চতুষ্পার্শ্বে বয়সের ছায়া
চতুষ্পার্শ্বে বয়সের ছায়া দীর্ঘ হতে থাকে ক্রমে।
আমার হৃদয়ে পাতা ঝরে, পাখি
শব্দহীন ফেলে যায় অনেক পালক। আজকাল
ব’সে থাকি প্রায়শই বারান্দায় পুরোনো চেয়ারে,
হাওয়া সাদা-কালো চুলে বুলোয় আদর খেলাচ্ছলে,
কয়েকটা কাক দূর থেকে
তাকায় আমার দিকে। ছেলেমেয়ে স্কুলে,
অসুস্থ ছেলেটা স্তব্ধ দেয়ালের দিকে
মুখ রেখে, গৃহিণী হেঁসেলে, মাঝে-মধ্যে
বেজে ওঠে ব্যস্ততার বোল। আশেপাশে নেই কেউ,
নিঃসঙ্গতা বয়সের নিত্যসঙ্গী ইদানীং, নাকি
যুগচিহ্ন এই?
অথচ এও তো জানি, হঠাৎ অসুস্থ হলে আমি
আমার স্বাস্থ্যের জন্যে কেউ অগোচরে
ব্যাকুল প্রার্থনা করে, আমার আনন্দে উল্লসিত
হয়, শোকে অত্যন্ত কাতর। যারা আমার কবিতা
ভালোবাসে তাদের শুভেচ্ছা ফুল হয়ে ঝরে পথে,
চলতি পথে কেউ নাড়ে হাত, কেউ হাবি দেয় উপহার।
তবু কি বলব আমি একা, এই চেনা বিশ্বে?
ছেলেবেলা থেকেই
ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি
ভারি দুঃখ পাই।
একটি রঙিন বল একদা কলকাতা থেকে এনে
আব্বা উপহার দিয়েছিলেন আমাকে,
একদিন সে-বল কোন শীতের বিকেলে
ছাদ থেকে প’ড়ে
গড়াতে গড়াতে
গড়াতে গড়াতে
কোথায় অদৃশ্য হল, পাইনি কখনো আর খোঁজ।
ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি
ভারি দুঃখ পাই।
একটি সফেদ হাঁস ছিল ভ্রাম্যমাণ
উঠোনে অথবা বারান্দায়,
ছিল শৈশবের ছায়ায় আমার গৃহপালিত রোদ্দুরে আর
আমার সবুজ স্নেহ খেত প্রতিদিন খুদকুড়োর সহিত।
ক্ষুধার্ত প্রহরে
একদিন সহসা তার পালকবিহীন
কতিপয় লালচে ভগ্নাংশ
খাবার টেবিলে এলো ভয়ানক বিবমিষা জাগিয়ে আমার।
ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি
ভারি দুঃখ পাই।
নেহার, আমার বোন, সত্যেন দত্তের ছিন্নমুকুল পড়ার
বয়সে আঁধারে ঝরে আমার ভেতর
অতিশয় কালো বৃষ্টি সে কবে ঝরালো,-
কিছুদিন আমি খুব একা বোধ করেছি একেলা।
ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি
ভারি দুঃখ পাই।
অরুণ, সুনীল, সুবিমল, সূর্যকিশোর, তাহের,
শিশির, আশরাফ আজ কয়েকটি নাম, শুধু নাম,
মাঝে-মধ্যে জোনাকির মতো জ্বলে আর নেভে।
ধূসর কিশোর সব সহপাঠী কোথায় যে করেছে প্রস্থান।
ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি
ভারি দুঃখ পাই।
আমার মনের সাদা ক্রমাগত কালোর দখলে
যাচ্ছে চলে, যাবে।
সম্প্রতি পীড়িত পাপবোধে; হে সময়,
কখনো তোমার প্রতি উদাস বিলাপ
করি নিবেদন।
ভাঙা মিছিলের মতো একেকটি আমি
দিকচিহ্নহীন পথে পলাতক, আজ অন্য আমি হয়ে আছি।
ছেলেবেলা থেকেই কিছু না কিছু সহসা হারিয়ে ফেলে আমি।
ভারি দুঃখ পাই।
তোমার সান্নিধ্যে কিংবা তুমি হীণতায়
কাটে বেলা; পরিত্যক্ত নিঃসঙ্গ সৈনিক
যেমন কম্পিত হাতে রণক্লান্ত ঠোঁট রাখে শেষ সিগারেট
তেমনি আঁকড়ে ধরি আজকাল একেকটি দিন আর ভাবি,
সহসা তোমাকে হারানোর দুঃখ যেন, হে মহিলা,
কখনো বা পাই।
জাদুঘর
‘আমি যাচ্ছি, আমার এ মুখ তুমি আর কোনো দিন
দেখবে না, আমি চলে যাচ্ছি, আমার সকল বেলা
তোমার দু’চোখ থেকে করতল থেকে
তুলে নিয়ে যাচ্ছি, তোমার মনোমণ্ডলে আমি আর
কেউ নই’ বলে তুমি একঘর আলো
শুষে নিয়ে করেছ প্রস্থান।
হে বিষাদময়ী নিরুপমা, হে প্রতিমা
কী করে তোমাকে বিসর্জন
দেব বিস্মৃতির কালিন্দীতে?
ইচ্ছে করলেই তো আর দুটি হৃদয়ের
সম্পর্কের সাঁকো, যেমন ভাবছ তুমি,
যায় না ভাসিয়ে দেয়া বিদ্বেষের বানে।
তুমি তো কখনো নও ব্ল্যাকবোর্ড লেখা
ভৌগোলিক কোনো নাম, নও ত্র্যালজেব্রার ফর্মুলা
অথবা পদ্যের পঙ্ক্তি নও কোনো, তড়িঘড়ি শুধু
ঘষে তুলে ফেললেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এখনও তো যেদিকে তাকাই, তুমি, শুধু, ব্যাপ্ত তুমি
সবখানে, এই তো দাঁড়াতে এসে নিঃশব্দে এখানে;
মেঝে কী ব্যাকুল নিত বুক পেতে
তোমার পায়ের ছাপ। বসতে চেয়ারে,
দোলাতে পা ঘন ঘন এবং পাখির পালকের
কোমল শব্দের মতো শাড়ির মর্মর উঠত বেজে
শিরায় আমার। এই ঘর তুমিময়
সকল সময়,
একে কোন জাদুবলে রেখেছ বানিয়ে অলৌকিক জাদুঘর?
কেন যে আমার হাতে সহজেই এক মুঠো বালি
রেখে চলে গেছ পেছনে নির্জন ফেলে ধ্বংসস্তুপ,
বুঝতে পারিনি।
তুমি ফিরে আসো আর না-ই আসো আমি এখানেই
থাকব অটল বসে সর্বক্ষণ, এ জায়গা কখনো ছাড়ব না।
উন্মত্ত মুয়াজ্জিনের মতো রটাচ্ছি তোমার নাম
প্রহরে প্রহরে,
সেই ধ্বনি মাথা কোটে স্তব্ধতার পুরুষ্ট দেয়ালে,
তোমার শরীর ভেবে বার-বার শূন্যতাকে করি আলিঙ্গন।
তাকে কি বলা যায়?
গহন বর্ষার তুমুল আঁচড়
নিমেষে ফেলবে কি মুছে চরাচর?
কার সে কালো চুল ভিজছে আকাশে?
কারবা হাহাকার সিক্ত বাতাসে?
ভিন্ন সাজ আজ পরেছে শহর।
দুপুরই সাঁঝ হল, মেঘের বহর
মেদুর যাত্রায়। কখনো হঠাৎ
আলো ব্যালেরিনা ছড়ায় দু’হাত।
ক্ষান্তি নেই এই শ্রাবণ ধারার,
যেনবা বিক্ষোভ সর্বহারার।
কোথায় ব্রজবুলি, সুললিত গান?
চতুর্দিকে বয় জলজ স্লোগান।
টেবিল ল্যাম্পের আলোয় গিবন
আবার ঝলসিত। কি গলি, কি বন
সবি তো একাকার। সহসা হৃদয়
কদম ফুল হয়, ঘন স্মৃতিময়।
প্রবল কালো ছিঁড়ে বৃষ্টি-জালের
আসোনি নিরুপমা। জলের তালে
বাজছে শূন্যতা। অথচ সাধিকা
কে যেন ভাঁজে সুর; নব্য রাধিকা?