পান্থজন
আমিও রেখেছি নগ্ন পদযুগ, এ জগতে। জলে
আয়না আছে বলে নিয়ত এড়িয়ে গেছি জলাশয়,
জলজ দর্পণে মজে সমাজ-সংসার কী অতলে
ডুবিয়ে পুরাণ হতে চাইনি কখনো। বড় ভয়
ছিল সেই লতাগুল্মময় জলাশয়কে আমার, কিন্তু তবু
মায়াবী বাণিজ্যে নিঃসঙ্গতা আমাকে নিয়েছে কিনে
কেশাগ্র অবধি, তাই বৈশাখের তীব্র দাহে প্রভু
তন্ন তন্ন করে জল খুঁজি। টলটলে অমন দর্পণ বিনে
বাঁচা দায়; প্রভু, তুমি সেই জল? আমি ছলচ্ছল আকাঙ্ক্ষায়
কখনো নিজেকে কখনোবা দূরে পদযাত্রা করে বারংবার
পাখির পালকে পাথরের দিকে চোখ রেখে দেখি শূন্যতায়
বিপন্ন উধাও তুমি, দর্পণে আমার মুখ কতিপয় হাড়।
এ কোন বৈশাখে আমি অকস্মাৎ পৌঁছে গেছি দীপ্র
জলাশয় খুঁজে খুঁজে? চতুর্দিকে বালি ভয়ানক
জান্তব, ক্ষুধার্ত; আমি, রুক্ষ, তৃষ্ণাতুর, খুঁড়ি ক্ষিপ্র
ক্রূর বালি ফোয়ারার লোভে। আমার দশটি নখ
ব্যর্থ, কালো; ওষ্ঠে গণ্ডে বালুকণা আর সীবন-রহিত জামা
খণ্ড খণ্ড হ’য়ে খসে বিচূর্ণিত স্মৃতির মতন।
এক পাল উন্মাত্ত উটের শব্দ মাথার ভেতর, তপ্ত তামা
চতুষ্পার্শ্বে তরঙ্গিত সর্বক্ষণ। গুপ্ত মায়াবী বাণিজ্যে ধন-
রত্ন পাব বলে এই কংকাল কণ্টকময় পথে
চলেছি সন্তের মতো উপবাসে। জলাশয় না পেলেও হেঁটে
হেঁটে যেতে হবে চিরদিন; কেননা কাঙাল আমি এ জগতে
স্বেচ্ছায় চেয়েছি হতে পান্থজন, যতই ঝরুক রক্ত পদযুগ ফেটে।
প্রতীক্ষায় থাকি
আমার বুকের থেকে সুকোমল একটি হরিণ
খুশির মতন লাফ দিয়ে রাজেন্দ্রানী পূর্ণিমায়
ভিজে যায়, মিশে যায়; অকস্মাৎ রক্তে ঢেউ তুলে
আমার চোখের থেকে কজন মুনিয়া বেশ পাখা
নেড়ে নেড়ে নিমেষে অদৃশ্য হয় গাছের ভেতর।
এবং আমার এই অসহায় কম্পমান করতল থেকে
গোলাপের পাণ্ডুলিপি, শেফালির বাণী দুঃখ হয়ে
ধুলায় মিলায়-দ্যাখো এখন কী নিঃস্ব আমি, হায়!
একদা মেঘের কত ছিল পকেটে আমার
ছিল বনচারী প্রতিধ্বনি, স্বপ্নের সুনীল বীজ।
এখন পকেট শূন্য; শুধু স্মৃতি লেগে আছে কিছু,-
সিগারেট শেষ হলে যেমন কিঞ্চিৎ নিকোটিন
আঙুলে জড়িয়ে থাকে। কী দারুণ নিঃস্বতায় ঘুরি
এদিক ওদিক রাত্রিদিন নিরুপায় এই আমি
ব্যর্থতার সমানবয়সী আর প্রতীক্ষায় থাকি
আবার কখন আসে ফিরে হৃত সম্পদ আমার।
প্রত্নতাত্ত্বিক
বাইরে বাইরে আমি খুব ঘোরাফেরা করে থাকি।
পায়ে ধুলোবালি, চুলে খুড়কুটো, না-কামানো দাড়ি
দু’চার দিনের, চুলকোনিপ্রবণ এবং অন্ধকার
নুড়িময় উৎসে এক গভীর পিপাসা ইত্যাকার
ভ্রমণের চিহ্ন লেগে আছে রুক্ষ সমস্ত শরীরে।
সংঘে সংঘে রেখে বেলা ঘুরছি বাইরে ক্লান্ত ভিড়ে।
হাওয়া কালকূটে ছাওয়া; এই শ্বাসরোধকারী
পথে বিদেশীর মতো কত আর ঘুরব একাকী?
এখন ভেতরে যাওয়া প্রয়োজন, জ্যোৎস্নার মতন
মশারির অভ্যন্তরে একা স্মৃতির বিস্তর ছাই
ঝাড়া, চুল টানা বুকে মৃদু হাত বুলোনো ইত্যাদি
কাজে অগোচরে কথাঞ্চিৎ লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন।
প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো আজ নিজে নানান আদি
স্তর খুঁড়ে খুব ঘন ঘন শিহরিত হতে চাই।
বরং
বাঁকা হাসি হাসলে তো হাসাই যায়,
যাকে ইচ্ছে তাকে
তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলে তো করাই যায়,
কিন্তু আমি তেমন কিছু করতে চাই না।
বরং হাসলে আমি ঠোঁট থেকে সহজ
রোদ্দুর ঝরিয়ে হাসব প্রতিবার,
‘দূর ছাই’ বলে কারুকেই
কখনো দূরে সরিয়ে দেব না।
মরা ঘোড়াকে ঠ্যাঙানো কঠিন কিছু নয়-
ইচ্ছে করলেই তার উদর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
নাড়িভুঁড়ি বের করে টাঙিয়ে দিতে পারি
আমার দরজায়।
কিন্তু আমি তেমন কিছু করতে চাই না।
বরং একটা তরুণ কেশর-দোলানো
বুনো ঘোড়াকে বাগ মানিয়ে
তার পিঠে সওয়ার হবো হমৎকার।
ইচ্ছে করলেই নিজের ঘর
অন্ধকার করে রাখা যায়,
ইচ্ছে করলেই বাগানটিকে
দুমড়ে-মুচড়ে তছনছ করা যায়।
কিন্তু আমি তেমন কিছু করতে চাই না।
বরং ঘরে বাতি জ্বেলে রাখব আর
খুরপি নাচিয়ে বাগানের মাটি
নিড়াব, ফুলের চারাগুলোকে
বেড়ে উঠতে দেব তন্বীর মতো।
বলার কিছু নেই
কিছুই তো বলব না, আমার বলার কিছু নেই।
তাছাড়া যা বলব তাতে অক্ষর মিলিয়ে এতেবার করতেই
হবে, এই দাবি কী করেইবা করি? শোনো হে বরং
ধরে নাও আমার এ আচরণ নিছক ভড়ং
ছাড়া কিছু নয়। আমি তো নীরবই থাকি
আকসার, জীবনের পায়ে গড়াগড়ি দিই আর অন্ধকারে ঢাকি
মুখ; আপাতত শিকস্তী জমির মতো পড়ে আছি,
নানান সত্তার কী জটিল রোদ্দুরে ছায়ায় বাঁচি।
কী-যে হয়, মাঝে-মধ্যে জিভের ডগাটা কোন ছলে
বেয়াড়া চঞ্চল হয়ে ওঠে বলে মুখের অঞ্চলে
বিস্ফোরণ ঘটে যায়। যদি বলি, এ পান্থশালায়
বেশুমার বুভুক্ষু থালায়
অহর্নিশ মৃত্যু-বাঘ ওৎ পেতে আছে,
দোলনার কাছে
মৃত্যু, যেন অশরীরি দাই-মা, গাইছে ঘুম-পাড়ানিয়া গান,
মৃত্যু ব্যান্ড মাস্টারের মতো বাদ্যহীন আসে, চকিতে বাগান
কংকালের ডালপালা বুকে নিয়ে মৃত্যুরই বাগিচা হয়ে যায়,
তবে কি একথা কেউ মেনে নেবে আজ? যে শাবাজ দূরে ধায়
অনেক উঁচুতে নীলিমায় তার চঞ্চুর ইস্পাতি
হিংস্রতায় ছিন্নভিন্ন বলে, হায়, হব কি আমিও আত্মঘাতী?
এই যে দেখছি ওরা, সারি সারি লোক, গোলাপের কাছে গিয়ে
ইনিয়ে-বিনিয়ে
এক আধসের চাল চায়, গাছের নিকট চায় নতুজানু অভিনব
পোশাক-আশাক, সর্বক্ষণ করে স্তব
নিসর্গের ইদানীং আর
অস্থিচর্মসার
হাজার হাজার শিশু চাঁদকে বেলুন ভেবে নিয়ে
মেটায় খেলার সাধ ধুলোয় গড়িয়ে।
এই যে দেখছি কত গ্রামীণ রমণী,
শহুরে ঘরণী
কী মিহি জ্যোৎস্নার শাড়ি পরে আড়ালেই
থাকে একাকিনী লজ্জা-জালে বন্দিনী এবং সেই
খাঁ-খাঁ রূপ এমনকি শয্যাসঙ্গীরও দেখার নেই অধিকার।
কিছুই দেখি না আমি, এ তো শুধু দৃষ্টিরই বিকার!
শক্রদের কয়েদখানায় ঘানি টেনেছি বলেই, হে স্বদেশ, শোনো,
তোমারই প্রেমের কোনো কোনো
দন্তুর ইজারাদার রক্তপায়ী পাখির মতন
আমাকে ভীষণ ঠোকরায় সুখে যখন তখন।
আমার তো শালপ্রাংশু বাহু নেই, এমনকি হাতই নেই তাই,
পারি না পবিত্র ক্রোধে জ্বলে উঠে মিথ্যার প্রাসাদ ছাই
করে দিতে, পারি না বেবাক মিসমার
করতে তাদের রাঙা তাসের ঘরের মতো মস্ত দরবার।