আবার মুষলপর্ব
কোথাও নদীর বাঁক, গাছপালা, কোথাওবা দুঃখময় ধু-ধু মাঠ।
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত ওরা অহর্নিশ; কখনো পথের মোড়ে থামে,
কখনো বিশ্রাম খোঁজে ক্যাম্পে, কখনোবা
সহসা ছিটকে পড়ে দিগ্ধিদিক। এ যুগে সর্বত্র
ঘরপোড়া লোক, ইউরোপে এশিয়ায় লক্ষ লক্ষ। বিপর্যয়ে
যূথচারী ওরা সব, অথচ একাকী। বিচ্ছিন্নতা
বয়ে বেড়াতেই হয়, এমনকি বাংলাদেশে আমাদেরও।
বাস্তবিক বিশ শতকের গোধূলিতে ছেঁড়া তাঁবু
ঘাড়ে নিয়ে পৌঁছেও আমরা
কুরুক্ষেত্র, মহাপ্রস্থানের
পাত্রপাত্রী। কিন্তু আজ জলেস্থলে কোথাও দেখি না
দুর্গম পথের যাত্রী সেই একা কুকুরের ছায়া।
হঠাৎ দুপুরে ব্যেপে আসে কালসন্ধ্যা
ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, কলোনিতে যাদের নিবাস
কিংবা যারা বাঁধে ডেরা ফুটপাতে কি গাছতলায়
তাদের শিরায় ডাইনোসরের বিকট চিৎকার
জেগে ওঠে মাঝে-মধ্যে-শুরু হয় অবলীলাক্রমে
আবার মুষলপর্ব; কে কার অস্ত্রের ক্ষিপ্র ভীষণ ঠোকরে
চকিতে ছিটকে পড়ে, বোঝা মুশকিল। এ ক্ষুধিত অন্ধকারে
শক্রমিত্র সবাই একাকার।
ছিন্নভিন্ন নর-নারী, রক্তে
ভাসে পথঘাট কী ব্যাপক আর কৃতান্তের মতো
কিরাতের বিষকালো শরে
অবিরত গোঙায় সভ্যতা বেদনার্ত রৌদ্রজলে।
আমার উড়োজাহাজ
কেবল সে-ই তা পারে। আমার বুকের রানওয়ে থেকে দ্রুত
ছুটে দূর নীলিমায় উড়ে যায় মেঘেদের স্তরে,
অন্ধকারে ক্লান্তিমান, রৌদ্রে ঝলসিত
দ্যাখো, কী সুন্দর উড়োজাহাজ আমার।
দ্যাখো, উড়োজাহাজ আমার
বাণিজ্যিক এলাকার মসৃণ পাথুরে অরণ্যের
অনেক ওপর দিয়ে মন্দিরের চূড়ো, মসজিদের
একলা মিনার থেকে বহুদূর শূন্যে উড়ে যায়,
আবার চকিতে আসে ফিরে
আমার নিজস্ব করতলে।
লাল নীল কাগজের টুকরো গেঁথে কেমন মায়াবী
পদ্ধতিতে বানিয়েছি এই উড়োজাহাজ গোপনে।
অনেকে তাকিয়ে দেখি ঈর্ষাতুর চোখে; ওরা আসে
দলে দলে, একজন অপরের পুনরুক্তি অবিকল, আর
বলে একই তপ্ত স্বরে,-‘কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেল
এ জাহাজ’, যেন ছাত্রদল সরব মুখস্থ করে পাঠ।
কেউ এই উড়োজাহাজের পাখা ছিঁড়ে ফেলে, কেউবা হঠাৎ
নখ নিয়ে ফুটো করে পেট। ‘আমার নিকট থেকে
তোমরা নিয়েছ কেড়ে বহু কিছু, উড়োজাহাজটা
একান্ত আমার থাক’ বলে দিলাম উড়িয়ে প্লেন।
আহত সে অনুপম উড়ে যায়, ছায়া পড়ে থাকে,
মাটিতে লুটিয়ে ছায়াটিকে দিই অধীর চুম্বন।
আমার কবিতা জুড়ে শুয়ে আছ
এ জীবন চড়িভাতি নয় বলে মধ্যপথে এক ঝটকায়
তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বুঝলাম কী ভুল করেছি।
কোনো কোনো উচ্চারণ, হায়, এভাবেই মানুষকে
আজীবন কুরে খায়, এমনকি নদীর, বৃক্ষের কাছে
করে অপ্রস্তুত বার বার। এখন তো দেখছি বিষম ঠেকে-
পারে না খারিজ করতে কোনোমতে, স্মৃতিও তোমাকে।
আমার নিকট থেকে তুমি বিচ্ছিন্ন হলেই, মানে
দূরে স’রে গেলে
হৃদয় শ্মশান হয়। কোথায়? কোথায় তুমি? এই
নাছোড় জিজ্ঞাসা
উন্মত্ত পাখির মতো, যতদিন বেঁচে আছি, চঞ্চুর আঘাতে
আমাকে করবে ছিন্নভিন্ন। এরপর
নিশ্চিন্তির কুটিরে বিশ্রাম করা চেষ্টার অতীত।
এই যে এখন আমি সুন্দর বন্দরপ্রিয় নৌকোর মতন
প্রবেশ করছি এই অজ্ঞাত ভেতরে অগোচরে,
এই যে এখন আমি পোকাকীর্ণ শব আর নক্ষত্রের শুদ্ধ
মিলন ঘটিয়ে পরিপক্ব রাত্রির গম্বুজে ব’সে
লিখছি কবিতা-এই কবিতার ডানদিকে তোমাকে দেখছি,
এই কবিতার
বামপার্শ্বে কম্পমান তোমার বিশদ ছায়া, একা;
আমার কবিতা জুড়ে শুয়ে আছ তুমি, শুধু তুমি।
এবং তোমার হৃৎস্পন্দনের পদ্ধতিতে প্রতি শব্দ
ঈষৎ কম্পনে
জেগে থাকে, তোমার নিঃশ্বাস লেগে বাক্যরাজি দ্রুত মগ্ন হয়
হাঁসের বুকের মতো রাঙা উষ্ণতায়।
এক ধরনের উপস্থিতি এও, হয়তোবা দূর
ভবিষ্যের পদচ্ছাপে পাবে ঠাঁই। অথচ তোমার
এমন নিরাবয়ব উপস্থিতি প্রকৃত সান্ত্বনা
নয় কিছুতেই।
সর্বদা তোমাকে চাই একান্ত নিকটে টাই, দ্যাখো,
আমার প্রতিটি রোমকূপ কী উৎসুক হয়ে রয়,
যেমন কর্কশ ঘাস শিহরিত হয় ঘন ঘন
বৃষ্টির আশায়।
আমার কাছে
আমার কাছে তোমার সময়
ইচ্ছে মতো রাখতে পারো।
তোমার সময় এই হৃদয়ে হংসমালা হয়ে দোলে
কিংবা মনের প্রাচীন গুহার জোনাকজ্বলায় মিশে থাকে।
কাউকে আমি দেব না সেই
সময়টুকু কেড়ে নিতে।
আড়াল থেকে ডাকলে তুমি
কোন মায়াবী মুদ্রা এঁকে?
এলাম ছুটে তড়িঘড়ি উস্কোখুস্কো কেমন যেন
বলবে সবাই লোকটা বটে নিশি-পাওয়া স্বপ্নাহত।
তোমার সময় স্বপ্ন হয়ে
আমার প্রাণের পান্থজনের
পথের সীমায় উপচে পড়ে
রাত বিরেতে নিরুদ্দেশে।
রুদ্ধ হলে মধ্যরাতে
যানবাহনের প্রবল স্রোত,
ছমছমে সেই নীরবতার মখমলে যার পায়ের শব্দ
ক্বচিৎ কখন বেড়ে ওঠে, তুমিই সে যে মনচারিণী।
তোমার সময় তুমি হয়ে
আমার কাছে বসে থাকে।
স্বর্গ পথের রেখার মতো
তার সিঁথিতে ওষ্ঠ রাখি।
আমার কাছে তোমার সময় ইচ্ছে মতো রাখতে পারো,
সেই সময়ে, হৃদয় সাক্ষী, নেই যে স্বত্ব অন্য কারো।
আমি চাই আজ
আমার গলার অন্ধকারের পর্দাটা ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসছে কথার রৌদ্র কয়েক ঝলক।
সেই রোদ্দুর হয়ে যার ফের গিটারের সুর,
গিটারের সুরে ভেসে ওঠো তুমি আড়ালে আমার
আত্মার-হ্রদে, যেন একরাশ গোলাপ-পাপড়ি।
আমার বাসনা যাত্রা করেছে তোমার দিকেই।
অলক্ষ্যে কবে হৃদয়ে আমার ফুটল চকিতে
প্রেমের মাতৃভাষা অপরূপ। আমার স্বপ্ন
ঘুমায় তোমার চোখের পাতায়, স্তনের ছায়ায়।
কৃষক যেমন নিজস্ব ক্ষেত দ্যাখে অপলক,
রমণী আমার, তেমনি তোমাকে দেখি বারবার।
আমার মাটিতে তুমিই সোনালি ফসলের শীষ।
তোমার শরীরে আনন্দ বুঝি পেয়েছে নিবাস,
অথচ বিষাদ চোখের দু’কূলে যায় বয়ে যায়।
পাখির মতন ঠোকারাতে চাই তোমার সুহাস
শরীরের ফল এবং আমার আঙুলের ছোঁয়া
লাগল তোমার নিবিড় সত্তা কড়ি ও কোমলে
নিশ্চিত হবে মুখর বাদ্যযন্ত্রের মতো।
তুমি তো আমার সতেজ সকাল, তুমিই আমার
দিনান্ত বেলা। তুমি যে আমার অমাবস্যার
গোপন আঁধার, তুমিই আমার রাঙা পূর্ণিমা।
তুমিই আমার মরীচিকা আর তুমিই আমার
মরূদ্যানের সুশীতল শোভা; তুমিই আমার
অকূল তৃষ্ণা, তুমিই আমার তৃষ্ণার জল।
পথের মতন তোমার শাড়ির পাড়ের জন্যে,
তোমার ব্লাউজ, তোমার কানের দুলের জন্যে,
তোমার চোখের পাতার জন্যে, ফুল-ঝলসিত
খোঁপার জন্যে আমি চাই আজ নিটোল শান্তি।
তোমার চলার পথের জন্যে, তোমার হাঁটার
ছন্দের আর ব’সে থাকবার ভঙ্গির জন্যে,
নীরবে তোমার জেগে থাকা আর স্বপ্নে-ভরাট
ঘুমের জন্যে আমি চাই আজ নিটোল শান্তি।
তোমার কণ্ঠস্বরের জন্যে, হাসির জন্যে,
এ-ঘরে তোমার আসার জন্যে, নিরাপদে দূরে
যাওয়ার জন্যে আমি চাই আজ নিটোল শান্তি।
তোমার গহন নৈঃসঙ্গ্যের জন্যে এবং
ঘরের ভেতর গোধূলির মেঘ, অকাল অমন
গানের জন্যে আমি চাই আজ নিটোল শান্তি।