুক,
সবচেয়ে শীতল সুরভি-মদির
ছায়া দেবো। আমি তোমার নিভৃত আশ্রয় হবো,
যেখানে তুমি দয়িতার উজাড় অন্তরঙ্গতাকে
আকণ্ঠ করবে পান। তোমাদের যুগ্মতা
আমার সামান্য অবয়বকে দেবে অপার মহিমা।
তোমাদের চুম্বন শূন্যে দুলিয়ে দেবে গোলাপচারা,
তোমাদের আলিঙ্গনে চারদেয়ালের ভেতর
ডেকে উঠবে অকাল বসন্তের কোকিল আর
খাট নিমেষে হয়ে যাবে কাশ্মীর-হ্রদের শিকারা’।
কয়েকটি ঘণ্টা আর একটি ছোট ঘর হঠাৎ
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আমার
একটি অপরূপ স্বপ্নকে মুছে ফেলল এবং আমি
নিজস্ব কষ্টকে বুকের ভেতর পাখির মতো পুষতে লাগলাম।
আমি আমার কবিতার খাতাকে
মিনতি জানালাম, ‘আমার এই কষ্টকে তুমি
একটু ঠাঁই দাও, নইলে আমার শ্বাস
রুদ্ধ হয়ে যাবে এক্ষুণি। তুমি কি সইতে পারবে তা?’
কবিতার খাতা বলে, ‘তোমার মনোজ রৌদ্র-জ্যোৎস্না, জুঁই
চামেলি, দোয়েল, বুলবুল, সোঁদা মাটি, গোস্পদ, ব্যাঙ,
দীর্ঘ সাঁকো, নদীতীরের যমজ গাছ, মেঘনার ঢেউ, পালতোলা নৌকা,
বস্তির ঝুপড়ি, কৃষকের কুটির, মধ্যরাতের স্তব্ধতা, তোমার স্বপ্ন,
দুঃস্বপ্ন, জনপথের কোলাহল, তোমার দীর্ঘশ্বাস, একাকীত্ব
নির্দ্বিধায় ধারণ করেছি আমার বুকে। মার্জনা করো,
তোমার এই কষ্টের জন্যে
জায়গা করে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা আমার নেই।
৯.১০.৯৪
বিনিময়
সবেমাত্র একটি কবিতা লিখে উঠল সে। তখন
এক বালক তার কাছে এসে বললো,
‘কবি, তোমার জন্যে এই গোলাপ এনেছি, নেবে তুমি?’
সে মৃদু হেসে বললো, ‘কী সুন্দর, দাও’।
এক ফ্রকপরা বালিকা চুলের ফিতে
তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘বড় শখের
আমার এই ফিতে, কবি, তুমি নেবে?’ সে বলল,
‘দাও, এটা দিয়ে আমি স্বপ্ন বানাব’।
একজন সুন্দরী তার সমুখে এসে বলে
কণ্ঠে সুরের তরঙ্গ খেলিয়ে, ‘এইমাত্র একটি আশ্চর্য
কবিতা লিখছ তুমি, তোমার জন্যে আমি আমার
হৃদয় এনেছি, কবি তুমি গ্রহণ করবে একে?’
সে অপলক তাকিয়ে থাকে সৌন্দর্যের চোখে। একটু পরে,
যখন তার ঘোর কাটে, সে উচ্চারণ করে-
‘এসো এসো, তোমার জন্যেই এতকাল প্রতীক্ষায় কাটিয়েছি,
দিবসরাত্রি, এতকাল নিজেকে নিংড়ে লিখেছি কবিতা’।
২২.১১.৯৪
ভাঙা ঘাটে
এখানে আসার কথা ছিল না তোমার। এরকম
ভাঙা ঘাটে আসে না কখনো
ভাসাতে কলস কেউ। জলের তেমন সজীবতা
নেই, ঝরা পাতাদের ফোঁপানি নিথর জলে ভাসে।
এখানে চৌদিকে কাঁটাবন, আগাছার ভিড়, ফুল
ফোটে না মোটেই, হু হু হাওয়া বয়ে যায় মরা ঘাসে,
মৃত পাখিদের শুক্নো পালক ছড়ানো ইতস্তত, বাউলের
ভাঙাচোরা দোতারা রয়েছে পড়ে দূরে এক কোণে।
এখানে আসার কথা ছিল না তোমার এই রুক্ষ
বিরানায়; অথচ স্বেচ্ছায় তুমি এখানেই এলে। আঘাটায়
তোমার পা পড়তেই জলাশয় কেমন সজীব;
কাকচক্ষু জল করে ছলছল, নিষ্পত্র গাছেরা সুসজ্জিত।
চোখের পলকে কী পুষ্পল কাঁটাবন, মৃত পাখি
হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে সুরে সুরে দাগ কাটে স্তব্ধতায়
স্থাপত্যে, গৈরিক বাউলের কণ্ঠে, সে যারে বোঝায়, সেই বোঝে
মৃর্ত হয়। তোমার গ্রীবায় বিষাদের জাল-ছেঁড়া প্রজাপতি।
সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তুমি
স্বচ্ছ জলে ধুয়ে দিলে ধূলিম্লান জীবন আমার
কী ব্যাকুল স্পর্শে, দেখি তোমার দু’চোখে ভালোবাসা
দিনান্তে অমর্ত্য কণ্ঠে শব্দহীন অপরূপ কলরব করে।
১৪.১২.৯৪