তুমি কি বিরূপ?
তুমি কি আমার সদ্য প্রকাশিত পদ্য সমুদয়
এক বর্ণ না পড়েই রেখেছ টেবিলে ফেলে উদাসীনতায়?
তুমি কি আমার প্রতি অত্যন্ত বিরূপ? নইলে কেন
সমস্ত শহরে আজ একটিও গোলাপ ফোটেনি?
কেন কোনো পাখি
আসেনি কথাও? কেন বিষাদ আমাকে
কবর খনক হয়ে খুঁড়ছে সর্বদা? মনে হয়,
দারুণ উষ্মায় তুমি ফিরিয়ে রেখেছে মুখ, নইলে
কেন আজ বিরোধী দলের কোনো ঘোষণা ছাড়াই
হরতাল সমস্ত শহরে? কেন আমি
নিজেকে ডুবিয়ে গাঢ় ছায়ায় কেবলি
কবিতার সঙ্গে একা-একা কথা বলি?
২৭.৫.৯৪
তুমি চুল আঁচড়াচ্ছিলে
এই তো সে রাতের কথা। দেয়াল ঘড়িতে তখন
রাত দশটা থর থর করছে
কবুতরের মতো। লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
তুমি চুল আঁচড়াচ্ছিলে। হলকা মেরুন রঙের
চিরুনির সঙ্গে কেলিপরায়ণ একরাশ কালো দিব্যুৎ
এবং আমি সোফায় বসে দেখছিলাম তোমাকে।
তোমার কাছে গিয়ে কালো বিদ্যুৎগুলো হাতে নিয়ে,
তোমার বুকের দুটো রাঙা টিলায়
মুখ রেখে সময়কে শাসন করার এক প্রবল ইচ্ছা
আমার ভেতর মাতলামি শুরু করছিল।
চুল আঁচড়াচ্ছিলে তুমি; তোমার চুলের প্রপাতের
দু’দিকে গড়িয়ে পড়ছিল সাইকেডেলিক স্বপ্নের মোহন নুড়ি
বয়ে যাচ্ছিল আমার বাসনার দীপাবলি।
তোমার সোনালি বাহুতে, গ্রীবায়
গোলাপি ঠোঁটে, উজ্জ্বল গালে আর গহন দুটি চোখে
জ্বল জ্বল করছিল আমার জন্ম-জনান্তর।
তুমি ঘরময় আলোর জাল কেটে কেটে
সোনার তরীর ধরনে এসে
ভিড়লে আমার সোফার ঘাটে, পিছনে গিয়ে
দাঁড়ালে; কয়েকটি কালো বিদ্যুৎ ছুঁলো আমাকে
আর পরিচিত এক সুঘ্রাণ
আমার চেতনাকে আরো প্রখর
করে তুলছিল। আমার ভেতরকারি প্রণয়ী
তখন জটিল লতাপাতায় জড়িয়ে যাওয়া
সিংঅলা এক ছটফটে হরিণ। এবার তুমি আমার
সামনের সোফায়।
কী গভীর তোমার দৃষ্টিপাত। সেই মুহূর্তে
আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারতো; তোমার
দৃষ্টিতে বয়ে যাচ্ছিল যে তারা স্রোত,
তাতে থই পাচ্ছিলাম না কিছুতেই, অমন
রহস্য তুমি কী করে ধারণ করো তোমার দুই চোখে,
কীভাবে আড়াল করো মৃত্যুবাণ? তোমার চোখের
নির্জন অতলে শতবার মরি এবং
সহস্রবার বেঁচে উঠি।
তুমি আবার গিয়ে দাঁড়ালে লম্বা আয়নার সামনে। আবার
শুরু হয় চিরুনি আর দীঘল চুলের মধ্যে
যুগপৎ বিরোধ আর মিতালি। একরাশ কালো বিদ্যুতের
ঝলসানিতে উদ্ভাসিত আমি
বুঁদ হয়ে থাকি গজল অধিকৃত গালিবের মতো
তাৎক্ষণিক চুম্বনের সুঘ্রাণে ভরপুর। তখন
রাত সাড়ে দশটা আমাদের শাসাচ্ছে, অথচ তুমি
অপরূপ আলোকলতার মতো দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলে।
২৮.৮.৯৪
তোমাকে লেখা আমার প্রথম চিঠি
প্রিয়তমা প্রতিমা আমার,
আমাদের পরিচয়ের যাপিত অনেক
রৌদ্রছায়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তোমাকে
আজো কোনো চিঠি লিখিনি।
প্রয়োজন কি অনুভব করিনি কখনো লেখার টেবিলে
প্যাড মেলে রেখে অথবা
বিছানায় শুয়ে তারার স্রোতে চোখ পেতে?
পথ চলতে গিয়ে মনে কি হয়নি
এক্ষুণি বাড়ি ফিরে তোমার উদ্দেশে
হৃদয়ের আভা ছড়িয়ে অক্ষরের শরীরে সাজাই
অনেক কথার শোভাযাত্রা?
টেলিফোন আমার চিঠির পথ আগলে
দাঁড়িয়েছে বার বার। তুমি টেলিফোনে কত না
বসন্ত দিনের সৌরভ, শারদ আকাশের
স্বচ্ছ নীলিমা, শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর দুপুর আর
জ্যোৎস্নারাতের স্বর্ণচাঁপাময় স্তব্ধতা
রচনা করেছ আমার কানে। আমি মুগ্ধতার মেঘে
ভেসে বেড়িয়েছি প্রহরে প্রহরে। তোমার কণ্ঠস্বর
চুম্বন করেছে আমাকে, বানিয়েছে আমার জন্যে শূন্যের মাঝার
এক প্রশান্ত বিশ্রামের ঘর। তোমার পরিশীলিত উচ্চারণ
আমাকে পৌঁছে দিয়েছে ভালোবাসার তীর্থে।
তোমার স্বপ্নিল টেলিফোন বলেছে এসো,
আমার দীঘল চুলের প্রশান্ত থেকে শান্তির ছায়া চেয়ে নাও;
এসো, আমার ঠোঁট থেকে স্বর্গীয় সুধা নাও ওষ্ঠ পেতে,
এসো, আমার দু’চোখ থেকে সন্ধ্যার পাখির নীড়ে ফেরার
তারা ঝলসিত আনন্দ চেয়ে নাও। তোমার টেলিফোন
আমার হৃদয়ের দিগন্ত জুড়ে সৃষ্টি করেছে হরিৎ শোভা।
হে সুন্দরীতমা, বাক্শিল্পী তুমি, কণ্ঠস্বরের
মাধুর্য মিশিয়ে নিত্য পাঠাও কথার সওগাত। ইথারে
ইথারে তরঙ্গিত আমাদের হৃদয়ের ধ্বনি। তোমাকে
আবারো আলিঙ্গন করি, আবারো তোমার
চোখে, বুকে মুখে স্তনে চুম্বনের তারা ফোটাই স্মৃতিতে।
তোমার চুল নিয়ে আঙুলে জড়ানো, তোমার পায়ের
আঙুলের সলজ্জ মৃদু হাসি, লজ্জার কোমল ছায়ায় মদির দুপুরে
তোমার নীরব শুয়ে থাকা আমাকে
স্মরণ করিয়ে দেয় টেলিফোনের অলৌকিক কণ্ঠস্বর।
ভুলে যাই তোমাকে চিঠি লেখার কথা।
তোমার কাছেও অবান্তর হয়ে যায় পত্ররচনা;
কিন্তু আমি চাই, আমাদের দু’জনের অন্তর্গত কথারা
অক্ষরের স্পর্শ পাক, যেমন আমার সত্তার প্রতিটি মুকুল
ফুল হয়ে উঠতে চায় তোমাকে স্পর্শ করার ব্যাকুলতায়।
এজন্যেই তোমাকে লেখা আমার এই প্রথম চিঠি উদাসীন
হাটে বিলিয়ে দিলাম তোমার বিনা অনুমতিতে।
আমার এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে,
মিনতি আমার, তিরস্কারের ওপারে রেখো, প্রিয়তমা প্রতিমা আমার।
আমার একটি কথা রাখবে তুমি? ভাদ্রের বিকেলের
ডাকেই তোমার হস্তাক্ষরের অপরূপ গান শুনতে চাই।
ভালোবাসা। একান্ত তোমারই
কবি।
২২.৮.৯৪
নতুন নৈশ টেস্টামেন্ট
কোজাগরী পূর্ণিমা আজ। রাতের
কাঁধের ওপর দিয়ে একটি বাদামি পাখির ধরনে
উড়ে যাচ্ছি। শ্যামলীর পথের ধারে
একজন বুড়ো সুড়ো লোক ল্যাম্পপোস্ট ঘেঁষে বসে
কী যেন খাচ্ছে মলিন ঠোঙার ভেতর
নোংরা আঙুল ঢুকিয়ে। তার পাশে ঘুর ঘুর
করছে রেওয়ারিশ, বিমর্ষ কুকুর। একটি ধবধবে
মোটরকার যাত্রীহীন দ্রুত চলে যাচ্ছে কোথায়।
এই মুহূর্তে আমি তোমার জ্যোৎস্নাধোয়া ভবনের
খুব কাছে। কী করে কোন্ ইন্দ্রজালের
সৌজন্যে আমি রাতজাগা প্রহরী আর
যমদূতমার্কা কুকুরের সতর্ক নজর এড়িয়ে
সিংদরজা পেরিয়ে সোজাসুজি দোতলায়
তোমার বন্ধ বেডরুমে
প্রবেশ করলাম, বলতে পারব না। রাতদুপুরে
তুমি ভাসমান টল টলে ঘুমের সরোবরে।
তোমার শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালাম নিশ্চুপ। বালিশে
ছড়ানো তোমার চুলের ঝর্না। বধির রাত্রি তোমার গ্রীবা, বাহু,
ঠোঁট, স্তন, নাভিমূল আর আশ্চর্য বদ্বীপ
কামুকের মতো ক্রমাগত লেহন করছে। আমি
ঈষৎ ঝুঁকলাম তোমার ওপর। তোমার
কবোষ্ণ, সুগন্ধি নিশ্বাস নিরিবিলি ছুঁয়ে যার আমাকে।
তোমার চারদিকে স্বপ্নেরা প্রজাপতির মতো
উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার বাসনার পাপড়িগুলো
ঝরছে তোমার ওপর, তুমি পাশ ফিরে
ডুবে গেলে গভীরতর নিদ্রায়। তোমার
মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে হাসির ঈষৎ আভা। স্বপ্নের
ভেতর আমার কোনো বোকা-বোকা কথা হঠাৎ
মনে পড়েছিল কি তোমার? বেডরুমের
দেয়াল, ড্রেসিং টেবিল, টেলিফোন সেট, টিভি,
ত্র্যালার্ম-দেওয়া ঘড়ি-সবকিছুই মুছে গেল
নিমেষে; শুধু তুমি শুয়ে আছো
মনোরম এক ঝর্নার ধারে। বনদেবীর
সুন্দরী সহচরীরা চামর দুলিয়ে বাতাস করছে তোমাকে।
সেই মুহূর্তে চুমোয় চুমোয় বিহ্বল করে দিতে পারতাম
তোমাকে, জাগিয়ে দিতে পারতাম
প্রবল আকর্ষণে। এসব কিছুই করিনি। আমি
চেয়ে থাকি নিদ্রাতুর তোমার দিকে, বুঝি
চেয়ে থাকব অনন্তকাল। মৌমাছিদের সোনালি
গুঞ্জরণ আমাদের ঘিরে বয়ন করবে স্মৃতির অলৌকিক পাড়।
অকস্মাৎ লুপ্ত ইন্দ্রজাল, আমি মুখ থুবড়ে পড়ি
আবার ঘরের মেঝেতে, গলা ছিঁড়ে বেরোয়
ঝলক ঝলক রক্ত এবং
চোখে লেগে থাকে কতিপয় অবিনশ্বর চিত্রকলা, যা
কখনো অনুবাদ করতে পারব না
কোনো কবিতায়। এই মহিমা-রহিত প্রহরে
কেবলি মৃদু উচ্চারণে
কথা বলব তোমার ঘুমন্ত সত্তার কানে কানে।
২০.১০.৯৪