এসো কোকিল, এসো স্বর্ণচাঁপা
হে কোকিল, শহরের নিভৃত কোকিল, অনির্দিষ্ট ঝোপ ছেড়ে
চলে এসো কবিতার খাতায় আমার;
প্রাণের আনন্দে গাও গান,
নিষাদের ভয় নেই, নোটেশন নেবো লোকচক্ষুর আড়ালে।
কোকিল আমাকে বলে, “কী করে গাইব গান, বলো,
তোমার খাতায়? তুমি যাকে ডাকো নিভৃতে সুপ্রিয়া,
যে আমার ডাক শুনে প্রহরে প্রহরে
কী ব্যাকুল রাঙা হয় তোমার জন্যেই,
এখন সে নেই এ শহরে, তাই আমি
বিরান কাগজে আজ ডেকে আনতে অপারগ অকাল বসন্ত”।
স্বর্ণচাঁপা, এসো তুমি অব্যাহত দারুণ খরায়
কবিতার খাতায় আমার,
শূন্য পাতা ভরে যাক তোমার সুঘ্রাণে। হরফেরা
স্নিগ্ধ আর সুরভিত হবে, চলে যাবে কালান্তরে।
ম্রিয়মাণ স্বর্ণচাঁপা বলে চাপা স্বরে,
“তুমি যার নাম করো উচ্চারণ নিশীথের কানে,
নিবিড় সৌজন্যে যার একদিন দুপুরে তোমার করতলে
পেতে দিয়েছিলো বুক আমার দু’জন
সহোদরা, তার দেখা নেই এ শহরে ইদানীং,
পারি না অতিথি হতে এখন তোমার এই কবিতার ঘরে”।
হে কোকিল, ওগো স্বর্ণচাঁপা,
হয়ো না বিমুখ আজ। সে নেই বলেই এখনই তো
এ নিঃসঙ্গ কবির সবচে’ বেশি প্রয়োজন তোমাদের সঙ্গ,
তোমাদের দাক্ষিণ্য, সম্প্রীতি।
এসো হে কোকিল, এসো স্বর্ণচাঁপা, দ্যাখো এ বিচ্ছেদে
সকাতর চেয়ে আছে কবিতার খাতা!
৯.১২.৯৪
কবিতা তোমার সঙ্গে
কবিতা, তোমার সঙ্গে সারাটি জীবন উন্মতাল
কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখি
আজো; এই গোধূলিতে পা ডুবিয়ে ভাবি-
আমার বিরান ঘাটে কেন
বড় বেশি দেরি করে ভেড়ালে তোমার
অনুপম কারুকাজময় তরী? কেন আরো আগে
দেখিনি তোমার রূপ, কোন্ অপরাধে? লহমায়,
হে কবিতা, আমার দীনতা তুমি দিয়েছে ঘুচিয়ে।
আমাকে পাঠাও তুমি ফুল, পাঠাও দোরেল,
পাতার আড়ালে-থাকা কোকিল, চাতক, মুঠো মুঠো
জোনাকি, সুমিষ্ট ফল, প্রজাপতি আর রঙধনু। কোনোদিন
ফির্নি রেঁধে আনো দ্বিপ্রহরে, কখনো শ্যামল সাঁঝে
চলে আসে কেক নিরিবিলি
তোমার সৌজন্যে। দেখি, মোহন ব্যঞ্জন
সাজাও আমার জন্যে গাঢ় অনুরাগে। ‘অন্নপূর্ণা’
বলে আমি দোল খাই তোমার নিবাসে।
কখনো আমার খর খর যৌবনের উজ্জ্বলতা
পেয়ে যায় তোমার সোনালি পদস্পর্শে,
খোলা চুল ঘরে আনে শ্রাবণের রাত। কালো দু’টি
চোখ অনন্তের ফোঁটা যেন,
নিজের রেশমি চুল নিয়ে খেলা করো
আপন সত্তায় মগ্ন, সরোবর হয়ে ডেকে বলো
‘এসো কবি নিঝুম সাঁতার কাটো উদ্বেলিত জলে’।
ফেরাতে পারি না দৃষ্টি, সরোদের মতো বাজে আমার শরীর।
কবিতা, তোমার সঙ্গে সারাটি জীবন অন্তরঙ্গ
কাটাবার সুখ
পেতে চাই, বড় আশা নিয়ে বসে থাকি
তোমাকে দেখার জন্যে পুনরায় একবার, মুখচুম্বনের
সাধ তীব্র হয় আর নিদ্রাহীন রাতে
তোমার স্তনের তিল কালো নক্ষত্রের মতো জ্বলে
আমার স্মৃতিতে। ভয়ে থাকি সর্বক্ষণ, পাছে তোমার আমার
মাঝখানে বিচ্ছেদের অলঙ্ঘ্য দেয়াল গড়ে ওঠে!
কবিতা, তোমার সঙ্গে সারাটি জীবন বাধাবন্ধহীন আমি
তুমুল কাটিয়ে দিতে চাই।
কখনো নেব না ছুটি, থাকব প্রস্তুত
প্রতিটি প্রহরে, যদি তুমি হাত ধরে নিয়ে যাও হৃদয়ের অন্তঃপুরে।
২৬.৭.৯৪
ক’দিন পর
কতদিন দেখি না তোমার মুখ; মনে হয়,
কয়েক খৃষ্টাব্দ অতিবাহিত হয়েছে তোমার সঙ্গে
শেষ দেখা হওয়ার পর, অথচ
সাত দিনও হয়নি।
তোমার নিকট থেকে অনেক দূরে একাকী
আমি থাকি, দিন কাটে, বিষাদে। জানি, যে রাস্তায় তোমার বাড়ি,
তার মোড়ের সাইনবোর্ডে আজো রৌদ্র ছায়া
খেলা করে, রেস্তোরাঁয় প্রত্যহ সন্ধ্যেবেলা
ভিড় বাড়ে আগেকার মতোই; মোটরকার,
মোটরসাইকেল হুস্ করে চলে যায় বাড়ির পদতল ঘেঁষে।
ক’দিন পর আবার তোমাকে দেখলাম,
যেমন কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক কর্মী
বহুকাল পর তার অন্ধকারাচ্ছন্ন অজ্ঞাতবাস থেকে খোলা পথে
বেরিয়ে দ্যাখে কী সুন্দর প্রস্ফুটিত চিরকালীন রোদ।
২৫.১১.৯৪
জানালার কাছে
জানালার কাছে দাঁড়াইতেই আমার
ভেতরে একটি সুরের জন্ম হলো, যার আদি উচ্চারণ-
আহ্, কি অপরূপ সকাল। গলিপথ
সৌভাগ্যের বাহুর মতো প্রসারিত, হাস্যেজ্জ্বল।
নরম রোদ জড়িয়ে ধরেছে পথ,
গাছপালা, লম্বা দেয়াল আর বাড়িগুলোকে।
হালকা হাওয়ায় নেচে উঠছে গাছের পাতা,
নারকেল গাছের ডালগুলো মাথা নুইয়ে রেখেছে,
যেন কোনো মাননীয় অতিথি আসবেন। এই মুহূর্তে
রাস্তায় কোনো যান নেই, জন নেই,
একেবারে ফাঁকা। হঠাৎ দেখি, তুমি হেঁটে আসছো একা;
তোমার ফিরোজা শাড়ি মুর্হূর্তগুলোকে
চঞ্চল করে তুলেছে, তোমার গৌর, স্বপ্নিল মুখে
চুমো খাওয়ার জন্যে রোদ আর হাওয়ার সে কি হুটোপুটি।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কেন জানি কৃতজ্ঞতায়
ভরে উঠল মন। এ কি, আমার কাঁধ ফুঁড়ে জেগে উঠেছে
দুটি স্বর্ণচাঁপা আর তিনটি রক্তজবা। ওরা এখন
উন্মুখ তোমার নৈবেদ্য হাওয়ার অভিলাষে।
তুমি কি এই মুক্তোপ্রতিম ভোরবেলায়
হেঁটে এলে আমার দুঃখগুলোকে মুছে ফেলার জন্যে?
তুমি কি এলে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার উদ্দেশ্যে,
যে-প্রতিশ্রুতি তোমার গহন মমতাময় দু’টি চোখ
মুদ্রিত করেছিল আমার মর্মমূলে? তুমি কি নিজেকে আমার কাছে
পরিপূর্ণ উন্মোচিত করবে ছায়ার আড়ালে স্নানরতা গ্রিক দেবীর মতো?
সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি এই ছোট ঘরে,
আমার অন্তরে বাউলের গোপীযন্ত্র
বাজিয়ে চলেছে মনের মানুষের আগমনী সুর এবং
আমি আবৃত্তি করছি তোমার নাম। অথচ
তোমার অনুপস্থিতির স্তব্ধতা
আমাকে উপহাস করছে খল নায়কের ধরনে।
২৪.৯.৯৪