হংসমিথুন
যখন আমরা দু’জন মুখোমুখি বসে
ঘনিষ্ঠ কথোপকথনে মাতি,
ওদের খুব চোখ টাটায়
আর ওরা আমাদের হিংসুটে
কায়দায় বিচ্ছিন্ন করতে চায়,
যেমন দাঙ্গা পুলিশ
রাজনৈতিক কর্মীদের
অবস্থান-স্থল থেকে।
যখন তোমার মুখ চুম্বনের জন্যে
মুখ বাড়াই,
আমাদের মাঝখানে দাপটে
ওরা ঝুলিয়ে দেয় নিষেধাজ্ঞা,
যেমন স্বৈরাচারী শাসকচক্র
নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মানুষের মিলনমেলা।
যখন আমি বুকের ভেতর
একরাশ স্বর্ণচাঁপা নিয়ে তোমার দিকে
যাত্রা করি, তখন ওরা
শহরময় সান্ধ্য আইন জারি করে।
তবু আমাদের নিবিড় ভালোবাসা কখনো
রাজহাঁসের মতো
গ্রীবা উচিয়ে হাঁটে বাগানে, কখনো বা
নিষাদের নিষ্ঠুর দৃষ্টি উপেক্ষা করে
স্পন্দিত পাখার নির্মল সুর ঝরিয়ে
দূরের নীলিমায় উল্লসিত হংসমিথুন।
১১.৯.৯৪
হঠাৎ বৃষ্টি এলো
হঠাৎ আজ বিকেলে চারদিকে অন্ধকারে ডুবিয়ে
বৃষ্টি এলো। শত শত আরবি ঘোড়ার পদশব্দে মনে পড়ল তোমাকে
আর মনে এলো অনেক বছর আগেকার কথা।
তখন আমি কৈশোরের বেড়া-ডিঙানো যুবা এবং
আমার বাবা ছিলেন জীবিত। আমি কোনো কোনো বিকেলবেলা
বিছানায় গা এলিয়ে, হাতের তালুতে থুৎনি রেখে
বাঈজির ঘুঙুরের মদির আওয়াজের মতো
বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তাকিয়ে থাকতাম বাইরে। এই দৃশ্য
অসহ্য ছিল বাবার কাছে। বিরক্তির হুলে কাতর তিনি ভাবতেন-
তাঁর ছেলেটার মাথায় শ্রাবণের আকাশ আর
বৃষ্টির অজস্র বিপজ্জনক জুঁই ঢুকে পড়েছে। আজো আমি
বাবার বর্ষাকালীন চোখের আগুন ভুলতে পারিনি।
আজ অন্ধকারময়, সপসপে বিকেলে বৃষ্টিপাত দেখে যুগপৎ
আমার বাবার চোখের ফুলকি এবং
তোমার দৃষ্টির বিদ্যুৎ মনে পড়ল। আমার
প্রয়াত পিতা আজকের দৃশ্য থেকে তাড়াতাড়ি দূরে
সরে দাঁড়ালেন তোমাকে প্রধান ভূমিকা দান করে। এই উতল হাওয়ায়
এখন তুমি আমার একার, একাকিত্বের অধীশ্বরী।
বৃষ্টির অন্তরঙ্গ সুর শুনতে শুনতে দেখি এইমাত্র গোসল সেরে
তুমি এসে দাঁড়িয়েছ আমার
শয্যার পাশে, চুলের ভেজা সুগন্ধে আমি মাতাল,
তোমার চুলের ঝর্নাধারা আমার সারা মুখে আর তুমি
আমার মুখ চুম্বন করছ আমাকে মহিমার চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে। বৃষ্টি
গেছে থেমে; এখন ঘরে নীরবতা
আমজাদী সরোদের সুর। কোথাও তুমি নেই।
শীতল জলে গা ধুয়ে
তুমি আদৌ আসোনি আমার কাছে। এভাবে
আসবেও না কোনোদিন। আমাকে এই মুহূর্তে বৃষ্টিহীনতায়
শাসন করছে আমার বাবার বর্ষাকালীন চোখের আগুন;
জলজ অন্ধকারে একলা ঘরে আমি ভীষণ পুড়ে যাচ্ছি।
২৫.৫.৯৪
২৩ অক্টোবর, ১৯৯৪
আমার ধূসরতাকে বালুকণার মতো উড়িয়ে
তুমি বললে, ‘কাল তোমার জন্মদিন,
এই উপলক্ষে তোমাকে
কয়েকটি কথা লিখে পাঠাতে চাই। ভাবছি,
রবীন্দ্রনাথ থেকে চয়ন করব
পংক্তি, কী বলো? তোমার কণ্ঠস্বরে
আমার জন্মদিনের
সকাল ছিল, ছিল হৃৎস্পন্দনের প্রতিভাস।
“মিছেমিছি ‘সঞ্চয়িতা’-র কাছে” আমি জানাই,
“হাত পাতবে কেন? বরং নিজেই তুমি
লিখে ফেলো কিছু”। “কী সাধ্য আমার
তোমার উদ্দেশে রচনা করি পংক্তিমালা”-তুমি
এই বাক্য সাজাও এবং আমার জন্মদিন
নবীন যুবার মতো উৎসুক চোখ মেলে তাকায় তোমার দিকে।
তোমাকে বলি, “যদি তুমি একটি সাদা পাতার ঠোঁটে
কলমের ওষ্ঠ স্থাপন করো, তাহলে
একটি দোয়েল, কতিপয় প্রজাপতি
শূন্য পাতাটিকে ঘিরে উড়ে বেড়াবে,
কিছু কনকচাঁপা
বাড়িয়ে দেবে হাত। ওদের সমবায়ী সহযোগিতায়
তোমার প্রয়াসে প্রস্ফূটিত হবে ভালোবাসার
হৃৎকমল, শুভেচ্ছার অপরূপ পরিভাষা।
আমি তোমার মৃদু হাসি অনুভব করি
আমার সত্তার তন্তুজালে। আমার উপলব্ধিতে
তরঙ্গ তুলে তোমার জন্মদিন
আমার জন্মদিনকে সোনালি বনহংসীর মতো
অনুসরণ করে মানস সরোবরে,
যেখানে আমাদের অবিনশ্বর মিলনোৎসব।
২২.১০.৯৪