এখন আমি
এখন আমি কারুর কোথাও যাবার কথা
শুনলে হঠাৎ চমকে উঠি,
এক নিমেষে ছলছলিয়ে ওঠে কেমন বুকের পুকুর।
কোথায় যাবে? কেন যাবে? এমনিতরো প্রশ্ন শুধু
চোখের তারায়, ঠোঁটের রেখায়
কাঁপতে থাকে।
কারুর দিকে হাত বাড়ালে হাত স’রে যায়।
দুঃখভেজা মেঘ-আড়ালে।
যখন-তখন
মনের আপন ঘাঁটি ভীষণ প্রকম্পিত।
এখন আমি কারুর কোথাও যাবার কথা
শুনলে হঠাৎ চমকে উঠি।
এখন আমি একটা কিছু ভেঙে যেতে দেখলে বিষম
ভেঙে পড়ি।
গোলাপ ফুলের চারাটা তার সজীবতা
খোয়ালে খুব ভয় পেয়ে যাই-
বালক বেলার দূর দুপুরে কাটা ঘুড়ির দৃশ্য আবার
যখন-তখন মনে পড়ে।
অনেকগুলো মৃত ঘোড়া শৈশবেরই ভুবনজোড়া
দীর্ঘ ঘাসে উল্টো পাল্টা থাকে পড়ে-
এখন আমি এমন কিছু ভাবলে ভীষণ
ভয় পেয়ে যাই।
বেশ তো থাকি সময় সময় আবছা আলোয় গৃহকোণে
বইয়ের পাতায় মাথা গুঁজে।
মাঝে মাঝে ঝরা পাতার ফিসফিসানি
বয়স বাড়ার খবর রটায়।
বয়স্য কেউ সূর্য ডোবার মতো হঠাৎ ডুবে গেলে,
অন্ধকারে মনের সঙ্গে
এক্কা দোক্কা খেলে কাটাই ক্লান্ত বেলা।
দুঃখ কেবল দুঃখ হয়ে ফেলে গভীর দীর্ঘ ছায়া
মুখের রেখায়-
তখন বুকের ভেতর শুধু একলা লাগে,
একলা লাগে।
কিছুই অচেনা নয়
কিছুই অচেনা নয়, এই ক্রোধ, ভাগবাটোয়ারা,
এ কুচকাওয়াজ, টিউনিক, এই প্রবল উত্থান,
কিছুই অচেনা নয়। মুখের বদলে অন্য মুখ,
চোখের বদলে চোখ, এখনও তো সেই চেনা রীতি।
এতটুকু স্বস্তি নেই; কনকচাঁপার দিকে চোখ
মেলে রাখলেও সাপ ফুঁসে ওঠে সর্বত্র কেবলি,
প্রাক্তন সন্ত্রাস পায় পরমায়ু নতুন সন্ত্রাসে।
নানান কংকাল আসে, বসে পাশে, কি করে বাঁচতে
হবে তারই পাঠ বারবার মুখস্থ করায় শুধু।
এই যে আপনি যান আপনিও যান মিছিলের
পুরোভাগে, আমি ঠিক থাকব পেছনে, বেগতিক
দেখলে চম্পট দেব যথারীতি। আমার তো আছে
ঘরময় পুষ্যি আর শেষাবধি যে কোনো কসরৎ
করে ক্ষ্যাপা ঘোড়ার কেশর ধরে ঝুলে থাকলেই
বাঁচবে আপন মাথা। অতএব পলায়ন, শুধু
পলায়ন জিন্দাবাদ বলে দেব ডুব সরোবরে?
কোথায় পালাব? স্বপ্নে? নাকি মনোহারি নিসর্গের
সবুজ কেল্লায় খুঁজব আশ্রয় নিরুপায়?
কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হয় ক্ষণে ক্ষণে, নিসর্গ নিজেও
সর্বদা অহিংস নয়, উপরন্তু এই জীবনের
আড়ালে জীবন যাঞ্চা করাটাই শিল্পিত বিকার
বলে কেউ লেখেন থিসিস, কিন্তু প্রাণ ধারণের
স্বাদ বাসি খাবারের মতো অল্প লেগে রয় জিভে।
অথচ কাটে না ভয় কিছুতেই, প্রহরে প্রহরে
আঁতকে উঠি পদশব্দে, চতুর্দিকে কী ভীষণ শক্তি,
অসুস্থ, উন্মত্ত, তোলে মাথা, যেন টিরানোসরাস।
ছাড়ুক হুংকার যত, আঁচড়াক মাটি, তছনছ
করুক নিসর্গ স্বেচ্ছাচারে, জানে না সে নিজে ক্ষয়-
চিহ্ন বয় নিজেরেই অস্থির খাঁজে খাঁজে অগোচরে।
কেন যে আমার এই ঘরে
অকস্মাৎ একদিন দুপুরে নাকি মধ্যরাতে তোমার সহিত
দেখা হলে পর, হিতাহিত
জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি নগ্ন দাঁড়িয়ে ছিলাম বহুক্ষণ
একা ঘরে। তোমার গহন চোখে চোখ পড়তেই একজন
বাউল আমার বুকে পদযাত্রা করলেন শুরু,
আমার গলায় তার একতারা গভীর দোলালো ছায়া,
যেন-বা অগুরু
বিলালো সুঘ্রাণ সত্তাময়।
কী মুদ্রা দেখালে তুমি শূন্যতায় বাহু মেলে, পেলাম অভয়।
রঙধনু আর মেঘেদের সঙ্গে দিব্যি দহরম করে
কেন যে আমার এই ঘরে
এলে তুমি মিছেমিছি? দেখছ না এখনও কোথাও
মেহগনি পদ্মখাট নেই কোনো, কী আনন্দ পাও
এখানে মাদুর পেতে বসে? ঝলমলে
ব্রোকেড জর্জেট আমি পারব না পরাতে তোমাকে। কোন ছলে
কী মধুর কথা বলে মন পেতে হয়, তা-ও শিখিনি কখনো।
হে দামিনী, হে ভামিনী শোনো,
আমি এক কৃশ, নষ্ট উত্তরাধিকারী, দ্যাখো, বহু দীর্ঘশ্বাসে,
দুঃখের বর্ষায় ভিজে সন্তের মতন উপবাসে
এনেছি তোমার জন্যে বুনে এই থান, কখনো আনন্দে আমি উন্মাতাল
একগাছি নিরিবিলি চিন্ময় সুতোর জন্যে আকাশ-পাতাল,
হায় রে, করেছি এক। এ নিরাভরণ
বস্ত্রে ঢেকে অমন বিদ্যুৎ শরীরের তুমি ফেলবে চরণ
আমার এ আঙিনায় তারপর, হায়,
বিলিয়ে ক্ষীণায়ু শোভা যাবে ঝরে ব্যর্থ নিরালায়।
কোনো ঐন্দ্রজালিকের প্রতি
আপনি ঐন্দ্রজালিক, ভুবনের আড়ালে ভুবন দেয় ডাক
মায়াবী সংকেতে, চলে নানা খেলা। স্টেজে স্টেজে সবাইকে তাক
লাগিয়ে দেয়াই কাজ আপনার। হয় কত কী যে
শত শত বিস্ফারিত দৃষ্টির সম্মুখে আর নিজে
আপনি থাকেন অবিচল, বিজ্ঞাপনী হাসি হেসে ক্ষিপ্রতায়
ঘটান বস্তুর রূপান্তর বার-বার। কী প্রথায়
চোখের পলকে ফের দ্বিখণ্ডিত উদ্ভিশন শরীর খেলাচ্ছলে
লাগান নিখুঁত জোড়া, অবিশ্বাস্য বটে। লোকে বলে,
রেখেছন আস্তিনের আড়ালে লুকিয়ে সব যন্ত্রপাতি, সত্যি
আপনি তো অলৌকিক মেকানিক! যে যাই বলুক, একরত্তি
খুশি নই
আপনার ইন্দ্রজাল দেখে, বরং বিষণ্ন হই
রঙিন টিকিট কিনে প্রতিবার। বস্তুত নিশ্চুপ থাকি উল্লোল মেলায়।
চাতুর্য, বিস্ময় আছে খুব এ খেলায়,
ভালবাসা নেই;
তাই শেষে অসামান্য হয় না কিছুই সামান্য তো সামান্যেই
আসে ফিরে। এ তুচ্ছতা নিয়ে মেতে কী আনন্দ পান?
কী লাভ সাজিয়ে ক্ষণিকের এই অলীক বিতান?
পতিত জমিনে কেন হেলায় বাদ্যর তালে তালে অবিরত
ফলান না ফসল অথবা দেশে দেশে আছে যত
অস্ত্রাগার, সেগুলো উদ্যান কেন হচ্ছে না এখনও হায়,
এ বিখ্যাত ইন্দ্রজালে? কেন ট্যাঙ্কগুলো আপনার ইশারায়
হয় না পুষ্পক রথ? রহস্য-ব্রোকেড যাচ্ছে ছিঁড়ে বিজ্ঞানের কী ব্যাপক
হাতে ক্রমাগত আর শুধু রূঢ় ছক
জন্ম নেয় দেশ-দেশান্তরে; এলো বড় বেশি স্বচ্ছতার কাল,
পারলে আমাদের রিক্ত মনে দিন ছড়িয়ে প্রকৃত ইন্দ্রাজাল।