আরো কিছুক্ষণ
আরো কিছুক্ষণ থাকো এখানে আমার খুব কাছে;
এখুনি যেও না।
শারীরিক শোভা নিয়ে দূরে। যদি যাও, শীতের সুতীক্ষ্ণ দাঁত
আরো বেশি হিংস্র হয়ে কামড়াতে থাকবে আমাকে সারাক্ষণ।
কতকাল পরে আমি তোমাকে দেখছি পুনরায়!
এই দুটি কালো চোখে গাঢ় মায়া আছে আগেকার
মতোই, আশ্চর্য স্তনচূড়া নত নয় এতটুকু,
শরীরের বিভা এখনো তো খুব মনোমুগ্ধকর।
কেবল এ-আমি দ্রুত ভীষণ বদলে যাচ্ছি, দ্যাখো,
তোমার সমুখে এক বিবিক্ত বৃদ্ধের প্রতিকৃতি!
আরো কিছু কথা বলো, কতদিন তোমার কথার
মাধুর্যে করেনি স্নান মন, কতদিন, হে সুপ্রিয়া,
তোমার হাসির আভা দেয়নি রাঙিয়ে
আমার প্রহর, দাও, আমাকে যযাতি করে দাও।
আরো কিছুক্ষণ থাকো এখানে আমার খুব কাছে।
না, দূরে থেকো না আর, আমার বাঁ পাশে এসে বসো,
রাখো হাত আমার তৃষিত হাতে, মুখ চুম্বনের
জন্যে দাও বাড়িয়ে তোমার মুখ, নিষেধের বেড়া ভেঙে যাক।
আরো কিছুক্ষণ থাকো যদি এখানে আমার কাছে,
যদি তুমি আমার নিষ্প্রভ চোখে চোখ রেখে বলো,
‘চল যাই আজ জ্যোৎস্নারাতে বনে কিংবা নৌকো ভ্রমণে’ তা হলে,
সুপ্রিয়া, বিশ্বাস করো, নিমেষে যুবক হয়ে যাব পুনরায়।
১৪.১২.৯৪
উত্তর
তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো,
‘এই আকাশ আমার।
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবে না।
সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতে পারো,
‘ফুল তুই আমার’,
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।
জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোৎস্ন আমার’,
কিন্তু চাঁদনী থাকবে নিরুত্তর।
মানুষ আমি আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকব নির্বাক?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।
২৩.৫.৯৪
ঋণ স্বীকার
গোলাপ সুঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে আমার বইয়ের
পাতা জুড়ে বসে বলে, “তুমি যাকে ভালোবাসো সে
আমার সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে সোফায়;
আমি তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে এসেছি”।
একটি বুলবুল আমার টেবিলে-রাখা
চায়ের পেয়ালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে
বলে সুর ঝরিয়ে, “যে তোমার সর্বেশ্বরী
সে আমার গান নিজের কণ্ঠে করেছে ধারণ;
আমি তোমাকে এ-কথা বলতে
দূরের বাগান ছেড়ে তোমার ঘরে এসেছি”।
শ্রাবণের মেঘদল আমাকে জড়িয়ে ধরে মেঘলা
স্বরে করে উচ্চারণ, “যে তোমার স্বপ্নের
অভ্রময় পথে হাঁটে একলা, তার চুলের ঝরনা
ধার নিয়েছে আমাদের শোভা; ঋণ স্বীকারের নাম নেই-
এ-কথা জানাতে আকাশ থেকে
তোমার ছোট ঘরে নেমে এসেছি”।
সুন্দরবনের হরিণ ঝিলের জল থেকে
মুখ তুলে হাওয়া চিরে, খুরে ধুলো উড়িয়ে
ছুটতে-ছুটতে আমার ঘরে পৌঁছে গ্রীবা
দুলিয়ে বলে “যে তোমার প্রিয়তমা, সে আমার চোখের
গড়ন করেছে হরণ আমি সেই অপরাধের
বিচারের দাবি নিয়ে এসেছি”।
আমি আমার সদ্যলেখা প্রেমের কবিতা
ওদের প্রত্যেককে দেখিয়ে বলি,-
দ্যাখো, এই পংক্তিমালায় তার হয়ে তোমাদের সবার
ঋণ স্বীকারের তুমুল ঝংকার তুলেছি।
২৬.৭.৯৪
এই মুহূর্তে তুমি
এই মুহূর্তে তুমি আসতে পারো এখনে। তোমার
পদস্পর্শে ঘাসগুলো হেসে উঠবে, লোকটার
স্বপ্ন সমুদয় আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসবে, তোমাকে
সংবর্ধনা জানাবে দোয়েল আর অজস্র
প্রজাপতি। কোনো দ্বিধা কোরো না তুমি,
তোমাকে আলিঙ্গন করবে
লোকটার আকাঙ্ক্ষার সকল গোলাপ, তোমার
পায়ে চুমু খাবে শারদ রাতের ঝর্নাধারা।
তুমি এসেই দ্যাখো একবার, তোমার কাঁধে
এসে বসবে পৃথিবীর সুন্দরতম পাখি,
প্রাণমাতানো সুর ঝরাবে তোমার সারা শরীরে।
একটি হরিণ ওর কোমল পদ্ধতিতে
তোমার আঁচল ধরে টেনে এনে তোমাকে
আসন পেতে দেবে পদ্মদীঘির কিনারে। তোমার
পায়ের রাঙা পাতা ধুইয়ে দেবে রূপোলি তন্বী মাছ।
তোমার সত্তায় জাগবে অপূর্ব শিহরণ এবং
তুমি কবিতার অপরূপ উন্মীলন দেখে চকিতে
বুঝতে পারবে, তোমাকে ঘিরেই সকল আয়োজন।
এই যে লোকটা দাঁড়ানো এখানে
সেই কবে থেকে, তাকে স্বর্ণচাঁপা, বন পায়রা, ক্যামেলিয়া,
শেষ রাতের তারা, জ্যোৎস্না-ঝলসিত নদীর ধারা অনেক আগেই
শনাক্ত করেছে কবি বলে। এই লোকটাই
তোমার প্রকৃত প্রেমিক, যে জানে আমাকে
তার সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয় কিছুতেই।
লোকটা, যে কবি, তার মুহূর্তগুলো নক্ষত্রের মতো
ছিটিয়ে দেবে তোমার চারপাশে,
তুমি সেই রূপোলি টুকরোগুলো ধারণ করো
তোমার চোখের পাতায়, অধরে, স্তনচূড়ায়, নাভিমূলে।
আকাশের তারার মিছিল যখন অপসৃত দৃষ্টি থেকে,
যখন জোনাকিরা সব আলো বিলিয়ে ফতুর হয়ে
মৃত পড়ে থাকবে ভেজা ঘাসে, তখন তুমি ইচ্ছে হলে চলে যেও।
সেই লাজনম্র প্রস্থানে কবিতা, উর্মি, শতাব্দী তোমাকে
অনুসরণ করবে ছায়া হয়ে এবং তখন
লোকটাকে ঘিরে স্বপ্নের ঝাঁক ঝাঁক গোলাপি মৌমাছির গুঞ্জরণ।
২৩.৯.৯৪
এমন কেন হয় না?
শুদ্ধতার সরোবরে ডুবসাঁতার কেটে
এইমাত্র উঠে এলে তুমি, তোমার
সত্তার অপরূপ তীক্ষ্ণ নগ্নতা থেকে ঝরছে জলের
স্বচ্ছ রূপোলি ফোঁটা উৎসুক ঘাসমাটিতে।
যেসব কদাকার বৃশ্চিক আমার হৃদয়ের
তন্তুগুলো আহার করে
বেঁচে থাকে কর্কশ নধরতায়, তুমি তাদের কাল রাত্তিরে
তোমার শৈল্পিক আঙুলে
তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছ কবরস্তানে। আমার
অন্তর্গত ক্ষত সযত্নে ধুইয়ে দিয়েছ শুদ্ধতার শিশিরে।
কাল রাত্তিরে তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি
ভালোবেসেছ; কাল তুমি এমন কিছু উচ্চারণে
আমাকে আলোকাবৃত করেছ যা,
শোনার আকাঙ্ক্ষায় আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
প্রতীক্ষায় ছিলাম। কাল নিশীতে বালিশে
মুখ চেপে তোমাকে আবৃত্তি করতে করতে ভালোবাসার মাতৃভাষায়
যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখন দূর থেকে
কয়েকটি নক্ষত্র দেখছিল আমাদের দু’জনের ঘুমের স্তব্ধতা।
এমন কেন হয় না, সব সময় দেখতে পাচ্ছি
তোমাকে? তুমি আমার সামনে লঘু পায়ে
ঘোরা ফেরা করছ স্যুইচ টিপছ আলো-হাওয়ায়,
চুল আঁচড়াচ্ছ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে,
শাড়ি পরছ, খুলছ ব্লাউজের হুক, আমার পাশে বসছ নিবিড়,
আমার আঙুল নিয়ে খেলা করছ, কখনো করছ
মুখ চুম্বন, কখনো আমার মাথা টেনে নিচ্ছ কোলে, কখনো-বা
তোমার চুলের ঝর্নাধারায় ঢেকে দিচ্ছ আমার মুখ-কেন এমন হয় না?
কেন এমন হয় না, ইচ্ছে করলেই তোমাকে ছুঁতে পারি
যে-কোনো সময়? ইচ্ছে হলেই তোমাকে নিয়ে
বেরিয়ে পড়তে পারি, নির্জনতাকে সাজাতে পারি নান্দনিক
যুগ্মতায়? এই মুহূর্তে তোমার যুগল স্তন উৎকর্ণ হয়ে
শুনছে আমার হৃদস্পন্দন, সেই ধ্বনিপুঞ্জে
তোমার নাম ঢেউ হয়ে নেচে উঠছে কি না, তা’
যাচাই করে নিতে আর আমি তোমার সুবর্ণ উরুর শোভা
দেখা আর চুমোর সুঘ্রাণের স্মৃতি আউড়ে চলেছি।
২৫.৯.৯৪