তোমার স্মৃতি
বুকের ভেতর সাঁকো ভাঙে, ঘর পু’ড়ে যায়, ইতস্তত
ভস্ম ওড়ে কিংবা কোনো
প্রাচীন গানের রেশ থেকে যায়।
বুকের রুক্ষ ধূসর পথে কখন কে যে উদাস ডাকে।
দেয়াল থেকে চোখ ফিরিয়ে ফের কখনো
অন্ধকারে দেখি মৃত শিশুর মতো
ছিন্নভিন্ন একলা বাদুড় হিম মেঝেতে প’ড়ে থাকি।
জ্যোৎস্নামাখা ঊর্ণাজালের মতো স্মৃতি, তোমার স্মৃতি
হৃদয় জুড়ে কেমন হু-হু বিষাদ গীতি।
রাস্তাজোড়া হাঁসের মিছিল, দোলা যেন হাজার হাজার
শুভ্র ঢেউয়ের; হঠাৎ লোকে
পথ ছেড়ে দেয় সবিস্ময়ে।
ট্রাফিক পুলিশ ঠোঁটের কোষে বাঁশি গুঁজে শূন্যে ভাসে।
ছিন্ন মেঘে ব্যান্ড মাস্টার লাঠি ঠোকে,
বাদ্যরবে পথ হয়ে যায় ফুলের বাজার।
পাখির সঙ্গে শ্বেত করোটি মত্ত নাচে নীল আকাশে।
জ্যোৎস্নামাখা ঊর্ণাজালের মতো স্মৃতি, তোমার স্মৃতি
হৃদয় জুড়ে কেমন হু-হু বিষাদ গীতি।
সুদূর আমার ছেলেবেলার ম্যাজিকঅলা ফুল্ল ঢোলা
কোর্তাপরা বানর হয়ে
ডুগডুগিটা বাজায় হেসে।
স্বপ্নাবেশে সিগারেটের শরীর পোড়াই কয়েকখানা;
হঠাৎ দেখি ভিয়েতনামের জলাশয়ে
কার সে শরীর আছে প’ড়ে কাদায় ঘোলা;
মগজে তার শূন্য বোবা হাত-পাগুলো দিচ্ছে হানা।
জ্যোৎস্নামাখা ঊর্ণাজালের মতো স্মৃতি, তোমার স্মৃতি
হৃদয় জুড়ে কেমন হু-হু বিষাদ গীতি।
নিঃস্ব কৃষক যেমন
কখনো নিশ্চিন্ত থাকি, ভুলে থাকি; হঠাৎ আবার
বুকের ভেতর কাঁপে চৈত্রের দুপুর, হৃদয়ের
অন্তহীন পথে ক্রমাগত গলে পিচ; খড়কুটো,
পশুর কংকাল থাকে পড়ে ইতস্তত। ধূমায়িত
নির্দয় সে-পথে তুমি ধু-ধু মরীচিকার মতন
বার বার দেখা দিয়ে কোথায় মিলিয়ে যাও দ্রুত।
আমার চিৎকার তুমি শুনতে কি পাওনি এখনও?
অথচ তোমাকে দেখি আশেপাশে, দেখি দূর থেকে
ঘরময় নারী-পুরুষের চক্রে, কখনো তাকাও, চোখে
রহস্যের ভাষা হয় ঘন, কখনোবা নৈঃশব্দের
বুক তোলপাড় করে তোলো দীপ্র হাসির সরোদে।
তোমার বিচ্ছেদ হচ্ছে খরশান শরীর আমার।
মনেরই ব্যাপার প্রেম, জানি; কিন্তু এমন আঁধার
ব্যাপ্ত অস্তিত্বের তটে যার ঘূর্ণাবর্তে জন্ম নেয়
অজস্র নক্ষত্রপুঞ্জ, আজও কী প্রবল তার দাবি।
একটি ফসল থেকে অন্য ফসল অবধি নিঃস্ব
কৃষক যেমন টিকে থাকে, একটি মিলন থেকে
অন্য মিলনের ক্ষুব্ধ তৃষিত সীমায় তেমনি আমি।
নিজের ছায়া
প্রত্যহ
নিজের ছায়া দেখে দেখে আমি ক্লান্ত।
ডানে-বাঁয়ে যেদিকেই তাকাই
তাকে দেখি, অর্থাৎ আমার ছায়াকে।
আমার ছায়ার ভেতর থেকে
এমন কিছু উঠে আসে না,
যা আমার জ্বরতপ্ত ললাটের জ্বালা
জুড়োতে পারে,
আমার অনিদ্রার চরে
বইয়ে দিতে পারে নিদ্রার জোয়ার।
অথচ কখনো-কখনো
আমার ছায়া নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে
মাথা ঝাঁকিয়ে
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায় প্রায় সামরিক কেতায়
আর প্রচণ্ড রাগী সুরে
আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে-
আমি আর তোমার বেগার খাটব না,
এবার বেরিয়ে পড়ব ঠিক আর
যা কিছু আমার বেঠিক মনে হবে,
ভেঙে তছনছ করে দেব সব,
তুমি আমাকে ঠেকাতে পারবে না।
আমার ছায়ার স্পর্ধায় আমি চমকে উঠি।
নৈশ প্রহরে পরস্পর
কি শুনে হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুম গভীর রাত্তিরে?
কবর খোঁড়ার শব্দ, নাকি প্রেতের আবছা স্বর
আমাকে জাগিয়ে দিল? পর মুহূর্তেই ভাঙে ভুল-
আমার শয্যার পাশে দেখি একা রয়েছে দাঁড়ানো
আমারই সন্তান। তার কণ্ঠস্বর যেন কোনো দূর
বিষণ্ন সৈকত থেকে এলো ভেসে ‘এই এই, শোনো,
কে তুমি, কে তুমি?’ তার প্রশ্নের শলাকা হল বিদ্ধ
হৃৎপিণ্ডে আমার; আর্ত আমি, অসহায়, তার দিকে
চেয়ে থাকি, বোবা, চেষ্টাহীন। কতদিন তার কত
ভৌগোলিক কৌতূহল মিটিয়েছি, নিত্য খুঁটিনাটি
প্রশ্নের উত্তর আমি জুগিয়েছি তাকে সহজেই।
অথচ এখন ব্যর্থ, পরাজিত এ নৈশ প্রহরে।
জানি সে অসুস্থ এক অসুখী বালক, হয়তোবা
সুখ-দুঃখ তাকে আর করে না বিহ্বল! নিমেষেই
স্বাভাবিক রৌদ্রছায়া তার চোখে, হায়, অন্য কিছু
হয়ে যায়! আমিও অস্পষ্ট চেনা, কখনো অচেনা
তার কাছে। কিন্তু তবু তার সেই ভীষণ জিজ্ঞাসা
প্রাসঙ্গিক বড় বেশি। তাহলে কে আমি? কার
পরিচয় আজ তুলে ধরব এই বালকের কাছে?
যে প্রবল ভোগী জীবনের গ্রীবায় চুম্বন আঁকে
বার-বার, তার? নাকি যে-যোগী অলক্ষ্যে হাঁটে ধু-ধু
প্রান্তরে একাকী, রুক্ষ, রিক্ত, হাতে রাখে না কিছুই,
তার? কিংবা অস্তিত্বের স্তরে স্তরে নানান যুগের
স্মৃতির ভগ্নাংশ নিয়ে যারা হাসে, কাঁদে, চুল ছেঁড়ে,
দেখা দিয়ে সহসা লুকায়, মুখ ঢাকে মনস্তাপে,-
আমি কি তাদেরই কেউ বাস্তবিক? বিনষ্ট, দণ্ডিত?
দ্বিধার ঠোকরে ছিন্নভিন্ন নিজেকেই প্রশ্ন করি
ঘুরে ফিরে, বলো তবে কোন আমি প্রকৃতই আমি?
সম্মুখে দাঁড়ানো প্রশ্নাকুল যে বালক, তার মধ্যে
আমার ঔরসজাত সন্তান কোথায়? এই ঘরে
সুস্থ, স্বাভাবিক সারাবেলা করত যে খেলা, করেছে
সে প্রস্থান বহুদূরে; একে আমি চিনি না বস্তুত।
এ এক নির্জ্ঞান তটে রয়েছি দাঁড়িয়ে আমি আর
আমার সন্তান, যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, নিরুত্তর।
পতন
কখনো বা কখনো সবাই প’ড়ে যায় অতর্কিতে।
ব্যাপক রোদ্দুর ভেঙে, অন্ধকারে ঢেউ তুলে যারা
পথচারী, পড়বো না কখনও হোঁচট খেয়ে আদাড়ে-বাদাড়ে,
এ ফখর তাদের সাজে না।
কখনো না কখনো সবাই প’ড়ে যায় অতর্কিতে।
সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে কিংবা বাসের হাতল ধরে
বাদুড় সাজার ক্ষিপ্ত প্রতিযোগিতার
মাশুল অনেকে দেয়, কেউ কেউ খানাখন্দে প’ড়ে,
হায়, কেউ কেউ খাদেও তলিয়ে যায়।
কখনো না কখনো সবাই প’ড়ে যায় অতর্কিতে।
শৈশবে যখন হাঁটি হাঁটি পা পা
চলার আবৃত্তি করতাম ট’লে কালো-সাদা বরফি-আঁকা
মেঝেতে মাতাল, তাল সামলাতে না পারলে পিতা
তড়িঘড়ি ধরতেন তাঁর আত্মজের হাত দৃঢ় হাতে আর কৈশোরেও
কখনো বাইরে গেলে প্রফুল্ল সকালে কি বিকেলে
সহসা ঠোকর খেলে পথে পতনোন্মুখ পুত্রকে
নিতেন সামলে অবলীলাক্রমে, বলতেন, ‘তোর
হুঁশ নেই এতটুকু, দেখেশুনে পথ চলা দরকার, বুঝলি?
নইলে দুর্ঘটনা ফাত্রা ছোকরার মতো উঠবে হেসে
হো হো তোর আহম্মকি দেখে।
ইদানীং তাঁর কথা খুব কমই বলা হয়, অকস্মাৎ
দেয়ালের ফটোগ্রাফে নির্বিকার দৃষ্টি প’ড়ে যদি,
অতীত ককিয়ে ওঠে কখনোবা, মনে হয়, একদিন পুরোনো
এ বাড়িতে তিনিও ছিলেন।
এখানে এ ঘরে কিংবা পথের কিনারে, শুনি, শিহরিত, একা,
আজও ক্লোরোফর্মের মতন ভাসে তার আত্মা আত্মা স্বর।
মনে প’ড়ে, যখন নামানো হল করবে পিতার
তেয়াত্তর বছরের উদাস শরীর গমগমে পুণ্যশ্লোক
উচ্চারণে, আমি প’ড়ে যাচ্ছিলাম খুঁড়ে তোলা মাটির ওপর
প’ড়ে যাচ্ছিলাম।
কখনো না কখনো সবাই প’ড়ে যায় অতর্কিতে।
আমি
প’ড়ে
যাচ্ছি
প’ড়ে
যাচ্ছি
অতি দ্রুত প’ড়ে
যাচ্ছি
প’ড়ে যাচ্ছি
ক্রমাগত, ভাবি আমার জনক ঐ
পবিত্র গাছের রূপে দেখাবেন লাল কি সবুজ সিগন্যাল;
কিন্তু আমি
প’ড়ে যাচ্ছি
প’ড়ে
যাচ্ছি
প’ড়ে
যাচ্ছি
পাবো না কখনো আর পৌরুষ-প্রবল তাঁর হাতের নির্ভর
প’ড়ে যাচ্ছি
প’ড়ে যাচ্ছি
শুধু প’ড়ে যাচ্ছি…