এক ধরনের অহংকার
এখনও দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহংকার।
বেজায় টলছে মাথা, পায়ের তলায় মাটি সারাদিনমান
পলায়নপর,
হাঁ-হাঁ গোরস্থান ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি না
আপাতত, তবু ঠিক রয়েছি দাঁড়িয়ে
প্রখর হাওয়ায় মুখ রেখে।
অত্যন্ত জরুরি কোনো আবহাওয়া ঘোষণার মতো
দশদিক রটাচ্ছে কেবলি হাড়ে ঘাস
গজাতে গজাতে
বুকে হিম নিয়ে তুমি বড় নির্বান্ধব, বড় একা হয়ে যাচ্ছ।
আমার ভূভাগ থেকে আমাকে উৎখাত করবার জন্যে কতো
পাই পেয়াদা
আসছে চৌদিক থেকে, ওরা তড়িঘড়ি
আমার স্বপ্নের
বেবাক স্থাবর-অস্থাবর
সম্পত্তি করবে ক্রোক, কেউ কেউ ডাকছে নিলাম
তারস্বরে, কিন্তু আমি উপদ্রুত কৃষকের মতো
এখনও দাঁড়িয়ে আছি চালে,
ছাড়ছি নে জলমগ্ন ভিটে।
আমার বিরুদ্ধে সুখ সারাক্ষণ লাগায় পোস্টার
দেয়ালে দেয়ালে,
আমার বিরুদ্ধে আশা ইস্তাহার বিলি করে অলিতে-গলিতে,
আমার বিরুদ্ধে শান্তি করে সত্যাগ্রহ,
আমার ভেতর ক্ষয় দিয়েছে উড়িয়ে হাড় আর
করোটি-চিহ্নিত তার অসিত পতাকা।
আমার জনক এত ব্যর্থতার শব আজীবন বয়েছেন
কাঁধে, বঞ্চনার মায়াবী হরিণ তাঁকে এত বেশি
ঘুরিয়েছে পথে ও বিপথে, আত্মহত্যা করবার
কথা ছিল তাঁর, কিন্তু তিনি যেন সেই অশ্বারোহী
জিনচ্যুত হয়েও যে ঘোড়ার কেশর ধরে ঝুলে থাকে জেদী,
দাঁতে দাঁতে ঘষে।
আমার জননী এত বেশি দুঃখ সয়েছেন, এত বেশি
ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্নের প্রাচীন কাঁথা করেছেন সেলাই নিভৃতে,
দেখেছেন এত বেশি লাল ঘোড়া পাড়ায় পাড়ায়,
এতবার স্বপ্নে জাগরণে
ভূমিকম্পে উঠেছেন কেঁপে, তার ভয়ানক কোনো মাথার অসুখ
হওয়া ছিল স্বাভাবিক; কিন্তু ঘোর উন্মত্ততা তাঁর
পাশাপাশি থেকেও কখনো তাঁকে স্বাভাবিকতার
ভাস্বর রেহেল থেকে পারেনি সরাতে একচুলও।
বুঝি তাই দুঃসময়ে আমার আপন শিরা-উপশিরা জেদী
অশ্বক্ষুরে প্রতিধ্বনিময়। সেদিকেই বাড়াই না পদযুগ,
কোনো দিন কোনো
গন্তব্যে পৌঁছুতে পারব না। আমি সেই অভিযান-
প্রিয় লোক, যার পদচ্ছাপ মরুভূমি ধরে রাখে
ক্ষণকাল যার আর্ত উদাস কংকাল থাকে প’ড়ে
বালির ওপর অসহায়, অথচ কাছেই হৃদ্য মরূদ্যান।
কী-যে হয়, একবার রক্তস্রোতে অন্যবার পূর্ণাঙ্গ জ্যোৎস্নায়
ভেবে যায় হৃদয় আমার। যেদিকে বাড়াই হাত
সেদিকেই নামে ধস, প্রসারিত হাতগুলো তলহীন গহ্বরে হারায়
আর আমি নিজে যেন পৌরাণিক জন্তুর বিশাল
পিঠের ওপর একা রয়েছি দাঁড়িয়ে; চতুষ্পার্শে
অবিরাল যাচ্ছে বয়ে লাভাস্রোতে, কম্পমান ভূমি,
প্রলয়ে হইনি পলাতক,
নিজস্ব ভূভাগে একরোখা
এখনও দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহংকার।
একজন কবির প্রয়াণ
একজন কবির প্রয়াণে শহরের পথঘাট গমগম
করে না মিছিলে-সে সংবাদ কেউ কেউ শোনে কম
বেশি; কারো শ্রুতির আড়ালে থেকে যায়। গাছপালা
স্তব্ধ হয়, ফুরায় ফুলের আয়ু আর নদীনালা
কালো মেঘ রাখে বুকে, পাখিরা মর্শিয়া করে পাঠ
আর কতিপয় শব্দ-প্রেমিকের প্রাণের কপাট
খুব হুহু খুলে যায়, হৃদয়ের সব গুল্মলতা
অলৌকিক শিশিরে শিশিরে ভিজে ওঠে সান্দ্র ব্যথা
ব্যক্তিগত বাজে, ওরা অলক্ষ্যেই করে মাল্যদান।
একজন অডেন দেখুন কী প্রচ্ছন্ন মারা যান।
একটা কেমন তক্ষশিলা
যখন থাকি সত্তা ঢেকে বেহুদা সন্তাপে,
হঠাৎ করে বুকের ভেতর তক্ষশিলা কাঁপে।
প্রাচীনতার গুমরোনো সেই আলো-আঁধার ছিঁড়ে
তোমার মুখের সিলুএট্টি জাগে বাসের ভিড়ে।
কখন যে ফের শেয়াল-রঙের আঁধারমাখা গলি
আমার কাছে অন্তরালে মেলে দেয় অঞ্জলি।
বিস্মরণও তরঙ্গিত একলা পাখির ডাকে,
সবার বুকে একটা কেমন তক্ষশিলা থাকে।
জীবন কাটে দুঃখ সুখের প্রান্তরেখা মেপে;
বিষণ্নতা, দোষ কি আমার? তুমি এলে ব্যেপে।
রাতবিরেতে এই নিবাসে চলছে খোঁজাখুঁজি;
অস্মিতারই যমজ ভ্রাতা বিষণ্নতা বুঝি।
বাড়ি ফেরা ভুল হয়ে যায়, ঊর্ণাজালে ফিরি,
দেয়াল-জোড়া নিজের ছায়ার আহাম্মুকে ছিরি;
চকিতে এক বেয়াড়া ফাঁস জাপ্টে ধরে গলা,
চেনাজানার বাইরে যাচ্ছি কার সেয়ানা ছলায়?
হঠাৎ কোনো মধ্যরাতে ঘুমের ঘরে একা
উঠলে জেগে আদিমতায় পাব তোমার দেখা?
হাট-করা এই কপাট ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছ ভেবে
দৌড়ে আমি স্বপ্নপ্রবণ, হৃদয় জ্বলে নেভে।
তোমার কথা ভেবে ভেবে রাত্রি আমার খাঁ-খাঁ
দুপুর হয়ে চক্ষু ভাজে, পোড়ায় প্রাণের শাখা।
দুই গণ্ডুষ জলের খোঁজে খুঁড়ছি বেবাক ভূমি,
এমন মরুর রুক্ষ ঝড়ে মুখ লুকালে তুমি।
ফুরফুরে এক প্রজাপতি এসে নিথর দ্বারে
ছড়িয়ে দিয়ে সপ্ত রেণু দৃষ্টি কেমন কাড়ে।
‘এই তো আমি খুঁজছ যাকে’, বলল প্রজাপতি,
‘তোমার হাতের শূন্য মাঠে হবে আমার গতি।
ছন্নছাড়া প্রজাপতি কিংবা শালিক পাখি
ঝলমলিয়ে বাঁধতে আসে আমার হাতে রাখি।
তোমায় আমি পাখির বুকে, মাছের চোখে পাব?
নইলে আমি মনস্তাপে নির্বাসনে যাব।
আমার ভারি আস্থা ছিল গোলাপের সদ্ভাবে,
কিন্তু গোলাপ উঠল ফুঁসে, যেন আমায় খাবে।
তক্ষশিলা জীবন্ত ফের ব্যাপক হাহাকারে,
রিক্ততারই ফস্কা ঝুঁটি ধরি অহংকারে।
এক্ষুণি আমার কিছু কেনাকাটা করবার আছে
এখন তোমরা কেউ আমাকে খামোকা দেরি করিয়ে দিও না,
এক্ষুণি আমার কিছু কেনাকাটা করবার আছে।
পকেটে রয়েছে যাবতীয় সামগ্রীর ফর্দ সুদীর্ঘ, উজ্জ্বল,
অবশ্য তালিকা না হলেও চলে। কি কিনতে চাই,
আপাতত কী কী কেনা দরকার
তার পাক্কা একটা হিসেব
গোপনে করছে খেলা মনের ভেতর।
এখন তোমরা কেউ আমাকে খামোকা দেরি করিয়ে দিও না।
তোমাদের একজন কেউ হাত বাড়িয়ে দিলেই
আমাকেও ধরতে হবে হাত,
আসন জোটাতে হবে তোমাদের সোনালি আড্ডায়।
আসবে কথার পিঠে কথা,
সন্ধ্যা নেবে শুষে
দিনের গালের রং, গুলতানি, হো-হো-হাসি, অবাধ হুল্লোড়,
চরিত্রহনন, কবিতার শব-ব্যবচ্ছেদ, কবির প্রণয় নিয়ে
ঈষৎ মস্করা
ইত্যাদিতে ক্ষয়ে যাবে অনেক প্রহর, পুনরুক্তিময়, কিন্তু,
এক্ষুণি আমার কিছু কেনাকাটা করবার আছে।
দ্যাখো, ভালো করে দ্যাখো, আমার ভুরুর এলাকায়
এখন শিশির নেই ফোঁটা ফোঁটা, আমার শরীরে
বস্তুত তোমরা কেউ আর
বকুলের গন্ধ খুঁজে পাবে না এখন। আজকাল
আমি আর মধ্যরাতে ধীরে সুস্থে ঘুরে বেড়াই না ইতস্তত
রাস্তায় রাস্তায়,
ফেলি না পা বন্ধ দোকানের ছায়ায়, স্তম্ভিত মাঠে।
এখন ব্যস্ততা কাঠবিড়ালীর মতো সারাদিন
লাফায় আমার শিরা-উপশিরাময়; আমাকে অনেক দূর
থেকে দেখে আমার শৈশব
সকৌতুক খোলা ছাদে পা দোলাচ্ছে ফকফকে জ্যোৎস্নায় কেবলি।
অকস্মাৎ একজন বিপন্ন পথিক
বাঁচাও বাঁচাও শব্দে
আমার মুখের রোদ মুছে নেয়, ভেঙে ফ্যালে আমার বুকের
গোলাপের ঝাড়।
আমি তো পুলিশ নই নাগরিক দ্বীপে,
তবু সে শব্দের পিছু পিছু
ছুটে যাই, দিগ্ধিদিকে ঘুরে কিছুক্ষণ ফিরে আসি ক্লান্ত, ব্যর্থ।
আমার তো খুব বেশি দেরি করা চলবে না। অথচ অমন
আচমকা বিপন্নতা কিছু
কখনো না কখনো আড়ালে
আমাদের প্রত্যেকের জন্যে জমা থাকে।
একজন বলেছিল, ‘আমাকে মনের মতো কিছু দাও তবে’,
আমি দশ দিক তন্ন তন্ন করে দুঃখকে একাকী
তার মুখোমুখি এনে বাসিয়ে দিলাম।
একজন আমার নিকট
রোদ্দুরের পূর্ণিমার পদাবলি চেয়েছিল শুনতে একদা,
আমি তাকে কেবলি আবৃত্তি
করিয়েছি রাত্রিদিন আঁধারের ভাষা। আই আর
কারুর জন্যেই কিছু করবার কথা ভাবি না কখনো।
শুধু ভাবি অবেলায়,
এক্ষুণি আমার কিছু কেনাকাটা করবার আছে।
কী কিনবো আমি? তরমুজ ডাব অথবা আঙুর,
কফির উজ্জ্বল কৌটো, স্বপ্নবৎ টেরিলিন শার্ট, ট্রাউজার?
এই তো দেখছি কাছে দূরে শহরের
প্রতিটি দোকান
বারবনিতার মতো অপেক্ষমাণ অথচ বড় উদাসীন-
আমি যা’ কিনতে চাই কখনো তা নয় লভ্য কোনো দোকানেই।